গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতা : মুসলিমবিশ্ব কি দায় এড়াতে পারে?
আবসার মাহফুজ>
গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতার একমাস পূর্ণ হয়েছে ৮ নভেম্বর ২০২৩। গাজার স্বাস্থ্যবিভাগের তথ্যানুযায়ী সেখানে ইসরায়েলি হামলায় ৭ অক্টোবর থেকে ৮ নভেম্বর সন্ধ্যা পর্যন্ত ১০ হাজার ৫৬৯ জন নিহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে শিশু রয়েছে ৪ হাজার ৩২৪। নারী ২ হাজার ৮২৩। একই সময়ে আহত হয়েছে ২৬ হাজার ৪৭৫ জন। নিখোঁজ রয়েছে ২ হাজার ৫৫০ জন। নিখোঁজদের মধ্যে ১ হাজার ৩৫০ জন শিশু, ১৯৩ জন স্বাস্থ্যকর্মী। হামলায় ৪৫টি অ্যাম্বুলেন্স বিকল হয়ে পড়েছে। গাজার বাইরে অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বাহিনীর আগ্রাসনে নিহত হয়েছে আরও অন্তত ১৬৩ ফিলিস্তিনি। এর মধ্যে শিশু প্রায় ৫০ জন। আহত হয়েছে আরও ২ হাজার ৪০০ জন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানিয়েছে গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইসরায়েল সুপেয় পানি, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, নিত্যপণ্যসহ সবধরনের সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়। এক মাসের বেশি সময় এসব সেবা ও পণ্য সংকটে থাকা বিধ্বস্ত গাজার স্বাস্থ্যব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে পড়েছে। সুপেয় পানির প্রায় সব উৎসই নষ্ট হয়ে গেছে। পয়ঃনিষ্কাশন প্রণালি বিধ্বস্ত হয়েছে। এ অবস্থায় অবরুদ্ধ উপত্যকাটিতে ৮ নভেম্বরের হিসেবে ৩৩ হাজার ৫৫১ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে, যাদের একটা বড় অংশ শিশু। বর্বর ইসরায়েলি বাহিনী দ্বারা অবরুদ্ধ গাজার এমন চিত্র উদ্বেগকর। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপারটি হচ্ছে ইসরায়েলের গণহত্যা থামাতে জাতিসংঘসহ পুরোবিশ^ই নির্লিপ্ত। মুসলিমবিশ^ও এ ব্যাপারে সোচ্চার নয়। এটি চরম দুঃখজনক এবং মানবসভ্যতার জন্য কলংকজনক।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী গত এক মাসে বিধ্বস্ত নগরীতে পরিণত হয়েছে পুরো গাজা উপত্যকা। গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের ৩৯তম দিনের (১৪ নভেম্বর ২০২৩) হিসেবে দেখা যাচ্ছে দীর্ঘ এই সময়ে ইসরায়েলি বিমানবাহিনী গাজায় বিপুল পরিমাণ বোমা ও বিস্ফোরক ফেলে শহরটিকে আক্ষরিক অর্থেই মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে। ইসরায়েলের এই নির্বিচার হামলার কারণে অবরুদ্ধ অঞ্চলটিতে প্রায় ৭ লাখ শিশু বাস্তুচ্যুত বা ঘরছাড়া হয়েছে। এই সময়ে নিহত হয়েছে অন্তত ৪ হাজার ৬০০ এরও বেশি শিশু। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে কাতার ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা জানিয়েছে, গাজায় ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৭ লাখ শিশু তাদের ঘর হারিয়েছে। জীবনযাপন করছে বিভিন্ন অস্থায়ী আবাস বা আশ্রয়শিবিরে। ইউনিসেফ জানিয়েছে, এই সব শিশুই ইসরায়েলি হামলার কারণে তাদের সবকিছু পেছনে ফেলে আসতে বাধ্য হয়েছে। এ নিবন্ধ লেখার সময় (১৪ নভেম্বর ’২৩) গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ২৪০ জনে। নিহতদের মধ্যে শিশুই ৪ হাজার ৬৩০ জন এবং নারী ৩ হাজার ১৩০ জন। অপরদিকে, গাজায় আল-শিফা হাসপাতাল প্রাঙ্গণে ফিলিস্তিনিদের লাশ খুবলে খাচ্ছে রাস্তার কুকুর। হাসপাতাল প্রাঙ্গণে স্তূপাকারে জমা হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের মরদেহ। ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী আহত ও অসুস্থদের রাস্তায় নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে দেখা যাচ্ছে, গাজার হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করেছে ইসরাইল। রোগী ও চিকিৎসাপ্রত্যাশীদের জন্য হাসপাতাল নিরাপদ ও অভয়ক্ষেত্র বলে বিবেচিত হলেও গাজার কোনো হাসপাতালই ইসরাইলি বাহিনীর নিশানার বাইরে নেই। হাসপাতালে অবস্থানরত রোগী, ডাক্তার, নার্স, চিকিৎসাকর্মী ও সরঞ্জাম কোনো কিছুই নিরাপদ নয়। গাজার দ্বিতীয় বৃহত্তম হাসপাতাল আল কুদস বন্ধ হয়ে গেছে। পানি, জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাবে এটি বন্ধ হয়ে গেছে। গাজার বৃহত্তম হাসপাতাল হিসেবে পরিচিত আল শিফার চারপাশে ট্যাংক মোতায়েন করা হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে স্নাইপাররা অবস্থান নিয়েছে। আকাশে সক্রিয় ড্রোন। হাসপাতাল থেকে কেউ বাইরে যেতে পারছে না। যে কেউ চেষ্টা করলে ইসরাইলি সেনাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছে। হাসপাতালের সর্বত্র লাশ ও রক্ত। ইতোমধ্যে কার্ডিয়াক ওয়ার্ড ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। এই হাসপাতালে আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ সাদা ফসফরাস ব্যবহার করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন সেখানকার স্বাস্থ্যমন্ত্রী। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তরফে জানানো হয়েছে, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত ১৩৫টি স্বাস্থ্যস্থাপনায় ইসরাইল হামলা করেছে। হামলার কারণে ২১টি হাসপাতাল ও ৪৭টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া হামলায় ১৯৮ জন স্বাস্থ্যকর্মী নিহত ও ৫৩টি অ্যাম্বুলেন্স ধ্বংস হয়েছে। জ্বালানি সঙ্কটের কারণে অবরুদ্ধ গাজার সব হাসপাতাল বন্ধ হয়ে যেতে পারে জানিয়েছেন গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ডক্টর আশরাফ আল-কুদরা। ১৩ নভেম্বর আল-জাজিরা আরবিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এ আশঙ্কা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যসেবা ইতোমধ্যে তাদের আয়ত্ত্বের বাইরে চলে গেছে, বিশেষ করে গাজার উত্তরাঞ্চলে। গাজার বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘ভয়াবহ’ বলে আখ্যা দিয়েছে জাতিসঙ্ঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউএ)। দ্রুত সময়ের মধ্যে যুদ্ধবিরতির ডাক ও জরুরি মানবিক সহায়তা প্রদানের আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি। চিকিৎসা মানুষের মৌলিক অধিকারের অংশ হলেও যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা মিত্রদের আশকারায় এ অধিকার লংঘন ও অস্বীকার করছে ইসরাইল।
বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, বিশ্ববাসীর প্রতিবাদ, নিন্দা ও ধিক্কার উপেক্ষা করে ইসরাইল গাজায় আগ্রাসন চালিয়ে গণহত্যা করছে। বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তু করে যুদ্ধাপরাধ করছে। হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, গীর্জা প্রভৃতি ধ্বংস করে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করছে। নির্বিচার বিমান ট্যাংক হামলা, স্থল অভিযান ইত্যাদির মাধ্যমে গাজার মতো ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী এলাকাকে কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত করছে। বিশ্ববাসী ও বিভিন্ন রাষ্ট্র এই অন্যায় ও একতরফা যুদ্ধ বন্ধ করার দাবি জানালেও ইসরাইল সরকার আগ্রাসন বন্ধ করতে রাজি নয়। গণহত্যা চালিয়ে যেতেই বরং বদ্ধপরিকর। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইসরাইলঘনিষ্ঠ দেশগুলোও আগ্রাসন অব্যাহত রাখার পক্ষে। শান্তি ও মানবাধিকারের পক্ষে সোচ্চার বলে কথিত এসব দেশ এখানে যুদ্ধ ও মানবাধিকারের বিপক্ষেই অবস্থান সুনির্দিষ্ট করেছে। যার কারণে ইসরাইলের মতোই এই দেশগুলোও নিন্দা-ধিক্কারের শিকার হচ্ছে। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ, এমনকি সেখানকার ইহুদিরাও যুদ্ধবিরোধিতায় সোচ্চার। ইতোমধ্যে গাজায় ইসরাইলের মানুষ হত্যাকে নির্বিচারে হত্যা বলে অভিহিত করা হয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব গুতরেস গাজা শিশুদের কবরস্থানে পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। প্রতি ১০ মিনিটে সেখানে একটি শিশু প্রাণ হারাচ্ছে। কিন্তু গণহন্তারক, মানবাধিকার লংঘনকারী, যুদ্ধবাজ ও যুদ্ধাপরাধী ইসরাইলকে প্রতিহত করার কোনো উদ্যোগ এখনো দেখা যাচ্ছে না। জাতিসংঘ নিষ্ক্রিয়। বরাবরই এই বিশ্বসংস্থা পশ্চিমাদের তলপীবাহী। চীন-রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়ানোর ধর্মীয় দায়িত্ব ছিল আরব ও ইসলামী দেশগুলোর। তাদের সংগঠন আরব লীগ ও ওআইসি কার্যকর কোনো পদক্ষেপই নিতে পারেনি। যুদ্ধ মাসাধিককাল অতিবাহিত হওয়ার পর ১১ নভেম্বর সউদী আরবের রাজধানী রিয়াদে আরব লীগ ওআইসি’র যে জরুরি সম্মেলন হয়েছে, তাতে তেমন কোনো ফল মেলেনি। ইরান ও তুরস্ক ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সোচ্চারকণ্ঠ হলেও অন্য মুসলিম দেশগুলোর ভূমিকা ছিল নিন্দনীয়। আরব ও মুসলিম দেশগুলোর নেতারা ইসরাইলি হামলার নিন্দা ও যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন মাত্র। এই সঙ্গে গাজায় মানবিক সহায়তার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। ইসরাইল আগ্রাসন বন্ধ করতে বাধ্য হয়, এমন কোনো কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারেনি তারা। সম্মেলন শেষে যে যৌথ ঘোষণা এসেছে তাতে আত্মরক্ষার নামে ইসরায়েলের গাজায় হামলার সমালোচনা করা হয়েছে মাত্র। যদিও যুদ্ধ বন্ধ করতে ও গাজায় ত্রাণ ঢুকতে দিতে ইসরায়েলকে চাপ দিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে এবং যুদ্ধশেষে গাজাকে ফিলিস্তিনের অন্য অংশ পশ্চিম তীর থেকে আলাদা করার সম্ভাবনাকে নাকচ করা হয়েছে। আর জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের পরবর্তী বৈঠকে একটি প্রস্তাব পাস এবং ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ না করতে আন্তর্জাতিক মহলের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু ইসরাইলের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নেয়ার প্রশ্নে তারা ঐক্যমত্যে পৌঁছাতে পারেননি। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক।
উল্লেখ্য, এবারের ওআইসি সম্মেলনে ১১ বছর পর ইরানের কোনো প্রেসিডেন্ট হিসেবে ইব্রাহিম রাইসিও যোগ দিয়েছিলেন। ইসরায়েল সেনাবাহিনীকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, চলতি যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রও একটি পক্ষ। এ বিষয়ে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে যে পরিমাণ সহায়তা দিচ্ছে তা নজিরবিহীন। তাই চলতি অপরাধের জন্য যুক্তরাষ্ট্রও পুরোপুরি দায়ী। প্রায় এক দশক বহিষ্কৃত থাকার পর চলতি বছরের শুরুতে আরব লিগে ফেরা সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদও রিয়াদ সম্মেলনে বক্তৃতা রাখেন। আসাদ গভীর শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, ইসরায়েলকে চাপ দেওয়ার জন্য আমাদের নিজেদের যদি প্রকৃত কোনো ম্যাকানিজম না থাকে, তাহলে আমাদের ফাঁকা বুলির কোনো অর্থ নেই। তাই আসাদের পরামর্শ ছিল, দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধবিরতিতে সম্মত না হলে ইসরায়েলের সঙ্গে আরব দেশগুলোর কোনো ধরনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করা বা বজায় রাখা ঠিক হবে না। রিয়াদ সম্মেলনে ইসরায়েলের ওপর জ্বালানি তেল ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল আলজেরিয়া ও লেবাননসহ আরও কিছু দেশ। কিন্তু সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), বাহরাইনসহ আরও কিছু দেশ এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। প্রসঙ্গত, ২০২০ খ্রিস্টাব্দে ইউএই, বাহরাইন ও মরক্কো যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে। সুদানও একই ঘোষণা দেয়। কিন্তু অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপের কারণে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি এখনও তা কার্যকর করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে ইসরায়েলের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার তথা মিনা অঞ্চলের দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিক করার এ প্রক্রিয়ার নাম ‘ইব্রাহিম চুক্তি’। ৭ আক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার আগে সৌদি আরবও এ চুক্তিতে নাম লেখানোর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। এখন যুদ্ধের কারণে তা হিমাগারে চলে গেলেও বাতিল হয়নি। ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রতিরক্ষা গ্যারিন্টি চায় সৌদি আরব। অর্থাৎ প্রতিবেশী কোনো দেশ আক্রমণ করলে সর্বাত্মক সামরিক, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা দেবে যুক্তরাষ্ট্র। প্রয়োজনে সেনা পাঠাবে। যেসব মুসলিম বা মধ্যপ্রাচ্যের দেশের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক রয়েছে যুদ্ধ শুরুর পর সেগুলোর মধ্যে মাত্র দুটি তেল-আবিব থেকে নিজেদের কূটনীতিক প্রত্যাহার করেছে। দেশ দুটি হলো জর্ডান ও তুরস্ক। অন্য মুসলিম দেশগুলো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এমনকি ওআইসি সম্মেলনে ইরান, আলজেরিয়া ও লেবাননসহ কয়েকটি দেশ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিলেও সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) এবং বাহরাইনসহ কিছু দেশের বিরোধীতায় তা সম্ভব হয়নি। অথচ সম্মেলনে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সব মুসলিম দেশ ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ নিতে পারলে মুহূর্তেই গাজায় গণহত্যা বন্ধ হতো বলে মত প্রকাশ করেছেন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
উল্লেখ্য, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির সঙ্গে মৈত্রী করেছিল তৎকালীন ওসমানি সাম্রাজ্য। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন মিত্রবাহিনীর হাতে জার্মান শিবির পরাস্ত হওয়ার পর মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ স্বাধীনতা পায়। একই সময়ে লেবানন নদীর পশ্চিম তীর ও গাজাসহ ফিলিস্তিন হিসেবে পরিচিত ভূখ-ের দখল নেয় যুক্তরাজ্য। ওই ফিলিস্তিন ভূখ-ের কিছু অংশ নিয়ে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে অবৈধভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয় ইসরায়েল রাষ্ট্রের। এর পর থেকেই জায়নবাদীরা আরব ভূমি দখলে বৃহত্তর ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার তৎপরতা শুরু করে। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দের ছয়দিনের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর পশ্চিম তীর ও গাজা দখল করে ইসরায়েল। ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে গাজা থেকে সম্পূর্ণ ফিরে এলেও পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের দখলদারি এখনও অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু ইসরায়েলের হত্যা, নিপীড়ন, দখলদারি ইত্যাদি উপেক্ষা করে পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অনড় রয়েছে ফিলিস্তিনিরা। ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দের অসলো চুক্তিতেও এ কথা বলা হয়েছে। তবে একসময় আরব দেশগুলো এ কথা জোর দিয়ে বললে এখন আর এত উচ্চকণ্ঠে তারা তা বলে না। এ অবস্থায় সম্প্রতি জেরুজালেমকে নিজেদের রাজধানী ঘোষণা করেছে ইসরায়েল। যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু পশ্চিমা দেশগুলো তার স্বীকৃতি দিলেও বিশ্বের অধিকাংশ দেশ দেয়নি। চলতি যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সৌদি আরব মৃদুস্বরে ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দপূর্ব সীমান্ত অনুযায়ী স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছে। কিন্তু তা বাস্তবায়নের জন্য কোনো বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিচ্ছে না। ওআইসি ও আরব লীগের ১১ নভেম্বরের যৌথ সম্মেলনেও সৌদি ও অন্য আরব দেশকে স্বাধীন ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠার বিষয়ে যথাপূর্ব নীরব থাকতে দেখা গেছে। নির্যাতিত ফিলিস্তিনীদের ব্যাপারে মুসলিম দেশগুলোর এমন ভূমিকা চরম নিন্দনীয়। মুসলিমবিশে^র এমন ন্যাক্কারজনক আচরণ ও ভূমিকা ইসরায়েলকে চরম বেপরোয়া করে তুলেছে। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক, লজ্জাকর ও উদ্বেগকর। অথচ আরব ও ইসলামী দেশগুলো একাট্টা হয়ে ইসরাইলের বিরুদ্ধে যে কোনো ব্যবস্থা নিলে তা সফল ও ফলপ্রসূ হতে বাধ্য।
উল্লেখ্য, বর্তমান সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত-নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর নাম ‘ফিলিস্তিনি’। ফিলিস্তিনিরা আজ নিজ দেশেই পরবাসী। জায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েলের দমন-নিপীড়ন ও গণহত্যার শিকার ফিলিস্তিনিরা প্রাণ বাঁচাতে আজ নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে দেশে দেশে উদ্বাস্তু জীবন বেছে নিয়েছে। একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জন্যে সুদীর্ঘ ৭৫ বছর অপেক্ষা করেও তারা পায়নি তাদের স্বপ্নের দেশ। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর সহায়তায় ইসরায়েল দখল করে আছে পুরো ফিলিস্তিন। দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূমিতে তারা সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে একের পর এক ইহুদি বসতি নির্মাণ ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ইহুদিদের এনে পুনর্বাসন করে যাচ্ছে। ফিলিস্তিনিদের ফসল ও ফলবান বৃক্ষ কেটে নিয়ে যাচ্ছে। গাজা ও পশ্চিম তীরসহ বিভিন্ন এলাকায় নানা ছুঁতোয় আরোপ করছে অর্থনৈতিক অবরোধ। অবরোধের কারণে খাদ্য ও ঔষধের অভাবে প্রতিদিনই মারা যাচ্ছে শত শত ফিলিস্তিনি শিশু ও বয়স্ক মানুষ। এখন সরাসরি হত্যাযজ্ঞে নেমেছে ইসরায়েল। আমরা ইসরায়েল কর্তৃক এই হত্যাকা-ের নিন্দা জানাই। আমরা মনে করি, হামাসের হামলাকে অজুহাত ধরে ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের যেভাবে নির্বিচারে হত্যা করছে তা একটি অমার্জনীয় যুদ্ধাপরাধ। এটি মানবসভ্যতার জন্যও চরম লজ্জার। এ অবস্থায় আর কালক্ষেপণ না করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত হবে ইসরায়েলকে থামাতে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপই গ্রহণ করা। একইসঙ্গে দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের যুক্তিপূর্ণ উদ্যোগও নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমরা আরব লীগ, ওআইসি সহ পুরো মুসলিমবিশে^র শক্তিশালী তৎপরতা দেখতে চাই।
লেখক: প্রাবন্ধিক, আন্তর্জাতিক সংবাদ বিশ্লেষক, সহকারী সম্পাদক দৈনিক পূর্বকোণ।