সৎ কর্ম গুনাহর কাফ্ফারা
অধ্যক্ষ হাফেয কাজী আবদুল আলীম রিজভী
فَاَعْرِضْ عَنْ مَّنْ تَوَلّٰى عَنْ ذِكْرِنَا وَ لَمْ یُرِدْ اِلَّا الْحَیٰوةَ الدُّنْیَاﭤ(29) ذٰلِكَ مَبْلَغُهُمْ مِّنَ الْعِلْمِؕ- اِنَّ رَبَّكَ هُوَ اَعْلَمُ بِمَنْ ضَلَّ عَنْ سَبِیْلِهٖۙ-وَهُوَ اَعْلَمُ بِمَنِ اهْتَدٰى(30) وَلِلّٰهِ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا فِی الْاَرْضِۙ-لِیَجْزِیَ الَّذِیْنَ اَسَآءُوْا بِمَا عَمِلُوْا وَیَجْزِیَ الَّذِیْنَ اَحْسَنُوْا بِالْحُسْنٰى( 31( اَلَّذِیْنَ یَجْتَنِبُوْنَ كَبٰٓىٕرَ الْاِثْمِ وَ الْفَوَاحِشَ اِلَّا اللَّمَمَؕ-اِنَّ رَبَّكَ وَاسِعُ الْمَغْفِرَةِؕ-هُوَ اَعْلَمُ بِكُمْ اِذْ اَنْشَاَكُمْ مِّنَ الْاَرْضِ وَ اِذْ اَنْتُمْ اَجِنَّةٌ فِیْ بُطُوْنِ اُمَّهٰتِكُمْۚ-فَلَا تُزَكُّوْۤا اَنْفُسَكُمْؕ-هُوَ اَعْلَمُ بِمَنِ اتَّقٰى (32) اَفَرَءَیْتَ الَّذِیْ تَوَلّٰى(33)وَ اَعْطٰى قَلِیْلًا وَّ اَكْدٰى (34) |
তরজমা: (হে রাসূল!) অতএব আপনি তারই দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিন, যে আমার স্মরণ থেকে বিমুখ হয়েছে এবং সে তো কেবল পার্থিব জীবনই চায়। এ পর্যন্তই তাদের জ্ঞানের দৌঁড়। নিশ্চয় আপনার প্রতিপালক ভালো জানেন তারই সম্পর্কে, যে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে এবং তিনি ভালভাবে জানেন তাকে, যে সুপথ প্রাপ্ত হয়েছে। এবং আল্লাহরই যা কিছু নভোমন্ডলে রয়েছে এবং যা কিছু ভু-মন্ডলে রয়েছে, যাতে দুস্কৃতকারীদেরকে তাদের কৃতকর্মের প্রতিফল দেন এবং সৎকর্মপরায়ণকে অত্যন্ত উত্তম প্রতিদান প্রদান করেন। যারা মহাপাপগুলো ও অশ্লীল কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকে কিন্তু এতটুকুই যে পাপের নিকট গিয়েছে ও বিরত হয়েছে, নিশ্চয় আপনার প্রতিপালকের ক্ষমা সুদূর বিস্তৃত। তিনি তোমাদেরকে ভালোভাবে জানেন তোমাদেরকে মৃত্তিকা হতে সৃষ্টি করেছেন এবং যখন তোমরা তোমাদের মায়ের গর্ভের মধ্যে ভ্রুণরূপে ছিলে। সুতরাং তোমরা নিজেরা নিজেদেরকে পবিত্র-পরিচ্ছন্ন বলোনা। তিনি ভালোভাবে জানেন যারা খোদাভীরু। তবে কি আপনি দেখেছেন তাকে, যে বিমুখ হয়েছে এবং দান করে সামান্যই ও পাষাণ হয়ে যায়। [সুরা আন-নাযম: আয়াত নম্বর ২৯-৩৪]
আনুষঙ্গিক আলোচনা
أَفَرَأَيْتَ الَّذِي تَوَلَّىٰ এর শানে নুযুল
উপরোক্ত আয়াতের শানে নুযুল বর্ণনায় মুফাসসেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন- ‘তাফসিরে দুররে মানছুর’ শরীফে ইমাম ইবনে জারীর রহমাতুল্লাহি আলায়হি কর্তৃক বর্ণিত রেওয়ায়তে রয়েছে জনৈক অমুসলিম ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করলে তার বন্ধু এই বলে তাকে তিরস্কার করল যে, তুমি পৈতৃক ধর্ম ছেড়ে দিলে? সে জবাবে বলল- আমি আল্লাহর শাস্তিকে ভয় করি। বন্ধু বলল-তুমি আমাকে কিছু অর্থকড়ি দিলে আমি তোমার শাস্তি নিজের কাঁধে তুলে নেব। ফলে তুমি বেঁচে যাবে। (নাউজুবিল্লাহ) অথচ কুরআনের বিধান হলো- ولا تزر وازرة وزر أخرى অর্থাৎ কেউ কারও (গুনাহ্র) বোঝা বহন করবে না। সুতরাং সে বন্ধুকে কিছু অর্থকড়ি দিল। বন্ধু আরো চাইলে সে ইতস্তত করার পর আরো দিল এবং অবশিষ্ট অর্থের একটি দলিল লিখে দিল। ‘তাফসিরে রুহুল মায়ানি’ তে উক্ত ব্যক্তির নাম ওলীদ ইবনে মুগিরা বলে লিখিত আছে। সে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল এবং তার বন্ধু তাকে তিরস্কার করে শাস্তির দায়িত্ব নিজে গ্রহণ করেছিল। এজন্য হাদিসে নববী শরিফে এরশাদ হয়েছে لا تصاحب الا مومنا অর্থাৎ মুমিন ব্যতীত অন্য কোন ধর্মাবলম্বীকে সঙ্গী-সাথী রূপে গ্রহণ করবে না। তখন উপরোক্ত আয়াত দু’টি নাযিল হয়। (তাফসিরে দুররে মানছুর ও তাফসিরে রূহুল মায়ানী শরীফ)
هُوَ أَعْلَمُ بِكُمْ إِذْ أَنشَأَكُم مِّنَ الْأَرْضِ
উদ্ধৃত আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় তাফসীর বেত্তাগণ উল্লেখ করেছেন-মহান আল্লাহ মানবকুলকে স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, মানব জাতি তার নিজের সম্পর্কে ততটুকু জ্ঞান রাখে না, যতটুকু তার ¯্রষ্টা রাখেন। কেননা, মাতৃগর্ভে সৃষ্টির বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করার সময় তার কোন জ্ঞান ও চেতনা থাকে না, কিন্তু তাঁর ¯্রষ্টা সুনিপুণ সৃষ্টি কৌশলে তাঁকে গড়ে তোলেন। আল্লাহর মহান এ বাণীতে মানবের অক্ষমতা ও অজ্ঞানতা ব্যক্ত করে বলা হয়েছে যে, মানুষ যে কোন ভালো ও সৎকর্ম করে, সেটা তার ব্যক্তিগত প্রচেষ্ঠা নয়, বরং আল্লাহ প্রদত্ত অনুগ্রহ। কারণ, কাজ করার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তিনি তৈরি করেছেন। অঙ্গ-প্রতঙ্গ তিনিই গতিশীল করেছেন। অন্তরে সৎকাজের প্রেরণা ও সংকল্প তাঁরই তাওফিক দ্বারা হয়। অতএব মানুষ যত বড়ই সৎকর্মী, মুত্তাকি ও পরহেজগারই হোক না কেন, নিজ কর্মের জন্য গর্ব করার অধিকার তার নেই। এছাড়া ভাল-মন্দ সব সমাপ্তি ও পরিণামের উপর নির্ভরশীল। সমাপ্তি ভালো হবে কি মন্দ হবে, তা বান্দার জানা নেই। অতএব গর্ব ও অহংকার কিসের উপর।
فَلَا تُزَكُّوا أَنفُسَكُمْ ۖ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنِ اتَّقَىٰ
আল্লাহর উপরোক্ত মহান বাণী ‘অতএব তোমরা আত্ম-প্রশংসা করো না। অর্থাৎ নিজেদের পবিত্রতার দাবি করো না। কারণ, মহান আল্লাহই ভাল জানেন কে কতটুকু খোদাভীরু’ এর ব্যাখ্যায় মুফাসসেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন যে, শ্রেষ্ঠত্ব আল্লাহ ভীতির উপর নির্ভরশীল-বাহ্যিক কাজ-কর্মের উপর নয়। আল্লাহভীরুতা ও তা-ই ধর্তব্য, যা মৃত্যু পর্যন্ত কায়েম থাকে।
সুরা আলে-ইমরানে এরশাদ হয়েছে-لَا تَحْسَبَنَّ ٱلَّذِينَ يَفْرَحُونَ بِمَآ أَتَواْ وَّيُحِبُّونَ أَن يُحْمَدُواْ بِمَا لَمْ يَفْعَلُواْ فَلَا تَحْسَبَنَّهُم بِمَفَازَةٍۢ مِّنَ ٱلْعَذَابِ ۖ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ অর্থাৎ আল্লাহ বলেন (হে পাঠক) তুমি অবশ্যই মনে করো না তাদেরকে যারা নিজেদের কৃতকর্মের উপর আনন্দিত হয় এবং নিজেদের না করা বিষয়ের উপর প্রশংসা করাকে পছন্দ করে তারা আল্লাহর আজাব থেকে দূরে কখনো মনে করবে না। আর তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি। হাদীছ শরিফে রয়েছে হযরত যয়নব বিনতে আবু সালমা (রা.) এর পিতামাতা তাঁর নাম রেখেছিলেন ‘বাররা’ অর্থাৎ সৎকর্মপরায়ন। রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলোচ্যفلا تزكوا انفسكم আয়াতাংশ তেলাওয়াত করে এই নাম রাখতে নিষেধ করেন। কারন, এতে সৎ হওয়ার দাবি রয়েছে। নামে নয়, আমলের মাধ্যমেই সৎকর্মশীল হওয়াই আল্লাহ-রাসুলের প্রত্যাশীত ও পছন্দনীয়। অত:পর তাঁর নাম পরিবর্তন করে যয়নাব রাখা হয়। [তাফসিরে ইবনে কাছীর]
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহমাতুল্লাহি আলায়হি সাহাবীয়ে রাসূল হযরত আব্দুর রহমান বিন আবু বকর রাহমাতুল্লাহি আলায়হি থেকে বর্ণনা করেন, জনৈক ব্যক্তি আল্লাহর হাবীবের সামনে অন্য এক ব্যক্তির প্রশংসা করলে তিনি নিষেধ করে বললেন-তুমি যদি কারো প্রশংসা করতেই চাও, তবে একথা বলে কর: আমার জানা মতে এই ব্যক্তি সৎ, আল্লাহভীরু। সে আল্লাহর কাছেও পবিত্র কিনা তা আমি জানি না। [মুসনাদে ইমাম আহমদ]
الَّذِينَ يَجْتَنِبُونَ كَبَائِرَ الْإِثْمِ وَالْفَوَاحِشَ إِلَّا اللَّمَمَ উদ্ধৃত আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় তাফসীর বিশারদগণ উল্লেখ করেছেন- আলোচ্য আয়াতে মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের বিধি-বিধান পালনকারী অনুগত ও সৎকর্মশীল বান্দাগণের প্রশংসা সূচক আলোচনা করত: তাদের পরিচয় এ-ই বর্ননা করা হয়েছে যে, তারা সাধারণ ভাবে কবীরা তথা বড় বড় গুনাহ থেকে এবং বিশেষভাবে অশ্লীল ও নির্লজ্জ কার্যকলাপ থেকে পবিত্র ও বিরত থাকে। এতে لمم শব্দের মাধ্যমে ব্যতিক্রম প্রকাশ করা হয়েছে। আর এই ব্যতিক্রমের সারমর্ম হলো ছোটখাটো গুনাহে লিপ্ত হওয়া তাদের কে সৎকর্মশীল উপাধী থেকে বঞ্চিত করে না।
আল্লাহর বাণী لمم শব্দের ব্যাখ্যায় সাহাবী ও তাবেয়ীগণের কাছ থেকে দু’ প্রকারের তাফসির বর্ণিত হয়েছে। প্রথমত: এর অর্থ হলো- সগীরা তথা ছোটখাটো গুনাহ্। পঞ্চম পারার সুরা ‘আন নিসা’ এর আয়াতে إِن تَجْتَنِبُوا كَبَائِرَ مَا تُنْهَوْنَ عَنْهُ نُكَفِّرْ عَنكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَنُدْخِلْكُم مُّدْخَلًا كَرِيمًا একে سيئات হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই তাফসির সাইয়্যেদুনা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস ও হযরত আবু হুরাইরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে ইমাম ইবনে কাছীর বর্ণনা করেছেন।
দ্বিতীয়ত: এর অর্থ সেসব গুনাহ, যা কদাচিৎ সংঘটিত হয়, অত:পর তা থেকে তাওবা করত: চিরতরে বর্জন করা হয়। এই তাফসির ও ইমাম ইবনে কাছির প্রথমে ইমাম মুজাহিদ থেকে এবং পরে হযরত ইবনে আব্বাস ও আবু হুরাইরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকেও বর্ণনা করেছেন। এর সারমর্ম এই যে, কোন সৎ লোক দ্বারা ঘটনাচক্রে কবীরা গুনাহ হয়ে গেলে যদি সে তাওবা করে, তবে সেও সৎকর্মী ও মুত্তাকীদের সৎকর্ম সমূহ ছগীরা গুনাহের কাফফারা : কুরআনে করীমের আয়াত ও হাদীসে রাসূলের রেওয়ায়ত পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, বান্দার সৎকর্ম সমূহকে সগীরা গুনাহের ক্ষতিপূরন হিসাবে দেখিয়ে, তার হিসাব সমান সমান করে দেওয়া হবে। জাহান্নামের পরিবর্তে সে জান্নাত প্রাপ্ত হবে। বিশুদ্ধ হাদিসে বর্ণিত আছে যে, কোন লোক যখন নামাজ আদায়ের জন্য ওজু করে, তখন প্রতিটি অঙ্গ ধৌত করার সাথে সাথে তার গুনাহের কাফফারা হয়ে যায়। মুখমন্ডল ধুয়ে নিলে চোখ, কান ও নাক প্রভৃতি অঙ্গের পাপসমূহের কাফফরা হয়ে যায়। আর পা ধোয়ার সাথে সাথে ধুয়ে যায় পাপ সমূহ। যখন সে মসজিদের দিকে রওয়ানা হয় তখন প্রতিটি পদক্ষেপে পাপের কাফফারা হতে থাকে। আল্লাহর আলীশান দরবারে কায়মনোবাক্যে ফরিয়াদ জানাই তিনি যেন সবাইকে উপরোক্ত দরছে কোরআনের উপর আমল করার সৌভাগ্য নসীব করেন। আমীন।
লেখক: অধ্যক্ষ-জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদরাসা, চট্টগ্রাম।