Anjuman-E Rahmania Ahmadia Sunnia Trust

আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা (আলায়হির রাহমাহ্) ও তাঁর ফলপ্রসূ সংস্কারাদি

আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা (আলায়হির রাহমাহ্) ও তাঁর ফলপ্রসূ সংস্কারাদি

আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা
(আলায়হির রাহমাহ্)
ও তাঁর ফলপ্রসূ সংস্কারাদি

মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান

মুসলমানদের বিশাল ইতিহাসের দু’টি দিক সবিশেষ লক্ষ্যণীয়: একদিকে চরম সাফল্য ও গগণচুম্বী উন্নতি, অন্যদিকে মাঝে মধ্যে দুঃখজনক বিপর্যয় ও প্রতিকার যোগ্য অবনতি। যতক্ষণ পর্যন্ত মুসলমানদের অন্তরে ইশ্ক্বে মোস্তফার নূর চমকিত ও সমুজ্জ্বল ছিলো, ততদিন পর্যন্ত রোম সম্রাট ক্বায়সার ও পারস্য সম্রাট কিসরার তাজ ও তখত (মুকুট ও সিংহাসন) মুসলামনদের পদ তলে দলিত হয়েছিলো, পক্ষান্তরে যখন মুসলমানদের হৃদয়-মন এ চির উজ্জ্বল নূরশূন্য হয়ে যেতে লাগলো তখন থেকে সুদূর পাশ্চাত্য (স্পেন) থেকে প্রাচ্যের বিশাল অঞ্চল পর্যন্ত লাঞ্ছনা ও অবমাননা যেন তাদের অদৃষ্টের লিপি হয়ে গেলো।  ড. আল্লামা ইকবাল মুসলমানদের চরম উন্নতির কারণ ও অবস্থা এভাবে বর্ণনা করেছেন-
هر كه عشق مصطفے سامانِ اوست
بحرو بر   گوشئه   دامانِ   اوست
অর্থ: যার নিকট ইশক্বে মোস্তফা অর্থাৎ বিশ্বনবীর অকৃত্রিম ভালবাসা ও অদম্য ইশক্বরূপী অতি মূল্যবান সম্পদ পাথেয় হিসেবে থাকে, বিশাল সমুদ্র ও বিস্তীর্ণ স্থলভাগ তার আঁচলের এ কোণায় এসে যায়।
যদি আমরা গভীর দৃষ্টিতে ইসলামের ইতিহাসের বিভিন্ন দিক দেখি ও উত্তমরূপে পর্যালোচনা করি, তবে ইসলামের প্রাথমিক যুগের মুনাফিক নেতা আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই ও ভ্রান্ত শিয়া নেতা (শিয়া মতবাদের প্রবর্তক) আবদুল্লাহ্ ইবনে সাবা থেকে আরম্ভ করে এ প্রায় শেষ যুগের ভন্ডনবী গোলাম আহমদ ক্বাদিয়ানী ও নাম সর্বস্ব (তথাকথিত) নজদী-সংস্কারক(!) পর্যন্ত এমন এক বিশ্রী ধারা বা পরম্পরাও চোখে পড়বে, যারা মুসলমানদের মধ্যে র’য়ে তাদের ঈমান ও ইয়াক্বীনকে লুণ্ঠন করতে থাকে। কিন্তু অন্য দিকে, খলিফাতুর রসূল সাইয়্যেদুনা সিদ্দিক্বে আকবার রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে আরম্ভ করে ইমামে আ’যম আবূ হানীফা আলায়হির রাহমাতু ওয়ার রিদ্বওয়ান পর্যন্ত, তারপর গাউসুল আ’যম শায়খ আবদুল ক্বাদির জীলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু ও ইমাম আবুল মনসূর মা-তুরীদী থেকে আরম্ভ করে মুজাদ্দিদে আলফে সানী ও ইমাম আহমদ রেযা আলায়হির রাহমাহ্ ওয়ার রিদ্বওয়ান পর্যন্ত আমাদের ঈমান ও ইশক্বের এমন মজবুত শিকল বা পরম্পরা দৃষ্টিগোচর হয়, যা তাওহীদ ও রিসালাতের বিপক্ষে রচিত প্রতিটি ষড়যন্ত্রকে ফাঁশ ও অচল করে দিয়েছে। ইমাম আহমদ রেযা আলায়হির রাহমাহ্ ওয়ার রিদ্বওয়ান ওই শিকলের একটি মজবুত কড়ার নাম।
তিনি ১৪ই জুন, ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ১০ শাওয়াল ১২৭২ হিজরীতে এ উপমহাদেশের প্রসিদ্ধ শহর রেরিলীতে জন্মগ্রহণ করেন। এটা ওই সময় ছিলো, যখন গোটা উপমহাদেশে ইংরেজ শাসনের বহুমুখী যুলমের বিরুদ্ধে জিহাদের পতাকা উড্ডীন হবার জন্য ইসলামী অহমিকা ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলো। মুসলমানগণ গোটা উপমহাদেশে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে জিহাদের পতাকা উড্ডীন করলেন। ওলামা এবং মাশাইখে আহলে সুন্নাত ও তাঁদের অবস্থান ও খানকাহ্সমূহ থেকে বের হয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামকারীদের প্রাণপণে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং ফিরিঙ্গী তাগুতদের বিরুদ্ধে যুগান্তকারী প্রচেষ্টার সূচনা করেছিলেন।
ওইসব আদর্শ নেতৃত্বদাতাদের মধ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামের বীরপুরুষ আল্লামা ফজলে হক শহীদ খায়র-আবাদী, মাওলানা সৈয়্যদ কেফায়ত আলী কা-নী মুরাদাবাদী, মাওলানা আবদুল জলীল শহীদ আলীগড়ী, মাওলানা সৈয়্যদ আহমদ উল্লাহ্ শাহ্ মাদ্রাজী, মুফতী সদরুদ্দীন আদরদাহ্ দেহলভী, মাওলানা ইনায়ত আলী কাকুরী, আযাদী- যুদ্ধের শহীদ মুনশী রসূল বখশ্ কাকুরী, মাওলানা ওয়াহ্হাজ উদ্দীন, মাওলানা ইমাম বখশ সাহ্বানী, মাওলানা ফয়য আহমদ বদায়ূনী ছিলেন ফিরিস্তীর শীর্ষে। কিন্তু মজবুত সংগঠন না থাকা, রাজনৈতিক প্রশিক্ষণের অপ্রতুলতা, মজবূত কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অভাব এবং বিশ্বাসঘাতক কিছু লোকের কারণে এ আন্দোলন সফল হয়নি। ফলে এরপর পুরো উপমহাদেশই ফিরিঙ্গী বর্বরতার শিকার হয়ে যায়। ওই সময় ইমাম আহমদ রেযার বয়স শরীফ  এক বছর কয়েক মাস ছিলো। ইমাম আহমদ রেযার পিতৃ পুরুষগণ সমরকন্দের এক পাঠান গোত্র বড় হীচের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। আর তাঁর সম্মানিত দাদা সা’ঈদ উল্লাহ্ খান শাজা-‘আতজঙ্গ বাহাদুর শাহ্ জাহান-বাদশাহর শাসনামলে সবরকন্দ থেকে হিজরত করে ভারতে তাশরীফ আনেন। ইমাম আহমদ রেযার পিতা মহোদয় ইমামুল মুতাক্বাল্লিমীন আল্লামা মুহাম্মদ নক্বী আলী খান রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর যুগের দক্ষ আলিমদের মধ্যে গণ্য ছিলেন। শাহ্ আলে রসূল মারহারাভী, শায়খ আহমদ যায়ন দাহলান মক্কী, শায়খ আবদুর রহমান সিরাজ মক্কী, মির্যা গোলাম কাদির বেগ, শায়খ হোসায়ন ইবনে সালিহ এবং মাওলানা আবদুল আলী রামপূরীও তাঁদের আন্তর্ভূক্ত ছিলেন।
ইমাম আহমদ রেযা আলায়হির রাহমাহ্ ওয়ার রিদ্বওয়ান চার বছর বয়সে ক্বোরআন মজীদের নাযেরাহ্ পাঠ সমাপ্ত করেন, ছয় বছর বয়সে ঈদে মীলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) এর এক জলসায় অত্যন্ত সারগর্ভ বক্তব্য পেশ করেন, ইমাম আহমদ রেযার জ্ঞানগত মহত্বের অবস্থা এ ছিলো যে, তিনি মাত্র আট বছর বয়সে ইলমে নাহ্ভ-এর একটি প্রসিদ্ধ কিতাবের ব্যাখ্যা লিখে ফেলেছেন। তার মাত্র দু’বছর পর ১৮৬৬ ইংরেজী সালে ১০ (দশ) বছর বয়সে ‘মুসাল্লামুস সাবূত’-এর উপর পাদ ও পাশ্বটীকা লিখে সংযোজন করেন। ১৮৬৯ সালে তিনি সমস্ত পুথিগত ও বিবষয়গত (علوم و فنون) শিক্ষার্জন সমাপ্ত করেন। আর তাঁকে দস্তারে ফযীলত (শেষবর্ষ সনদ ও পাগড়ী) প্রদান করা হয়েছিলো। ওই বছর তিনি শিশুর দুগ্ধপান (رضاعت) সম্পর্কিত এক বিস্তারিত ও পূর্ণাঙ্গ ফাতওয়া প্রণয়ন ও প্রকাশ করেন। এরপর তাঁকে ‘দারুল ইফতা’ (ফাতওয়া প্রণয়ন বিভাগ)-এর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ১৮৭৪ ইংরেজী সালে আঠার বছর বয়সে তাঁর দাম্পত্য জীবনের সূচনা হয়। ১৮৭৫ ইংরেজীতে তিনি হযরত সৈয়দ আলে রসূল মারহারাভী আলায়হির রাহমাহ্ ওয়ার রিদ্বওয়ান-এর বরকতময় হাতে বায়‘আত হন।
২১ বছর বয়সে ইমাম আহমদ রেযা আপন পিতা মহোদয়ের সাথে হজ্জ ও যিয়ারতের জন্য বায়তুল্লাহ্ শরীফে পৌঁছেন, যেখানে হিজাযবাসী আলিমগণ তাঁর ব্যক্তিত্বে প্রভাবিত হয়ে তাঁকে ‘যিয়াউদ্দীন আহমদ’ (দ্বীনে মুহাম্মদীর সমুজ্জ্বল আলো) উপাধি দেন। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি বেরেলীতে উপমহাদেশের মহা ইসলামী বিদ্যাপীঠ (মাদ্রাসা) ‘দারুল উলূম মানযার-ই ইসলাম’-এর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি দ্বিতীয়বার হজ্জ পালন করেন। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে তিনি মুসলিম উম্মাহকে ক্বোরআন-ই হাকীমের বিশুদ্ধতম উর্দু তরজমা ‘কান্যুল ঈমান’ উপহার দেন। ১৯২১ ইংরেজীর নভেম্বর মাসে, মোতাবেক ২৫ সফরুল মুযাফফর ১৩৪০ হিজরীতে ইমাম আহমদ রেযা ফাযেলে বেরলভী এ নশ্বর জগত থেকে অবিনশ্বর জগতে পদার্পণ করেন।
এ উপমহাদেশের ইতিহাসে ইমাম আহমদ রেযার জ্ঞানগত ও আত্মিক স্তর (মাক্বাম) বহু উর্ধ্বে। তিনি একাধারে পঞ্চান্নটি বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেন। এসব বিষয়ে ইমাম আহমদ রেযার লিখিত সহস্রাধিক কিতাব রয়েছে। বস্তুত ‘ফাতাওয়া-ই আলমগীরী’র পর হানাফী মাযহাবের মহান কীর্তি ‘ফাতাওয়া-ই রেযভিয়া’ ইমাম আহমদ রেযার জ্ঞানগত অন্তর্দৃষ্টি ও গবেষণাগত মহত্বের অকাট্য প্রমাণ বহন করে। তাঁর এ ‘ফাতাওয়া গ্রন্থ’ ইসলামী আইনের সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য প্রামাণ্য উৎস গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত।
ইসলামী দার্শনিক আল্লামা ইকবাল ফিক্বহ শাস্ত্রে ইমাম আহমদ রেযার দক্ষতা, মেধা এবং কঠিন ফিক্বহী মাসআলাদিতে তাঁর গবেষণা ও সুক্ষ্মদৃষ্টির কথা স্বীকার করে লিখেছেন-
“هندوستان  كے دور آخر ميں حضرت امام احمد رضا (رحمة الله عليه) جيسا طباع اور ذهين فقيه پيدا نهيں هوا- ميں نے يه رائے  ان كے فتاوى كے مطالعه سے قائم كى هے جو ان كى ذهانت وفطانت،  جودت طبع كمال فقهيات اور علوم دينيه ميں تبحر علمى كے شاهد وعادل هيں۔”
অর্থ: ‘‘ভারতের শেষ যুগে হযরত ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি আলায়হির মতো উন্নতস্বভাব বিশিষ্ট ও মেধাবী ফিক্বহবিদ পয়দা হয়নি। আমি এ সিদ্ধান্তে তাঁর ফাতাওয়া পাঠ-পর্যালোচনা করে উপনীত হয়েছি, যা তাঁর মেধা, চতুরতা, উন্নতস্বভাব, পূর্ণাঙ্গ বুঝশক্তি এবং দ্বীনি ইলমে সমুদ্রসম গভীরতার পক্ষে যথোপযুক্ত সাক্ষ্য বহন করে।’’
ইমাম আহমদ রেযার বিশাল জ্ঞানগত প্রচেষ্টা ও সংস্কারমূলক চেষ্টাগুলোর প্রতি গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করা হলে দেখা যাবে যে, তিনি ইমাম গাযালী, ইমাম মুহি উদ্দীন ইবনুল আরবী, ইমাম আবুল হাসান আশ্আরী, ইমাম আবুল মানসূর মা-তুরীদী, আল্লামা আবূ বকর মুহাম্মদ ইবনে তাইয়্যেব বাক্বেল্লানী এবং হযরত মুজাদ্দিদ আলফে সানীর মতো মহাজ্ঞানী, রূহানী পেশোয়া এবং মহান সংস্কারক ব্যক্তিদের কাতারের-ই।
একথাও সুস্পষ্ট যে, এ মহান ইমামের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে পর্যালোচনাকারী মুহাক্বিক্ব কিংবা ইতিহাস বিদগণ তখনই হতভম্ভ হয়ে যান, যখন তাঁর জ্বালাময়ী, হৃদয়গ্রাহী ও চিত্তাকর্ষক অবস্থা ও আনন্দে নিমজ্জিত ইশ্ক্ব ও মুর্চ্ছনায় সমৃদ্ধ বক্তব্য ও লেখনীগুলো তাঁদের সামনে আসে। আরবী, ফার্সী, উর্দু ও হিন্দী ভাষায় আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযার কবিত্ব এবং কাব্য রচনার যেই উন্নত মন-মানসিকতা ও যোগ্যতার যেই কীর্তি ও সাক্ষ্য তিনি উপস্থাপন করেছেন, এসব কটিতে তিনিই তাঁর উপমা। তাঁর অনন্য না’তিয়া কালামবিশিষ্ট লেখনী ‘হাদাইক্বে বখশিশ’ আজও জ্ঞানী ও গুণীদের প্রশংসা কুঁড়াচ্ছে। আর এসব বিষয় গভীরভাবে দেখা হলে নির্দ্বিধায় বলতে হবে যে, ইমাম আহমদ রেযা একদিকে যেমন অতুলনীয় ফক্বীহ্ ও ইমাম অন্যদিকে তিনি এক অতি উচুঁ মানের কবি ও অকৃত্রিম আশেক্বে রসূল। এমনকি একথা বললেও অত্যুক্তি হবে না যে, তাঁর অকৃত্রিম ও জীবনের সার্বক্ষণিক ইশ্ক্বে রসূলের কারণেই দ্বীনের ক্ষেত্রে এতসব অবদান ও উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে যাওয়া তাঁর জন্য সহজ হয়েছিলো।
ইমাম আহমদ রেযার ব্যক্তিত্বের এক বিরাট দিক হচ্ছে ভারত উপমহাদেশে দ্বীন-ই মোস্তফার সংস্কার ও নব জীবন দান করা। কারণ, ইংরেজদের এ উপমহাদেশে চেপে বসার পর বিশেষ করে ভারতীয় মুসলমানগণ নানা ধরণের বিপদ ও প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলেন। বিশেষত: যখন ধূর্ত ইংরেজগণ হিন্দুদেরকে তাদের পক্ষের করে নিতে পেরেছিলো, তখন মুসলমানদেরকেই তাঁদের একমাত্র প্রতিপক্ষ বলে তারা সাব্যস্ত করে নিয়েছিলো। এর অন্যতম কারণ এ ছিলো যে, ইংরেজরা মনে করেছিলো যে, এ উপমহাদেশে দীর্ঘদিন যাবৎ মুসলমানগণ রাজত্ব করেছেন, তাই তাঁরা তাঁদের আগের গৌরবকে অক্ষুন্ন কিংবা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হবেন। সুতরাং ইংরেজগণ মুসলমানদের প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করে অনায়াসে এদেশ শাসন করার জন্য চূড়ান্ত পর্যায়ের প্রতারণামূলক চাল চালিয়েছিলো। তাদের ওই সব চাল ও চক্রান্তের কিছুটা নিম্নে আলোচনা করা হলো-
১. ইংরেজগণ ফার্সীর পরিবর্তে উপমহাদেশে ইংরেজীকেই দাপ্তরিকভাষা ঘোষণা করলো।
২. ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (মাদ্রাসাগুলোর) বিপরীতে মিশনারীর স্কুলসমূহ প্রতিষ্ঠা করেছিলো।
৩. উপমহাদেশের মুসলমানদের সামাজিক ও ধর্মীয় ঐক্যকে টুকরো টুকরো করার জন্য ক্বাদিয়ানিয়াত ও গোস্তাখানে রসূলের পথভ্রষ্ট ধর্মীয় দল-উপদল সমূহ তৈরী করেছিলো।
৪. ইসলামী নিয়মনীতি ও পাঠ্য অনুসারে শিক্ষাদানের পরিবর্তে তারা সাম্রাজ্যবাদী ও ধর্ম বিবর্জিত নিয়মনীতি ইত্যাদি শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করলো।
৫. মুসলমানদের জন্য সরকারী-বেসরকারী ক্ষেত্রে চাকরী-বাকরীর পথ পরিপূর্ণভাবে বন্ধ করে দেওয়া হলো।
৬. খ্রিস্টান মিশনারীগুলোকে ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠা করা হলো, যারা গরীব ও সরলপ্র্রাণ মুসলমানদেরকে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করার প্রতি পুরোদমে আহ্বান করে যাচ্ছিলো।
৭. সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে মুসলমানদেরকে অচল ও অসহায় করে ফেলার জন্য ইংরেজগণ হিন্দুদেরকেই নানা ধরণের সুযোগ সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করলো।
পক্ষান্তরে, সময়ের গতির সাথে সাথে মুসলমানদের প্রচেষ্টাও চলতে থাকে। কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ে রাজনৈতিক প্রশিক্ষণের অভাব, কেন্দ্রীয়ভাবে সম্মিলিত নেতৃত্বের অনুপস্থিতি, অর্থনৈতিক ও পারিপার্শি¦ক সহযোগিতার দৈন্যদশা ইত্যাদির ফলে মুসলমানদের অগ্রযাত্রা দারুণভাবে ব্যাহত হয়েছিলো, এসব প্রতিকূলতা কিছুটা নিম্নে আলোচনা করা হলো-
১. মুসলমানদের ওলামা-মাশাইখের এক বিরাট সংখ্যা নানাভাবে শহীদ হলেন, অনেককে আন্দামান সহ বিভিন্ন দূর-দূরান্তরের দীপাঞ্চলে আমৃত্যু বন্দী দশায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ফলে মুসলমানদের দ্বীনি মাদ্রাসা ও খানকাহ্গুলোর নিয়মনীতি তছনছ হয়ে যায়।
২. বিশেষ করে মুসলমানগণ ইংরেজদের যুলুম-নিপীড়নের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে রইলো।
৩. অর্থনৈতিক ও সামাজিক দৈন্যদশা মুসলমানদেরকে সরকার ও হিন্দুদের হাতের পুতুল কিংবা ক্রীড়নকে পরিণত করা হচ্ছিলো।
৪. খ্রিস্টান মিশনারীগুলো বিভিন্ন পদ ও অর্থের লোভ দেখিয়ে গরীব ও অশিক্ষিত মুসলমানদেরকে সত্য দ্বীন থেকে ফেরানোর জন্যও অপচেষ্টা চালিয়েছিলো।
৫. উপমহাদেশে ইংরেজী সংস্কৃতি, তাহযীব-তামাদ্দুনের হামলায় ইসলামী সংস্কৃতি এবং তাহযীব-তামাদ্দুন বিলুপ্ত  হবার পথে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিলো।
৬. এমন নাজুক পরিস্থিতিতে নদওয়াতুল ওলামার মাও. শিবলী নো’মানী ভারতের মুসলমানদের উপর ইংরেজদের আনুগত্য করাকে ধর্মীয়ভাবে ফরয বা অপরিহার্য করার সরকারী ফাতওয়া প্রদান করলেন। নবাব সিদ্দীক্ব হাসান ভূপালী, মৌ. নযীর হোসাইন দেহলভী এবং অন্যান্য আলিমগদণ ইংরেজ সরকারের অনুগত্য করলেন এবং তাদের সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে দিলেন। এমন হতাশা ও নিরাশার যুগে একজন সর্বদিক সম্পর্কে সচেতন ও নির্ভুল দিক নির্দেশনা প্রদানকারী ব্যক্তির প্রয়োজন অনস্বীকার্য ছিলো। যিনি –
১. ভারতের মুসলমানদেরকে ইমাম আশ‘আরী ও ইমাম মা-তুরীদীর মতো, আক্বীদা ও আমলগত পথ ভ্রষ্টতা থেকে রক্ষা করে ক্বোরআন-সুন্নাহ্র সহীহ আকাইদ ও আমল সম্পর্কে সচেতন করে তাদেরকে মজবুত আক্বীদা ও আমলের উপর এনে দাঁড় করিয়ে দিতে পারেন।
২. শায়খ আবদুল ক্বাদির জীলানী গাউসে পাকের মতো, শরীয়তের যাহেরী ও বাতেনী দিকগুলোতে সৃষ্ট পরিবর্তন ও দ্বী-মুখী আচরণকে খতম করে প্রকৃত ইসলামী রূহানিয়াৎ কায়েম করবেন।
৩. হযরত মুজাদ্দিদ আলফে সানীর মতো তথাকথিত ‘দ্বীনে ইলাহী’র মতো নতুন বাতিল ধর্মের পূর্ণাঙ্গভাবে জ্ঞানগত ও সেটার কুফলগত দিকগুলো চিহ্ণিত করে, সমস্ত নব সৃষ্ট ভিত্তিহীন কাজ ও প্রথার অবসান ঘটাতে পারেন।
৪. উপমহাদেশের মুসলমানদেরকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবন ও দ্বীনী মর্যাদাদির সংরক্ষণের জন্য চিন্তাগত ও দৃষ্টিভঙ্গিগত দিক-নির্দেশনা দিতে সক্ষম এবং
৫. ভারতীয় মুসলমানদেরকে অন্য বাতিল ধর্ম ও জোরে শোরে প্রচারিত খ্রিষ্টধর্মের বিরুদ্ধে জ্ঞানগত ও কর্মগতভাবে প্রস্তুত করতে পারেন।
সুতরাং এমন পরিস্থিতি ও অবস্থায় শুধু ইমাম আহমদ রেযাকেই নির্ভুল ও সফল বিপ্লব আনয়নকারী হিসেবে দেখতে পাই; যিনি এ গুরু দায়িত্ব অতি সুন্দরভাবে পালন করেছেন। তিনি ক্বোরআন-হাদীসের আলোকে যেসব অইসলামী আক্বাইদেরও খন্ডন ও অইসলামী কার্যাদি প্রতিহত করার আজীবন চেষ্টা করেছেন সেগুলোর কিছুটা নিম্নে প্রদত্ত হলো-
১. এক শ্রেণীর মানুষ বলছে, আল্লাহ্ মিথ্যা তথা অন্যান্য পাপ কার্যাদি করতে সক্ষম। (না‘ঊযুবিল্লাহ্)
২. আল্লাহর জ্ঞান তাঁর ইচ্ছার উপর মওকূফ। (নাঊযুবিল্লাহ্)
৩. নবীর অবস্থান গ্রামের চৌধুরী কিংবা জমিদারের মতোই। (আল্লাহরই পানাহ্)
৪. নবী আলায়হিস্ সালামকে বড় ভাইয়ের সমতুল্য মর্যাদা দিতে হবে। (মা‘আযাল্লাহ্!)
৫. খাতামুন্নবিয়্যীনের মতো আরো শেষ নবী হওয়া সম্ভব। (নাউযুবিল্লাহ্)
৬. রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ইলমে গায়ব অস্বীকার করা।
৭. ওফাতের পর নবীর হায়াতকে অস্বীকার করা। (না‘ঊযুবিল্লাহ্)
৮. নবী-ই পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর রওযা-ই পাকের যিয়ারতের জন্য হাযির হওয়াকে শির্ক সাব্যস্ত করা।
৯. নবী-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি সম্মান ও আদব প্রদর্শন করাকে শির্ক সাব্যস্ত করা।
১০. রসূলে পাকের স্মরণ ও মীলাদ মাহফিল করাকে বিদ‘আত সাব্যস্ত করা।
১১. রসূলে পাকের ওসীলা অবলম্বন করাকে শির্ক সাব্যস্ত করা।
১২. রসূল-ই পাকের ইলমকে আম ইনসান, এমনকি শিশু, পাগল ও চতুষ্পদ জন্তুর জ্ঞানের সমতুল্য সাব্যস্ত করা।
১৩. অভিশপ্ত শয়তানের ইলমকে নবী-ই আকরামের ইলম থেকে বেশী বলে প্রমাণ করার অপচেষ্টা চালানো।
১৪. খতমে নুবূয়তের পরও কোন নবীর আগমন সম্ভব বলে কল্পনা করা।
১৫. নবীগণের অবমাননাকে তাওহীদের মহত্ব বলে বর্ণনা করা।
১৬. হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম জীবিত-এ কথা অস্বীকার করে তাঁর মৃত্যু (ওফাত) হয়ে গেছে বলে প্রমাণ করার অপচেষ্টা চালানো।
১৭. রসূলে পাকের খেয়াল নামাযে এসে যাওয়াকে গরু-গাধার খেয়ালে নিমজ্জিত হওয়ার চেয়েও নিকৃষ্ট এবং জঘন্য বলে সাব্যস্ত করা। নাউযুবিল্লাহ্! ইত্যাদি ইত্যাদি।
এ হলো তাওহীদ ও রিসালত সম্পর্কে আক্বাইদকে পরিবর্তন করার ওই তুফান, যা ইংরেজদের তৈরীকৃত পথভ্রষ্ট ধর্মীয়, ফির্ক্বাগুলো প্রবাহিত করেছে। এসব অ-ইসলামী আক্বাইদকে তাওহীদ ও সুন্নাতের আড়ালে রচনাকারী ও প্রসারকারী হলো উপমহাদেশের কিছু চিহ্ণিত ব্যক্তি।
পক্ষান্তরে, বদ আক্বীদা ও পথভ্রষ্ঠতার এ তূফানের মোকাবেলা একাই ইমাম মুজাদ্দিদ আহমদ রেযা বেরলভী করেছেন। ফলে এ উপমহাদেশের মুসলমানদের ইমান-আক্বীদা নিরাপদ হয়ে গেছে। শুধু উপরোক্ত বদ-আক্বীদাগুলোর খন্ডনে ইমাম আহমদ রেযা এক শত তেতাল্লিশটা প্রামাণ্য ও অকাট্য কিতাব রচনা করেছেন। অন্য সব বিষয়ে তাঁর সহস্রাধিক গ্রন্থ-পুস্তকের কথা সবার জানা কথা। তদুপরি, তিনি অগণিত উপযুক্ত উত্তরসূরী তৈরী করে গেছেন, যাঁরা তাঁর পদাঙ্ক অনুকরণ করে বিশাল খিদমত আঞ্জাম দেন। তাঁর রাজতৈনিক চিন্তাধারাও এক্ষেত্রে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

লেখক: মহাপরিচালক, আনজুমান রিসার্চ সেন্টার, চট্টগ্রাম।