আবু নসর মুহাম্মদ আল ফারাবী
আবু নসর মুহাম্মদ আল ফারাবী
(৮৭০ – ৯৫০ খ্রিস্টাব্দ) –
শেখ মুহাম্মদ ইব্রাহীম >
তুরস্কের মধ্য দিয়ে সির-দরিয়া নামে বিখ্যাত নদী প্রবাহিত হয়ে আরব সাগরে গিয়ে পড়েছে। এই নদীর সঙ্গে আরিস নদীর যেখানে মিলন হয়েছে সেখানেই ফারাব শহর অবস্থিত। চেংগিস খাঁর ধ্বংস লীলার পর ফারাব শহর ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। এককালে এই ফারাব ছিল বিশ্ববিখ্যাত জ্ঞানী ও দার্শনিকদের জন্মস্থান। তুর্কীদের সভ্যতা কেন্দ্র এই ফারাব শহরে ৮৭০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি আবু নসর মুহাম্মদ আল ফারাবী জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাল্যকাল ফারাবে অতিবাহিত হয়। এখানে তিনি বিদ্যাশিক্ষা গ্রহণ করে বুখারায় কিছু দিন কাজীর পদ অলংকৃত করেন। তাঁর অদম্য জ্ঞান স্পৃহা তাঁকে কাজীর পদ পরিত্যাগ করে আরো প্রচুর জ্ঞান সাধনার জন্য তৎকালীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্রভূমি বাগদাদে গমন করতে হয়। এখানে তিনি আরবী ভাষা উত্তমরূপে আয়ত্ব করেন এবং গ্রীক ভাষা রপ্ত করেন। এরপর প্রখ্যাত শিক্ষক আবু বিসর মিতাহ ইবনে ইউনুচের কাছে এ্যারিস্টটলের দর্শন ও তর্কশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। প্রায় সত্তরটি নোট বুকে দর্শনশাস্ত্রের সারাংশ লিপিবদ্ধ করেছিলেন। তিনি আবু বকর ইবনে র্সারাজ নামক বিখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক ও বৈয়াকরণের নিকট আরবী ভাষা ও ব্যাকরণ শিক্ষা লাভ করেন। তৎকালীন শিক্ষার ধারানুযায়ী আল ফারাবী বিখ্যাত পণ্ডিতগণের নিকট অংক, জ্যোতিষশাস্ত্র, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও চিকিৎসাশাস্ত্রের গভীর জ্ঞান লাভ করেন। এমনকি তিনি সংগীত শাস্ত্রও অধ্যয়ন করেন। আল ফারাবী সর্ববিদ্যা বিশারদ হলেও একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক হিসেবে অমর হয়ে আছেন। তিনি কিছুকাল পারস্যের হারবান নামক সেবিয়ানদের ধর্ম শিক্ষা কেন্দ্রে অবস্থান করে তাদের ভাষা, দর্শন ও জ্যোতির্বিদ্যায় জ্ঞানলাভ করেন।
আল-ফারাবী সুদীর্ঘ চল্লিশ বছর জ্ঞান-সাধনার প্রাণকেন্দ্র বাগদাদে আবস্থান করেন। এ সময় তিনি একাগ্রচিত্তে এ্যারিস্টটলের তর্কশাস্ত্র ও দর্শনশাস্ত্রের বিস্তৃত ভাষ্য রচনা করেন এবং দর্শন শাস্ত্রে কয়েকটি মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেন। বাগদাদে চল্লিশ বছর অবস্থানকালে প্রায় ছয়জন খলীফার আবির্ভাব ঘটে। ঘন ঘন শাসক পরিবর্তনে রাষ্ট্রীয় গোলযোগ সৃষ্টি হওয়ায় নীরব শাস্ত্রপ্রিয় এই জ্ঞানতাপসকে অনেক অসুবিধে ভোগ করতে হয়। এতে করে জ্ঞান-সাধনার ক্ষেত্র বাগদাদ নগরী ত্যাগ করতে তাঁকে বাধ্য করা হয়। বাগদাদ ছেড়ে কিছুকাল জন্মভূমি তুর্কিস্থানে অবস্থান করেন। এই সময় স্থানীয় শাসক আলি সামানের আদেশে আল-ফারাবী ‘আল-তালিম আল-সানী’ নামক গ্রন্থটি রচনা করেন। এখানে উল্লেখ্য, প্রাচ্যের সূধী সমাজে এ্যারিস্টটল ‘মুয়াল্লিম আউয়াল’ অর্থাৎ প্রথম গুরু এবং আল-ফারাবী ‘মুয়াল্লিম সানী’ অর্থাৎ দ্বিতীয় গুরু হিসেবে খ্যাত। এ কারণে আল-ফরাবীর গ্রন্থটির নামকরণ ‘আল্ সানী’ রাখা হয়েছে।
পরে আল ফারাবী তুর্কিস্থান ত্যাগ করে সিরিয়ার দামেস্কে গমন করেন। সেখানে তিনি শাসক আকশীদ তাতারের অনুগ্রহ লাভ করেন। সেখান থেকে ফরাবী মিসর গমন করেন। কয়েক বছর সেখানে অবস্থান করে পুনরায় সিরিয়ার আলেপ্পোতে প্রত্যাবর্তন করেন।
৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে আমির সায়েফ উদ্দৌলা সিরিয়ার শাসককে পরাজিত করে আলেপ্পোতে রাজধানী স্থাপন করেন। অতি অল্প সময়ে আলেপ্পো জ্ঞান বিজ্ঞানের কেন্দ্রভূমি হয়ে ওঠে। আমির আল ফারাবীকে তাঁর দরবারে স্থান দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে দৈনিক মাত্র চার রৌপ্য দিরহাম ভাতা ও একটি নির্জন শান্তিময় কুঠির প্রার্থনা করেন।
তাঁর এই সামান্য আবেদন মঞ্জুর হয় এবং তিনি জ্ঞানসাধনায় লিপ্ত হন। ৯৫০ খ্রিস্টাব্দে আমীর সায়েফউদ্দৌলা দামেস্কে অভিযান করেন এবং আল ফারাবীকে সঙ্গে নেন।
আল-ফারাবী দর্শন, বিজ্ঞান, চিকিৎসা, ভাষাতত্ত্ব, সংগীত প্রভৃতি বিষয়ে প্রায় শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। তন্মধ্যে বিশটির মতো গ্রন্থের অস্তিত্ব বিদ্যমান। তাঁর অমূল্য গ্রন্থাবলী প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দার্শনিকদের মধ্যে তিনি অন্যতম। তিনি একজন বহু ভাষাবিদ ছিলেন। মুসলিম দার্শনিকদের মধ্যে আল ফারাবী প্রথম। তারপরই ইবনে সিনা ও ইবনে রুশদের নামই উল্লেখ্য। প্লেটো ও এ্যারিস্টটল সম্পর্কে ফারাবীর ভাষ্য তাৎপর্যময়- এজন্য পরবর্তীকালের দার্শনিকদের মধ্যে তাঁর প্রভাব রয়েছে। তিনিই ইসলামের প্রথম বিশ্বকোষ রচয়িতা ও মুসলিম তর্কশাস্ত্রের জন্মদাতা। ইসলামী ধর্মতত্ত্বের আলোচনায় তিনি দর্শনের সঙ্গে ধর্মের তুলনামূলক বিচারকালে ধর্মীয় ওহী, তসবীহ, রিসালাত, জান্নাত-দোযখ, আল-লওহে কালাম, আরশ-কুরশী, তকদীর, তকলীদ প্রভৃতির বিশদ ব্যাখ্যা দান করেন।
আল্ ফারাবী ইসলামের সমাজতান্ত্রিকতার বিষয় চিন্তা করেন। এজন্য তাঁকে প্রাচ্যের শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক, দার্শনিক সমাজ বিজ্ঞানী ইবনে খলদূনের পথপ্রদর্শক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
রাষ্ট্রনীতিতে আল্ ফারাবীর প্রচুর আগ্রহ ছিল এবং এক হিসেবে তিনি আরব জাতির মধ্যে রাষ্ট্রনীতির অগ্রদূত। ফারাবী রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে প্রচুর গবেষণা করে নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নতুন ব্যাখ্যা দান করেন। তাঁর ব্যাখ্যা প্লেটোর বিশ্লেষণ থেকে ভিন্ন। হাজার হাজার বছর পূর্বেই তিনিই সর্বপ্রথম এক রাষ্ট্রীয় বন্ধনে অখন্ড পৃথিবীর কল্পনা করেছিলেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ক তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘সিয়াসাতুল মাদানীয়া’, ‘আরাউয়াল আহলিল’, ‘মাদিনাতুল -ফাযিলাহ’, ‘জওয়ামিনুস্ সিয়াসাত’ এবং ‘ইজতিমাউমাদানিয়া’ আজও মৌলিক গ্রন্থ হিসেবে বিদ্যমান। সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে তাঁর মতামত : ‘কতকগুলো জাতি অন্যজাতির উপর রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব খাটাতে চায় এবং এভাবে নিজেদের জীবন নিরাপদ, সুখময় ও ঐশ্বর্যময় করতে চায়। তার দরুণ শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে গ্রাস করার জন্য সর্বদাই উৎসুক হয়। সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের উপর এরকম রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রভুত্ব বিস্তার করে, যার ফলে বিজিত জাতি হীনবশ্যতা স্বীকারে বাধ্য হয়। সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র সর্বদাই অপর রাষ্ট্রগুলোকে শত্রু মনে করে, তার দরুণ নিজেদের সদা যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত থাকতে বাধ্য হয়।
রাষ্ট্রীয় শাসক সম্পর্কে তাঁর মতামত: যদি একজন সর্বগুণান্বিত শাসক না মেলে এবং শাসকের আদর্শ গুণাবলী যদি একাধিক ব্যক্তির মধ্যে থাকে, তাহলে তাঁরা সকলেরই ইসলামী রাষ্ট্রের যৌথ শাসনভার চালানোর ক্ষমতা রয়েছে। ফারাবীর এই নীতি থেকে বর্তমান মন্ত্রীসভা পরিচালিত শাসনকার্যের পূর্ণ সমর্থন মেলে। তিনি আরো বলেছেন যদি কোন সময় দেখা যায় যে, রাষ্ট্রে দর্শনের স্থান নেই, তাহলে শাসনকার্যে অন্যান্য সুষ্ঠুবিধান থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রের আদর্শ শাসকের অভাব দেখা দেবে। সাময়িক রাষ্ট্রনায়ক যথার্থ শাসক হতে পারবে না এবং রাষ্ট্রের অবনতি অশ্যম্ভাবী হবে। তখন যদি শাসকের সঙ্গে সহযোগিতা করার কোন বিজ্ঞ জ্ঞানী দার্শনিক না থাকে তাহলে কিছুকাল পরে সে রাষ্ট্রের পতন হবেই। চিকিৎসাশাস্ত্রে তাঁর শিষ্য ইবনে সিনার মতো তাঁর অবদান না থাকলেও তাঁর রচিত ‘আল মদিনাত-আল ফাযিলাহ’ গ্রন্থটি চিকিৎসাশাস্ত্রের উল্লেখ যোগ্য গ্রন্থ। তাঁর অমূল্য বাণীটি এখনো সর্বজন বিদৃত: বৃক্ষের সার্থকতা যেমন ফল-ধারণে, সেরকম নৈতিক গুণাবলীর সার্থকতা পরম শান্তিলাভে। অতএব, চরম ও পরম শান্তিলাভের একমাত্র পথ ক্রমাগত সজ্জীবন- যাপন করা।
দশ শতকের মাঝামাঝি একজন শান্ত প্রকৃতির ক্ষুদ্রাকৃতি, ক্ষুদ্র চক্ষুতারকা সম্বলিত, কয়েক গাছি শ্মশ্রুমন্ডিত জ্ঞান সাধক আবু নসর মুহাম্মদ আল্ ফারাবী ইসলামের ইতিহাসে একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ছিলেন। তাঁর খ্যাতি সর্বজন বিদিত। তিনিই প্রাচ্যের দর্শনশাস্ত্রের দ্বিতীয় শিক্ষাগুরু আল ফারাবী। এই মহান দার্শনিক ৯৫০ খ্রিস্টাব্দে সিরিয়ার দামেস্কে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বিশেষ আড়ম্বরের সাথে দামেস্কের বাব আল্ সাগীর নামক অঞ্চলে উমাইয়া বংশের প্রতিষ্ঠাতা হযরত আমীর মুয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু-এর সমাধি পাশে আল ফারাবীর নশ্বর দেহ সমাহিত হয়। যুগ যুগ ধরে এই সমাধিস্থলে প্রচুর লোক সমাগম হয়।