ইমামের মর্যাদা ও বর্তমান অবস্থান
মাওলানা মুহাম্মদ আবুল হাশেম
মসজিদের ইমাম হওয়াও আশ্চর্যের চাকুরি। যে কোন লোক ইমামের উপর আপত্তি করতে পারে এবং যে কেউই বকাবকি করার অধিকার রাখে। ইমাম যতই উচ্চ মর্তবা ও উন্নত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হোক না কেন, মুক্তাদিদের রূঢ় কথাবার্তা থেকে সুরক্ষিত থাকতে পারেন না।
হযরত সা’দ ইবনে আবূ ওয়াক্কাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে দেখুন, জলীলুল্ ক্বদর সাহাবী, প্রথম পর্যায়ের মুসলমান, আশারা-ই মুবাশ্শারা (জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশ সাহাবী)-এর অন্যতম, যাঁর সম্পর্কে ক্বোরআনের আয়াতসমূহ নাযিল হয়েছে, একমাত্র সাহাবী যাঁর জন্য রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম স্বীয় পিতামাতাকে একত্র করে বলেন: তোমার জন্য আমার মাতাপিতা উৎসর্গীত। যাঁর অন্তরে কোন মুসলমানের জন্য হিংসা-বিদ্বেষ ছিল না, ‘মুস্তাজাবুদ দা’ওয়াত’ (যার দো‘আ কবূল হয়) ছিলেন, হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র সান্নিধ্যে সকল যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, আল্লাহ্র পথে সর্বপ্রথম তীরন্দাজ ছিলেন, স্বয়ং রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করে খারার-এর দিকে রওয়ানা করেন। তাঁর বরকতময় হাতে বহু সংখ্যক বিজয় অর্জন হয়।
কিন্তু যখন কূফা শাসনকালে ইমামতির মুসল্লায় দ-ায়মান হন, তখন কূফাবাসীদের আপত্তিসমূহের কেন্দ্রস্থল হয়ে গেলেন। কূফাবাসী হযরত ওমর ফারূক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে অভিযোগ-আপত্তিসমূহ প্রেরণ করতে থাকলো এবং সেগুলোর মধ্যে একটি অভিযোগ এও থাকত যে, “সা’দ ইবনে আবূ ওয়াক্কাস সঠিকভাবে নামায পড়ান না।”
ওই পরম সম্মানিত সাহাবী, যিনি আল্লাহ্র নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম থেকে নামায শিখেছেন, সে ব্যক্তির নামাযের উপর গ্রামবাসীর আপত্তি, একেবারে আজকালের মতই অবস্থার দৃশ্যায়ণ করছে। বর্তমান সময়ের ইমাম নামায যদিওবা সরাসরি নবীজি থেকে নামায শিখেন নি, কিন্তু নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বাণীসমগ্র থেকে শিখেছেন। যেসব লোকের দীনিয়াত সম্পর্কে একেবারে অবগতি নেই, তাদের দৃষ্টিও ইমামের পায়জামার কাপড় এবং সাজদায় উঠানো আঙ্গুলসমূহের উপর থাকে। যেসব লোক দু’ চার মাসআলা কোন কিতাব/পুস্তক থেকে পড়ে নেয়, বিশেষভাবে দীনের নামধারী ঠিকাদার ব্যক্তিবর্গ, কিন্তু ওইসব মাসাইল-এর বিস্তারিত বিবরণ এবং পূর্ববর্তী শীর্ষস্থানীয় আলিমগণের মতামত সম্পর্কে একেবারে গাফিল ও অজ্ঞ হন, তাদের মুখও ইলমদার আলিমগণের উপর মন্তব্য করতে ক্লান্ত হয় না।
যা হোক যখন হযরত সা’দ ইবনে আবূ ওয়াক্কাসের প্রতি আনিত অভিযোগ হযরত ওমর ফারূক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু পর্যন্ত পৌঁছল, তখন ওমর ফারূক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য কূফাবাসীদের কাছে মুহাম্মদ ইবনে মাসলামাহ্ এবং আবদুল্লাহ ইবনে আরক্বাম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমাকে প্রেরণ করেন, যারা এক এক মসজিদে গিয়ে হযরত সা’দ ইবনে আবূ ওয়াক্কাসের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
আশ্চর্যের বিষয় যে, অভিযোগ-আপত্তিগুলো কূফা থেকে মদীনা পর্যন্ত পৌঁছে গেল, কিন্তু মুহাম্মদ ইবনে মাসলামাহ্ এবং আবদুল্লাহ ইবনে আরক্বাম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা যার কাছেই জিজ্ঞাসা করেন, উত্তরে হযরত সা’দ ইবনে আবূ ওয়াক্কাস-এর প্রশংসা-ই শুনতেন। এক এক মসজিদে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন কিন্তু কারো পক্ষ থেকে কোন আপত্তি পেলেন না। তবে হ্যাঁ, যখন জিজ্ঞেস করতে করতে বনূ আবস-এর মসজিদ পর্যন্ত এসে পৌঁছলেন, তখন শুধু এক লোক ‘উসামাহ ইবনে ক্বাতাদাহ’ নামক উঠে দাঁড়িয়ে হযরত সা’দ ইবনে আবূ ওয়াক্কাস-এর ব্যাপারে আপত্তি করলো যে, তিনি সঠিকভাবে নামায পড়ান না, জিহাদের বিষয়ে সংকীর্ণতা দেখান, বিচার-ফয়সালার ক্ষেত্রে ন্যায়-ইনসাফের ভিত্তিতে কার্য সম্পাদন করেন না।
আপত্তি যাই হোক না কেন কিন্তু এখানে গভীর মনযোগের বিষয় হচ্ছে, আপত্তিসমূহ কূফা থেকে মদীনা পর্যন্ত প্রেরণ করা হলো, অথচ কূফার কোন মসজিদে এক ব্যক্তি ছাড়া কোন ব্যক্তি আপত্তিকারী পাওয়া গেল না। এ বাস্তব ঘটনাটি ইতিহাসের অংশ এবং প্রণিধাণযোগ্য গ্রন্থাবলিতে বিদ্যমান রয়েছে। যাচাই-বাছাইয়ের সময়ে ওই এক ব্যক্তিই পাওয়া গেল, যার হযরত সা’দ ইবনে আবূ ওয়াক্কাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ব্যাপারে আপত্তি ছিল। কিন্তু আপত্তিসমূহ মদীনা প্রেরণ করা হলো এবং এ মন্তব্য করা হলো যে, যদি সা’দ ইবনে আবূ ওয়াক্কাসকে পদচ্যুত করা না হয়, তাহলে ফিতনা-ফ্যাসাদের আশংকা রয়েছে। অতঃপর ওমর ফারূক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হযরত সা’দ ইবনে আবূ ওয়াক্কাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে পদচ্যুতও করে দেন।
এ বাস্তবতার নিরিখে এ কথা বলা কখনো অমূলক হবে না যে, কখনো কখনো শুধু এক বা দু জন মুক্তাদীর ইমামের প্রতি আপত্তি থাকে, কিন্তু তাদের প্রপাগান্ডা এত বেশি তীব্র হয় যে, তারা অপরাপর লোকদেরকে এ কথায় একমত করতে সফল হয়ে যায় যে, “এ ব্যক্তি এ মহান পদবীর উপযুক্ত নয়, যদি তাকে এখনই এ পদের উপর বহাল রাখা হয়, তাহলে ফিতনা-ফ্যাসাদের আশংকা রয়েছে। আর এ প্রপাগান্ডা জিতে যায় এবং ইমাম হেরে যায়।”
এ পর্যায়ে প্রপাগান্ডা তৈরীকারীদের উদ্দেশ্যে অন্তরের কান দ্বারা শোনার আহ্বান রাখছি, এতে সন্দেহ নেই যে, আমাদের ন্যায় মসজিদের ইমামগণ প্রশংসার উপযুক্ত নই, কিন্তু আমার ভাইয়েরা! কখনো কখনো মসজিদের ইমাম নির্দোষও হয়ে থাকেন এবং আপনাদের আপত্তিগুলো অমূলক হয়ে থাকে। এ সময়ে নিজ ‘আমিত্ব’-এর প্রশান্তির স্থলে আল্লাহ্র পাকড়াও থেকে ভয় করুন এবং মস্তিষ্কে এ শিক্ষনীয় ঘটনাকে ধারন করুন যে, যখন হযরত সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু আপত্তিকারীর কাছ থেকে অসত্য কথা শুনেন, তখন আল্লাহ্ তা‘আলার দরবারে দু’হাত তুলে এ দো‘আ করেন: اَللّٰهُمَّ إِنْ كَانَ عَبْدُكَ هٰذَا كَاذِبًا، قَامَ رِيَاءً وَسُمْعَةً، فَأَطِلْ عُمْرَهُ، وَأَطِلْ فَقْرَهُ، وَعَرِّضْهُ بِالْفِتَنِ-. অর্থাৎ হে আল্লাহ্! যদি তোমার এ বান্দা মিথ্যুক হয়, লোক দেখানো এবং আত্মপ্রচারের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলে তার আয়ু বৃদ্ধি করে দাও, তার দারিদ্রতাকে প্রসারিত করো এবং তাকে ফিতনায় লিপ্ত করো।” [বোখারী, আস সহীহ, হা/৭৫৫]
সময় পেরিয়ে গেল এবং হযরত সা’দ ইবনে আবূ ওয়াক্কাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু পদচ্যুতও হলেন, প্রপাগান্ডা জিতে গেল, কিন্তু সা’দ ইবনে আবূ ওয়াক্কাসের দো‘আ আল্লাহ্ জাল্লাজালালুহুর দরবারে সুরক্ষিত রইলো। অতঃপর লোকেরা দেখলো যে, ওই লোক যে তার প্রতি মিথ্যা আপত্তি করেছিল অতিশয় বার্ধক্যে উপনীত হয়েছে, তার ভ্রুগুলো চোখের উপর এসে পড়েছিল, রাস্তায় দাড়িয়ে দাড়িয়ে ভিক্ষা করত এবং যখন কোন নারী রাস্তায় সামনে পড়ত, তাকে উত্ত্যক্ত করত এবং লাঞ্চিত ও অপদস্ত হত।
লোকেরা বলত, হে বুড়ো! তোমার নারীদের উত্ত্যক্ত করার সময় লজ্জা হয় না? উত্তরে বলত: আমি কী করবো? আমি বৃদ্ধের প্রতি সা’দ ইবনে আবূ ওয়াক্কাস (এক ইমাম)’র বদদো‘আ লেগে গেছে।”
বর্তমান সময়ের ইমাম হযরত সা’দ ইবনে আবূ ওয়াক্কাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ন্যায় তো নয়, কিন্তু কোন মুসলমানের উপর অন্যায়ভাবে আপত্তি করার সময় আল্লাহ্র পাকড়াওকে ভুলে যাওয়াও সীমাহীন বদনসীব হওয়ার আলামত। আমরা তো আমাদের প্রপাগান্ডায় তো জিততে পারি, কিন্তু আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট ফয়সালা সত্যের উপর ভিত্তি করে হয়ে থাকে, সুতরাং আমাদের ওই ফয়সালা সম্পর্কে নির্ভয় হওয়া উচিত নয়।
আল্লাহ্ রাব্বুল ইয্যত আপন হাবীব পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ওসীলায় আমাদেরকে মসজিদের ব্যবস্থাপনায় উন্নতি সাধনের তাওফীক্ব দান করুন, মসজিদের ইমাম, খতিব এবং কমিটির প্রত্যেককে নিজ নিজ জিম্মাদারি বুঝার এবং যথাসম্ভব পালন করার তাওফীক্ব দান করুন।
লেখক: পরিচালক, আনজুমান রিসার্চ সেন্টার ও খতীব-নওয়াব ওয়ালী বেগ খাঁ জামে মসজিদ, চকবাজার, চট্টগ্রাম।