নবী শব্দের বিশ্লেষণ
মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান>
ইসলামের চারটি বুনিয়াদী (মৌলিক) পরিভাষা রয়েছে ‘ইলাহ্’ ‘রসূল’, ‘নবী’ এবং ঈমান। এ নিবন্ধে ‘নবী’ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়াস পাবো। ‘নবী’ (نبى) শব্দটি نَبَأْ (নাবাউন) থেকে صفت مشبه (সিফাতে মুশাব্বাহ্) ‘নাবাউন’ মানে যদি ‘খবর (সংবাদ) হয়, তবে ‘নবী’ মানে হবে ‘খবর ওয়ালে’ (সংবাদ বিশিষ্ট)। যেমন كَرِيْمٌ (কারীম) ‘করম ওয়ালে’ رَحِيْمٌ (রহম ওয়ালে), حسين (হাসীন) ‘হুস্ন ওয়ালে’। অনুরূপ نَبِىٌّ (নবী) ‘খবর ওয়ালে’। এর মধ্যে তিনটি অর্থ হতে পারে। খবরদাতা, খবর নেন এমন ও খবর রাখেন এমন। যদি ‘নবী’ মানে ‘খবর দাতা’ হয়, তবে জানতে ইচ্ছা জাগে কোন্ খবর, কোথাকার খবর? পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশন, তার, চিঠি, টেলিফোন ও মোবাইল ইত্যাদি। এ সবই তো খবরদাতা। কিন্তু এগুলোতে যে বা যারা খবর লিখেন বা দেন, তাদের কাউকে ‘নবী’ বলা যায় না। আর যদি বলেন হারাম-হালালের সংবাদদাতা ও শরীয়তের মাসআলা-মাসাইল বলে দেন এমন এমন মুফতী, আলিম, মুজাদ্দিদ ও মুজতাহিদ প্রমুখ, তাঁদের কাউকেও নবী বলা যাবে না। সুতরাং কোন ‘বিশেষ খবর’ হওয়া চাই, যা যিনি দেন তাঁকেই নবী বলা হয়। এ প্রসঙ্গে গবেষণালব্ধ কথা হচ্ছে- যমীনবাসীদেরকে যমীনের খবরদাতা এবং এ চাক্ষুষ জগতের খবরাদি দেয় পবিত্র-পত্রিকা ও তার ইত্যাদি আর কিতাবাদি কিংবা ইজতিহাদ দ্বারা মাসআলা-মাসাইল যাঁরা বলে দেন, তারা ‘আলিম’ কিংবা ‘মুজতাহিদ’ কিন্তু যমীন (পৃথিবী) বাসীদেরকে আরশের খবরদাতা এবং অদৃশ্য জগতের যিনি খবর দেন, তিনিই হলেন ‘নবী’ (نبى) । যেখান থেকে সংগ্রহ করে খবর দেওয়ার যাবতীয় মাধ্যম অকেজো, সেখানকার যেই মহান সত্তা খবর দেন তিনিই হলেন নবী। অতএব, যারা নবীগণের ‘ইলমে গায়ব’ (অদৃশ্য-জ্ঞান)কে অস্বীকার করে তারা প্রকৃতপক্ষে তাঁদের ‘নবূয়ত’কেই অস্বীকার করে। যারা বলে যে, নবীগণ শুধু শরীয়তের মাসআলা-মাসাইল জানেন আর দুনিয়াবাসীদেরকে সেগুলো বলার জন্য এসেছিলেন, তারা ‘নবী’ ও ‘মুজতাহিদ আলিম’-এর মধ্যে কীভাবে পার্থক্য করবে? আমি নিম্নে কয়েকটা রেওয়ায়ত (হাদীস শরীফ) উল্লেখ করছি, যেগুলো থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে যাবে যে, ‘নবী’ কোথাকার খবর দেন-
এক. হযরত জাবির রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু একদা কিছুটা দুঃখিত মনে উপবিষ্ট ছিলেন। হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন, ‘‘জাবির! কি ব্যাপার? দুশ্চিন্তা গ্রস্ত কেন?’’ হযরত জাবির আরয করলেন, ‘‘আমি এ জন্য চিন্তিত যে, আমার পিতা হযরত আবদুল্লাহ্ উহুদের যুদ্ধে শহীদ হয়ে গেছেন। তাঁর কন্যাদের ও মোটা অংকের ঋণ রেখে গেছেন। তাঁর ইনতিকালের শোক এবং আমার বোনগণ ও কর্জগুলোর চিন্তা এ উভয়ই আমার মধ্যে একত্রিত হয়ে গেছে।’’ হুযূর-ই আকরাম এরশাদ করলেন, ‘‘তোমাকে কি এমন কিছু বলে দেবো, যা দ্বারা তোমার সব দুঃখ ও দুশ্চিন্তা দূরীভূত হয়ে যাবে?’’ হযরত জাবির আরয করলেন, ‘‘হুযূর! অবশ্যই বলুন!’’ হুযূর ইরশাদ করলেন, ‘‘আজ পর্যন্ত মহান রব কারো সাথে কোন হিজাব বা অন্তরাল ছাড়া কথা বলেননি; কিন্তু তোমার পিতা ওই প্রথম মরহুম (মৃত ব্যক্তি) كَلَّمَه رَبَّه كِفَاهًا যার সাথে তার রব কোন হিজাব ছাড়া (সরাসরি) কথা বলেছেন।’’ হযরত জাবির রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু অতি আগ্রহের সাথে আরয করলেন, ও কথা কি ছিলো, তা আমিও শুনতে চাই।’’ হুযূর-ই আকরাম এরশাদ ফরমালেন, ‘‘মহান রব তোমার পিতাকে বলেছেন, تَمَنَّ (কিছু আরজু করো)!’’ তোমার পিতা আরয করেছে, ‘‘মুনিব ও মাওলা! আপনি আমাকে সব কিছু দিয়েছেন, কোন জিনিষের আরজু করবো? তারপর আরয করেছে মাওলা, আমার আরজু হচ্ছে আমাকে দুনিয়ায় আবার প্রেরণ করা হোক, আবার উহুদের ওই উত্তপ্ত ভূমি হোক! এভাবে আবার রক্ত দ্বারা স্নাত হই, আপনার রাহে মাথা কাটাবো। যেই তৃপ্তি আপনার রাস্তায় মাথা কাটানোর মধ্যে পেয়েছি। তা অন্য কিছুতে পাইনি।’’ তখন মহান রব এরশাদ করেছেন, ‘‘আমার কানূন তো এটা নয় যে, কাউকে পরীক্ষা করে কিংবা কাউকে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করে পুনরায় পরীক্ষার সম্মুখীন করবো!’’
দুই. এক মহিলা সাহাবী হুযূর-ই আক্রামের পবিত্র দরবারে হাযির হয়ে আরয করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ্! আমার একমাত্র যুবক পুত্র সন্তান আপনার সাথে জিহাদে গিয়েছে এবং শহীদ হয়ে গেছে। সে যদি জান্নাতে থাকে, তবে আমি ধৈর্য ধারণ করবো, আর যদি এর ব্যতিক্রম হয়, তবে আমি তার জন্য এমনভাবে কান্না করবো, যা যুগের স্মৃতি হয়ে থাকবে।’’ হুযূর-ই আকরাম এরশাদ ফরমালেন, ‘‘হে আল্লাহর বান্দী! জান্নাতের আটটি স্তর আছে, তোমার পুত্র জান্নাতের সর্বোচ্চ স্তর ‘ফিরদাউস’-এ রয়েছে।’’
তিন. এক ব্যক্তিকে হুযূর-ই আক্বদাসের পবিত্র জীবদ্দশায় শাস্তিস্বরূপ পাথর নিক্ষেপের শাস্তি দেওয়া হয়েছিলো। কোন এক ব্যক্তি তাকে পাথর নিক্ষেপের পর মন্দভাবে স্মরণ করলো। তখন হুযূর-ই আক্রাম এরশাদ করলেন, ‘‘তুমি তাকে মন্দ বলছো, অথচ সে জান্নাতের নহরগুলোতে ডুব দিচ্ছে।’’
দেখুন! হুযূর সরকার-ই দু’ আলম মদীনা শরীফে অবস্থান করে কোথাকার খবর দিচ্ছেন। তিনি সেখানকার খবর দিচ্ছে, যেখান থেকে খবর সংগ্রহের কোন পার্থিব মাধ্যম পাওয়া যায় না। এখানে আরো লক্ষণীয় যে, প্রশ্নকারীকে হুযূর-ই আক্রাম একথা বলেন নি যে, আমি মদীনা শরীফে আছি, আর শহীদগণ তো অদৃশ্য জগতে রয়েছে। আমি কিভাবে জানাবো তারা কোথায় আছে। একথাও বলেননি যে, আচ্ছা, হযরত জিব্রাঈল আসুক, তাকে জিজ্ঞাসা করে উত্তর জেনে তোমাকে বলবো; বরং প্রশ্ন শুনতেই কোনরূপ চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই জবাব দিয়ে দিলেন! তাছাড়া, প্রশ্নকর্তারও এ আক্বীদা ছিলো যে, অদৃশ্য জগতের খবর আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট রয়েছে।
চার. মিশকাত শরীফের ‘বাবু মানাক্বিব সায়্যিদিনা ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’তে বর্ণিত আছে যে, একদা হুযূর সায়্যিদে আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীক্বা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার নিকট তাশরীফ রাখছিলেন। জ্যোৎ¯œা রাত্রি ছিলো। আসমান পরিস্কার ও তারাগুলো ঝলমল করছিলো। হযরত উম্মুল মু’মিনীন আরয করলেন, ‘‘এয়া রসূলাল্লাহ! এমন কোন ব্যক্তিও কি আছেন, যাঁর নেকী আসমানের তারকারাজির সমান? দেখুন, প্রশ্নটা কতই গুরুত্বপূর্ণ! কারণ, তারাগুলো ভিন্ন ভিন্ন আসমানে রয়েছে। প্রথম আসমান থেকে সপ্তম আসমান পর্যন্ত। কতগুলো এত ছোট যে, আজ পর্যন্ত দেখা যায়নি। আর কিছু সংখ্যক এমনও রয়েছে যে, যেগুলো সূর্যের আলোর কারণে দেখা যায়না। অন্য দিকে মুসলমানদের নেকীগুলোও বিভিন্ন ধরনের। কিছু ইবাদত পাহাড়গুলোর গূহায় করা হয়, কিছু ইবাদত রাতের অন্ধকারে করা হচ্ছে, আর কিছু করা হচ্ছে দিনের আলোতে। কিছু করা হচ্ছে একাকী, আর কিছু করা হচ্ছে জনসমক্ষে। এখানে লক্ষণীয় হচ্ছে-এ প্রশ্নের জবাব তিনিই দিতে পারেন, এ সব ইবাদত যাঁর সামনে আছে। বুঝা গেলো যে, হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার আক্বীদা বা দৃঢ় বিশ্বাস হচ্ছে-
سر عرش پر تيرى گذر ، دل فرش پر تيري نظر
ملكوت ملك ميں كوئي نهيں شئ وه جو تجھ پر عياں نهيں
অর্থ: আরশের শিরের উপর আপনার বিচরণ, ফরশের হৃদয়ের উপর আপনার দৃষ্টি, ঊর্ধ্বজগত ও বিশ্বরাজ্যে এমন কোন জিনিষই নেই, যা আপনার চোখের সামনে সুস্পষ্ট নয়।
এখানে আরো লক্ষণীয় যে, ওই প্রশ্নের জবাবে হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম একথা বলেন নি, ‘‘হে আয়েশা! তোমার মত আমিও মদীনার যমীনে আছি। আমার কি জানা থাকার কথা যে, ক্বিয়ামত পর্যন্ত আমার উম্মত কোথায় থাকবে? তারা কি পরিমাণ নেকী করবে? আমার কি জানা থাকার কথা যে, কোন আসমানে কতগুলো তারকা আছে! আমাকে রোজা-নামাযের বিষয়ে প্রশ্ন করো!’’ তিনি একথাও বলেন নি যে, জিব্রাঈল আমীন আসুক, তাকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নেবো। একথাও বলেননি, কাগজ কলম আনো হিসাব করে যোগফল বের করে নিই! বরং কোনরূপ চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই তাৎক্ষণিকভাবে বলে দিলেন, ‘‘হাঁ, এক ব্যক্তি আছে, যার নেকীগুলো আসমানের তারাগুলোর সমান সংখ্যার। আর তিনি হলেন হযরত ওমর ফারূক্ব।’’ উম্মুল মু’মিনীন আরয করলেন, ‘‘তা হলে আমার পিতা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্বের আমলগুলোর অবস্থা কি?’’ হুযূর-ই আকরাম এরশাদ ফরমালেন, ‘‘তাঁর হিজরতের রাতের খিদমত হযরত ওমরের যাবতীয় নেকী অপেক্ষা উত্তম।’’ বুঝা গেলো যে, হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আপন উম্মতের প্রতিটি নেকী সম্পর্কে অবগত আছেন। তিনিই হলেন ‘খবর রাখেন এমন নবী।’
পাঁচ. মিশকাত শরীফে ‘কিতাবুয্ যাকাতঃ বাবু ফদ্বলে সদ্বক্বাহ্’তে রয়েছে – উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীক্বাহ্ বলেন, একবার হুযূর-ই আকরামের পবিত্র বিবিগণ নবী-ই আকরামের পবিত্র দরবারে আরয করলেন-اَيُّهَا اَوَّلُ لُحُوْقًا بِكَ يَا رَسُوْلَ اللهِ অর্থ: ‘‘হে আল্লাহর রসূল! আমাদের মধ্যে সর্বপ্রথম কে আপনার সাথে মিলিত হবে?’’ তিনি বললেন, اَطْوَلُكُنَّ يَدًا অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে যার হাত লম্বা সেই আমার সাথে সর্বাগ্রে মিলিত হবে। আমরা আমাদের হাতগুলো মেপে দেখলাম। দেখলাম আমাদের মধ্যে বিবি সাওদার হাত সবার চেয়ে লম্বা। কিন্তু পরবর্তীতে জানা গেলো যে, ‘লম্বা হাত’ বিশিষ্ট মানে বেশী দান-সদক্বাহ্কারী। সুতরাং বিবি যায়নাবের ওফাত সবার আগে হয়েছে। কারণ, তিনি সবার চেয়ে বেশী দান-সাদক্বাহ্ করতেন।
দেখুন! ছোট্ট একটি প্রশ্নে কতগুলো বিষয় রয়েছে? প্রত্যেকের ওফাতের সময়। কে কখন ইনতিকাল করবেন? ওফাতও কি ধরনের হবে? ঈমানের উপর হবে কিনা? ওফাতের পর আমরা কোথায় থাকবো? আপনার নিকট, না অন্য কোথাও। কারণ তারা জিজ্ঞাসা করেছেন আমাদের মধ্যে সর্বপ্রথম কে আপনার সাথে মিলিত হবে?
এখানেও হুযূর-ই আক্রাম একথা বলেননি এটা তো উলূমে খামসাহর একটি (অদৃশ্য পাঁচ বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত)। আমি কিভাবে জানবো? এটাও বলেন নি যে, জিবরাঈল আমীনকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নেবো। তারপর বলবো বরং তিনি তাৎক্ষণিকভাবে সন্তুষ্টিজনক জবাব দিয়ে দিলেন। তিনিই হলেন আমাদের সর্ব বিষয়ে জ্ঞাতা নবী।
ছয়. বোখারী শরীফে কিতাবুত্ব ত্বাহারাতে আছে- একবার হুযূর-ই আক্রাম এক জায়গা অতিক্রম করছিলেন। দু’টি কবর দেখলেন। আর বললেন, ও দু’টি কবরে অতি মামূলী গুহানহর কারণে আযাব হচ্ছে- তাদের মধ্যে একজন চুগলখুরী করতো, আর অন্যজন উট চরাতো। সে সেগুলোর প্র¤্রাব থেকে নিজেকে বাঁচাতো না।’’ তারপর খেজুর গাছের একটি তাজা শাখা নিয়ে দু’ টুকরো করে একেকটি টুকরা কবর দু’টিতে গেড়ে দিলেন। আর এরশাদ করলেন, এ দু’টি যতদিন ভেজা থাকবে ততদিন সে দু’টির তাফবিহর বরকতে কবর দু’টির আযাব হালকা হবে।
‘নবী’ (نبى) মানে খবর নেন এমন নবী
হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম দুনিয়ায়, কবরে, হাশরে, প্রতি জায়গায় আপন উম্মতের রক্ষা করছেন ও করবেন, খবন নেন। ক্বিয়ামতের দিনে সবার আগে মাখলূকের খবর হুযূর- আকরামই নেবেন। তারপর হিসাব-নিকাশ আরম্ভ হবে। বোখারী ও মুসলিম ইত্যাদির হাদীস শরীফ দ্রষ্টব্য।
লেখক: মহাপরিচালক-আনজুমান রিসার্চ সেন্টার, চট্টগ্রাম।