ঈদে গাদীর : ষড়যন্ত্রের স্বরূপ উন্মোচন
আবুল কাশেম মোহাম্মদ ফজলুল হক>
১. বিদায় হজ্জ শেষে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় ফিরছিলেন। হজরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর সাথে হজরত বুরাইদা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু অথবা হজরত উসামা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু কিংবা অন্য কোন সাহাবির সাথে মনোমালিন্য হয়েছিলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘গাদীরে খুম’ পৌঁছলেন। গাদীর মানে পুকুর বা কূপ। খুম একটা জায়গার নাম। যেখানে পৌঁছে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছোট একটি বক্তব্য রাখলেন। বক্তব্যটি ছিল হজরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এর ব্যাপারে। হজরত আলীর সাথে যাঁদের মনোমালিন্য হয়েছে তাদের উদ্দেশে। এ বক্তব্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপস্থিত সাহাবায়ে কেরামের উদ্দেশে বললেন, “আমি কি তোমাদের ‘মাওলা’ নই?” উপস্থিত সবাই বললেন, ‘অবশ্যই’। ‘আমি কি প্রতিটা ঈমানদার নর-নারীর কাছে তার জীবন থেকেও বেশি প্রিয় নই?’ উপস্থিত সকলেই আবার জবাব দিলেন, ‘‘অবশ্যই। ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।’’
তখন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন, ‘‘আমি যার মাওলা, আলীও তার মাওলা। হে আল্লাহ, যে আলীকে ভালবাসে, তুমিও তাকে ভালবাস এবং যে আলীর সাথে দুশমনি করে, তুমিও তার সাথে দুশমনি কর।’’
একথার পর হজরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু সহ বহু সাহাবি হজরত মাওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন ‘‘আলী, আপনি সকাল-সন্ধ্যা প্রতিক্ষণেই সকল ঈমানদার নর-নারীর কাছে প্রিয়।’’ এই হলো ঘটনার সংক্ষিপ্ত প্রাসঙ্গিক অংশ।
২. হজরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হলেন মহান আহলে বাইতের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। সেদিনের ঘোষণায় প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে ‘মাওলা’ বলেছেন। ‘মাওলা আলী’। কোন সন্দেহ নেই। সন্দেহের অবকাশও নেই। গদীরের হাদীসকে অস্বীকার করারও কোনো সুযোগ নেই। ইবনে তাইমিয়া ও ফিরোজাবাদীসহ যারা এই হাদীস নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তা অগ্রহণযোগ্য। এই হাদীস সঠিক। অতএব হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু মাওলায়ে কায়েনাত একথার স্বীকৃতি দেয়া ঈমানের অপরিহার্য দাবি। এটা হজরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর জন্যে অনেক বড় মর্যাদা ও সম্মান। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র জবানে যা ঘোষণা হয়েছে। শুধু মাওলার স্বীকৃতি নয়; মাওলা আলীসহ আহলে বাইতকে অন্তর দিয়ে ভালবাসাও ঈমানের অপরিহার্যতা, যা পবিত্র ক্বোরআনের আয়াত দ্বারা প্রমাণিত।
৩. এই ঘোষণাকে কেন্দ্র করে শিয়া সম্প্রদায় ‘ঈদ’ পালন করে। যাকে তারা ‘ঈদে গাদীর’ বলে অভিহিত করেছে। আর তা করে ১৮ই জিলহজ্জ। কারণ হজরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর জন্য প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই ঘোষণা ছিল ১৮ই জিলহজ্জ। যুগযুগ ধরে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের নির্ভরযোগ্য ওলামায়ে কেরাম ‘ঈদে গাদীর’ উদযাপন না করার ব্যাপারে উম্মতে মুহাম্মদীয়াকে সতর্ক করে আসছেন। আর বলেছেন এটা শিয়াদের অনুষ্ঠান এবং এর ভেতরে ইসলামকে কুঠারাঘাত করার ষড়যন্ত্র লুকিয়ে রেখেছে দুষ্টচক্র শিয়ারা।
৪. এখন প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি ওলামায়ে আহলে সুন্নাত হজরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ব্যাপারে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই ঘোষণায় খুশি নন? হজরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে ওলামায়ে আহলে সুন্নাত ‘মাওলা’ হিসেবে মান্য করেন না? হজরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে কি ওলামায়ে আহলে সুন্নাত সম্মান ও মোহাব্বত করেন না?
সম্মানিত পাঠক, মূল বিষয়ে যাওয়ার আগে এই মোটামোটা কথাগুলো বুঝে নিন এবং মাথায় রাখুন। ওলামায়ে আহলে সুন্নাত হজরত আলীর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু জন্য প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই সম্মানজনক ঘোষণায় যারপরনাই খুশি। ওলামায়ে আহলে সুন্নাত হজরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা ও সম্মান নিবেদন করে। নির্দ্বিধায় মাওলা মানে এবং উচ্চকণ্ঠে ‘মাওলায়ে কায়েনাত’ স্বীকৃতি দেয়। মাওলায়ে কায়েনাতের সম্মান ও ভালবাসাকে ঈমানের অপরিহার্য দাবি জ্ঞান করে।
তাহলে ‘ঈদে গাদীর’ পালন করে না কেন? মূল আলোচনা এখানেই। “মান কুনতু মাওলাহু ফাহাজা আলীয়্যুন মাওলাহু” এই ঘোষণাকে ওলামায়ে আহলে সুন্নাত হৃদয় দিয়ে ধারণ করে, মাওলা মান্য করে, সম্মান ও শ্রদ্ধা নিবেদন করে। তারপরও ঈদে গাদীরের বিরোধিতা করে কেন? এই রহস্য উন্মোচন করার জন্যই আজকের এই নিবন্ধ।
৫. মূল রহস্য উদঘাটনের আগে আরেকটা বিষয় খেয়াল করুন। মাওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর জন্য প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি শুধু এই ঘোষণাই দিয়েছেন? সম্মানসূচক আর কোন ঘোষণা দেন নি? “আমি ইলমের শহর এবং আলী তার দরজা” এটা কি কম সম্মানের? “আলীর চেহারার দিকে তাকানো ইবাদত” এটা কি কম গুরুত্বের? “আলী আল্লাহ ও রাসূলকে ভালবাসে। আল্লাহ এবং রাসূলও আলীকে ভালবাসেন।” এটাও কি কম ওজনের? “তুমি আমার কাছে তেমন, মূসার কাছে হারুন যেমন। তবে আমার পর কোন নবী নেই।” এটার মধ্যেও কি কম সম্মান? “খুশি থাক হে আলী। তোমার জীবনও আমার সাথে। তোমার ওফাতও আমার সাথে।” এটাও কি কম দামী? এরকম আরও অনেক মর্যাদাপূর্ণ ঘোষণা আছে মাওলা আলীর জন্য প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে। শুধু মাওলা আলীর জন্যই নয়; আহলে বাইতের সদস্য হজরত ফাতেমা, হজরত হাসান, হজরত হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু-এর জন্য আছে অসংখ্য সম্মানজনক ঘোষণা।
শুধু আহলে বাইতই নন; ঘোষণা রয়েছে অন্য তিন খলিফাসহ অসংখ্য সাহাবায়ে কেরামের ব্যাপারে।
“হজরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এর ঈমানের সাথে সারা পৃথিবীবাসীর ঈমান ওজন করলে হজরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এর ঈমানের ওজন বেশি হবে, “আবু বকর তুমি জাহান্নাম থেকে মুক্ত,” “জান্নাতের সবকটি দরজা থেকে যাকে ডাকা হবে তিনি আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু।” “নবী-রাসূলদের পর আবু বকর থেকে শ্রেষ্ঠ কারও উপর সূর্য উদিত হয় নি।” “আমার রব ছাড়া আমি কাউকে খলিল হিসেবে গ্রহণ করলে গ্রহণ করতাম আবু বকরকে।” “আল্লাহ তাআলা হক স্থাপন করেছেন হজরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এর জবানে ও ক্বলবে।” “আমার পরে কেউ নবী হলে হত ওমর।” “তিনটি বিষয়ে আমার রব আমার সাথে একমত হয়েছেন।” “উসমানকে সম্মান কর। কেননা আমার সাহাবিদের মধ্যে আমার সাথে অধিক সাদৃশ্যপূর্ণ উসমান।” “আমি কি এমন ব্যক্তি থেকে লজ্জাবোধ করব না, যার থেকে ফেরেশতারা লজ্জাবোধ করে!” “আল্লাহ, আমি উসমানের উপর রাজি। সুতরাং তুমিও তাঁর উপর রাজি হয়ে যাও।”
সুপ্রিয় পাঠক, সামান্য নমুনা পেশ করলাম মাত্র। সাহাবিদের ব্যাপারে এরকম সম্মানজনক ঘোষণা বহু আছে। কারও জন্য কম, কারও জন্য বেশি। জবানে নবুওয়তে যার জন্য যা বের হয়েছে, আমাদের উচিত খুশিমনে তা মেনে নেয়া এবং স্বীকৃতি দেয়া।
৬. তাহলে “মান কুনতু মাওলাহু ফাহাজা আলীয়্যুন মাওলাহু” এই সম্মানজনক ঘোষণা ছাড়া মাওলায়ে কায়েনাতের জন্য আরও কত সম্মানসূচক ঘোষণা আছে। হজরত খাতুনে জান্নাতের ব্যাপারে আছে। হাসনাইনে কারিমাইনের জন্য আছে। শুধু তা-ই নয়, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য মহান আল্লাহ পাকের ঘোষণা- “ওয়ামা আরসালনাকা ইল্লা রাহমাতাল্লিল আলামীন” এবং এধরণের আরও বহু ঘোষণা আছে। কোনটাকেই শিয়ারা ঈদ বানালো না!!! শুধু এটাকে ঈদ বানাল। যেটা ১৮ই জিলহজ্জ! কী রহস্য আছে? মান কুনতু মাওলাহু ফাহাজা আলীয়্যুন মাওলাহুর মধ্যে।
১৮ই জিলহজ্জের সম্মানজনক এই ঘোষণাকে কেন তারা ঈদ বানিয়ে নিল? অন্যসকল সম্মানজনক ঘোষণাকে কেন তারা ঈদ বানাল না? “রাহমাতুল্লিল আলামীন” ঘোষণাসহ প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও অন্যান্য সাহাবি এবং আহলে বাইতের মর্যাদাগুলোকে বাদ দিয়ে শুধু এই একটিকেই কেন? এই তো রহস্য! এই রহস্য না জানার কারণে অনেক সাধারণ মুসলমান এবং অনেক আলেমও বিভ্রান্ত হচ্ছে! কারণ “ঈদে গাদীর” “মাওলার অভিষেক” নাম দিয়ে তারা আসল রহস্য সামনে না এনে হাইলাইট করে হজরত আলীসহ আহলে বাইতের ভালবাসাকে। আহলে বাইতের ভালবাসার প্রতি ঈমানদার মাত্রই দুর্বল। সেকারণে মাওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু সংক্রান্ত বিষয়ের প্রতি একটা সফট-কর্নার তৈরি হয়।
পাঠক, আসলে লেখার অনেক কিছুই আছে। অনেকদিন ধরে লেখার সময় পাই না। পিঠ ও ঘাড়ের ব্যাথায় সময় পেলেও বসতে পারি না। ভিডিও করার টেকনিক্যাল হাতগুলো ঈদের ছুটিতে বাড়িতে। কি আর করার! সংক্ষেপে দু’চার কলাম লেখা!
৭. মূলত হজরত মাওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ও সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র এত এত সম্মানসূচক ঘোষণাগুলোকে এড়িয়ে শুধু “মান কুনতু মাওলাহু ফাহাজা আলীয়্যুন মাওলাহু” এই সম্মানজনক ঘোষণাকে ‘ঈদ’ বানানোর পেছনে অনেক ষড়যন্ত্র লুকিয়ে রেখেছে তাক্বিয়াবাজ শিয়ারা। সেগুলো থেকে আমি দুটি উল্লেখ করছিঃ
এক. আহলে সুন্নাতের ওলামার মতে, এখানে ‘মাওলা’ শব্দের অর্থ সাহায্যকারী, বন্ধু, ভালবাসার মানুষ। আর তাক্বিয়াবাজ শিয়ারা এখানে ‘মাওলা’ অর্থ গ্রহণ করে খলিফা বেলা-ফছল (خليفة بلا فصل)। তথা বিরতি ছাড়া খলিফা। মানে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর সরাসরি খলিফা হজরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু। মাঝখানে অন্য কারো খেলাফতের মাধ্যমে (فصل) ফছল তথা বিভাজন তৈরি করার সুযোগ নেই। তাদের এই কথার আলোকে ঘোষণার অর্থ দাঁড়ায়- সহজ ভাষায় যদি বলি, ‘গদীরে খুমে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজরত আলীকে নবির পরেই খলিফা ঘোষণা করে গেছেন; সুতরাং নবির এই ঘোষণার পর অন্য কারো খলিফা হওয়ার সুযোগ নেই!’
প্রিয় পাঠক, ‘মাওলা’ শব্দের যে অর্থ শিয়ারা গ্রহণ করেছে, সে অর্থে তারা এটাকে ঈদ হিসেবে পালন করে। কোনকোন দেশে তারা তা প্রকাশ করে, কোথাও কোথাও তা লুকিয়ে রাখে। তাদের বক্তব্য ও লেখনীতে তার বহু প্রমাণ আছে। লেখার কলেবর বড় হওয়ার আশংকায় আমি সেদিকে যাচ্ছি না।
৮. ‘মাওলা’ শব্দের অর্থ শিয়াদের মত করে মেনে নিলে তার ধাক্কা কোথায় কোথায় লাগে, আসুন দেখে নিই। (খলিফা বলা ফছলী) خليفة بلا فصل মানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরই হজরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ‘খলিফা’ ঘোষিত। আলীর আগে অন্য কারো খলিফা হওয়ার সুযোগ নেই। মানে কী দাঁড়াল? হজরত আবু বকর-ওমর-উসমান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম-এর খেলাফত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘোষণাবিরোধী, শরীয়তের দৃষ্টিতে অবৈধ! খলিফা হিসেবে তাঁরা যা করেছেন, তাঁর সবই অবৈধ! তাঁরা যাদের থেকে বায়াত নিয়েছেন এবং যারা তাদের হাতে বায়াত হয়েছেন সবই শরিয়ত বিরোধী, অবৈধ! অথচ বায়াত গ্রহণকারীদের মধ্যে মাওলা আলীও একজন! শিয়াদের বক্তব্য মতে মাওলা আলী কি তাহলে অবৈধ খলিফার হাতে বায়াত নিয়েছেন? ৩৫ হিজরি পর্যন্ত দীর্ঘ সময় নাজায়েজ খেলাফত দেখেও তার উপর বায়াত নিয়ে নীরবতা অবলম্বন করেছেন? নাউজুবিল্লাহ!
হজরত আবু বকর’র রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর খেলাফত অবৈধ! হজরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু খেলাফত নাজায়েজ! হজরত উসমান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর খেলাফত নাজায়েজ! নাজায়েজ খেলাফতের উপর সকল সাহাবি ঐকমত্য পোষণ করেছেন, বায়াত হয়েছেন! নাজায়েজ খলিফার হাতে ৩৫ হিজরি পর্যন্ত মুসলিম বিশ্ব পরিচালিত হয়েছে! যুদ্ধ-বিগ্রহ পরিচালিত হয়েছে! ঘোষণা মতে, হজরত আলীর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু খলিফা হওয়ার কথা ছিল কিন্তু তা না করে অন্য যারা খেলাফত গ্রহণ করেছেন, এবং বায়াত গ্রহণ করেছেন তারা সকলেই নাজায়েজ কাজ করেছেন, গুনাহের কাজ করেছেন! একারণে তাঁদের শরয়ী আদালত বিনষ্ট হয়ে গেছে! মানে সাহাবিদের আদালত নষ্ট! এই যখন অবস্থা, তখন হাদিসের গ্রহণযোগ্যতা কি আর থাকে?
না! কারণ, হাদিসের গ্রহণযোগ্যতার জন্য ‘আদালত’ তথা ন্যায়পরায়ণতা দরকার। পবিত্র কুরআনের গ্রহণযোগ্যতা ও সত্যতাও থাকে না। কারণ কুরআন সংগ্রহ ও সংকলনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন হজরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এবং তা কার্যত বাস্তবায়ন করেছিলেন হজরত জায়েদ বিন ছাবেতের নেতৃত্বে সাহাবায়ে কেরাম। শিয়াদের গৃহীত অর্থের আলোকে যেহেতু কারোরই আদালত নেই, সুতরাং পবিত্র কুরআনের গ্রহণযোগ্যতা এবং সত্যতাও প্রশ্নবিদ্ধ!
সুধী পাঠক, এরপর কি আর ইসলাম থাকে? কুরআন-হাদিসের সত্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হলে কি আর ইসলাম থাকে? সকল সাহাবি অবৈধ খেলাফতের উপর বায়াত গ্রহণ করেছেন? অথচ প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমার উম্মত গোমরাহীর উপর একমত হবে না। শিয়াদের একথার আলোকে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভবিষ্যত বাণীও মিথ্যা হয়ে যায়! নাউজুবিল্লাহ!
এই সেই কারণ যেই কারণেই তারা প্রথম তিন খলিফাসহ অধিকাংশ সাহাবিদের গালি দেয়! কেননা তারা মনে করে, হজরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুসহ প্রথম তিন খলিফা মাওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে ঠকিয়ে, জুলুম করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছিল।
দুই. দ্বিতীয় রহস্য যা তারা লুকিয়ে রাখে তা হল, ১৮ই জিলহজ্জ হজরত উসমান জিন্নূরাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র শাহাদাত দিবস। তাদের বিশ্বাসমতে, হজরত উসমানও যেহেতু মাওলা আলীকে ঠকিয়ে জুলুম করে ক্ষমতা দখলকারীদের একজন, সেকারণে তাঁর শাহাদাত তাদের কাছে বেদনার না হয়ে বরং আনন্দের। অতএব, এ কারণে এক্সট্রিম শিয়ারা ১৮ই জিলহজ্জকে ‘ঈদের দিন’ মনে করে। মানুষকে দেখায় মাওলা আলীর ভালবাসার কথা। ভেতরে তৃতীয় খলিফার হত্যাকা-ের উল্লাস! কতটা জঘন্য এরা!
সম্মানিত পাঠক, আরও অনেককিছু লেখার ছিল। কলেবর বড় হবে বিধায় সংক্ষিপ্ত করলাম। আশা করি এটুকুতেই আসল শিয়াদের এবং নব্য শিয়াদের বোধোদয় হবে। আবারও বলি, আহলে সুন্নাত মাওলায়ে কায়েনাতের এবং সকল সাহাবায়ে কেরামের মর্যাদায় খুশি এবং স্বীকৃতি প্রদান করে। খোলাফায়ে রাশেদীনের ধারাবাহিকতাকে ‘হক’ মনে করে। আহলে বাইতের ভালবাসাকে ঈমানের অপরিহার্য দাবি মনে করে। ঈদে গাদীরের অন্তরালে ইসলামের মূলে আঘাত করার ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে বিধায়, কথিত এবং ৩৫১ হিজরিতে শিয়া শাসক কর্তৃক আবিষ্কৃত ঈদে গাদীরের বিরোধিতা করেন।
৯. প্রিয় পাঠক, এতক্ষণে আপনারা দেখেছেন, ‘মাওলা’ শব্দের যে অর্থ তারা গ্রহণ করে, তা চরম ষড়যন্ত্রমূলক। বিদায় হজ্জ থেকে ফেরার পথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে অবশ্যই ‘মাওলা’ ঘোষণা করেছেন। কিন্তু خليفة بلا فصل নির্বাচন করেন নি। মাওলার ঘোষণা আর খলিফা ঘোষণা এক নয়। শিয়ারা যেহেতু প্রথম তিন খলিফাকে মেনে নিতে পারে না, সেকারণে ‘মাওলা’ শব্দ দ্বারা তারা তাদের ‘মতলবী’ অর্থ গ্রহণ করে যাতে তিন খলিফাকে অবৈধ, জালিম প্রমাণ করা যায়! নাউজুবিল্লাহ! আসল কথা হল, ‘মান কুন্তু মাওলাহু’ ফা হাজা আলিউন মাওলাহু’ এই ঘোষণা দ্বারা হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে সুনির্দিষ্টভাবে খলিফা ঘোষণা করা হয়নি। অন্য ফজিলত বুঝানো হয়েছে। তার প্রমাণ স্বয়ং হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকেই আছে। সহীহ্ বুখারীর ৪৪৪৭ নং হাদিস এবং মুসনাদে আহমদের ২৩৭৪ নং হাদিসে আছে, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে অসুস্থতায় ওফাতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন সে অসুস্থতার সময় মাওলা আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখে বের হলে হযরত আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু তার হাত ধরে বললেন, ‘আলী নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরে খেলাফত কার দায়িত্বে থাকবে চলো আমরা এ বিষয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করি’। হযরত আলী তাতে রাজি হননি। তাহলে কি বুঝা গেল? গদিরে খুমের ঘটনায় মাওলা বলার মাধ্যমে যদি হযরত আলী খলিফা হিসেবে নির্বাচিতই হয়ে যেতেন তবে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অন্তিম সময়ে হযরত আব্বাসও এই প্রস্তাব দিতেন না এবং হযরত আলীও সরাসরি বলে দিতেন, ইতোপূর্বে গদীরে খুমের ঘটনায় আমি তো খলিফা নির্বাচিত হয়েই আছি। সুতরাং আবার জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন কি? মাওলা মানে খলিফা হলে তা হযরত আলী সেদিন বলতেন। কিন্তু আফসোস! শিয়ারা হযরত আলী থেকেও বেশি বোঝে!
তাহলে প্রশ্ন জাগে, এই হাদিসে ‘মাওলা’ শব্দের সঠিক অর্থ কী? আল্লামা ইবনুল আসীর রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেছেন, অনেক অর্থে ব্যবহৃত হয় ‘মাওলা’ শব্দ। ওলামায়ে আহলে সুন্নাত এই হাদীসের ক্ষেত্রে প্রধানত ২টি অর্থ উল্লেখ করেছেন। এক. মদদগার তথা সাহায্যকারী, দুই. বন্ধু, প্রিয়, ভালবাসার মানুষ। ইবনে আব্দুল বারসহ অনেক মুহাদ্দিস প্রথম অর্থকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তবে হাদিসের (سياق ও سباق) বিবেচনায় নিম্নোক্ত দুটি কারণে এই হাদিসে মাওলার ২য় অর্থটিও প্রযোজ্য হতে পারেঃ
১. হাদিসের শানে উরুদের কারণে। অর্থাৎ যে ঘটনার কারণে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ খুতবা প্রদান করেছিলেন তার কারণে। মাওলা আলীর সাথে হজরত বুরাইদার মনে কিছু অসন্তুষ্টি পয়দা হয়েছিল। আর কারও প্রতি পরিপূর্ণ ভালবাসা থাকলে তার প্রতি মন অসন্তুষ্ট থাকে না। সেই প্রেক্ষিতে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছিলেন, বুরাইদা, তুমি কি আলীকে অপছন্দ করো? বললেন, হাঁ। তখন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আলীর প্রতি অসন্তুষ্টি রেখো না। মান কুনতু মাওলাহু ফাহাজা আলীয়্যুন মাওলাহু’। অর্থাৎ আমি যার মোহাব্বতের, আলীও তার মোহাব্বতের। তখন বুরাইদা বললেন, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ কথার পর হযরত আলী শেরে খোদা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হয়েছে গেলেন আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় ও মহব্বতের ব্যক্তি! হযরত বুরাইদার এই কথা দ্বারা হাদীসের ‘মাওলা’ শব্দের অর্থ অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে যায়।
২. কোন কোন বর্ণনায় আছে, হুযূর-ই আকরাম এরশাদ করেন, اللهم وال من والاه وعاد من عاده এ অংশটি من كنت এর মাওলা শব্দের অর্থ কী, তা অনেকটাই পরিষ্কার করে দিয়েছে। কারণ معاداة (শত্রুতা) এর বিপরীতে موالاة শব্দটি ব্যবহার হয়েছে। معاداة এর বিপরীতে ব্যবহার হওয়াই প্রমাণ করে যে, এখানে موالاة মানে বন্ধুত্ব। সুতরাং বুঝা যায়, তার আগে যে মাওলা শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, তার অর্থ বন্ধু তথা প্রিয়। মেশকাত শরীফের ব্যাখ্যাকার আল্লামা ত্বীবী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি অত্যন্ত জোর দিয়ে বলেছেন যে; ‘এই হাদিসে ‘মাওলা’ বলে যে বেলায়তের উল্লেখ করা হয়েছে, তা খেলাফত অর্থে নয় বরং موالاة তথা বন্ধুত্ব অর্থে ব্যবহৃত।’ ইমাম শাফেয়ীসহ অনেক ওলামায়ে আহলে সুন্নাতও তা-ই বলেছেন।
উপসংহার পাঠক, ‘মাওলা’ একটি শব্দ। যা হাদিসে উল্লেখিত। একটা শব্দের সঠিক অর্থ নিরূপণ করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, আমার এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা থেকে বুঝা গেছে।
লেখক: উপাধ্যক্ষ, কাদেরিয়া তৈয়েবিয়া কামিল মাদরাসা, মোহাম্মদপুর ঢাকা।