এশার নামাযের ফযীলত ও মাসায়েল
অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি
وَعَنْ مُعَاذ بْنُ جَبَل رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اَعْتِمُوْا بِهٰذِهِ الصَّلوةِ فَاِنَّكُمْ قَدْ فُضِّلْتُمْ بِهَا عَلَى سَائِرِ الْاُمَمِ وَلَمْ تُصَلِّهَا اُمَّةَ قَبْلَكُمْ -(رواه ابوداود)
অনুবাদ: হযরত মু’আজ ইবনে জবল রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, এই নামাযকে দেরীতে পড়ো কেননা তোমাদেরকে সেটার কারণে সমস্ত উম্মতের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া হয়েছে। তোমাদের পূর্বে এ নামায অন্য কোন উম্মত পড়েনি। [আবূ দাউদ]
প্রাসঙ্গিক আলোচনা
বর্ণিত হাদীস শরীফে এশার নামাযের ফযীলতের কথা উল্লেখ হয়েছে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র উম্মত সকল উম্মতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। এ শ্রেষ্ঠত্বের অসংখ্য কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি কারণ হলো এশার নামায লাভ করা। উল্লেখ্য যে পূর্ববর্তী কোনো নবীর উম্মতের উপর এশার নামায ফরয ছিল না। অবশ্য কোনো কোনো নবী তা নফল হিসেবে পড়েছেন মর্মে বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন হযরত মুসা কলিমুল্লাহ্ আলায়হিস্ সালাম সীনা উপত্যকা থেকে ফিরে এসে আপন স্ত্রী সফুরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহাকে সুস্থ ও নিরাপদ অবস্থায় পেয়ে শোকরিয়া হিসেবে এশার নামায পড়েছিলেন। [মিরআতুল মানাজীহ্: ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪৪২]
বিধিবদ্ধ ফরজ হিসেবে আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সর্বপ্রথম এশার নামায আদায় করেছেন। [তাহাভী শরীফ]
অর্ধরাত পর্যন্ত নামায আদায়ের সওয়াব
عَنْ عُثْمَانَ بْنُ عَفَّانَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ شَهِدَ الْعِشَاءَ فِىْ جَمَاعَةٍ كَانَ لَهُ قِيَامُ نِصْفَ لَيْلَةٍ وَمَنْ صَلَّى العِشَاءَ وَالْفَجْرَ فِىْ جَمَاعَةٍ كَانَ لَهُ لِقِيَامِ لَيْلَةٍ- (رواه الترمذى والنسائى وابوداود)
হযরত ওসমান ইবনে আফফান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি জামাতের সাথে এশার নামায আদায় করল তার জন্য অর্ধরাত নামায আদায়ের সওয়াব রয়েছে। আর যে ব্যক্তি এশা ও ফজরের নামায জামাত সহকারে আদায় করেছে তার জন্য রাত ব্যাপী নামায আদায়ের সমপরিমাণ সওয়াব রয়েছে। [তিরমিযী- হাদীস: ২২১, আবূ দাউদ- হাদীস: ৫৫৫]
এশার নামাযের ফযীলত সংক্রান্ত আরো অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে। নিম্নে কয়েকটি হাদীস উপস্থাপন করা হলো:
এশার নামায বিলম্বে আদায় করা মুস্তাহাব
عَنْ اَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى الله عَلَيْهِ وسَلّمَ لَوْلَا اَنْ اَشُقَّ عَلٰى اُمَّتِىْ لَامَرْتُهُمْ اَنْ يُوَخِّرُوا الْعِشَاءَ اِلى ثُلٰثِ الْلَيْلِ اَوْنِصْفِهُ- (رواه الترمذى)
হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমার উম্মতের জন্য কষ্টসাধ্য না হলে আমি তাদের নির্দেশ প্রদান করতাম তারা যেন এশার সালাতকে রাতের এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত বা মধ্যরাত পর্যন্ত পিছিয়ে দেয়। [তিরমিযী শরীফ]
বর্ণিত হাদীস শরীফ দ্বারা প্রতীয়মান হলো, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর অনুমতিক্রমে শরীয়তের বিধি বিধানের ব্যাপারে ইখতিয়ার প্রাপ্ত ও ক্ষমতাপ্রাপ্ত। এ ছাড়াও বিলম্বে পড়ার হিকমত হলো, যেন নামাযের জন্য অপেক্ষার সওয়াব লাভ করা যায়। যেন এর পরে অধিক কথাবার্তা বলার সময় না থাকে এবং তাৎক্ষণিকভাবে ঘুমিয়ে পড়তে পারে।
[মিরআতুল মানাজীহ্: ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪৪১, কৃত: হাকীমুল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ারখান নঈমী (রাহ.), বঙ্গানুবাদ: মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান]
এশার নামাযের পূর্বে ঘুমানো মাকরূহ
عَنْ اِبِىْ بَرْزَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ اَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَكْرَهُ النَّوْمَ قَبْلَ الْعِشَاءِ وَالْحَدِيْثُ بَعْدَهَا- (متفق عليه)
হযরত আবু বারযাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এশার আগে নিদ্রা যাওয়া ও এশার পর (অপ্রয়োজনীয়) কথাবার্তা বলা অপছন্দ করতেন। [বুখরী ও মুসলিম]
এশার পর গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তা বলা যাবে
এশার নামাযের পর রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদের বিভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে কথাবার্তা বলতেন মর্মে হাদীস শরীফে প্রমাণ পাওয়া যায়। এরশাদ হয়েছে-
عَنْ عُمَرَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَسْمُرُ مَعْ اَبِىْ بَكْرٍ فِىْ الْامْرِ مِنْ اَمْرِ الْمُسلِمِيْنَ وَانَا مَعَهُمَا- (رواه الترمذى)
হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হযরত আবু বকর (সিদ্দিক) রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর সাথে মুসলমানদের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাত জেগে কথাবার্তা বলতেন এবং আমিও তাঁদের উভয়ের সাথে থাকতাম। [তিরমিযী শরীফ]
পাঁচ ওয়াক্তের নামায বান্দার গুনাহসমূহ মিটিয়ে দেয়
মানুষ ইচ্ছায় অনিচ্ছায়, সকাল-সন্ধ্যায়, দিবারাত্রি আল্লাহর নাফরমানি, অবাধ্যতা, অন্যায়, পাপাচার, মিথ্যাচার, কপটতা গর্হিত অনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ করে চলছে- খোদায়ী বিধান লংঘন করছে। নবীজির সুন্নত পরিত্যাগ করছে, অহরহ অপকর্ম করে যাচ্ছে। আল্লাহ্ তা‘আলা স্বীয় বান্দাকে এহেন মন্দকাজ থেকে বিরত রাখার জন্য নামাযের মতো উৎকৃষ্ট নিয়ামত দান করেছেন। বান্দা যখন একনিষ্ঠভাবে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের পাবন্দী করবে, আল্লাহ্ তা‘আলা বান্দার গুনাহ্ সমূহ ক্ষমা করে দেবেন। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে-
عَنْ اِبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ اَرَايتُمْ لَوْ اَنَّ نَهْرًا بِبَابِ اَحْدِكُمْ يَغْتَسِلُ فِيْهِ كُلَّ يَوْمٍ خَمْسَ مَرَّاتٍ هَلْ بَقِىَ مِنْ دَرنِهِ شَيْءُ قَالُوْا لَا يَبْقِىْ مِنْ دَرْنِهِ شيْءٌ قَالَ فَكَذَالِكَ مِثْلُ الصَّلواتِ الخَمْنِ يَمْحُوْا اللهُ بِهِنَّ الخَطَايَا- (متفق عليه)
হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, তোমাদের কারো বাড়ীর সম্মুখে যদি একটি প্রবহমান নহর থাকে আর তার মধ্যে সে প্রত্যহ পাঁচবার গোসল করে তাহলে ঐ ব্যক্তির শরীরে কোন ময়লা অবশিষ্ট থাকবে কি? সাহাবীগণ উত্তর দিলেন তার শরীরে কোন ময়লাই অবশিষ্ট থাকবে না। অতঃপর তিনি বলেন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের উদাহরণও তদ্রুপ। আল্লাহ্ তা‘আলা এ নামাযের মাধ্যমে বান্দার গুনাহ্ সমূহ মিটিয়ে দেন। [বুখরী ও মুসলিম শরীফ]
মাসায়েল
এশার নামাযের ওয়াক্ত: মাগরিবের ওয়াক্ত শেষ হয়ওয়ার পর থেকে এশার নামাযের ওয়াক্ত শুরু হয়। এবং সুবহে সাদিক পর্যন্ত অব্যবহাত থাকে। এশার নামায রাতের এক তৃতীয়াংশ সময় পর্যন্ত বিলম্ব করা মুস্তাহাব। [আলমগীরি: ১ম খণ্ড, ফতোয়ায়ে শামী: ফাতওয়া-ই রিজভীয়্যাহ্: ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-২২৬]
এশার নামাযের রাক্আত সংখ্যা: এশার নামায মোট ১২ রাক’আত, প্রথমে ৪ রাক’আত সুন্নাতে গায়রে মুয়াক্কাদাহ, ৪ রাক’আত ফরয, ২ রাক’আত সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ, ২ রাক’আত নফল।
মাসআলা
ফরজের পূর্বে ৪ রাক’আত সুন্নাতের নিয়্যত করা হলো; এমতাবস্থায় জামা’আত শুরু হয়ে গেল, দু’রাক’আত সুন্নাত আদায় করে জামাতে শামিল হয়ে যাবে। বাদ পড়া দু’রাক’আত সুন্নাত পূনরায় পড়ার দরকার নেই। [ফাতওয়া-ই রিজভীয়্যাহ্: ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৬১১]
মাসআলা
এশার নামাযের পূর্বের চার রাক’আত সুন্নাত না পড়ে ফরজের পর পড়ার ইচ্ছা করলে ফরজের পর যে দু’রাক’আত সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ্ রয়েছে তা আদায় করার পর পূর্বের ৪ রাক’আত সুন্নাত পড়ার অনুমতি রয়েছে। [মু’মিন কী নামায, ফাতওয়া-ই রিজভিয়্যাহ্ : ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭১৬]
মাসআলা
রমজান মাসে যে ব্যক্তি জামাত সহকারে এশা পড়তে পারেনি, সে ব্যক্তি বিতর নামায জামাত সহকারে পড়বে না। যে ব্যক্তি একাকী এশার ফরয নামায পড়েছে সে বিতর নামাযও একাকী আদায় করবে। [ফাতওয়া-ই রিজভিয়্যাহ: ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪৮]
মাসআলা
এশার নামায পড়ার আগে নিদ্রা যাওয়া মাকরূহ। এশার নামাযের পর দুনিয়াবী কথাবার্তা বলা, গল্প-গুজব করা ও শ্রবণ করা মাকরূহ। [বাহারে শরীয়ত: ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৩২১]
মাসআলা
হজ্জের সময় মুযদালিফার ময়দানে মাগরিব ও এশার দুই ওয়াক্তের নামায এশার সময়ে পড়তে হবে। [বাহারে শরীয়ত: ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠ-১৩১]
লেখক: অধ্যক্ষ- মাদ্রাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া ফাযিল (ডিগ্রি), বন্দর, চট্টগ্রাম।