Anjuman-E Rahmania Ahmadia Sunnia Trust

আঁধার চিরে ফুটলো আলো

আঁধার চিরে ফুটলো আলো

তাহিয়্যা কুলসুম >

ঘটনা-০১.
একদা এক বিদেশি পথিক পথপাড়িকালে এক বৃদ্ধার আতিথেয়তা গ্রহণ করে। সাথে ছিল একটি উট, যেটি পাশের চারণ ভূমিতে ছেড়ে দেওয়া হয়। এমতাবস্থায় উটটি ‘কুলায়ব’ নামের এক ব্যক্তির বাগানে প্রবেশ করে একটি গাছের সাথে গা ঘষতে থাকে, যে গাছে ছিল একটি পাখির বাসা এবং সে বাসায় ছিল দু’টি ডিম। উটের ঘর্ষণের ফলে একটি ডিম মাটিতে পড়ে ভেঙ্গে যায়। এতে পাখিটি চিৎকার করতে লাগলে বাগানের মালিক কুলায়ব ক্ষুদ্ধ হয়ে উটটিকে শর নিক্ষেপ করে। এদিকে কুলায়বের শর নিক্ষেপ দেখে বৃদ্ধাও প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে ওঠে। তার অতিথির উটকে আহত করা হয়েছে। এটি তার জন্য অত্যন্ত অপমানজনক। এর শোধ অবশ্যই গ্রহণীয়। প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য বৃদ্ধা আত্মীয়-স্বজনদের কাছে আকুতি জানাতে থাকে। বৃদ্ধার করুণ আর্তনাদে ব্যথিত হয়ে তার দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় কুলায়বের ওপর হামলা করে তাকে হত্যা করে। ফলশ্রুতিতে বৃদ্ধার গোত্র এবং কুলায়বের গোত্রের মধ্যে মারাত্মক যুদ্ধ আরম্ভ হয়। এ যুদ্ধ বংশানুক্রমে আশি বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়।

ঘটনা-০২
এক ব্যক্তির একটি কন্যা সন্তান জন্ম হলো। তার স্ত্রীর জোর সুপারিশে সন্তানটিকে হত্যা না করে রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলো, তা এমন সময়ে যে সময়টিতে কন্যা সন্তান জন্ম নিলে তাকে জীবন্ত কবরস্থ করা হতো। ওই ব্যক্তি স্ত্রীর কথানুযায়ী সন্তানটিকে হত্যা না করে রেখে দেয়। ধীরে ধীরে সন্তানটি বড় হতে থাকে এবং সুন্দরী অপসরা সদৃশ সকলের নজর কাড়ে। সুমিষ্টভাষী এবং হৃদয়গ্রাহী আচরণে বাবার মন কাড়তে থাকে। এমতাবস্থায় মেয়েটির জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসতে লাগলো। এতে উক্ত ব্যক্তিটি রাগে-ক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগতে থাকে,

তাকে বিয়ে দিবে নাকি নিজের কাছে ঘরে রেখে দিবে। অবশেষে সে তার স্ত্রীকে বললো, আমি আমার বংশের কয়েকজন নিকটাত্মীয়ের কাছে বেড়াতে যাব, কন্যাকেও আমার সঙ্গে যেতে দাও। স্ত্রী খুশি হয়ে সুন্দর পোশাকে ও অলঙ্কার পরিয়ে তাকে সুসজ্জিত করলো। অতঃপর তার কোনো ক্ষতি না করার জন্য প্রতিশ্রুতি নিলো। ওই ব্যক্তি তার কন্যা সন্তানকে নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে গর্ত খোঁড়া শুরু করলো, মেয়েটি গর্ত থেকে মাটি তুলে বাবার কাজে সহযোগিতা করছিল। হায়, সে তখনো জানতো না যে নিজের কবর সে নিজেই খুঁড়ছে। মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে বাবার ঘর্মাক্ত শরীরের ঘামও সে মুছে দিচ্ছে। মাটি এসে বাবার দাড়িতে লাগছিল আর সে দাড়িগুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলছে, আহা! আব্বাজান, আপনার দাড়িতে ধূলি লেগেছে। অবশেষে গর্ত খোঁড়া শেষ হলে ব্যক্তিটি মেয়েটির হাত-পা বেঁধে গর্তে ফেলে দিলো। সে তখন বুঝতে পেরেছে তার বাবা তাকে হত্যা করতে যাচ্ছে, হৃদয় বিদারক ভাষায় বাবার কাছে মিনতি করে চলেছে, ‘‘বাবাজান, আমি আপনার কী অপরাধ করেছি, কী জন্য আমাকে হত্যা করছেন?’’ কিন্তু আফসোস, নির্মম পাষণ্ডতায় ভরপুর সে বাবার মনে এ আকুতির ঠাঁই হলো না। নির্দয়ভাবে মেয়েটিকে গর্তে ফেলে দিয়ে দ্রুত গর্তটি ভরাট করে ফিরে আসে।
শুধুমাত্র উপরের দু’টি ঘটনা নয়, এমনই হাজারো নির্মম, হৃদয়গ্রাহী, কলুষপূর্ণ অরাজকতায় ভরপুর ঘটনা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। যার কারণে সময়টি পরিচিত হয় ‘অন্ধকার যুগ’ নামে। বলছিলাম প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র আবির্ভাবের পূর্ববর্তী সময়কাল ‘জাহেলি যুগ’র কথা। ‘বিশ্বনবী’ গ্রন্থে সময়টির কথা এভাবেই বর্ণিত হয়েছে- ‘‘সে সময় জগতে সত্যই আঁধার যুগ নামিয়া আসিয়া ছিল। আরব, পারস্য, মিসর, রোম, ভারতবর্ষ প্রভৃতি তৎকালীন সভ্য জগতের সর্বত্রই সত্যের আলো নিভিয়া গিয়াছিল। জবুর, তাওরাত, বাইবেল, বেদ প্রভৃতি যাবতীয় ধর্মগ্রন্থই বিকৃত ও রূপান্তরিত হইয়া পড়িয়াছিল, ফলে স্রষ্টাকে ভুলিয়া মানুষ সৃষ্টির পায়েই বারে বারে মাথা নত করিতেছিল। তৌহিদ বা একেশ্বরবাদ জগৎ হইতে লুপ্তপ্রায় হইয়াছিল; প্রকৃতি-পূজা, প্রতিমা-পূজা, প্রতীক-পূজা, পুরোহিত-পূজা, অথবা ভূতপ্রেত ও জড়-পূজাই ছিল তখনকার দিনে মানুষের প্রধান ধর্ম। রাষ্ট্রীক, সামাজিক বা নৈতিক শৃঙ্খলা কোথাও ছিল না। অনাচার, অত্যাচার ও ব্যভিচারে ধরণী পীড়িত হইয়া উঠিয়াছিল।’’
তৎকালীন সমাজ থেকে ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যার বোধ একেবারেই বিলোপ হয়ে পড়েছিল। ‘জোর যার মুল্লুক তার’ এ নীতি সর্বত্র বিরাজমান ছিল। শক্তিমানের মুখের কথাই ছিল আইন। অবাধে চলত অন্যায়, অত্যাচার, ব্যভিচার, চুরি, ডাকাতি কিংবা হত্যা ও রক্তপাত। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোত্রে বিভক্ত ছিল সমাজ, ছিল না কোন সুবিন্যস্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থা, অবিসংবাদিত কোনো নেতৃত্ব। গোত্রীয় সদস্যদের মধ্যে বিবাদ মীমাংসার ক্ষেত্রে ‘জীবনের বদলে জীবন’ এবং ‘অঙ্গের বদলে অঙ্গ’ সর্বজন স্বীকৃত আইন বলে গণ্য হতো। এক গোত্রের সাথে আরেক গোত্রের যুদ্ধ-সংঘাত সারা বছর লেগেই থাকতো এবং তাও অতি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্রে করে। কিন্তু যত তুচ্ছ কারণেই হোক, যুদ্ধ একবার লেগে গেলে সহজে শেষ হতো না, কখনো তো তার স্থায়ীত্ব হতো শতাব্দীকাল অবধি।
সে সময়ের অর্থনৈতিক চিত্রও তেমন সুখকর ছিল না। অল্প বিস্তর ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রচলন থাকলেও তা ছিল গুটি কয়েক ব্যক্তির হাতে। ফলে সমাজের এক বিশাল অংশ তাদের জীবিকা নির্বাহ করতো লুটতরাজের ওপর। ডাকাতিতে সিদ্ধহস্ত হওয়াকে তৎকালীন কৃতিত্ব ও বীরত্বের পরিচয় বলে মনে করা হতো। কিভাবে নিরীহ পথিককে হত্যা করে সহায়-সম্পদ কেড়ে নিতে সক্ষম হয়েছে তার বীরত্ব বর্ণনা করে কবিতা আবৃত্তি করা হতো, আবার সে কবিতার জন্য সকলে বাহবাও পেতো। ক্রমাগত দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও রক্তপাতের কারণে দয়া-মায়া, মমতা ইত্যাদি মানবীয় গুণাবলী মানুষের মধ্য থেকে বিলুপ্ত হয়ে তদস্থলে ঠাঁই হয়েছিল নিষ্ঠুরতা, হিংসা ও উন্মত্ততা। ন্যায়-অন্যায় বোধ লুপ্ত হয়ে যাওয়ায় সমাজে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে ব্যভিচার। একজনের সন্তানকে আরেকজনের সন্তান বলে চালিয়ে দেয়া হতো। নির্লজ্জতায় তারা এ পর্যন্ত পৌঁছেছিল যে, পবিত্র কা’বা ঘর উলঙ্গ অবস্থায় নারী-পুরুষ একত্রে তাওয়াফ করার প্রচলন হয়ে পড়েছিল।
নারীজাতির অবস্থা আরো শোচনীয় ছিল। তাদের দুর্ভোগের কোন সীমা ছিল না। গৃহপালিত পশুর মতো তারা যথেচ্ছ ব্যবহার হতো। পিতার মৃত্যুর পর পরিত্যক্ত স্ত্রী-কন্যাগণ পুত্রের ভোগের দাবিদার হতো। একজন পুরুষ যত খুশি বিবাহ করতে পারতো আবার যখন ইচ্ছা তাদের পরিত্যাগও করতে পারতো। সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় ছিল কন্যা সন্তানকে সমাজের বোঝা মান্যকরণ।
কারো গৃহে কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করলে তাদের মুখমণ্ডল বিবর্ণ হয়ে যেতো এবং অধিকাংশ সময় কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবরস্থ করা হতো। ফলে পুত্র সন্তানের আশায় এক নারী একই সময়ে বিভিন্ন পুরুষকে বিবাহ্ করতে পারতো। এতে এক উৎকট সামাজিক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছিল।
সুদের বিস্তার হয়েছিল মহামারী আকারে। গরু-ছাগলের মতো মানুষের হাট বসতো, যেখানে দাস-দাসীর ক্রয়-বিক্রয় হতো। দাস-দাসীদের জীবন-যাপন ছিল পশু পর্যায়ের। তাদের জীবনের নিরাপত্তা ছিল না, খাবারের নিশ্চয়তা ছিল না, সম্মান মর্যাদা ছিল না। মনিবের দয়ায় নির্ভর করতো তাদের জীবন।
ধর্মীয় অবস্থা নানাবিধ কুসংস্কার ও পৌত্তলিকতায় জর্জরিত ছিল। তবে তাওহীদ বা ‘একেশ্বরবাদ’র অস্তিত্ব যে ছিল না- তা সত্য নয়। তারা আল্লাহ্র অস্তিত্বে বিশ্বাস করতো এবং আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ইত্যাদি বলে বিশ্বাস করতো। তারা বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি বানিয়ে পূজা করতো এই ভেবে যে, এ দেব-দেবীগুলো আল্লাহর কাছে তাদের হয়ে সুপারিশ করবে এং তাদের দুনিয়াবি বিভিন্ন স্বার্থ হাসিলে সহায়ক হবে। পবিত্র কা’বাঘরে তারা ৩৬০টি মূর্তি ঢুকিয়ে রেখেছিল। তবে ‘হানিফ’ নামে পরিচিত সম্প্রদায়ের লোকেরা মূর্তি পূজার বিরোধী ছিল এবং নিস্কলুশ জীবন-যাপনে অভ্যস্ত ছিল।
এভাবে সকল দিক দিয়ে বিশ্বজগৎ যখন অধঃপতনের চূড়ান্ত অবস্থায় উপনীত হয়েছিল, জাহেলিয়াতের অন্ধকারে পথ হারিয়ে ত্রাহি চিৎকার করছিল নির্যাতিত, নিপীড়িত, শোষিত-বঞ্চিত অসহায় মানুষ। তখনই সময় ছিল মানবতার মুক্তির দিশারী, সত্যের আলোকবর্তী প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র আবির্ভাব।
‘আঁধার যুগের অবস্থা এই রূপই ভয়াবহ ছিল। মানুষ পশু হইয়া গিয়াছিল। সেই নরপশুদিগের বীভৎস তাণ্ডব-লীলায় ধর্ম ও নীতির অস্ফুট আর্তনাদ কোথায় তলাইয়া গিয়াছিল। এই চরম দুর্গতি হইতে মানুষকে উদ্ধার করিবার জন্য একজন মহাপুরুষের আবির্ভাব তাই আসন্ন হইয়া উঠিয়াছিল। [বিশ্বনবী]
‘মুসলিম রেঁেনসার কবি’ হিসেবে খ্যাত ফররুখ আহমদ তাঁর কবিতায় জাহেলি যুগের অন্ধকারাচ্ছন্নতার মাঝে রাসূলের আগমনকে ‘আলোর গোলাব কলি’ রূপে রূপায়িত করেছেন।
‘‘শোন শোন খোদার হাবীব, নবীর কথা বলি,
আঁধার ধরায় উঠলো ফুটে আলোর গোলাব কলি।
পাপের চাপে হয় বুঝি লয় দুনিয়া জাহান
আঁধার ধরা, অন্ধকারে হারালো আসমান,
পথ খুঁজি আর কোন খানে পায় না যে ইনসান,
হতাশ হয়ে মরে মানুষ, পড়ে ধূলায় টলি॥’’
বাংলার জননন্দিত কবি গোলাম মোস্তফা ঘোর তমসাচ্ছন্ন সময়ে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র আবির্ভাব ‘বিশ্বমুক্তির যথার্থ কাম্যবস্তু’ হিসেবে ছন্দায়িত করেছেন-
‘‘অন্যায় অবিচার ধরাবাসী লিপ্ত,
রক্তের লালসায় তনু-মন দীপ্ত,
ভাই-ভাই ঠাঁই-ঠাঁই হয় না মীমাংসা,
মারামারি-কাটাকাটি ঈর্ষা-জিঘাংসা।
এই ঘোর দুর্দিনে এলো কে গো বিশ্বে,
উজ্জ্বলিয়া দশদিশি, তরাইতে নিঃস্বে!
মুখে তার প্রেম বাণী, করুণা ও সাম্য,
বিশ্বের মুক্তি ও কল্যাণ কাম্য।’’
জিন-ইনসান, প্রাণী, উদ্ভিদ, জড়পদার্থ, আকাশ-পাতাল সকলের জন্যই রহমত এবং আলোকবর্তিকা রূপে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র এ ধরায় শুভ আবির্ভাব ঘটে। তাঁর আগমনে পৃথিবী রক্ষা পায় এক বিপর্যয়ের হাত থেকে। কেটে যায় অন্ধকার, সর্বত্র প্রতিষ্ঠা পায় এক ‘নূর’ যার আলোতে স্পষ্ট হয় সত্য এবং ন্যায়, নীতি। তিনি এসেছেন সত্যের আলো নিয়ে, বিজ্ঞানময় ক্বোরআনের আলো নিয়ে, তাই কেটে গেছে লোকের মনের অন্ধকার। জগতকুলে তাঁকে শ্রদ্ধার সাথে বলবে, তোমার কারণেই কেটে গেল পৃথিবীর যত অন্ধকার। কবির কণ্ঠে তাই অনুরণিত,
‘‘তুমি যে নূরের রবি, নিখিলের ধ্যানের ছবি,
তুমি না এলে দুনিয়ায়, আঁধারে ডুবিত সবই।’’
আল্লামা শফী উকাড়ভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি কৃত লুরী শরীফে সেই সম্ভাষণ প্রতিধ্বনিত হয় এভাবে-
‘‘কুফর ও শির্ক কী কা-লী ঘটাঁেয় হো গ্যয়ী সা-রী দূর
মাশরকি ও মাগরিব দুনিয়া আন্দর হো গ্যয়ী নূর হী নূর।’’
মানব সভ্যতার এমন কোন ক্ষেত্র নেই যা মহানবীর সংস্কার থেকে খালি ছিল। বিভিন্ন পাপসহ অন্ধকারে নিমজ্জিত আরব জাতিকে ন্যায়-নীতি ও সাম্যের ভিত্তিতে এক আদর্শ জাতিতে রূপান্তরিত করেন। ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনীতি সহ সব ক্ষেত্রে এক অভূতপূর্ব সংস্কার সাধন করেন। বার্নার্ড শ’ বলেন,
‘‘গোটা বিশ্বের বিভিন্ন ধর্ম, সম্প্রদায় আদর্শ ও মতবাদ সম্পন্ন মানব জাতিকে যদি ঐক্যবদ্ধ করে একনায়কের শাসনাধীন আনা হতো তবে তাদেরকে একমাত্র হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামই সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য নেতারূপে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করতে পারতেন।’’
তাঁর ধর্মীয় সংস্কার সমূহের মধ্যে প্রথমে তিনি আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করেন। ভন ক্রেমার বলেন, ‘‘নিকৃষ্ট ভক্তিযোগ্য বস্তু পূজা হতে কঠিন এবং অনমনীয় একেশ্বরবাদ এটাই ছিল ইসলামের ধর্মীয় সংস্কার।’’ যখন পৌত্তলিকতা, ধর্মীয় কুসংস্কার, বস্তুপূজা প্রভৃতি আরবের ধর্মীয় জীবনকে কলুষিত করছিল, তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সমগ্র ইসলাম জগতকে তাওহীদের মূলমন্ত্রে একটি ভ্রাতৃসংঘে আবদ্ধ করেন।
সামাজিক সংস্কার সমূহের মধ্যে তাঁর উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপগুলো হলো মানবতার ভিত্তিতে সমাজ গঠন করা, নারী সমাজের মর্যাদা নিশ্চিত করা, দাস প্রথা নির্মূল করে তাদের সম্মান দান করা, প্রতিবেশি, এতিম-মিসকিনের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য পূর্বে বলবৎ ‘জোর যার মুলুক তার’ নীতি পরিহার করেন। খুন-খারাবি, মদ্যপান, জুয়াখেলা, সুদপ্রথা, সর্বপ্রকার অন্যায়, ব্যভিচার উচ্ছেদ করে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। কবি গোলাম মোস্তফা খুবই সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন-
‘‘হাতে তার দুর্জয় শক্তির যন্ত্র, জালিমের ক্ষমা নাই-এই তার মন্ত্র,
ত্যাগ, সেবা, সদাচার, মুখে তার স্ফূর্তি, মহিমায় আলোকিত সৌম্য সে মূর্তি।
দুর্বলে করে না সে নিপীড়ন হস্তে, আর্তেরে তুলে দেয় শুভাশিস মস্তে,
ভ্রান্তেরে বলে দেয় মঙ্গল-পন্থা, রক্ষক, বীর, নহে ভক্ষক, হন্তা।
ভিক্ষুকে টেনে নেয় আপনার বক্ষে, ছোট-বড় ভেদ নাহি তার চক্ষে,
মানুষের আত্মারে করে না সে ক্ষুদ্র, হোক না সে বেদুঈন হোক না সে শূদ্র।’’

আদর্শের মূর্তপ্রতীক রাহমাতুল্লিল আলামীন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম দাসত্ব প্রথার মূলে কুঠারাঘাত করেন। সেনাপতিত্ব দান করেন ক্রীতদাস যায়েদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে। ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন নিযুক্ত করেন ক্রীতদাস হযরত বিলাল রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে। হযরত আনাস, সালমান ফারসি ও সুহায়েব রুমি এবং অপরাপর ক্রীতদাসদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ক্বোরআনের বাণী প্রচার করে বলেন, ‘‘পুরুষের ওপর নারীর যতটা অধিকার আছে, নারীরও পুরুষের ওপর ঠিক ততটা অধিকার আছে।’’
বিবাহ, তালাক, বিধবা-বিবাহ, স্ত্রীলোকের মৃত পিতা বা স্বামীর সম্পত্তি ভোগের অধিকার প্রভৃতি বিধান দ্বারা সমাজের আমূল পরিবর্তন সাধন করেন। ‘‘মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত’’ উক্তি দ্বারা নারীদের মাতৃমর্যাদা উন্নীত করেন। কন্যা সন্তান হত্যার ব্যাপারে পবিত্র ক্বোরআনের অমোঘ বাণী দ্বারা হুঁশিয়ারি প্রদান করেন, ‘‘তোমরা দারিদ্রতার ভয়ে তোমাদের কন্যা সন্তানকে হত্যা করোনা, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজে ঘোষণা দেন, ‘‘জাহেলি যুগের কোন অপকর্মের কারণে যদি কাউকে শাস্তি দেওয়ার আদেশ করা হতো, তাহলে আমি কন্যা সন্তান হত্যাকারীদের শাস্তি দিতাম।’’
সরকারে দো’আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও প্রচলিত সব অরাজকতা দূর করে আমূল সংস্কার সাধন করেন। তাঁর রাজনৈতিক সংস্কার সমূহের আওতাভুক্ত বিষয়গুলো হলো- উন্নত জাতি গঠন, লিখিত সংবিধান প্রণয়ন, রাষ্ট্র পরিচালনা, সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি এবং অমুসলিমদের অধিকার রক্ষা।
নবীকুল দরদার মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম অন্ধকার যুগের অনৈতিক উপায়ে অর্থ উপার্জনের সকল পথ বন্ধ করে নীতিসম্মত অর্থোপার্জনের বিধান চালু করে অর্থনৈতিক সংস্কারে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেন। তাঁর রাজস্ব ব্যবস্থার আওতাভুক্ত খাত সমূহ ছিলো আল-গনিমাহ, যাকাত, জিজিয়া, খারাজ ও আল-ফাই। উল্লেখিত খাত থেকে আগত অর্থ তিনি গরীব জনগণ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে ব্যয় করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং বায়তুল মাল প্রতিষ্ঠা করেন।
ক্বোরআনের সর্বপ্রথম বাণী ‘পড়–ন আপনার প্রতিপালকের নামে’ এই বাণীর মাধ্যমে তিনি জ্ঞান অর্জনকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার মাধ্যমে শিক্ষা ও জ্ঞান বিস্তারে বিপ্লব সাধন করেন। এভাবে তিনি সকল স্তরে পরিবর্তন সাধন করে মানবিকতার ভিত্তিতে এক সর্বজনীন ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। তাইতো তিনি ‘রাহমাতুল্লিল আলামীন’ তথা সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য রহমত স্বরূপ। তাঁর আগমনে দূরীভূত হয়ে যায় সমাজের সকল অন্ধকার।
পরিতাপের বিষয় এই যে, মানবিক আদর্শের মাধ্যমে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যে, উৎকর্ষতার ভিত্তি স্থাপন করেছেন, আজ সে মুসলিম জাতি তাঁর আদর্শ থেকে বিচ্চুত হয়ে অজ্ঞতার অন্ধকারে আবার তলিয়ে যাচ্ছে। মহান আল্লাহ্ সবাইকে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শ অনুসরণ করে এ অন্ধকার অতিক্রম করে আলোর জগতে স্থায়ী হওয়ার তাওফিক দান করুন। আ-মী-ন।

লেখিকা: প্রাবন্ধিক।