নূরনবীর ছায়া ছিলোনা
মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান
নূরনবীর ছায়া ছিলোনা
[সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম]
হুযূর মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নূরানিয়াৎ (নূর হওয়া) সম্পর্কে যখন কারো হৃদয়-মন, দৃষ্টি ও অন্তর্দৃষ্টি আলোকিত হয়ে যায়, তখন তার সামনে হুযূর মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ছায়া না থাকার বিষয়টি খোদ্-বখোদ স্পষ্ট হয়ে যায়। কারণ, নূর ও ছায়া একত্রিত হতে পারে না। সর্বশক্তিমান খোদা তা‘আলা বিশ্বকুল সরদার সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে যে-ই অগণিত মু’জিযা দ্বারা ধন্য করেছেন, সেগুলোর মধ্যে এক মহা মু’জিযা এও যে, তাঁর নূরানী শরীরের ছায়া ছিলো না। সুতরাং ঈমানদার মাত্রই হুযূর-ই আক্রামের এ মু’জিযাকে অবশ্যই স্বীকার করবে। উম্মতের শীর্ষস্থানীয় আলিমগণ এ মাসআলার পক্ষে অসংখ্য দলীল-প্রমাণ সংগ্রহ করে লিপিবদ্ধ করেছেন। এ নিবন্ধে সংক্ষেপে ওইসব দলীল-প্রমাণের কিছুটা উল্লেখ করার প্রয়াস পাচ্ছি-
হযরত ইমাম নাসাফী বলেন-
قَالَ عُثْمَانُ رَضِىَ الله عَنْهُ اِنَّ الله مَا اَوْقَعَ ظِلَّكَ عَلَى الْاَرْضِ لِئَلَّا يَضَعَ اِنْسَانٌ قَدَمَه عَلٰى ظِلِّكَ
[تفسير مدارك التنزيل: ج ـ৩: ص: ১০৩]
অর্থঃ হযরত ওসমান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র দরবারে আরয করেছেন, ‘‘নিশ্চয় আল্লাহ্ তা‘আলা আপনার ছায়া যমীনের উপর পড়তে দেননি, যাতে কোন মানুষ সেটার উপর পা না রাখে।
[তাফসীর-ই মাদারিকুত্ তানযীল: ৩য় খন্ড: পৃ. ১০৩]
হযরত ইমাম আবদুল্লাহ্ ইবনে মুবারক, সাইয়্যেদুনা ইমামে আ’যম আবূ হানীফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বিশেষ শাগরিদ, আর মুহাদ্দিস ইবনে জূযী রা’সূল মুফাস্সিরীন হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা থেকে বর্ণনা করেন-
لَمْ يَكُنْ لِلنَّبِىِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ظِلٌّ وَلَمْ يَقُمْ مَعَ الشَّمْسِ قَطُّ اِلاَّ غَلَبَ ضُوْءُ ه ضُوْءَ الشَّمْسِ وَلَمْ يَقُمْ مَعَ سِرَاجٍ قَطُّ اِلاَّ غَلَبَ ضُوْءُ ه ضُوْءَ السِّرَاجِ ـ [جمع الوسائل للقارى : ج-ـ১: صفحه ـ ১৭৬، زرقانى على المواهب : ج ـ ৪ـ صفحه ـ ২২ـ شرح شمائل للمناوى : -جـ ১ صفحه: ৪৭]
অর্থঃ হুযূর নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ছায়া ছিলোনা। আর তিনি সূর্যের সামনে দাঁড়ালেই তাঁর নূর সূর্যের আলোর উপর বিজয়ী হতো, প্রদীপের আলোতে তিনি দাঁড়ালে অবশ্যই তাঁর নূররাশি প্রদীপের আলোর উপর বিজয়ী হতো।
[জাম‘উল ওয়াসা-ইল:১ম খন্ড, ১৭৬পৃ.,
যারক্বানী আলাল মাওয়াহিব: ৪র্থ খন্ড, পৃ. ২২,
শরহে শামাইল: ১ম খ ন্ড: পৃ. ৪৭]
হযরত হাকীম তিরমিযী হযরত যাকওয়ান তাবে‘ঈ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন-
اَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمْ يَكُنْ يُرى لَه ظِلٌّ فِىْ شَمْسٍ وَلاَقَمَرٍ ـ [ترمذى ـ نوادر الاصول : زرقانى : ج ـ ৪ـ صفحه : ৩৪০]
অর্থঃ রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ছায়া না রোদে দেখা যেতো, না চাঁদের আলোতে।
[তিরমিযী, নাওয়াদিরুল উসূল, যারক্বানী: ৪র্থ খন্ড, পৃ. ২৪০]
হাফিযুল হাদীস আল্লামা জালাল উদ্দীন সুয়ূতী আলায়হির রাহমাহ্ তাঁর ‘খাসা-ইসুল কুবরা’য় একটি স্বতন্ত্র অধ্যায় বিন্যস্থ করেছেন আর লিখেছেন-
بَابُ الْايَةِ فَاِنَّه صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمْ يَكُنْ لَّه ظِلٌّ فِى الشَّمْسِ وَلاَقَمَرٍ ـ
অর্থঃ মু’জিযা শীর্ষক অধ্যায়: রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ছায়া ছিলোনা- না রোদে, না চাঁদের আলোতে।
আল্লামা ইবনে সা‘ঈ বলেন-
قَالَ اِبْنُ سَبْعٍ مِنْ خَصَائِصِه صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اَنَّ ظِلَّه كَانَ لاَ يَقَعَ عَلَى الْاَرْضِ وَاَنَّه كَانَ نُوْرًا فَكَانَ اِذَا مَشى فِى الشَّمْسِ اَوِ الْقَمَرِ لاَ يُنْظَرُ لَه ظِلٌّ
[الخصائص الكبرى : جـ ১ ـ صفحه : ৬৮]
অর্থঃ ইবনে সাব‘ই বলেছেন, হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বৈশিষ্ট্যাবলীর মধ্যে এও রয়েছে যে, তাঁর ছায়া যমীনের উপর পড়তো না; কেননা, তিনি ‘নুর’ ছিলেন। যখন তিনি রোদ কিংবা চাঁদের আলোতে চলতেন, তখন তাঁর ছায়া দেখা যেতোনা।
হযরত ইমাম ক্বাযী আয়ায রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এভাবে লিখেছেন-
وَمَا ذُكِرَ مِنْ اَنَّه كَانَ لاَظِلَّ لِشَخْصه فِىْ شَمْسٍ وَلاَ قَمَرٍ لِاَنَّه كَانَ نُوْرًا وَاَنَّ الذُّبَابَ كَانَ لَا يَقَعُ عَلى جَسَدِه وَلاَ ثِيَابِه ـ [شفاء شريف : -ج ـ ১ : صفحه : ২৪২]
অর্থঃ নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নুবূয়ত ও রিসালতের দলীলগুলোর মধ্যে এও উল্লেখ করা হয়েছে যে, তাঁর নূরানী শরীরের ছায়া সূর্যের আলোতে এবং চাঁদের আলোতে থাকতো না। কারণ, তিনি নূর ছিলেন। আর নিঃসন্দেহে তাঁর পবিত্রতম দেহের উপর ও তাঁর বরকতমন্ডিত কাপড়ের উপর কখনো মাছি বসতো না। [শেফা শরীফ: ১ম খন্ড: পৃ. ২৪২]
বোখারী শরীফের ব্যাখ্যাকারী হযরত ইমাম আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ক্বাস্তলানী আলায়হির রাহমাহ্ থেকে বর্ণিত-
لَمْ يَكُنْ لَه صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
ظِلٌّ فِىْ شَمْسٍ وَلاَ قَمَرٍ
অর্থঃ হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ছায়া সূর্য ও চাঁদের আলোতে দৃষ্টিগোচর হতোনা। (এর কারণ এ ছিলো যে, হুযূর-ই আক্রাম নূর ছিলেন।-ইমাম যারক্বানী)
শায়খ হোসাঈন ইবনে মুহাম্মদ দিয়ারুল বাকরী আলায়হির রাহমাহ্ বলেছেন-
لَمْ يَقَعْ ظِلُّه عَلَى الْاَرْضِ وَلاَ يُرى لَه ظِلٌّ
فِىْ شَمْسٍ وَلاَ قَمَرٍ ـ [كتاب الخميس]
অর্থঃ তাঁর ছায়া যমীনের উপর পড়েনি আর না সূর্যের রোদে, না চাঁদের আলোতে দেখা গেছে। [কিতাবুল খামীস]
হযরত ইমাম রাগেব ইসফাহানী আলায়হির রাহমাহ্ লিখেছেন-
رُوِىَ اَنَّ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ اِذَا مَشَى لَمْ يَكُنْ لَه ظِلٌّ [مفردات امام راغب : صفحه : ৩১৭]
অর্থ: বর্ণিত আছে যে, নবী-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম যখন (রোদে কিংবা চাঁদের আলোতে) চলতেন, তখন তাঁর ছায়া থাকতো না।
তাছাড়া, ইমাম শিহাব উদ্দীন খাফ্ফাজী মিসরী, আল্লামা বোরহান উদ্দনি আহমদ হালাবী, আল্লামা শিহাব উদ্দীন আহমদ ইবনে হাজার মক্কী, আল্লামা শায়খ মুহাম্মদ তাহের, আল্লামা শায়খ সুলায়মান জুমাল, আল্লামা শামী, ইমাম ফখর উদ্দীন রাযী, ইমাম তাক্বিউদ্দীন সুবকী, আল্লামা সা-হিবুল ওয়াফা, ইমামে রব্বানী শায়খ আহমদ মুজাদ্দিদে আলফে সানী, হযরত শায়খ আবদুল হক্ব মুহাদ্দিসে দেহলভী, হযরত শাহ্ আবদুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলভী, শায়খুল মুফাস্সিরীন হযরত ক্বাযী সানা উল্লাহ্ পানিপথী, মোল্লা মুহাম্মদ মু‘ঈন কাশেফী আল হারভী প্রমুখ আলায়হিমুর রহমাহ্ আপন আপন যুগখ্যাত কিতাবে সুস্পষ্ট ভাষায় লিখেছেন যে, হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শরীর মুবারকের ছায়া ছিলোনা, কারণ তিনি আপাদমস্তক শরীফ নূর।
ইমামে আহলে সুন্নাত মাওলানা শাহ আহমদ রেযা বেরলভী আলায়হির রাহমাহ্ লিখেছেন এ মাসআলায় অতি চিত্তাকর্ষী ও সপ্রমাণ কিতাবাদি। ওই গুলোতে অতি স্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শরীর মুবারকের ছায়া নেই। কেননা, তিনি নূর-ই মুবীন। নূরের ছায়া নেই। এ মাসআলায় তাঁর লিখিত কিতাবগুলোর মধ্যে নি¤œলিখিত কয়েকটা কিতাব অতি উল্লেখযোগ্য-
১. ক্বামারুত তামাম ফী নফিয়্যিয যিল্লী ‘আন্ সাইয়্যেদিল আনাম,
২. নফিয়্যুল ফায়ই ‘আম্মান ইস্তানারা বি নূরিহী কুল্লু শায়ই,
৩. সালাতুত্ সাফা ফী নূরিল মোস্তফা,
৪. হুদাল হায়রান ফী নফিয়্যিল ফায়ই ‘আন সাইয়্যিদিল আকওয়ান এবং
৫. হাদাইক্বে বখশিশ ইত্যাদি।
তাছাড়া, এ প্রসঙ্গে আ’লা হযরতের পিতা মহোদয় ইমামুল আসফিয়া হযরত মাওলানা নক্বী আলী খান আলায়হির রাহমাহ্ও অতি হৃদয়গ্রাহী বক্তব্য পেশ করেছেন।
আরো মজার বিষয় যে, হুযূর-ই আক্রামের শরীর মুবারকের ছায়া ছিলোনা মর্মে দেওবন্দী আলিমগণও তাদের স্পষ্ট বক্তব্য লিখে গেছেন। যেমন মৌং রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী দেওবন্দী ‘ইমদাদুস্ সুলূক’, পৃ. ৮ মৌং আশরাফ আলী থানভী দেওবন্দী এবং মুফতী-ই দেওবন্দ মৌং আযীযুর রহমান প্রমুখ।
পরিশেষে, উপরিউক্ত দলীল-প্রমাণাদি থেকে একথা সুস্পষ্ট হলো যে, সাহাবা-ই কেরাম, তাবে‘ঈন, মুজতাহিদ ইমামগণ, মুহাদ্দিস ও মুফাস্সিরগণ, ওলামা, আউলিয়া এবং সুফীগণের মাযহাব বা আক্বীদা হচ্ছে হুযূর-ই পুরনূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নূরানী শরীর মুবারকের ছায়া ছিলোনা।