পহেলা রমযান গাউসুল আজম’র শুভ জন্মদিন ও উম্মুল খায়ের ফাতিমা
আসিফ উল আলম
খোদাভিরু পরহেজগার পিতা ও মহিয়ষী মাতার ঔরষেই জন্ম হয় জগদ্বিখ্যাত ওলীর। পহেলা রমযানুল মোবারক ওলিগণের রাজাধিরাজ হযরত গাউসুল আজম দস্তগীরের শুভ জন্ম দিবসে তাঁর বুজর্গ পিতা ও মহিয়ষী মাতা সম্পর্কে আলোকপাত করার প্রয়াসঃ
হযরত আব্দুল্লাহ সাউমেয়ী রহমাতুল্লাহি আলায়হি পরহেজগারির জন্য ছিলেন জিলান শহরে প্রসিদ্ধ। শুধু তাঁর পরহেজগারি নয়, বরং তাঁর কন্যার পরহেজগারি ছিল আরও প্রসিদ্ধ। এবাদত-বন্দেগি, পর্দা-পরহেজগারির দিক থেকে এমন মেয়ের তুলনা পাওয়া যায় না। এই অতুলনীয় কন্যাকে তুলে দিবেন এমন যোগ্য হাতও তিনি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। আব্দুল্লাহ সাউমায়ীর বয়স বাড়ছিল। এদিকে তাঁর কন্যার বয়সও থেমে নেই। এ নিয়ে আব্দুল্লাহ সাউমায়ীর চিন্তা লেগেই থাকত। এটা কেবলই চিন্তা; দুশ্চিন্তা নয়। কেননা, তিনি তো জানতেন, আল্লাহ সবকিছুর উত্তম পরিকল্পনাকারী। তাই তিনিও কন্যাকে রেখে দিয়েছিলেন নিজের তত্ত্বাবধানে। জ্ঞান, দর্শন, ধর্ম সবকিছুতে মেয়েকে পৌঁছে দিচ্ছিলেন, সর্বোচ্চ পর্যায়ে।
এই কন্যাও বাবাকে কখনো নিরাস করেন নি। ঘরে থেকে ১৮ পারা পবিত্র কুরআন মুখস্ত করে নিয়েছিলেন। শিখে ফেলেছিলেন, তাসাউফের অনেক শিক্ষা। এই শিক্ষা চর্চার মাধ্যমে নিজেকে নিয়ে গেলেন অনন্য উচ্চতায়। এর মাঝে আব্দুল্লাহ সাউমেয়ী পেয়ে গিয়েছিলেন যোগ্য পাত্র। প্রথম সাক্ষাতেই তাঁর মনে হয়েছিল যে, এই তো সে যোগ্য হাত, যে হাতে কন্যাকে তিনি তুলে দিয়ে চিন্তামুক্ত থাকতে পারবেন।
কিন্তু তাঁর দৃঢ়তা দেখুন। কন্যাকে পাত্রের হাতে তুলে দিতে সময় নিয়েছেন, অপেক্ষা করেছেন, অবলোকন করেছেন ১-২ বছর নয়, দীর্ঘ ১২ বছর। যুবকটি আব্দুল্লাহ সাউমেয়ীর বাগানের একটি ফল কুড়িয়ে পেয়েছিলে। প্রচ- ভুখা থাকায়, খেয়ে ফেললেন। পরে চিন্তা করলেন, যার ফল তার থেকে অনুমতি না নিয়ে খেয়ে তিনি চরম ভুল করেছেন। তাই ক্ষমা চাইতে গেলেন ওই বাগানের মালিক হযরত আব্দুল্লাহ সাউমায়ীর কাছে। কুড়িয়ে পাওয়া একটি ফল খাওয়ার কাফফারা স্বরূপ আব্দুল্লাহ সাউমায়ী ১২ বছর পর্যন্ত নিজের বাগানের চাকুরি করিয়েছিলেন এই যুবককে। আসলে চাকুরি নয়, নিজের সাথে রেখে রেখে তাসাউফ এবং বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষা দিয়েছিলেন এবং চরিত্র পরীক্ষা করেছিলেন। ততদিনে কন্যার বয়স ৪০ পার। ১২ বছরের সার্বিক বিবেচনার পর তিনি কন্যাকে তুলে দিয়েছিলেন ওই পাত্রের হাতে।
এই কন্যাও যে সাধারণ ছিলেন না। কন্যা সমন্ধে আব্দুল্লাহ সাউমায়ী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছিলেন, “আমার মেয়ে কুৎসিত, বধির, পঙ্গ, বোবা এবং অন্ধ।” আব্দুল্লাহ সাউমায়ী এ কথাটি বলেছিনে পাত্রকে। এটা ছিল পাত্রের জন্য শেষ পরীক্ষা। পাত্র তাও রাজি হয়েছিলেন। কারণ, কাফফারা তো আদায় করতেই হবে। কিন্তু বাসর ঘরে গিয়ে পাত্রের চোখ স্থির হয়ে যায়। কুৎসিত বলা কন্যাটির চেহারার জ্যোতি যেন পূর্ণিমার চাঁদকেও হার মানাবে। বোবাতো নয়, প্রতি শব্দ মুক্ত ঝরা। এ দেখে বাসর ঘর থেকেই ছুটে এসেছিলেন বর। পরে আব্দুল্লাহ সাউমায়ী ব্যাপারটি বর্ণনা দিয়েছিলেন এভাবে, “আমি তোমাকে পরীক্ষা করেছিলাম। আসলে কথা হচ্ছে, আমার মেয়ে আজ পর্যন্ত কোনো পরপুরুষকে দেখেনি, ঘর থেকেই কোনো দিন বাইরেও যায় নি। তাই সে যদিও জন্মান্ধ নয়, কিন্তু বাইরের জগত না দেখায় তাকে অন্ধ বলেছি। বোবা বলেছিলাম কারণ পিতা-মাতা ছাড়া কারো কণ্ঠ সে আজ পর্যন্ত শোনে নি। পঙ্গু এ কারণে বলেছি, জন্মের পর সে হাঁটা-চলা করলেও কখনো বেপর্দা কোথাও যায় নি। বধিরও এ কারণে বলেছি যে, সে আজ পর্যন্ত মা-বাবা ছাড়া কারও কণ্ঠ শোনে নি।”
তুলনাহীন এ কন্যার নাম সাইয়্যেদা উম্মুল খায়ের আমাতুল জাব্বার ফাতিমা। যিনি খুব সংক্ষেপে উম্মুল খায়ের ফাতেমা নামেই পরিচিত। আর পাত্রের নাম সাইয়্যেদ আবু সালেহ মূসা জঙ্গী-দোস্ত রহ.। তাঁরা উভয়েই তাসাউফের নিজ নিজ স্থানে ছিলেন অনন্য। সাইয়্যেদা উম্মুল খায়ের ফাতেমা এবং সাইয়্যেদ আবু সালেহ মূসা উভয়ের বংশীয় ধারা গিয়ে মিলিত হয় রসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত। এটি এমন এক বংশ, যে বংশেরও কোনো তুলনা হয় না।
আগেই বলেছিলাম, এ কোনো সাধারণ কন্যা নয়। ৬০ বছর বয়সে সাধারণত নারীদের পক্ষে সন্তান জন্মদান সম্ভব হয় না। কিন্তু ঠিক এই বয়সেই সাইয়্যেদাহ উম্মুল খায়ের ফাতেমা রহমাতুল্লাহি আলায়হির কোল জুড়ে আসে সন্তান। এমনটা সচারচার হয় না, কারণ আমাদের মধ্যে কেউ তো এভাবে আল্লাহর ওপর ভরসা করতেও পারি না। তাঁরা পেরেছিলেন। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করবে, তিনিই তার জন্য যথেষ্ট হবেন। (কুরআন ৬৫ : ৩) তাঁরা এটা বুঝেছিলেন, আমরাই বুঝতে পারি না।
আজকের দিনে বিজ্ঞান বলে, সন্তানরা মায়ের গর্ভে থাকাকালীন সময় থেকেই শুনতে শুরু করে। গর্ভে সন্তান তাই শোনে, যা ওই মা শোনে এবং বলে। আর এই শোনা শব্দগুলোও সন্তানের স্মরণে থাকে। এগুলো বর্তমান বিজ্ঞানের কথা। ১০০০ বছর আগে এমন কোনো থিউরি তেমন কেউ জানতো বলে মনে হয় না। ওই সময়েই এই অতুলনীয় রমনী সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে সারাদিন কুরআনুল কারিম তেলাওয়াত করতেন। ততটুকুই তেলাওয়াত করতেন, যতটুকু তাঁর মুখস্ত ছিল, অর্থাৎ, ১৮ পারা। পরবর্তী সময়ে শিশু আব্দুল কাদেরকে যখন মক্তবে দেওয়া হয়, তখন উস্তায বিসমিল্লাহ বলতেই তিনি বিসমিল্লাহ সমেত পুরো আঠারো পারা শুনিয়ে দেন। উস্তায পরে জানতে পারেলেন, এই অদ্ভূত ঘটনাটি সম্ভব হয়েছে, সাইয়্যেদাহ উম্মুল খায়ের ফাতেমা রহ.-এর কারণেই।
কয়েক বছর পর স্বামী ও পিতা উভয়েই ইন্তেকাল করেন। বয়সের ছাপ অনুভব করলেও উম্মুল খায়ের ফাতেমা কোনোদিনও তা পুত্রের ওপরে পড়তে দেন নি। ‘আমি কখন না কখন চলে যাই, ছেলেকে যেন শেষ সময়ে সাথে পাই’ এমন চিন্তা করে ছেলেকে বুকের সাথে বেঁধে রাখতে পারতেন। ছেলেও এতটা বাধ্য যে, থেকে যেতো। কিন্তু তিনি এই ছেলের মধ্যে দেখেছিলেন আগামীর সম্ভাবনা, জ্ঞানার্জনের তৃষ্ণা। তাই নিজের পরিস্থিতি বুঝিয়ে ছেলেকে আবেগের জালে না জড়িয়ে বিদ্যার্জনের জন্য ছেড়ে দিয়েছেন বাগদাদের পানে। শেষ বয়সের সম্বলকে দ্বীনের রাস্তায় উন্মুক্ত করে তিনি নিজে যন্ত্রণা ভোগ করলেও, ইসলাম পেয়েছে শ্রেষ্ঠতম একজন মনীষী। উম্মুল খায়ের ফাতেমা রহ.-এর এই ত্যাগের ফলে যুবক আব্দুল কাদের প্রথম যাত্রাতেই পুরো দস্যু দলকে সৎ লোক বানিয়ে ফেলেছিলেন। এ রকম আরো কতো কিছু আছে, সেসব কার না জানা? কিন্তু এইসবের পেছনে একজন নারীই যে দাঁড়িয়ে আছেন, একজন মায়েরই যে আত্মত্যাগ এখানে আর্তনাদ করছে, মৃত্যুশয্যায় ছেলেকে কাছে না পাওয়ার যন্ত্রণা যে দাফন আছে এসব ঘটনার পেছনেই, তা অনেকেরই উপলব্ধির বাহিরে।
রমজানের এই দিনে সেই একাকিনী মা’কে স্মরণ করছি, যাঁর সহ্য করা তীব্র কষ্টের ফলে আজ আমরা চরম বিপদাপদেও চিৎকার করে বলতে পারি,
“ইমদাদ কুন ইমদাদ কুন,
আয রাঞ্জ ও গাম আযাদ কুন
দার দ্বীন ও দুনিয়া শাদ কুন
ইয়া গউসুল আজম দাস্তগীর।”
আজকের দিনে সেই দম্পতির কদমে শুকরানা সালাম পেশ করছি যাঁদের বদৌলতে আমরা গুনাহগার হয়েও অভয় বাণী শুনি,
“মুরিদি হিম ওয়াতিব ওয়াশতাহ ওয়াগান্নি
ওয়া ইফআল মা তাশা উ ফাল ইসমু আলী
মুরিদি লা তাখাফ আল্লাহু রাব্বি
আতানি রিফআতানিলতুল মানালী”
[মুরিদ আমার, সাহস রেখো, হও খুশি, নির্ভয়ে গাও,
উচ্চে আমার নামটি, কাজেই যা খুশি তা করেই যাও।
মুরিদ আমার, ভয় করো না, আল্লাহ আমার রব
দিলেন আমায় উচ্চতা, সে পেলাম পাওয়ার সব। -কাব্যানুবাদ উস্তায, হাফেজ মাওলানা আনিসুজ্জামান]
পহেলা রমজানের পবিত্র রজনীতে সেই পূত রমনীকে স্মরণ করি, যার কারণে আজ মনের প্রশান্তি নিয়ে জীবনের অন্তিম দুআ করতে পারি,
“কাদেরি কার কাদেরি রাখ কাদেরিওঁ মে উঠা,
কদরে আব্দুল কাদেরে কুদরত নুমা কে ওয়াস্তে।”
লেখক : শিক্ষার্থী, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া, কামিল হাদিস, ১ম বর্ষ।