খেলাধুলা: ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ
মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ্ আল-মাসুম
খেলাধুলা দ্বারা শারীরিক শক্তি ও মেধার বিকাশ ঘটে। খেলাধুলা দ্বারা স্বাস্থ্যের বহু উপকার হয়। আর ইসলামী দৃষ্টিতে খেলাধুলা হচ্ছে এমন আনন্দ ও উপভোগ যেখানে মানসিক ও শারীরিক বিকাশ বা উপকার রয়েছে এবং যা শরীয়তের মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক নয়, যা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। বয়স ভেদে মানুষের শরীর চর্চার ধরনের পরিবর্তন হয়। কিন্তু সাময়িক শরীর চর্চার বদলে যদি তা কেবল সময়ের অপচয় হয়, স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হয়, যদি খেলাধুলার কারণে ঐ ব্যক্তি দ্বীন থেকে গাফেল হয়, দায়িত্ব বিস্মৃত হয় বা তাতে জুয়া মিশ্রিত হয়, তখন ঐ খেলা হারামে পরিণত হয়। আলোচ্য নিবন্ধে এ বিষয়ে সপ্রমাণ আলোচনা করার প্রয়াস পেলাম। খেলাধুলা বৈধ হওয়ার জন্য শরীয়তের ১২টি পূর্বশর্ত রয়েছে। যথা-
১. আল্লাহ বিমুখতার দিকে যাতে ঠেলে না দেয়
যেই খেলা নামাজ, আল্লাহর জিকির ও শরীয়তের মৌলিক বিধিবিধান পালন, পিতা-মাতার খেদমত ইত্যাদি থেকে বিরত রাখে সেই খেলা বৈধ নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: হে মুমিনগণ! তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সšুÍতি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল না করে। যারা এ কারণে গাফেল হয়, তারাই তো ক্ষতিগ্রস্ত। যে সব বিষয় মানুষকে দুনিয়াতে আল্লাহ থেকে গাফেল করে, তন্মধ্যে দু’টি বড়: ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি। তাই এই দু’টির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। নতুবা দুনিয়ার যাবতীয় ভোগ-সম্ভারই উদ্দেশ্য। আয়াতের সারমর্ম এই যে, ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতির মহব্বত সর্বাবস্থায় নিন্দনীয় নয়। বরং এদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, এসব আয়োজন উপভোগ মানুষকে শরীয়তের সীমারেখা ও আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল করে দিচ্ছে কিনা।
২. আক্বীদা বা বিশ্বাসগত ত্রুটি-বিচ্যুতি না থাকা
যে খেলাধুলা ঈমান-আক্বীদায় সমস্যা করে বা যাতে আক্বীদা পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে তা হারাম। বর্তমানে কিছু ইলেকট্রনিক বা অনলাইন খেলায় এ রকম কিছু সমস্যা পরিলক্ষিত হচ্ছে। যেমন: ঢ়ঁনম খেলা এবং কোন প্রাণীর ছবি ও মূর্তি যুক্ত খেলা।
৩. জুয়া, বাজি ও আর্থিক লেনদেন নিষিদ্ধ
যে খেলায় জুয়া, বাজি ও আর্থিক লেনদেন থাকে তা হারাম। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন: হে মুমিনগণ, এই যে মদ, জুয়া, প্রতিমা এবং ভাগ্য-নির্ধারক শরসমূহ এসব শয়তানের অপবিত্র কার্য বৈ তো নয়। অতএব, এগূলো থেকে বেঁচে থাক- যাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হও।
৪. অধিক সময় ব্যয় না করা
খেলাধুলার ক্ষেত্রে সময়ের খুব বেশি অপচয় হচ্ছে কিনা সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আর পূর্ণাঙ্গ সময় তো দেওয়া যাবেই না। কেননা সময় হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। সময়ের সমষ্টিই হচ্ছে জীবন। জীবনের প্রতিটি মূহূর্তের হিসাব দিতে হবে।
আবু বারযাহ্ আল আসলামী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন: কিয়ামতের দিন কোন ব্যক্তি নিন্মোক্ত প্রশ্নের উত্তর না দেওয়া পর্যন্ত তার দুই পা সামনে বাড়াতে পারবে না: তার জীবন কোথায় ব্যয় করেছে? তার জ্ঞান কোন কাজে লাগিয়েছে ? তার সম্পদ কিভাবে উপার্জন ও কোন খাতে ব্যয় করেছে? এবং তার শরীর কোন কাজে ব্যয় করেছে?। অতএব আমাদেরকে সময়ের গুরুত্ব দিতে হবে। এ ছাড়া খেলার মাধ্যমে প্রসিদ্ধি সুনাম সুখ্যাতি লাভের চেষ্টা করা যাবে না। খেলাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না।
৫.জীবনের জন্য ঝুঁকি না হওয়া
এমন কোন খেলাধুলা করা যাবে না যা নিজের জীবন নাশ কিংবা প্রবল আহত হওয়ার আশংকা থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: তোমরা নিজের জীবনকে ধ্বংসের সম্মুখীন করো না।
৬. কারো ক্ষতি না করা
খেলার আওয়াজ বা অন্য কোনভাবে প্রতিবেশি বা অন্য কারো কোন ক্ষতি সাধন না করা। রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘ইসলামে কারোর ক্ষতি করা নেই, ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াও নেই।’
৭. শালীনতা বজায় রাখা
খেলাধুলায় শালিনতা বজায় রাখতে হবে। গালাগালি ও বকাঝকা ও অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করা যাবে না। জয় পরাজয় নিয়ে যাতে ঝগড়া-বিবাদ, কলহ, শত্রুতার সৃষ্টি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
৮. পর্দার বিধান রক্ষা করা ও সতর ঢাকা
নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ও দেখা সাক্ষাৎ যাতে না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। যা সর্ব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। খেলোয়াড় ও দর্শকদের সতর আবৃত থাকতে হবে। অথচ অনেক খেলায় পুরুষের সতর খোলা থাকে। ফুটবল খেলা, সুইমিং ও সার্ফিং আরও অন্যান্য কিছু খেলায় সতর রক্ষা করা হয় না। এভাবে সতর খুলে খেলা করা ও খেলা দেখা কোনটিই জায়েজ নয়। পুরুষের সতর হলো নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত ঢেকে রাখা। আর অধিকাংশ উলামায়ে কেরামের মতে মহিলাদের সতর হচ্ছে আপাদমস্তক। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
عَنْ عَلِيٍّ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَا تَكْشِفْ فَخِذَكَ، وَلَا تَنْظُرْ إِلَى فَخِذِ حَيٍّ، وَلَا مَيِّتٍ-
অর্থাৎ ‘তুমি নিজের ঊরু খুলো না। কোনো জীবিত বা মৃত ব্যক্তির ঊরুর দিকে দৃষ্টি দিও না।’
৯.ধর্মীয় কর্তব্য পালনে উদাসীন না হওয়া
এমন কোনো খেলা বৈধ নয়, যা আল্লাহর কোনো ফরজ বিধান পালনের কথা দিব্যি ভুলিয়ে দেয়। যেমন কোনো ফরজ নামাযের সময় খেলাধুলা করা। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘এমন কিছু লোক রয়েছে, যারা অজ্ঞতাবশত বাজে কথা খরিদ করে মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করার জন্য এবং সত্য পথকে তারা বিদ্রুপ করে। তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাকর শাস্তি।’ আলোচ্য আয়াতটি খেলাধুলা ও অনর্থক কাজের নিন্দায় সুস্পষ্ট ও প্রকাশ্য।
১০.শরিয়তের মহৎ লক্ষ্যের প্রতি খেয়াল রাখা
পৃথিবীতে আমাদের জীবন লক্ষ্যহীন নয়। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে ‘আমি জিন ও মানবজাতিকে কেবল ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি।’ আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন, ‘তিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন, যাতে তিনি তোমাদের পরীক্ষা করেন- তোমাদের মধ্যে আমলের দিক থেকে কে উত্তম।’ তাই যে খেলার কারণে মুমিনের ইবাদতে বিঘœ ঘটে, তা না-জায়েজ।
১১.হারাম উপার্জনমুক্ত হওয়া
খেলাধুলায় জুয়া ও বাজি ধরা হলে তা বৈধ নয়। কিন্তু আজকাল আন্তর্জাতিক খেলাধুলায় জুয়া ও বাজিকে কেন্দ্র করে নানা অনভিপ্রেত ঘটনার উদ্ভব প্রায়ই ঘটতে দেখা যায়। অথচ পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, প্রতিমা-বেদি ও ভাগ্যনির্ধারক তীরসমূহ তো নাপাক শয়তানের কর্ম। সুতরাং তোমরা তা পরিহার করো। যেন তোমরা সফলকাম হও। শয়তান শুধু মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চার করতে চায়। আর চায় আল্লাহর স্মরণ ও সালাত থেকে তোমাদের বাধা দিতে। তাই তোমরা কি বিরত হবে না?’
১২.জয়-পরাজয়ে শত্রুতা-মিত্রতা সৃষ্টি না হওয়া
ভাল খেলার কারণে অতি ভক্তি বা খারাপ খেলার কারণে অতি তিরস্কার করা কোনোটাই ইসলামে কাম্য নয়। ইসলামে শত্রুতা-মিত্রতার মাপকাঠি কেবল আল্লাহর ভালবাসা। আবু উমামা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সূত্রে বর্ণিত হাদিসে হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে কাউকে আল্লাহর জন্যই ভালোবাসে ও আল্লাহর জন্যই ঘৃণা করে এবং কাউকে কিছু দিয়ে থাকে আল্লাহর জন্যই এবং কাউকে কিছু দেওয়া থেকে বিরতও থাকে আল্লাহরই জন্য, তাহলে তার ঈমান পরিপূর্ণ হলো।’
প্রাগুক্ত মূলনীতি বা পূর্বশর্ত সমূহ মেনে যে খেলাধুলা করা সম্ভব, সে গুলো জায়েয হবে। ইমাম ইবনে কুদামা রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, ‘এমন প্রত্যেক খেলা-ধুলা, যা শারীরিকভাবে কোন ক্ষতিসাধন করে না এবং ধর্মীয় কাজেও কোনরূপ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না,তা বৈধ।’ তবে এই অনুমতি শুধু সাময়িক বৈধ বিনোদনের উদ্দেশ্যে দেয়া হয়েছে। কিন্তু যদি কেউ খেলা-ধুলা বা বিনোদনকেই জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বানিয়ে নেয় এবং এটাকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করে, তখন তা হালাল বা বৈধ থেকে হারাম বা মাকরূহের পর্যায়ে পৌঁছে যায়। তাই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
وَكُلُّ شَيْءٍ يَلْهُوْ بِهِ الرَّجُلُ بَاطِلٌ إِلَّا رَمْيَهُ بِقَوْسِهِ وَتَأْدِيْبَهُ فَرَسَهُ وَمُلَاعَبَتَهُ امْرَأَتَهُ ‘
অর্থাৎ এমন প্রত্যেক জিনিস যা মানুষকে উদাসীন ও দ্বীন বিমুখ করে তোলে, তা পরিত্যাজ্য। শুধু তীরন্দাজী করা, ঘোড়াকে প্রশিক্ষণ দেয়া এবং নিজ স্ত্রীর সাথে মৃদু হাস্যরস করা ব্যতীত।’ অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে-
عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ الله وَ جَابِرِ بْنِ عُمَيْرٍ قَالَ أَحَدُهُمَا لِلْآخَرِ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ كُلُّ شَيْءٍ لَيْسَ مِنْ ذِكْرِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ فَهُوَ لَهُوٌ أَوْ سَهْوٌ إِلا أَرْبَعَ خِصَالٍ : مَشْيُ الرَّجُلِ بَيْنَ الْغَرَضَيْنِ وَتَأْدِيبُهُ فَرَسَهُ ومُلاعَبَةُ أَهْلِهِ وَتَعَلُّمُ السِّبَاحَةِ
অর্থাৎ ‘‘প্রত্যেক সেই জিনিস (খেলা) যা আল্লাহর স্মরণের পর্যায়ভুক্ত নয়, তা অসার ভ্রান্তি ও বাতিল। অবশ্য চারটি কর্ম এরূপ নয়; হাতের নিশানা ঠিক করার উদ্দেশ্যে তীর খেলা, ঘোড়াকে প্রশিক্ষণ দেওয়া, নিজ স্ত্রীর সাথে হাস্যরস করা এবং সাঁতার শেখা।’’
উর্পযুক্ত হাদীসের আলোকে মুজতাহিদগণ কিছু খেলায় পুরষ্কারের ব্যবস্থা করাকে বৈধতা দিয়েছেন। যথা-
ক. ঘোড়া ও উটের দৌড় প্রতিযোগিতা
হযরত ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা বর্ণনা করেন, রাসূলে মকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেসব ঘোড়া মোকাবেলার জন্য লালন করা হয়েছিল সেগুলোর মধ্যে ‘খাফিয়া’ থেকে ‘সানিয়াতুল বিদা’ পর্যন্ত প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করেছিলেন। আর যেসব ঘোড়া এতদুদ্দেশ্যে লালন করা হয়নি সেগুলোর মধ্যে ‘সানিয়াতুল বিদা’ থেকে ‘মাসজিদে বনি জুরাইক’ পর্যন্ত প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করেছিলেন। ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সেসব লোকেরই একজন ছিলেন; যারা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিলেন’।
খ. তীর নিক্ষেপ প্রতিযোগিতা
এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তীর নিক্ষেপ এবং উট ও ঘোড়দৌড় ব্যতীত অন্য কিছুতে প্রতিযোগিতা নেই।
আর কিছু খেলা রয়েছে যেগুলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বিশেষভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন, যদিও সেগুলোতে কিছু উপকারিতা আছে বলেও উল্লেখ করা হয়। যেমন দাবা, তাস, লুডু-পাশা, পায়রা উড়িয়ে খেলা ইত্যাদি। এগুলোর সাথে জয়-পরাজয় ও টাকা-পয়সার লেনদেন জড়িত থাকলে এগুলো জুয়া ও অকাট্য হারাম। অন্যথায় কেবল চিত্তবিনোদনের উদ্দেশ্যে খেলা হলেও হাদীসে এসব খেলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি দাবা খেলায় প্রবৃত্ত হয়, সে যেন তার হাতকে শূকরের রক্তে রঞ্জিত করল। অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে, যে ব্যক্তি পাশা জাতীয় খেলায় লিপ্ত হবে, সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানী করল। এমনিভাবে কবুতর নিয়ে খেলা করাকেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম অবৈধ সাব্যস্ত করেছেন। এই নিষেধাজ্ঞার বাহ্যিক কারণ হল, সাধারণভাবে এসব খেলায় মগ্ন হলে মানুষ জরুরী কাজ-কর্ম এমন কি সালাত, সাওম ও অন্যান্য ইবাদত থেকেও উদাসীন হয়ে যায়।
এক কথায় ইসলামে খেলাধুলা শর্ত সাপেক্ষে বৈধ হলেও সব প্রকারের খেলাধুলা বৈধ নয়। বিশেষত যেসব খেলাধুলায় জুয়া থাকে তা তো স্বয়ং রাব্বুল আলামিন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। বর্তমান বিশ্বকাপ ফুটবল, ক্রিকেট সহ প্রচলিত অধিকাংশ খেলাধুলায় ইসলামী শরী‘আতের উপরিউক্ত শর্তাবলী উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না। বরং জীবনের ঝুঁকি, নামাযের প্রতি অবহেলা, ইসলাম বহির্ভূত অন্য কিছুর অনুসরণ, সময় ও অর্থের অপচয়, জুয়া-বাজি ধরা, রংখেলা, গ্যালারিতে উদ্দাম নৃত্য-গান, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, উলকি আঁকা ইত্যাদির বাহুল্য থাকে। তাই এসব খেলাধুলা সম্পূর্ণ নাজায়েজ ও হারাম। একবিংশ শতাব্দীর সৌদি আরবের শ্রেষ্ঠ মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও উসূলবিদ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন বলেছেন, এগুলো সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। সংকীর্ণ পোশাক পরিধান করে অথবা উরু উন্মুক্ত করে খেলাধুলা করা জায়েয নয়। সুতরাং তা দেখাও নাজায়েয। অতঃপর তিনি দলীল হিসাবে নিম্নোক্ত হাদীসটি উপস্থাপন করেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা বর্ণনা করেন, হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
أن النبي صلى الله عليه وسلم قال: “لا تزول قدم ابن آدم يوم القيامة من عند ربه حتى يسأل عن خمس: عن عمره فيما أفناه، وعن شبابه فيم أبلاه، وماله من أين اكتسبه وفيم أنفقه، وماذا عمل فيما علم
‘ক্বিয়ামত দিবসে পাঁচটি বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আদম সন্তানের পদযুগল আল্লাহ তা‘আলার নিকট হতে সরতে পারবে না।
যথা- ১. তার আয়ুস্কাল সম্পর্কে,সে তার জীবনকাল কোথায় অতিবাহিত করেছে? ২. তার যৌবনকাল সম্পর্কে, কী কাজে তা বিনাশ করেছে?
৩. ও ৪. তার ধন-সম্পদ সম্পর্কে কোথায় হতে তা উপার্জন করেছে এবং কোন কোন খাতে তা খরচ করেছে? এবং ৫. সে যতটুকু জ্ঞান অর্জন করেছিল সে মুতাবেক কী কী আমল করেছে’? সুতরাং যে খেলায় কোন ধর্মীয় ও পার্থিব উপকারিতা নেই, সেসব খেলাই নিন্দনীয় ও নিষিদ্ধ। যে খেলা শারীরিক ব্যায়াম তথা স্বাস্থ্য রক্ষার জন্যে অথবা অন্য কোন ধর্মীয় ও পার্থিব উপকারিতা লাভের জন্যে অথবা কমপক্ষে মানসিক অবসাদ দূর করার জন্যে খেলা হয়, সে খেলা শরীয়ত অনুমোদন করে, যদি তাতে বাড়াবাড়ি করা না হয় এবং এতে ব্যস্ত থাকার কারণে প্রয়োজনীয় কাজ-কর্ম বিঘিœত না হয়। জেনে শুনে ঐ ধরনের পুরস্কার গ্রহণের খেলার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা এবং দেখা উভয়ই হারাম। কেননা এ ধরনের খেলায় উপস্থিত হওয়াটা তাকে সমর্থন করার শামিল।’ আর শরীয়তে নাজায়েজ কাজে বিজয়ী হওয়ার জন্য প্রার্থনা করাও নাজায়েজ। তাই খেলায় কোনো এক পক্ষ বিজয়ী হওয়ার দোয়া করাও নাজায়েজ । আর সাপ, বেজি, বানর ইত্যাদির খেলা দেখা, দেখানো এবং বিনিময় দেয়া ও নেয়া জায়েজ নেই। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে ইসলামি অনুশাসন মেনে চলার তাওফিক দান করুন।
টিকা:
– সূরা মুনাফিকূন,আয়াত: ৯
– সূরা মায়িদাহ, আয়াত: ৯০
– জামে তিরমিজী,হাদীস: ২৪১৭
– সূরা বাকারা, আয়াত: ১৯৫
– মুয়াত্তা মালিক, হাদিস : ২৭৫৬; দারা কুতনি, হাদিস: ৪৫৯৫
– সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৪০১৫/৪০১৭
– সূরা লোকমান,আয়াত:৬
– তাফসিরে রুহুল মাআনি
– সূরা জারিয়াত,আয়াত:৫৬
– সূরা মুলক,আয়াত:০২
– সূরা মায়িদা,আয়াত: ৯০-৯১
– সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৪৬৮১
– আল-মুগনী, ১৪/ ১৫৭
– সুনানে দারিমী, হাদীস:২৪৪৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস:১৭৩০০,১৭৩৩৭
– নাসাঈর কুবরা, হাদীস:৮৯৩৮-৮৯৪০; ত্বাবারানীর কাবীর, হাদীস: ১৭৬০, সিলসিলাহ সহীহাহ, হাদীস: ৩১৫
– সহিহ মুসলিম,হাদীস:৪৯৫০
– সুনানে ইবনে মা-জাহ,হাদীস: ২৮৭৮; জামে তিরমিজি, হাদীস: ১৭০০
– সহিহ মুসলিম, ১৭৭০/২২৬০
– সুনানে আবু দাউদ,হাদীস: ৪৯৩৮;সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস: ৩৭৬২
– সুনানে আবু দাউদ,হাদীস: ৪৯৪২
– জামে তিরমিযী, হাদীস:২৪১৬; সিলসিলা ছহীহাহ, হাদীস:৯৪৬; ফাতাওয়া ইসলামিয়া, ৪র্থ খন্ড, পৃ. ৪৩১
– ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ১৫খন্ড, পৃ. ২৩৮, ফতওয়া নং:১৮৯৫১
– ফতওয়ায়ে শামী,৯/৫৬৫, আল-মাওসূয়াতল ফিক্বহিয়া,২/২৬৫
– ফতওয়ায়ে শামী,৬/৩৪৯; আহসানুল ফতওয়া, ৮/২০৭
লেখক: আরবি প্রভাষক, রাণীরহাট আল-আমিন হামেদিয়া ফাযিল মাদরাসা, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম