ইমাম-ই আ’যম আবূ হানীফা
ইমাম-ই আ’যম আবূ হানীফা
মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান
ইমামুল আইম্মাহ্, সাইয়্যেদুল ফুক্বাহা, যাকিয়্যুল উম্মাহ্, রা’সূল আত্কিয়া, মুজাহিদ-ই কবীর ইমাম-ই আ’যম আবূ হানীফা নো’মান ইবনে সাবিত আল্-কূফী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র মধ্যে বিশ্ব¯্রষ্টা অনেক গুণ, বৈশিষ্ট্য ও কল্যাণ গচ্ছিত রেখেছেন। এ নিবন্ধে আমি ইমামে আ’যমের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের সাথে ইল্মে হাদীসে তাঁর উচ্চ মর্যাদাও সপ্রমাণ বর্ণনা করার প্রয়াস পাবো, যাতে প্রত্যেক সঠিক বিবেচনার অধিকারী সহীহ হাক্বীক্বত (আসল বাস্তবতা) সম্পর্কে জানতে পারে এবং পক্ষান্তরে পক্ষপাতদুষ্ট ও ভুল পথের পথিকগণের মিথ্যা প্রপাগন্ডা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আল্লাহর নেক ও পবিত্রাত্মা বান্দাদের শত্রুতা অবলম্বন বা পোষণ করে ‘আল্লাহর সাথে যুদ্ধ’-এর শিকার হয়ে কেউ যেন নিজের পরকালকে বরবাদ না করে বসে।
প্রাথমিক পরিচয়
ইমাম আবূ হানীফা নো’মান ইবনে সাবিত ৮০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। নো’মান নাম, আবূ হানীফা কুনিয়াৎ, ইমামে আ’যম লক্বব (উপাধি)। হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র খিলাফতকালে তাঁর দাদা ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য হন। তাঁর ইসলামী নাম নো’মান রাখা হয়েছিলো। তিনি তাঁর জন্মভূমি থেকে হিজরত করে ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানী কূফায় চলে যান। সেখানে হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর দরবারে হাযির হন। সেখানে তিনি মাওলা আলীর দরবারে আপন জন্মভূমির প্রসিদ্ধ বস্তু ‘ফালুদা’ হাদিয়া স্বরূপ পেশ করেন এবং নিজের সন্তান সাবিতের জন্য দো‘আ প্রার্থনা করলেন। হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাঁর মঙ্গলের জন্য দো‘আ করলেন। সাবিত যখন পঁয়তাল্লিশ বছরের হলেন, তখন তাঁকে আল্লাহ্ তা‘আলা, ৮০ হিজরী সনে, এক বরকতময় সন্তান দান করলেন। দাদার নামে তাঁর নাম রাখা হলো। তাঁর বয়স যখন ১২ কিংবা ১৩ বছর হলো, তখন হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র পবিত্র দরবারে হাযির হন। ১৭ বছর বয়সে তিনি ইলম হাসিল করার প্রতি মনোনিবেশ করলেন। তিনি ১০০ হিজরীতে ইমাম হাম্মাদের দরসগাহে হাযির হন। যতদিন ওস্তাদ মহোদয় ইমাম হাম্মাদ জীবদ্দশায় ছিলেন তিনি (প্রায় বিশ বছর) তাঁর নিকট থেকে জ্ঞানার্জন করতে থাকেন। ইমাম হাম্মাদ ছাড়াও ইমামে আ‘যম আরো অনেক প্রসিদ্ধ ওস্তাদ থেকে জ্ঞানার্জন করেন। তাঁদের মধ্যে ইমাম জা’ফর সাদিক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু অন্যতম।
ইমাম-ই আ’যম ইলমে হাদীসে ‘মুকাস্সির’ পর্যায়ের ছিলেন
রঈসুল মুহাদ্দিসীন, শায়খুল ইসলাম সুফিয়ান ইবনে ওয়ায়নাহ্ বলেন, সর্বপ্রথম যেই মহান ব্যক্তি আমাকে ‘মুহাদ্দিস’ বানিয়েছেন, তিনি হলেন ইমাম আবূ হানীফা। মুহাম্মদ ইবনে সাম্মা‘আহ্ বলেন, ইমাম আবূ হানীফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু নিজের লেখনীগুলোতে (অর্থাৎ ওইসব মাসআলায়, যেগুলো তিনি তাঁর শীষ্যদের দ্বারা লিপিবদ্ধ করাতেন) সত্তর হাজারেরও বেশী হাদীস উল্লেখ করেছেন। আর নিজের কিতাব ‘আল-আ-সার’-এ চল্লিশ হাজার হাদীস লিপিবদ্ধ করেছেন। হাফেযুল হাদীস, মুহাদ্দিস-ই কবীর ইয়াহিয়া ইবনে মু‘ঈন বলেছেন, ‘‘আমি এমন কোন মানুষ দেখিনি, যাকে আমি মুহাদ্দিস ওয়াকী’ ইবনুল র্জারাহ্’র উপর প্রাধান্য দিতে পারি। এ মুহাদ্দিস ওয়াকী’ ইমাম আবূ হানীফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র অভিমত অনুসারে ফাত্ওয়া দিতেন এবং তাঁর নিকট থেকে হাদীস শুনেছেনে। এ’তে প্রমাণিত হয় যে, ইমাম-ই আ’যম ‘মুকাস্সির ফিল হাদীস (مكثر فى الحديث) ছিলেন। তিনি নিঃসন্দেহে তেমন ছিলেন না, যেমনি কিছু সংখ্যক অবিবেচক পক্ষপাতদুষ্ট লোক মনে করে থাকে; তারা বলে বেড়ায় ইমাম-ই আ’যম নাকি শুধু ১৬ কিংবা ১৭টি হাদীস জানতেন।
ইবনে ক্বাইয়্যেম তার কিতাব ‘ই’লামুল মুআক্বক্বি‘ঈন’-এ লিখেছেন, ইমাম বোখারীর অন্যতম শায়খ ইয়াহিয়া ইবনে আদম বলেছেন, ইমাম আবূ হানীফা নো’মান তাঁর শহরের ইল্মে হাদীসের সমস্ত আলিম থেকে হাদীস সমূহ সংকলন করেছিলেন। [মুক্বাদ্দামাহ্-ই ই’লাউস্ সুনান: পৃষ্ঠা- ১৯২]
মুহাক্বক্বিক্ব আলিমদের দৃষ্টিতে ইমামে আ’যম
* শায়খুল ইসলাম ইবনে আবদুল বার মালেকী লিখেছেন- وَرَوٰى حَمَّادُبْنُ زَيْدٍ مِنْ اَبِىْ حَنِيْفَةَ اَحَادِيْثَ كَثِيْرَةً-
অর্থাৎ: হযরত হাম্মাদ ইবনে যায়দ ইমাম আবূ হানীফা থেকে ‘অনেক’ হাদীস বর্ণনা করেছেন। [আল ইন্তিফা: পৃষ্ঠা- ১৩০] যদি ইমাম আ’যমের নিকট হাদীস না থাকতো কিংবা খুব কম সংখ্যক হাদীস থাকতো, তবে হযরত হাম্মাদ ইবনে যায়দ তাঁর নিকট থেকে ‘অনেক’ হাদীস কীভাবে বর্ণনা করেছেন?
* ইমাম ওয়াক্বী’ ইবনুল জাররাহ্ (ওফাত ১৯৭ হিজরী), যিনি ইমাম ও হাফেযুস্ সাবাত এবং ইরাকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ছিলেন, বলেছেন-
لَقَدْ وُجِدَ الْوَرْعُ عَنْ اَبِىْ حَنِيْفَةَ فَى الْحَدِيْثِ مَالَمْ يُوْجَدْ عَنْ غَيْرِه-
অর্থ: নিঃসন্দেহে ইমাম আবূ হানীফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হাদীসে এমন সতর্কতা অবলম্বন করেছেন, যেমন সতর্কতা অন্য কারো মধ্যে পাওয়া যায়নি।
* মুহাদ্দিস ইবনে আদী (ওফাত ৩৬৫ হি.) ইমাম আসাদ ইবনে আমর রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি (ওফাত ১৯০ হি.)-এর জীবনীতে লিখেছেন-
وَلَيْسَ فِىْ اَصْحَابِ الرَّاىِ بَعْدَ اَبِىْ حَنِيْفَةَ اَكْثَرَ حَدِيْثًا مِنْهُ-
অর্থ: আসহাব-ই রায় অর্থাৎ ফক্বীহগণের মধ্যে ইমাম আবূ হানীফার পর আসাদ ইবনে আমর অপেক্ষা বেশী হাদীস অন্য কারো কাছে ছিলো না।
[লিসানুল মীযান: ১ম খন্ড: পৃষ্ঠা-৩৩৪, কৃত- আল্লামা ইবনে হাজর আসক্বালানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি]
তাছাড়া, আল্লামা ইবনে সাওর আসাদ ইবনে আমর, ইমাম সদরুল আইম্মাহ্ মক্কী হানাফী, ইমাম মক্কী ইবনে ইবরাহীম, আল্লামা খতীব-ই বাগদাদী প্রমুখ নির্দ্বিধায় বলেছেন, ইমাম আবূ হানীফা থেকে প্রচুর হাদীস বর্ণিত হয়েছে। মুহাদ্দিসে জলীল ইয়াযীদ ইবনে হারূন, ইমামুল জারহি ওয়াত্ তা’দীল ইয়াহিয়া ইবনে সা‘ঈদ আল-ক্বাত্তান এবং মোল্লা আলী ক্বারীও একই কথা বলেছেন।
অতি অশ্চর্যের কথা হচ্ছে- ইমাম আবূ হানীফা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি সত্তর হাজারের অধিক হাদীস তাঁর বিভিন্ন লেখনীতে বর্ণনা করেছেন, চল্লিশ হাজার হাদীস দ্বারা ‘কিতাবুল আসার’কে সমৃদ্ধ করেছেন। এতদ্ সত্ত্বেও পক্ষাপাত দুষ্ট লোকেরা বলছে, ইমাম আবূ হানীফা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি হাদীস শাস্ত্রে ইয়াতীম ছিলেন। তাঁর থেকে শুধু ১৭টি হাদীস বর্ণিত। এটা কি পরিমাণ মহা জুল্ম ও অবিবেচকের পরিচায়ক?
ইমাম-ই আ’যম তাবে’ঈ ছিলেন
প্রসিদ্ধ ইতিহাসবিদ মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক ইবনে নদীম বলেন,
وَكَانَ مِنَ التَّابِعِيْنَ لَقِىْ عِدَّةً مِّنَ الصَّحَابَةِ وَكَانَ مِنَ الْوَرِعِيْنَ وَ الزَّاهِدِيْنَ-
অর্থ: ইমাম আবূ হানীফা তাবে‘ঈদের মধ্যে গণ্য হতেন। কেননা, তিনি কয়েকজন সম্মানিত সাহাবীর সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। তিনি অত্যন্ত পরহেযগার ও দুনিয়ার মোহত্যাগী বুযুর্গদের অন্যতম ছিলেন। হযরত মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী (ওফাত ১০১৪ হি.) লিখেছেন, জমহুর (প্রায় সব) মুহাদ্দিস আলিম বলেছেন, সাহাবীর শুধু সাক্ষাৎ পেলেই মানুষ তাবে‘ঈ হয়ে যায়, তার জন্য দীর্ঘদিনের সঙ্গ বা সান্নিধ্য এবং হাদীস বর্ণনা করা পূর্বশর্ত নয়।
[যায়নুল জাওয়াহির: ২য় খন্ড: পৃষ্ঠা- ৪৫২] শীর্ষস্থানীয় মুহাদ্দিসীন-ই কেরাম, যেমন- ইমাম খতীব-ই বাগদাদী, ইমাম ইবনে আবদুল বার, আল্লামা যাহাবী ও হাফেজ ইবনে হাজর প্রমুখ লিখেছেন- হযরত ইমাম আবূ হানীফা আলায়হির রাহমাহ্ যে সাহাবীদেরকে দেখেছেন তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
‘ফাতাওয়া-ই র্দুরুল মুখতার’-এ লিখা হয়েছে যে, ইমাম আবূ হানীফা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির যমানায় বিশজন সাহাবী মওজুদ ছিলেন। আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ আমীন ইবনে আবেদীন শামী তাঁদের নামও লিখে দিয়েছেন। ‘র্দুরে মুখতার’-এ একথা উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইমাম-ই আ’যম আটজন সাহাবী থেকে হাদীসও বর্ণনা করেছেন। তাঁরা হলেন- ১. হযরত আনাস, হযরত জাবির, ৩. হযরত আবুত্ব ত্বোফায়ল, ৪. হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে উনায়স জুহফী, ৫. হযরত ওয়াসিলাহ্, ৬. হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনুল হারস ইবনে জুয এবং ৮. হযরত আয়েশা বিনতে ‘আজয মহিলা সাহাবী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম ও আনহা।
‘ফাতাওয়া-ই র্দুরুল মুখতারে’ উল্লেখ করা হয়েছে- ইমাম আবূ হানীফা নো’মান ইবনে সাবিত হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর এক বৃহত্তর মু’জিযা।
সুসংবাদ
হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এক বিশেষ সময়ে হযরত সালমান ফারসী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র মাথায় হাত মুবারক রেখে এরশাদ করেন-
لَوْكَانَ الاِيْمَانُ/لَوْكَانَ الدِّيْنُ/لَوْكَانَ الْعِلْمُ عِنْدَ الثُّرَيَّا لَنَالَه رِجَالٌ / رَجُلٌ مِنْ هؤُلَاءِ /لَذَهَبَ بِه رَجُلٌ مِّنْ فَارِسَ اَوْقَالَ مِنْ اَبْنَاءِ فَارِسَ حَتّٰى يَتَنَا وَلَه-
অর্থ: যদি ঈমান অথবা দ্বীন অথবা ইল্ম সুরাইয়া নক্ষত্র (ধ্রুবতারা)-এর নিকট পৌঁছে যায়, তবে কতিপয় পুরুষ অথবা একজন পুরুষ এ পারস্য- বংশোদ্ভূতদের থেকে, সেটাকে পেয়ে যাবে।
এ হাদীসের ব্যাখ্যা
রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর এ এরশাদ হযরত ইমাম আবূ হানীফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র বেলায়ও প্রযোজ্য হতে পারে। সুতরাং ইমাম জালাল উদ্দীন সুয়ূতী শাফে‘ঈ (ওফাত ৯১১ হি.) লিখেছেন, ‘‘আমি বলছি যে, হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এ হাদীস শরীফে ইমাম আবূ হানীফা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি-এর সুসংবাদ দিয়ছেন।’’
ইমাম ইবনে হাজর মক্কী শাফে‘ঈ লিখেছেন, হাফেয, মুহাক্বক্বিক্ব জালাল উদ্দীন সুয়ূতী শাফে‘ঈ বলেন, ইমাম আবূ হানীফার সুসংবাদ ও পূর্ণাঙ্গ ফযীলতের জন্য এটা একটা সহীহ ও নির্ভরযোগ্য প্রমাণ। (তার পর বলেছেন) ইমাম সুয়ূত্বীর কোন শাগরিদ বলেছেন, আমাদের ওস্তাদ ও শায়খ পূর্ণ নিশ্চয়তা ও দৃঢ়তার সাথে বলেছেন- ইমাম আবূ হানীফার কথাই এ হাদীস শরীফে বুঝানো হয়েছে। সুতরাং এটা একটা একেবারে প্রকাশ্য কথা, এতে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই।
[সূত্র: আল খায়রাতুল হিসান: ১ম খন্ড: পৃষ্ঠা- ১৩] হযরত শাহ্ আহমদ ইবনে আবদুর রহীম অর্থাৎ শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ্ মুহাদ্দিসে দেহলভী হানাফী (ইন্তিকাল ১১৭৬টি) তাঁর এক মাকতূব (চিঠি)-এ লিখেছেন, ইমাম আবূ হানীফা এ হাদীসের অন্তর্ভুক্ত, আল্লাহ্ তা‘আলা ফিক্বহ শাস্ত্রকে তাঁর মাধ্যমে প্রসারিত করেছেন।
[কলেমাতে তৈয়্যবাত ও ইযালাতু খিফা: ১ম খন্ড ইত্যাদি] নবাব সিদ্দীক্ব হাসন খান সাহেব, আহলে হাদীসের নেতা, লিখেছেন- বিশুদ্ধ অভিমত হচ্ছে ইমাম আবূ হানীফা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি উপরোক্ত হাদীসের অন্তর্ভুক্ত এবং পারস্য বংশোদ্ভুত সফল মুহাদ্দিসও। [ইত্তেহাফুল নুবালা]
ইমাম সাহেবের তিলাওয়াত-ই ক্বোরআন
তিনি রাতে পূর্ণ ক্বোরআন এক রাক‘আত নামাযে পড়ে ফেলতেন। তিনি যেখানে ইনতিকাল করেছেন সেখানে ক্বোরআন শরীফের সাত হাজার পূর্ণাঙ্গ খতম করেছিলেন। ক্বাওয়া-‘ইদুল জাওয়াহির’-এ উল্লেখ করা হয়েছে যে, হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মুবারক মুহাদ্দিস ও আরিফ বিল্লাহ্ বলেছেন, চারজন ইমাম এক রাক‘আত নামাযে পূর্ণ ক্বোরআন খতম করেছেন- ১. ইসলামের তৃতীয় খলীফা হযরত ওসমান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, ২. হযরত তামীম-ই দারী, ৩. হযরত সা‘ঈদ ইবনে জুবায়র এবং ৪. ইমাম-ই আ‘যম আবূ হানীফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম। ইমাম সাহেব রমযান মাসে ৬১ বার ক্বোরআন খতম করতেন। সেগুলোর মধ্যে এক খতম দিনে, এক খতম রাতে এবং এক খতম তারাবীহ্র নামাযে।
ইমাম আবূ হানীফার দিয়ানত (ধার্মিকতা)
ইমাম ওয়াকী’ ইবনুল র্জারাহ্ বলেন, আমি ইমাম সাহেবের নিকট মওজুদ ছিলাম। ইত্যবসরে এক মহিলা রেশমী কাপড় নিয়ে আসলো। আর বলতে লাগলো, ‘‘এ কাপড় আপনি বেচে দিন! ইমাম সাহেব বললেন, ‘‘কত টাকায়।’’ সে বললো, ‘‘একশ’ টাকায়।’’ তিনি বললেন, ‘‘এটার দামতো একশত টাকা অপেক্ষা বেশী।’’ তার পর বললেন, ‘‘বল কত দামে এ কাপড় বেচবো?’’ সে একশ’ থেকে কিছু বেশী নির্দ্ধারণ করলো। শেষ পর্যন্ত সে চারশত টাকা পর্যন্ত দাম বললো। ইমাম সাহেব বললেন, ‘‘সেটার দাম তদপেক্ষাও বেশী। সে বলতে লাগলো, ‘‘আপনি আমার সাথে ঠাট্টা করবেন না। ‘‘ইমাম-ই আ’যম বললেন, ‘‘সত্যি এটার দাম তদপেক্ষাও বেশী।’’ সুতরাং ওই কাপড়ের সঠিক দাম পাঁচশত টাকা নির্দ্ধারণ করা হলো। আর সেও তা তত টাকায় বিক্রি করলো। এ’তে ইমাম আ’যমের ধর্ম পরায়ণতার প্রমাণ মিলে।
ইমাম আ’যমের আমানতদারী
হযরত সুফিয়ান ইবনে ওয়াকী’ বলেন-
كَانَ اَبُوْ حَنِيْفَةَ عَظِيْمَ الْاَمَانَةِ-
অর্থাৎ: ইমাম আবূ হানীফা খুব বড় আমানতদার ছিলেন। যখন ইমাম-ই আ’যমের ওফাত (শাহাদত) হলো, তখন তাঁর ঘরে মানুষের পাঁচ কোটি টাকার আমানত মওজুদ ছিলো।
ইমাম আ’যমের হজ্জ পালন ও মহান রবের সুসংবাদ
‘ফাতাওয়া-ই দুররে মোখতার’-এ লিখা হয়েছে যে, ইমাম-ই আ’যম ৫৫ বার হজ্জ করেছেন। সর্বশেষ হজ্জের সময় কা’বা-ই মু‘আয্যমার খাদিমদের থেকে এক রাতের অনুমতি নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেন। আর বায়তুল্লাহ্র দু’টি স্তম্ভের মধ্যভাগে ডান পায়ের পিঠের উপর বাম পা রেখে দণ্ডায়মান হলেন। পূর্ণ ক্বোরআন খতম করেছেন। তাপর খুব কান্না করলেন এবং আপন রবের দরবারে মুনাজাত করলেন- ‘‘হে সমস্ত জগতের ইলাহ্! এ দুর্বল বান্দা যেভাবে তোমার ইবাদত করেছে, তা তোমার উপযোগী হয়নি। কিন্তু তোমাকে তোমার মহত্বের গুণাবলী সহকারে বিশ্বাস করেছি, যেভাবে তোমার প্রতি বিশ্বাস করার হক্ব রয়েছে। এখন তুমি তার ইবাদতের ত্রুটিগুলোকে তার পূর্ণ পরিচিতির কারণে ক্ষমা করে দাও! অর্থাৎ তার পূর্ণাঙ্গ মা’রিফাতকে ইবাদতের ত্রুটির কাফ্ফারা করে দাও।’’ এরপর বায়তুল্লাহ্ শরীফের এক কোন্ থেকে এ অদৃশ্য আওয়াজ আসলো- ‘‘হে আবূ হানীফা! তুমি আমাকে যেমন উচিৎ তেমনিভাবে জেনেছো! যেই ইবাদত তুমি আমার করেছো, অতি উত্তমভাবেই করেছো। এখন আমি তোমাকে আর যেসব মানুষ ক্বিয়ামত পর্যন্ত তোমার মাযহাবের উপর থাকবে, সবাইকে ক্ষমা করে দিলাম।’’
ইমাম আবূ হানীফার দৃঢ়তা
উমাইয়া বংশের সর্বশেষ বাদশাহ্ মারওয়ান ইবনে মুহাম্মদ আল-হিসার (মৃত্যু ১৩২ হি.)-এর শাসনামলে ইরাকের যালিম গভর্ণর ইয়াযীদ ইবনে আমর ইবনে হুবায়রাহ্ রাজনৈতিকভাবে নিজের ক্ষমতাকে আরো মজবূত করার এবং জনগণের সাহায্য সহযোগিতা অর্জনের জন্য প্রধান বিচারকের পদ গ্রহণের প্রস্তাব পেশ করা জরুরী মনে করলো। কিন্তু ইমাম-ই আ’যম ওই সময়ের সরকারের জোর-যুল্মের কারণে ওই পদ গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন। ইবনে হুবায়রাহ্ এ অস্বীকারের কারণে ইমাম-ই আ’যমকে ১১০টি কষাঘাত করার তথাকথিত শাস্তি নির্দ্ধারণ করলো। প্রতি দিন দশটি করে এ কষাঘাত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো। ইমাম-ই আ’যমকে প্রথমে কুফার বিচারক নিয়োগ করার প্রস্তাব করেছিলো, তারপর ‘‘ক্বাযীউল ক্বুযাত’’ (চীফ জাস্টিজ)-এর পদ পেশ করা হলো, ইমাম-ই আ’যমকে কয়েকদিন বন্দী রেখে এ পদ গ্রহণের জন্য চাপ সৃষ্টি করা হলো। কিন্তু তিনি তা গ্রহণে সম্পূর্ণ অস্বীকার করলেন। উল্লেখ্য প্রধান বিচারকের পদের সাথে সাথে বায়তুল মালের দায়িত্বও তাঁকে প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিলো। কিন্তু তিনি কোনটাই গ্রহণ করতে রাজি হননি। ইবনে হুবায়রাহ্ (গভর্ণর) শপথ করে ছিলো যে, এ পদ গ্রহণে রাজি না হলে তাঁর মাথার উপর বিশটা কষাঘাত করা হবে। কিন্তু তিনি দৃঢ়তার হিমালয় হয়ে রইলো। তিনি কো মতেই- তা গ্রহণে রাজি হলেন না। ইমাম আ’যম বলেছিলেন ইবনে হুবায়রার পার্থিব নির্যাতন আমার জন্য আখিরাতের হাতুড়ি ও গাদার আঘাতের চেয়ে অনেক সহজ হবে। তাই তিনি বলেছিলেন, ‘‘তাঁকে এজন্য হত্যা করা হলেও তিনি ওই পদ গ্রহণ করবেন না।’’ একদিকে তাঁকে রাজি করানোর জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা করা হলো, অন্যদিকে জেলখানায় তাঁর প্রতি নির্যাতনের নানা ধরনের ষ্টীম রোলার চালানোরও ব্যবস্থা করা হলো। শাসক গোষ্ঠীর যুল্ম-অত্যাচারের মাত্রা এতটুকু পৌঁছেছিলো যে, তাঁর খাদ্যে বিষ প্রয়োগ করা হলো। আর ওই বিষ তাড়াতাড়িতাঁর শরীরে ছড়িয়ে পড়ার জন্য তাঁর শরীরের উপর আঘাতের পর আঘাত করা হচ্ছিলো।
ইমাম-ই আ’যমের শাহাদত
আম ইতিহাস বেত্তাগণ লিখেছেন যে, ইমামে আ’যমের অজান্তে তাঁকে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিলো, কিন্তু বিশেষ বিশেষ ইতিহাস বেত্তাগণ লিখেছেন যে, যখন ইমাম-ই আ’যমের সামনে বিষ মাখা পানীয়ের পেয়ালা পেশ করা হলো, তখন তিনি তা পান করতে অস্বীকার করলেন আর বললেন, আমি জানি তাতে কি দেওয়া হয়েছে। সুতরাং আমি তা পান করে আত্মহত্যা করতে পারি না। সুতরাং তাঁকে মাটির উপর শায়িত করে জোরপূর্বক বিষ পান করানো হয়েছিলো। এর ফলে তাঁর ওফাত হয়েছিলো। ইন্না-লিল্লা-হি ওয়া ইন্না-ইলায়হি রাজেঊন। ১৫০ হিজরিতে তাঁর ওফাত হয়েছিলো।
প্রথমবার কমবেশী পঞ্চাশ হাজার মুসলমান তাঁর জানাযার নামায পড়েছিলো। আগমনকারী লোকের কাতার শেষ হচ্ছিলো না। ফলে ছয় বার তাঁর জানাযার নামায হয়েছিলো। বর্ণিত আছে যে, ওফাতের প্রাক্কালে তিনি সাজদা করেন। সাজদারত অবস্থায় তাঁর ওফাত হয়েছিলো। বাগদাদের কাযী (বিচারক) তাঁকে গোসল প্রদান করেন। ইবনে সাম্মাক বলেন, গোসল দেওয়ানোর পর আমি দেখেছি- তাঁর কপালের উপর নি¤œলিখিত আয়াত শরীফ লিপিবদ্ধ ছিলো-
يَاۤ اَيُّهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ ارْجِعِىْ اِلىٰ رَبِّكِ رَاضِيَةً مَّرْضِيَّةً فَادْخُلِىْ فِىْ عِبَادِىْ وَادْخُلِىْ جَنَّتِىْ-
তাঁর ডান হাতে লিপিবদ্ধ ছিলো- فَادْخُلُوْا الْجَنَّةَ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُوْنَ-
বাম হাতে লিখা ছিলো এ আয়াত- اِنَّا لَا نُضِيْعُ اَجْرَ مَنْ اَحْسَنَ عَمَلًا-
আর তাঁর পেটের উপর লিপিবদ্ধ ছিলো- يُبَشِّرُكُمْ رَبَّكُمْ بِرَحْمَةِ مِّنْهُ وَرِضْوَانٍ-
তারপর যখন জানাযা (কফীন) উঠানো হলো তখন আহ্বান আসলো- তোমার মুনিব তোমার জন্য জান্নাতে খুলদ ও দারুস্ সালামকে মুবাহ্ করে দিয়েছেন। তারপর যখন কবর শরীফে রাখা হলো তখন আহ্বান আসলো- فَرُوْحٌ وَّ رَيْحَانٌ وَ جَنَّةٌ نَّعِيْم-
তাঁর জানাযার নামায কাযী হাসান ইবনে ওমারাহ্ পড়িয়েছেন। এ থেকে ইমাম আ’যমের মহত্বাও আল্লার দরবারে অকল্পনীয় গ্রহণযোগ্যতার অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায়। সুতরাং আমরা, যারা ইমাম আ’যমের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধাশীল ও তাঁর মাযহাবের অনুসারী, অত্যন্ত ভাগ্যবান। আর যারা তাঁর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে তাদের দুর্ভাগ্য সম্পর্কে বলার অপেক্ষা রাখে না।
লেখক: মহাপরিচালক আনজুমান রিসার্চ সেন্টার, চট্টগ্রাম।