শ্রদ্ধার নয়নে চির অম্লান : আব্বা হযরত আল্লামা নঈমী
শ্রদ্ধার নয়নে চির অম্লান : আব্বা হযরত আল্লামা নঈমী
[রাহমাতুল্লাহি আলাইহি]
মুহাম্মদ কাসেম রেযা নঈমী
জন্ম তথ্য
বাংলাদেশের দক্ষিণ চট্টগ্রামে অবস্থিত প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী আনোয়ারা থানা। বহুকাল ধরে অসংখ্য ওয়ালী-বুযুর্গ, সুফী-দরবেশ’র সাধনাস্থল ও তাঁদের পবিত্র পদধুলিতে ইসলামী পরিবেশ দ্বারা মুখরিত ছিলো এ অঞ্চল। তাঁদেরই একজন প্রখ্যাত বুযুর্গু ওয়ালী-এ কামিল হযরত শাহ্ আসাদ আলী ফকীর (রহ.) কোন এক সময়ে এ অঞ্চলে আগমন করে বসতি স্থাপন করেন এবং স্থানীয়দের ইসলামী তাহযীব-তামাদ্দুন’র শিক্ষাদান করেন। তিনি নির্জনে ইবাদত বান্দেগী করতেন এবং সাপ্তাহিক জুম‘আ বারে ঘোড়ায় আরোহন করে স্থানীয় একটি মসজিদে এসে জুম‘আ’র নামায আদায় করতেন। পরবর্তীতে তিনি পরিবার-পরিজনকে রেখে (রিজালুল গায়ব রূপে) নিরুদ্দেশ হয়ে যান। শত চেষ্টা করেও পরিবার ও স্থানীয়দের কেউ তাঁর হদীস লাভ করতে পারেনি। পরবর্তীতে এ মহান সাধকের যোগ্য উত্তরসূরীগণ অত্র অঞ্চলের চাঁপাতলী গ্রামে বসবাস করে আসছেন। এ মহান সাধকেরই সুযোগ্য পৌত্র আশিক-এ রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইমাম-এ আহ্ল-এ সুন্নাত আল্লামা গাযী সায়্যিদ আযীযুল হক্ব শেরে-এ বাংলা (রহ.)’র অন্যতম মুরীদ মরহুম মুন্সী নূর আহমদ আল-ক্বাদিরী ও মরহুমা ছফূরা খাতুনের ঘরে আন্তার্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামী স্কলার সুন্নিয়্যাতের প্রাণ-স্পন্দন মুফতী-এ আহ্ল-এ সুন্নাত ক্বা’ইদ-এ আহ্ল-এ সুন্নাত শের-এ মিল্লাত হযরতুল আল্লামা আলহাজ¦ মুফতী মুহাম্মদ ওবাইদুল হক নঈমী (রহ.) ১৯৪৩ সনের ১১ মার্চ রোজ বৃহস্পতিবার জন্মগ্রহণ করেন। সম্পর্কের দিক দিয়ে মরহুমা ছফুরা খাতুন (আমার সম্মানিত দাদী) মরহুম মুন্সী নূর আহমদ আল- ক্বাদিরী (আমার সম্মানিত দাদা)-এর মামাতো বোন ছিলেন।
শৈশব কাল
আব্বা হযরত আল্লামা নঈমী (রহ.)’র বয়স যখন প্রায় সাড়ে চার বছর পূর্ণ হলো তখন তিনি স্বীয় পিতা মহোদয়ের তত্ত্বাবধানে স্থানীয় মকতবে প্রথমে পবিত্র আমপারা পাঠ সম্পন্ন করেন। এরপর পবিত্র কুরআনের নাযেরা পাঠ সমাপ্ত করেন। অত:পর তিনি একটি স্থানীয় মাদ্রাসায় শিশু স্তরে ভর্তি হোন। শৈশবকালে আব্বা হযরত (রহ.) পরম পাঠানুরাগী এবং অত্যন্ত ভদ্র ও সভ্য প্রকৃতির ছিলেন। তিনি ছয় বছর বয়সেই তাঁর সম্মানিতা মাতা (আমার সম্মানিতা দাদী) মরহুমা ছফূরা খাতুনকে হারান। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজি‘ঊন)।
শিক্ষা জীবন
আব্বা হযরত আল্লামা নঈমী (রহ.) যখন শিশু স্তরের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন তখন তাঁর সুযোগ্য পিতা আব্বা হযরত (রহ.) কে তৎকালীন প্রসিদ্ধ দ্বীনি শিক্ষা নিকেতন চট্টগ্রামস্থ পাঁচলাইশ ওয়াজেদিয়া আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করান এবং তিনি অত্র মাদ্রাসায় ১ম শ্রেণী থেকে পর্যায়ক্রমে ফাযিল স্তর পর্যন্ত নিয়মতান্ত্রিকভাবে দাখিল, আলিম ও ফাযিল কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন এবং সরকার কর্তৃক বৃত্তি লাভ করেন। কথিত আছে, তিনি মধ্যখানে চট্টগ্রাম পটিয়াস্থ শাহচাঁন্দ আউলিয়া আলিয়া মাদ্রাসায় কিছুকাল লেখাপড়া করেন। ফাযিল শিক্ষাসনদ লাভ করে ১৯৬২ সনে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের গুজারাটস্থ জামেয়া গাউসিয়া নঈমীয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে বিশ^বরেণ্য আলিম হাকীমুল উম্মাত মুফতী আহমদ ইয়ার খাঁন নঈমী (রহ.)’র সান্নিধ্যে প্রায় ৬ মাস পবিত্র হাদীস ও ফিক্হ শাস্ত্রের উপর ১ম কোর্স সমাপ্ত করেন। পরবর্তীতে ১৯৬৪ সনে পুনরায় তদানীন্তনকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের গুজরাট সফর করে একই মাদ্রাসায় একই বিষয়ের উপর আরো ৬ মাস লেখাপড়া করে চূড়ান্ত কোর্স সমাপ্ত করেন এবং ইলম-এ হাদীস ও ইলম-এ ফিক্হ’র উপর বিশেষ ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। অত:পর হাকীমুল উম্মত মুফতী আহমদ ইয়ার খাঁন নঈমী (রহ.)’র হাত মোবারক থেকে শিক্ষাসনদ লাভ করে “ নঈমী” উপাধীতে অভিষিক্ত হন। পরবর্তীতে স্বীয় দেশে ফিরে এসে ১৯৬৫ সনে ওয়াজেদিয়া আলিয়া মাদ্রাসা হতে কৃতিত্বের সাথে কামিল হাদীস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হোন। উল্লেখ্য, সে বছরই তাঁর পিতা (আমার সম্মানিত দাদা) মরহুম মুন্সী নূর আহমদ আল-ক্বাদিরী ইন্তিকাল করেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজি‘ঊন) পরবর্তী বছর ১৯৬৬ সনে আব্বা হযরত (রহ.) তাঁরই পরম শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষাগুরু ও ওয়াজেদিয়া মাদ্রাসার সুযোগ্য প্রিন্সিপাল হযরতুল আল্লামা আতিকুল্লাহ খাঁন (রহ.) ঢাকার বখশিবাজারস্থ সরকারী মাদ্রাসা-ই আলিয়ায় কামিল ফিকহ্ বিভাগে ভর্তি করান। অত্র মাদ্রাসায় তিনি তাঁর কয়েকজন পরম শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষাগুরুর বিশেষ সান্নিধ্য লাভে ধন্য হোন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন- ১. মাদ্রাসার শায়খুল হাদীস ও তৎকালীন ঢাকার ‘বায়তুল মুর্কারাম’ জাতীয় মসজিদের খতীব হযরতুল আল্লামা মুফতী সায়্যিদ আমিমুল ইহসান মুজাদ্দিদি বারাকাতী (রহ.), ২. সুদুর চীন দেশের অর্ন্তগত “কাশগার” অঞ্চল থেকে আগত আরবী সাহিত্যিক ও কবি হযরতুল আল্লামা শায়্খ আব্দুর রহমান কাশগারী (রহ.)। এ সকল হাযরাতের বিশেষ সান্নিধ্যে থেকে আব্বা হযরত (রহ.) অত্র মাদ্রাসা হতে অত্যন্ত সুনামের সাথে কামিল ফিক্হ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। অত:পর অত্র মাদ্রাসায় প্রায় ৬ মাস উর্দু ভাষার উপর ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন।
কর্মজীবন
১৯৬৬ সনে আব্বা হযরত আল্লামা নঈমী (রহ.) স্বীয় পরম শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষাগুরু প্রিন্সিপাল হযরতুল আল্লামা আতিকুল্লাহ খাঁন (রহ.)’র নির্দেশে উর্দু ভাষার ডিপ্লোমা কোর্স সমাপ্ত করে সুদূর ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ফিরে এসে ওয়াজেদিয়া আলিয়া মাদ্রাসায় সিনিয়র শিক্ষক পদে যোগদান করার মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা করেন এবং প্রায় এক বছর অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পাঠদান করেন। ইত্যবসরে তাঁর জ্ঞানের সুনাম সবত্র ছড়িয়ে পড়ে। বর্ণিত আছে, পরবর্তী বছর ১৯৬৭ সনে তাঁরই পরম শ্রদ্ধাভাজন আরেক শিক্ষাগুরু চট্টগ্রাম জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদ্রাসার প্রথম সুযোগ্য প্রিন্সিপাল হযরতুল আল্লামা জনাব ওয়াকারুদ্দিন রিজভী ক্বাদিরী (রহ.) তাঁকে ইমাম-এ আহল-এ সুন্নাত আল্লামা গাযী আযীযুল হক্ব শেরে বাংলা (রহ.)’র নূরানী হাতে প্রতিষ্ঠিত হাটহাজারীস্থ আজিজিয়া অদুদিয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসার মুহাদ্দিস পদে নিয়োগ দান করেন। তিনি মুহাদ্দিস পদে দায়িত্ব লাভ করার পর পাঠদানে অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছিলেন। উল্লেখ্য অত্র মাদ্রাসা সে সময়ে “কামিল হাদীস” স্তর পর্যন্ত উন্নীত ছিলো। পরবর্তী ১৯৬৮ সনে শাহানশাহ-এ সিরিকোট কুতুবুল আউলিয়া আল-এ রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম) হযরতুল আল্লামা হাফিয ক্বারী সায়্যিদ আহমদ শাহ সিরিকোটি (রহ.)’র বরকত মন্ডিত হাতে প্রতিষ্ঠিত এশিয়াখ্যাত সুন্নী দ্বীনি শিক্ষা নিকেতন চট্টগ্রাম জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসা’র সুযোগ্য প্রিন্সিপাল আল্লামা নসরুল্লাহ খাঁন ক্বাদিরী আফগানী (রহ.)’র বিশেষ অনুরোধে এবং গাউস-এ যামান মুরশিদ-এ বরহক্ব আল-এ রসূল হযরতুল আল্লামা হাফিয ক্বারী সায়্যিদ মুহাম্মদ তায়্যিব শাহ (রহ.)’র অন্যতম খলীফা জনাব নূর মুহাম্মদ আল-ক্বাদিরী (রহ.)’র মাধ্যমে জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষক পদে যোগদান করেন। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে “শায়খুল হাদীস” পদে উন্নীত হয়ে ইন্তিকাল অবধি ন্যায়-নিষ্ঠা ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে খিদমত আঞ্জাম দিয়ে যান। তবে মধ্যখানে ১৯৮০ সনে পটিয়াস্থ শাহচাঁন্দ আউলিয়া আলিয়া মাদ্রাসায় এক বছর অধ্যাপনায় নিয়োজিত ছিলেন এবং সে বছরই তাঁর অনন্য প্রচেষ্টায় ওই মাদরাসায় কামিল হাদীসের ক্লাস চালু হয়। পরবর্তীতে স্বীয় পীর ও মুরশিদ গাউস-এ যামান আল-ই রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম) মুরশিদ-এ বরহক্ব আল্লামা হাফিয ক্বারী সায়্যিদ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ (রহ.)’র নির্দেশে পুনরায় জামেয়ার খিদমতে আত্মনিয়োগ করেন। সর্বশেষ তিনি ২০০৮ সনে সরকারীভাবে অবসর গ্রহণ করেন। অবসর গ্রহণ করলেও বর্তমান হুযুর ক্বিবলা মুরশিদ-এ বরহক্ব হযরতুল আল্লামা সায়্যিদ মুহাম্মদ তাহির শাহ (মুদ্দাজিল্লুহুল আলী) এই মর্মে নির্দেশ প্রদান করেন, “সরকারীভাবে নঈমী সাহেব অবসর গ্রহণ করলেও হযরাত-এ কিরাম তাঁকে অব্যাহতি প্রদান করেননি। তিনি আমৃত্যু জামেয়ার খিদমত করে যাবেন”। বর্তমনে শেরে মিল্লাত (রহ.)’র নূরানী র্দস গ্রহণে ধন্য এমন অসংখ্য শীষ্য অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, মুহাদ্দিস, ফক্বীহ, মুফাস্সির পদে থেকে বিভিন্ন খিদমাত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন। পাশাপাশি বাংলাদেশসহ বর্হিবিশে^ সরকারী বেসরকারী ও সমাজের বিভিন্ন স্তরের তাঁর অনেক শীষ্য দেশ-দশের সেবা করে যাচ্ছেন।
দৈহিক গঠন
আব্বা হযরতে আল্লামা নঈমী (রহ.)’র উচ্চতা ছিলো প্রায় ৫ ফুট ১ ইঞ্চি। শারীরিক গঠন মধ্যম প্রকৃতির ছিলো এবং মেদ-ভুড়ি সম্পন্ন ছিলেন না। চোখ ছিলো কালো। চেহেরা ছিলো ফর্সা। মুখে ছিলো ঘন দাঁড়ি। তিনি দাঁড়িতে মেহেদী ব্যবহার করতেন। গোঁফ কেটে ছোট করে রাখতেন। দন্ত ছিলো মধ্যম প্রকৃতির এবং সামনের উপরের দুই দাঁতের মাঝে হালকা ফাঁক ছিলো। চেহেরা নয় লম্বা নয় গোলাকার। প্রাথমিক সময়কালে তিনি বাবরি চুলের অধিকারী ছিলেন, পরবর্তীতে চুল হালকা পাতলা হয়ে যায়। বুকের উপরিভাগে ঘন ও পিঠের উপরের দুই পাশে হালকা পশম ছিলো। পায়ের তালু ছিলো সমতল। তিনি কালো, লম্বা, শক্ত টুপি ব্যবহার করতেন। তাঁর পরিধেয় বস্ত্র ছিলো জুব্বা, কাবলী, সালোয়ার।
ত্বরীক্বতের দীক্ষা গ্রহণ
আব্বা হযরত আল্লামা নঈমী (রহ.) জাহিরী ইল্ম (প্রকাশ্যে অর্জিত জ্ঞান) কে সুপথ প্রাপ্তির একমাত্র পাথেয় মনে করেননি। কারণ, অধিকন্তু ইলম-এ তাসাও্ওফ (সূফী তত্ত্ব) ও বাতিনী ইল্ম (মহান আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ অপ্রকাশ্য জ্ঞান) বিমুখ শুধু জাহিরী ইল্মের ধারক-বাহকরাই ইসলামের গুঢ়-রহস্য উদঘাটনে ব্যর্থ হয়, তাই ইলম-এ তাসাও্ওফ ও বাতিনী ইল্ম’র দ্বারে উপনীত হওয়ার জন্য আধ্যাত্মিক শিক্ষা ও সঠিক সিলসিলার ত্বরীক্বত শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। পূর্বসূরী সুন্নী মুসলিম মনীষীগণ এ ধারাকে মনে প্রাণে ধারণ করে দু’জাহানে সাফল্য অর্জন করেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় সে আধ্যাত্মিক শিক্ষার্জনের মহান ব্রত নিয়ে ১৯৬৮ সনে গাউস-এ যমান, মুরশিদ-এ বরহক্ব আওলাদ-এ রসূল (সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লামা সায়্যিদ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ (রহ.)’র নূরানী হাতে বায়‘আত গ্রহণ করে “সিলসিলা-এ আলিয়া ক্বাদিরীয়্যাহ” ত্বরীক্বতের দীক্ষা গ্রহণ করেন। সে থেকে প্রতিনিয়ত ত্বরীক্বতের বহুমুখী খিদমতে নিয়োগের মাধ্যমে ইন্তিকাল অবধি স্বীয় পীর-মুরশিদ হুযুর ক্বিবলা (রহ.) ও তাঁর আওলাদগণের অন্যতম মুখপাত্র হিসেবে বাংলাদেশসহ বর্হিবিশে^ ত্বরীক্বতের প্রচারণায় নিরলস খিদমত আঞ্জাম দিয়ে গেছেন আলহামদু-লিল্লাহ।
স্বীয় পীর’র সাথে আব্বা হযরত’র সম্পর্ক
গাউস-এ যামান, মুরশিদ-এ বরহক্ব আল-এ রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লামা হাফিয ক্বারী সায়্যিদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ (রহ.)’র সাথে আব্বা হযরত (রহ.)’র এক প্রকার উষ্ণ সম্পর্ক ছিলো। হুযুর ক্বিবলা (রহ.) আব্বা হযরত (রহ.) কে খুব বেশী ভালোবাসতেন। আব্বা হযরতও সে ভালোবাসার যথাযথ মূল্যায়ন করতে যথাসম্ভব চেষ্টা করে গেছেন আলহামদু-লিল্লাহ। আব্বা হযরত (রহ.) তাঁর পীর ও মুরশিদ’র শানে লেখা ‘কেয়া কারে তা‘রীফ-এ যাত-এ শাহে তায়্যিব কি আনাম’ ক্বছীদার শেষ চরণে লিখেন- “থাম লে মুরশিদ কা দামান আয়ে নঈমী তা আবাদ, ছোড় নাহ হারগিয কাভি তূ উন কা হ্যায় আদনা গোলাম”। অকপটচিত্তে বলা যায়, ত্বরীকতে দীক্ষিত হওয়ার পর থেকে আমৃত্যু তিনি এই শিক্ষণীয় শেষ পঙতিযুগলের কথা তাঁর জীবনে অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করেছেন। যেখানে বর্তমানে কিছু কিছু মানুষ অর্থের লোভে নিজের ঈমান ও মাযহাব বিক্রি করে দিচ্ছে, সেখানে আব্বা হযরত (রহ.) এই ধরনের নোংরা পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়া তো দূরের কথা, তিনি তাঁর জীবনে একটি মুহুর্তের জন্যও এই বরহক্ব সিলসিলা ও স্বীয় পীর-মুরশিদের ব্যাপারে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিন্দুমাত্র সংশয় পোষণ করেননি; বরং সিলসিলা ও পীর-মুরশিদ’র আদর্শ এবং আহল-এ সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’র আক্বীদা’র উপর অবিচল ও অটল ছিলেন এবং ন্যায়-নিষ্ঠার সাথে দ্বীন-মাযহাব ও সিলসিলার অগ্রগতিতে অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন আলহামদু-লিল্লাহ। আপন মুর্শিদের সাথে উষ্ণ সম্পর্কের কয়েকটি ঘটনা নি¤েœ তুলে ধরা হলো-
১. এই ঘটনা আব্বা হযরত (রহ.) আমি অধমকে কয়েক বছর আগে বলেছিলেন- কোন এক বছর আব্বা হযরত (রহ.) গাউস-এ যমান মুরশিদ-এ বরহক্ব আল্লামা হাফিয ক্বারী সায়্যিদ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ (রহ.)’র জীবদ্দশায় সিরিকোট দরবার শরীফে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। যাওয়ার কয়েকদিন আগে এক রাতে আব্বা হযরত স্বপ্নে দেখলেন- তিনি সিরিকোট দরবার শরীফের একটি ছোট্ট গলি বেয়ে উঠছেন উঠার পরপরই গাউস-এ যমান হুযুর তায়্যিব শাহ (রহ.)’র সাথে আব্বা হযরতের যিয়ারত হলো, আব্বা হযরত (রহ.) হুযুর ক্বিবলা (রহ.)’র সাথে সালাম ও কুশল বিনিময় করলেন অত:পর হুযুর ক্বিবলা (রহ.) আব্বা হযরতের কপালে চুমু খেলেন। এ স্বপ্নের কথা আব্বা হযরত (রহ.) কাউকে বলেননি। পরবর্তীতে যথা সময়ে সিরিকোট শরীফ যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। সিরিকোট দরবার শরীফ পৌঁছার পর দরবারের ঠিক ঐ গলি বেয়ে আব্বা হযরত (রহ.) উঠলেন উঠার পর হুযুর ক্বিবলা’র সাথে আব্বা হযরত (রহ.)’র যিয়ারত হলো। আব্বা হযরত (রহ.) হুযুর ক্বিবলা (রহ.)’র সাথে সালাম ও কুশল বিনিময় করলেন এবং ঠিক স্বপ্নের ন্যায় হুযুর ক্বিবলা (রহ.) আব্বা হযরতের কপালে চুমু খেলেন, সুবহানাল্লাহ!!!। শুধু এইটুকুতে শেষ নয়, এরপর হুযুর ক্বিবলা (রহ.) বললেন- “ইয়ে আপ কে খাব কি তা‘বির হ্যায়”, অর্থ এটা আপনার স্বপ্নের ব্যাখ্যা। সুবহানাল্লাহ!!!।
২. আব্বা হযরত (রহ.) কোন এক প্রসঙ্গে মাওলানা নঈমুল হক নঈমীকে বললেন- ‘নঈম! আমার বিশ^াস, আমার উপর কোনো যাদু-টোনা বিশেষ প্রভাব ফেলতে পারবেনা ইনশাআল্লাহ্। নঈমুল হক আরয করলেন- হুযুর! এর কারণ কী? আব্বা হযরত (রহ.) বললেন- কোনো এক বছর বালুয়ার দিঘির পাড়স্থ খানকাহ্ শরীফে হুযুর ক্বিবলা তৈয়ব শাহ (রহ.)’র অবস্থানকালীন আমি হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়ি। এমনভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি যে, বিছানা থেকে উঠতেও পারছিলাম না। আমার পুরোপুরি এই আশঙ্কা ছিলো, আমার উপর কেউ যাদু-টোনা করেছে। পুরো পৃথিবী সাক্ষী, হুযুর ক্বিবলা (রহ.) যখন বাংলাদেশ সফরে আসেন তখন আমি নিজের ব্যক্তিগত মাহফিল ও যাবতীয় ব্যস্ততা বাদ দিয়ে হুযুর ক্বিবলা (রহ.)’র খিদমতে নিয়োজিত থাকি। হুযুর ক্বিবলা খানকাহ শরীফে অবস্থানরত, কিন্তু আমি আমার অসুস্থতার কারণে হুযুরের খিদমতে যেতে পারছিনা। বিষয়টি আমাকে খুব ব্যথিত করলো। ওই অবস্থায় এক রাতে বিষন্নচিত্তে আমি ঘুমিয়ে পড়ার পর স্বপ্নে দেখলাম, আমি বিছানায় শায়িত অবস্থায় আছি আর আমাকে এক পার্শ¦ থেকে হাকীমুল উম্মাত মুফতী আহমদ ইয়ার খাঁন নঈমী (রহ.) এবং অন্য পার্শ¦ থেকে আল্লামা সায়্যিদ নূরুচ্ছাফা নঈমী (রহ.) ধরে বিছানা থেকে তুললেন। অত:পর তাঁরা উভয়ে আমাকে হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে সামনের দিকে নিয়ে যান। তখন দেখতে পেলাম, আমার সামনে হুযুর ক্বিবলা (রহ.) উপবিষ্ট। এ দুই হযরত হুযুর ক্বিবলা (রহ.) কে বললেন- “এ বাচ্চাকে আপনি গ্রহণ করুন”। হুযুর ক্বিবলা (রহ.) আমাকে সাদরে গ্রহণ করে নিলেন। আলহামদুলিল্লাহ্! এরপর হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেলো। ঘুম ভাঙার পর আমি নিজেকে পরিপূর্ণ সুস্থ পেলাম এবং কোন বাধা-বিপত্তি ছাড়াই বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেলাম। অত:পর কালবিলম্ব না করে বলুয়ার দিঘি পাড়স্থ খানকাহ শরীফে হুযুর ক্বিবলা (রহ.)’র খিদমতে চলে গেলাম। হুযুর ক্বিবলা (রহ.) আমাকে দেখে হেসে হেসে গতরাতের স্বপ্নের কথা বলে দিলেন। আল্লাহু আকবর!!! তখন থেকে আমার মনে বিশ^াস জন্মালো, কোনো যাদু-টোনা আমার উপর বিশেষ প্রভাব ফেলতে পারবে না ইনশা-আল্লাহ।
স্বপ্নযোগে ইমাম বুখারী’র দর্শনলাভ
আব্বা হযরত (রহ.)’র শীষ্য মাওলানা নঈমুল হক নঈমী আমি অধমের কাছে বর্ণনা করেন-ইন্তিকালের কয়েকবছর আগের কথা, একদিন আব্বা হযরত পবিত্র আলমগীর খানকাহ শরীফের দু’তলায় হাঁটছিলেন, সাথে নঈমুল হকও ছিলেন আব্বা হযরত (রহ.) তাঁকে বললেন- নঈম!! সম্ভবত আমি আর বেশীদিন বাঁচবো না। নঈম বললেন- হুযুর আপনি এরকম কেন বলছেন? আপনি ইনশাআল্লাহ অনেকদিন বাঁচবেন। সবাই আপনার হায়াতে বরকত সাধিত হওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত দো‘আ করছে। আপনি আরো অনেকদিন খিদমত করবেন ইনশাআল্লাহ। আব্বা হযরত (রহ.) বললেন- আমি ইমাম বুখারী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) কে স্বপ্নে দেখেছি। সুবহানাল্লাহ!!! কারণ বুযুর্গদের তা‘বীর হলো, যে ব্যক্তি ইমাম বুখারী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) কে স্বপ্নে দেখবে সে বেশী সময়কাল বাঁচবে না। একটু কৌতুহলবশত নঈম জিজ্ঞেস করলেন- হুযুর! ইমাম বুখারী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) দেখতে কেমন ছিলেন? আব্বা হযরত (রহ.) বললেন- দেখতে খুবই সুন্দর! ইমামের বুকে প্রচুর লোম ছিলো।
স্বপযোগে রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)’র দীদার লাভ
এই ঘটনা আমি অধমের কাছে মাওলানা নঈমুল হক নঈমী এই মর্মে বর্ণনা করেন- আজমীর শরীফের কোন এক সফরে আমি শেরে মিল্লাত হুযুরের সাথে ছিলাম। আমি প্রত্যক্ষ করলাম শেরে মিল্লাত হুযুর (রহ.) প্রতি রাতেই একটি ওয়াজীফা বই থেকে কিছু দো‘আ পাঠ করছেন। আমি কৌতুহল বশত: হুযুরকে জিজ্ঞেস করলাম- হুযুর আপনি প্রত্যেকদিন রাতে কী ওয়াজীফা পড়েন? আব্বা হযরত (রহ.) বললেন- আমি প্রত্যেক রাতে একটি দরূদ শরীফ পাঠ করি। আর এই দরূদ শরীফ আমি অনেকদিন ধরে পাঠ করে আসছি। কোন এক রাতে (নিজ গৃহে) আমি ওই দরূদ শরীফটি পাঠ না করে ঘুমিয়ে পড়ি। সে রাতেই স্বপ্নযোগে রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)’র দীদার লাভ করি। সুবহানাল্লাহ!!! আল্লাহর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাকে বললেন- তুমি আজকে দরূদ শরীফ পাঠ করলে না কেন? আল্লাহু আকবর!!! আব্বা হযরত বললেন- তখন থেকে আমি প্রত্যেক রাতে নীরবচ্ছিন্নভাবে সে দরূদ পাঠ করতে থাকি।
ওয়াজের ময়দানে পদচারণা
আমার জানা মতে, আব্বা হযরত (রহ.) ফাযিল স্তরে অধ্যয়নরত অবস্থায় মাঠে-ময়দানে ওয়াজ-নসীহত’র সূচনা করেন। তিনি ওয়াজের ময়দানে একজন খাঁটি নবী ও ওয়ালী প্রেমিক, অনলবর্ষী বক্তা, মোনাযির-এ আহ্ল-এ সুন্নাত হিসেবে খ্যাত ছিলেন। তিনি সর্বদা তাঁর ওয়াজ ও বক্তব্যে ইসলামের সঠিক রূপরেখা ‘আহল-এ সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’র আক্বীদা ও আমল’র প্রচার ও প্রসার বিশেষত “মাসলাক্ব-এ আ‘লা হযরত”-এর প্রচারে এবং ওহাবী, মাওদুদী, শিয়া, লা-মাযহাবী সম্প্রদায়সহ সকল প্রকার বাতিল মতবাদ খন্ডনে আপোষহীন ভূমিকা পালন করেন। এ কারণে তিনি বেশ কয়েকবার ওয়াজের ময়দানে ওই সকল বাতিল ফিরক্বা কর্তৃক আক্রান্তও হন। ইসলাম ও সুন্নীয়্যাত প্রচার ও প্রসারে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল ছাড়াও বহির্বিশ্বে বিভিন্ন ধর্মীয় কনফারেন্সে তাঁর অংশগ্রহণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি পবিত্র মক্কা, মদীনা-এ তায়্যিবা, ইরাক, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কাতার, তুরস্ক, জেরুজালেম, পাকিস্তান, ভারত, মালেশিয়া, ইরান, লন্ডন, বার্মা (বর্তমান মিয়ানমার), নেপাল ইত্যাদি রাষ্ট্র সফর করে দ্বীন-মাযহাব ও ত্বরীক্বতের প্রচারে বিশেষ অবদান রাখেন। তাঁর জীবনের সর্বশেষ সফর ছিলো ২০১৯ সনের যুল-হাজ্জাহ মাসে সিরিকোট দরবার শরীফে। তিনি তাঁর জীবনের সর্বশেষ বয়ান করেন ২০২০ইং সনের ২০ মার্চ চট্টগ্রাম বোয়ালখালীর কধুরখিলস্থ তায়্যিবিয়া তাহিরিয়্যাহ সুলতান মোস্তাফা শাহী জামি‘ মসজিদে জুম’আ দিবসে। ওয়াজের বিষয় ছিলো- পবিত্র লাইলাতুল মি‘রাজ। উল্লেখ্য তিনি উক্ত মসজিদে ইন্তিকাল অবধি প্রায় ৭ বছরের অধিক সময়কাল জুম’আর খতীব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।