ঈমানের সর্বশ্রেষ্ঠ আলামত বা নিদর্শন হলো নামাজ
অধ্যক্ষ হাফেয কাজী আবদুল আলীম রিজভী>
بِسْمِ اللّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
تَدْعُو مَنْ أَدْبَرَ وَتَوَلَّى (17) وَجَمَعَ فَأَوْعَى (18) إِنَّ الْإِنْسَانَ خُلِقَ هَلُوعًا (19) إِذَا مَسَّهُ الشَّرُّ جَزُوعًا (20) وَإِذَا مَسَّهُ الْخَيْرُ مَنُوعًا (21) إِلَّا الْمُصَلِّينَ (22) الَّذِينَ هُمْ عَلَى صَلَاتِهِمْ دَائِمُونَ (23) وَالَّذِينَ فِي أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ مَعْلُومٌ (24) لِلسَّائِلِ وَالْمَحْرُومِ (25) وَالَّذِينَ يُصَدِّقُونَ بِيَوْمِ الدِّينِ (26) وَالَّذِينَ هُمْ مِنْ عَذَابِ رَبِّهِمْ مُشْفِقُونَ (27) إِنَّ عَذَابَ رَبِّهِمْ غَيْرُ مَأْمُونٍ (28) وَالَّذِينَ هُمْ لِفُرُوجِهِمْ حَافِظُونَ (29) إِلَّا عَلَى أَزْوَاجِهِمْ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ فَإِنَّهُمْ غَيْرُ مَلُومِينَ (30
অনুবাদ: সে (অর্থাৎ জাহান্নামের অগ্নি) ডাকছে তাকে, যে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেছে এবং বিমুখ হয়েছে এবং (সম্পদ) পুঞ্জীভূত করে সংরক্ষিত করে রেখেছে। নিশ্চয় মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে বড় অধৈর্য লোভী করে। যখন তাকে অনিষ্ট স্পর্শ করে, তখন সে হা-হুতাশ করে আর যখন কল্যাণ প্রাপ্ত হয় তখন সে কৃপণ হয়ে যায়। কিন্তু নামাযীগণ যারা আপন নামাযগুলোর প্রতি সর্বক্ষণ পাবন্দ থাকে, এবং যাদের সম্পদের মধ্যে একটা নির্দিষ্ট প্রাপ্য রয়েছে। প্রার্থনাকারী ও বঞ্চিতের জন্য; এবং যারা প্রতিফল দিবসকে সত্য বলে বিশ্বাস করে। এবং যারা আপন প্রতিপালকের শাস্তিকে ভয় করতে থাকে। নিশ্চয় তাদের পালনকর্তার শাস্তি ভয়ে শূন্য হয়ে থাকার বস্তু নয়। এবং যারা তাদের লজ্জাস্থানগুলোকে সংযত রাখে। কিন্তু তাদের স্ত্রী অথবা মালিকানাভুক্ত দাসীদের বেলায় তারা তিরস্কৃত হবে না। [সূরা আল-মাআরিজ, ১৭-৩০ নং আয়াত]
আনুষঙ্গিক আলোচনা
إِنَّ الْإِنْسَانَ خُلِقَ هَلُوعًا ـ إِذَا مَسَّهُ الشَّرُّ جَزُوعًا ـ وَإِذَا مَسَّهُ الْخَيْرُ مَنُوعًا ـ
উদ্ধৃত আয়াতসমূহের ব্যাখ্যায় মুফাসসেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন هلوع শব্দের আভিধানিক অর্থ হল লোভী, অধৈর্য ও ভীরুব্যক্তি। তাফসীরে আয়াতে উল্লেখিত هلوع শব্দের ব্যখ্যায় মুফাসসিরকুল সরদার সাইয়্যেদুনা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন هلوع মানে সেই লোক যে হারাম ধন-সম্পদে লোভ করে। সাইয়্যেদুনা হযরত সাঈদ ইবনে যুবায়র রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন এর অর্থ হল কার্পণ্যকারী। আর ইমাম মুকাতিল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন এর অর্থ হল সংকীর্ণমনা অধৈর্য লোক। উল্লেখ্য যে, এ সকল অর্থ প্রায় কাছাকাছি। কুরআনে কারীমে পরবর্তী আয়াতে এর ব্যাখ্যায় এরশাদ হয়েছে هلوع সেই লোক তাকে যখন অনিষ্ট স্পর্শ করে তখন সে হা-হুতাশ করে আর যখন মঙ্গলের অধিকারী হয় সে কার্পণ্য করে।
এখানে প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে, যখন তাকে সৃষ্টিই করা হয়েছে দোষযুক্ত করে তখন তাকে অপরাধী সাব্যস্ত করা হয় কেন? মুফাসসেরীনে কেরাম এর জবাবে বলেছেন এখানে মানব-স্বভাবে নিহিত প্রতিভা ও উপকরন বুঝানো হয়েছে। মহান আল্লাহ মানব স্বভাবে সৎকর্মের প্রতিভাও নিহিত রেখেছেন। তাকে জ্ঞান-গরিমাও দান করেছেন। মহাগ্রন্থ আল-কুরআন ও রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণের মাধ্যমে প্রত্যেক ভাল-মন্দ কাজের পরিণতিও বলে দিয়েছেন। মানুষ স্বেচ্ছায় জন্মলগ্নে গচ্ছিত মন্দ উপকরনের কারণে অপরাধী হয় না। هلوعশব্দের ব্যাখ্যায় কুরআনে কারীম স্বেচ্ছাধীন ক্রিয়াকর্মই উল্লেখ করেছেন। যেমন এরশাদ হয়েছে-إِذَا مَسَّهُ الشَّرُّ جَزُوعًا ـ وَإِذَا مَسَّهُ الْخَيْرُ مَنُوعًا
অর্থাৎ মানুষ এত অধৈর্য ও ভীরু প্রকৃতির যে, যখন সে কোন দুঃখ-কষ্টের সম্মুখীন হয়, তখন সে হা-হুতাশ শুরু করে দেয়। পক্ষান্তরে যখন কোন সুখ-শান্তি ও আরাম লাভ করে তখন কৃপণ হয়ে যায়। এখানে শরিয়তের সীমার বাইরে হা-হুতাশ বুঝানো হয়েছে। এমনিভাবে কৃপণতা বলতে ফরজ ও ওয়াজিবের কর্তব্য পালনে ত্রুটি।
إِلَّا الْمُصَلِّينَ – الَّذِينَ هُمْ عَلَى صَلَاتِهِمْ دَائِمُونَ
উদ্ধৃত আয়াতদ্বয়ের ব্যাখ্যায় তাফসীরশাস্ত্র বিশারদগণ উল্লেখ করেছেন আয়াতে المصلين তথা নামাযীগণ বলে মুমিনগণকে বুঝানো হয়েছে। ঈমানের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ও সর্বশ্রেষ্ঠ আলামত বা নিদর্শন হল নামায। হাদীসে পাকে এরশাদ হয়েছে- لكل شئ علم وعلم الايمانا الصلاةঅর্থাৎ রাসূলে আকরাম নূরে মুজাস্সাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন প্রত্যেক বস্তুর নিদর্শন রয়েছে, আর ঈমানের চিহ্ন বা নিদর্শন হল নামায। হাদীসে নববী শরীফে আরো এরশাদ হয়েছে-
الصلاة عماد الدين فمن أقامها فقد أقام الدين ومن تركها فقد هدم الدين অর্থাৎ নামায হল দ্বীনের খুঁটি বা স্তম্ভ। যে ব্যক্তি (নিজের জীবনে) নামায কায়েম করেছে সে অবশ্যই দ্বীন-ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছে। আর যে লোক নামায ত্যাগ করেছে সে অবশ্যই দ্বীন-কে ধ্বংস করেছে (নিজের জীবন থেকে)। (নাউজু বিল্লাহ)।
নামায দ্বীনের মূল স্তম্ভ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন বিধায় নামায উল্লেখ করে ঈমান আর নামাযীগণ বলে মুমিনগণকে বুঝানো হয়েছে।
আবার কুরআনে কারীমের দ্বিতীয় পারার প্রথম পৃষ্ঠায় ঈমান বলে নামাজকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। যেমন, এরশাদ হয়েছে-وما كان الله ليطيع إيمانكم অর্থাৎ আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের উদ্দেশ্য বা অভিপ্রায় নয় যে, তোমাদের ঈমান তথা নামাযকে নষ্ট করা। অর্থাৎ বায়তুল মুকাদ্দাস কেবলা হিসেবে থাকাবস্থায় তারই দিকে মুখ ফিরিয়ে ষোল কিংবা সতের মাস নামায আদায়কারী মুমিনগণের নামায আল্লাহর দরবারে কবুল হয়েছে। দুনিয়া-আখেরাত উভয় জাহানে তার প্রতিদান প্রদত্ত হবে। কোন অবস্থায় বাতিল করে নষ্ট করা হবে না। (আলহামদুলিল্লাহ)
উপরিউক্ত সংক্ষিপ্ত আলোচনার সারমর্ম হল ঈমান আনায়নের পর সর্বপ্রথম ফরজ হওয়া শ্রেষ্ঠতম ইবাদত হল নামায, কেয়ামতের ময়দানে সর্বপ্রথম আল্লাহর দরবারে নামাযের হিসাব গ্রহণ করা হবে। নামায ঈমানের পরিচায়ক এই নামায মে’রাজ রজনীতে লা-মকানে ফরজ করা হয় মুমিনগণের উপর মে’রাজের উপহার স্বরূপ। তাই সকল মুমিনের উপর প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর হতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত জীবনভর সর্বাধিক আন্তরিক যত্নবান হওয়া অপরিহার্য এই নামাযের প্রতি।
মহান আল্লাহর আলিশান দরবারে কায়মনোবাক্যে ফরিয়াদ জানাই তিনি যেন সকল মুমিন নর-নারীকে আলোচিত দরসে কুরআনের উপর আমল করে উভয় জাহানে সফলকাম হওয়ার সৌভাগ্য নসীব করেন। আমীন।