ব্রিটিশ গোয়েন্দা অফিসার মি. হামফ্রের ডায়েরী হামফ্রেজ মেমোরিজ, মূল: মি. হামফ্রে
অনুবাদ: লোকমান আহমদ আমীমী
[ব্রিটিশ গোয়েন্দা অফিসার মি. হামফ্রের ডায়েরীটি (স্মরণিকা) দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় যখন জার্মানীর হস্তগত হয়; তখন জার্মান পত্রিকা ‘ইসপিগল’ তা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে। এতে ব্রিটিশদেরকে বিশ্ব সমাজের নিকট অত্যন্ত লজ্জিত হতে হয়। স্মরণিকাটি ফরাসী পত্রিকায়ও প্রকাশিত হয়েছিল। জনৈক লেবাননী বুদ্ধিজীবী কর্তৃক তা আরবী ভাষায় এবং আঞ্জুমানে জওয়ানে পাকিস্তান কর্তৃক তা উর্দু ভাষায় অনুবাদ করা হয়। এ আত্মকথায় উল্লেখিত ‘মোহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব’ প্রসঙ্গটি পাঠকদের জন্য বাংলা ভাষায় অনুদিত হল। আর মি. হামফ্রে ও ইবনে ওয়াহাবের ভুল মন্তব্যগুলোকে সংক্ষিপ্ত টীকার মাধ্যমে সংশোধন করে দেয়া হলঃ সা¤্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ, ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থে আঘাত হেনে মধ্যপ্রাচ্য ই¯্রাঈলকে আসীন করে দিয়েছে। সা¤্রাজ্যবাদী সোভিয়েত ইউনিয়ন উপসাগরীয় অঞ্চলে বাহাই মতবাদীদের বসিয়েছিল। ঠিক সেভাবে সা¤্রাজ্যবাদীগণ ভারতীয় উপমহাদেশে কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের বুনিয়াদ স্থাপন করেছিল। আর সুদানে মাহ্দিয়তের ফিৎনা দাঁড় করিয়েছিল। বহু ভাষাবিদ মি. হামফ্রে মুসলিম রাষ্ট্রসমূহে বিশেষ করে তুরস্ক, ইরাক, ইরান ও আরব দেশগুলোতে সার্থকভাবে বৃটিশ সরকারের গোয়েন্দাগিরি করেছেন। তিনি ও তাঁর সহযোগিগণ কিভাবে মুসলিম জগতে মোহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাবের মাধ্যমে ওহাবী মতবাদের বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন মি. হামফ্রের এ আত্মকথায় তার যৎ কিঞ্চিৎ আভাস পাওয়া যাবে। কারণ মি. হামফ্রে তুরস্কের শায়খ আফিন্দীর নিকট ছদ্মবেশী মুসলমান সেজে কোরআন হাদীস চর্চা করে মোহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাবের একান্ত বন্ধু ও সহযোগী হয়েছিলেন।-অনুবাদক]
মি. হামফ্রে লিখেছেন আমি যখন তরখানের কাজে নিয়োজিত ছিলাম, তখন একজন লোকের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়। তিনি সেখানে যাতায়াত করতেন ও তুর্কী, ফার্সী, আরবী ভাষায় কথাবার্তা বলতেন। তিনি দ্বীনি তালেবে ইলমের পোষাক পরিধান করতেন। তাঁর নাম হল ‘মোহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাব’ তিনি উচ্চাভিলাষী, সম্মানাকাংখী এবং ধোপ দুরস্ত লোক ছিলেন। উসমানী সরকারের প্রতি অত্যন্ত ঘৃণা পোষণ করতেন ও সর্বদা তাঁদের সমালোচনা করতেন। কিন্তু ইরান সরকারের সাথে তার কোন যোগাযোগ ছিল না। তরখান আবদুর রেযার সাথে তার বিশেষ সম্পর্কের কারণে উভয়েই উসমানী খলিফাকে নিজের পরম শত্রু মনে করতেন। কিন্তু এটা আমার বোধগম্য হয়নি যে, তিনি কি কারণে আবদুর রেযা তরখানের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুললেন। অথচ একজন ছিলেন সুন্নী মতবাদের দাবীদার আর অপরজন ছিলেন শিয়া মতাবলম্বী। আমি এটাও জানতে পারিনি, তিনি ফার্সী ভাষা কোথায় শিখলেন। অবশ্য বসরায় শিয়া সুন্নীরা এক সাথে জীবন যাপন করত। উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। সেখানে আরবী ফার্সী উভয় ভাষার প্রচলন ছিল। অবশ্য তুর্কী ভাষা জানা লোকের সংখ্যাও একেবারে কম ছিল না।
মোহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাব স্বাধীনচেতা লোক ছিলেন। তাঁর মন শিয়া-সুন্নী পক্ষপাতিত্ব মুক্ত ছিল। অথচ সেখানকার বেশীর ভাগ সুন্নীই শিয়া বিরোধী ছিল। আবার কোন কোন সুন্নী মুফতী শিয়াদের কাফির বলে অভিহিত করতেন। শায়খ মোহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাবের দৃষ্টিতে হানাফী, শাফিয়ী, হাম্বলী ও মালিকী শিক্ষা কেন্দ্রের কোনটিরই বিশেষ কোন গুরুত্ব ছিল না। তাঁর বক্তব্য হল আল্লাহ্ তা‘আলা যা কোরআন মজিদে বলেছেন, ব্যাস, তাই আমাদের জন্য যথেষ্ট।
শায়খ মোহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাব কোরআন হাদীস চর্চা করেছেন। স্বীয় অভিমতের পক্ষে ইসলামী জ্ঞান বিশারদদের মতামত প্রমাণ হিসেবে পেশ করতেন। কিন্তু কোন কোন সময় তাঁর চিন্তাধারা প্রখ্যাত আলিমদের বিপরীত অর্থে হত। তিনি কথায় কথায় বলতেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম শুধু কিতাব ও সুন্নতকে অপরিবর্তনীয় বিধান করে আমাদের জন্য পেশ করেছেন। তিনি কখনো বলেননি যে, সাহাবায়ে কেরাম ও আইম্মায়ে দ্বীনের বর্ণনা অটল এবং অবতীর্ণ ওহীর শামিল। আমাদের জন্য কিতাব ও সুন্নতের অনুসরণ করাই শুধু ওয়াজিব। ওলামা, চার ইমাম, এমনকি সাহাবাদের মতামত যাই হোক না কেন, তাদের ইত্তেফাক ও ইখতিলাফের দ্বারা দ্বীনকে মজবুত করা নিষ্প্রয়োজন।
একদিন ইরান থেকে আগত জনৈক আলিমের সাথে খাবার টেবিলে তর্ক শুরু হয়ে গেল। সে আলিমের নাম ছিল শায়খ জাওয়াদ কুম্মী। তিনি আবদুর রেজা তরখানের মেহমান ছিলেন। শায়খ জাওয়াদ কুম্মীর সাথে মোহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাবের মৌলিক মতভেদ ছিল। তাঁদের কথাবার্তা সত্ত্বরই তিক্ততার রূপ পরিগ্রহ করল। শায়খ কুম্মী ইবনে আবদুল ওহাবকে বললেন, ‘যদি তুমি স্বাধীন চিন্তার লোক হও, নিজের দাবী অনুযায়ী ইসলাম সম্পর্কে যথেষ্ট লেখাপড়া করে থাক, তবে কেন শিয়াদের মত হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে সম্মান প্রদর্শন করনা?
ইবনে আবদুল ওহাব উত্তরে বললেন, ‘‘হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও অন্যান্যদের মত ও তাঁদের কথা আমার কাছে প্রমাণ নয়। আমি শুধু কিতাব ও সুন্নতকে মানি।’’
কুম্মী- ও আচ্ছা, তুমি যদি সুন্নাতের অনুসারী হয়ে থাক, তবে কি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন নি যে, انا مدينة العلم وعلى بابها ‘‘আমি ইলমের শহর আর আলী ইলমের দরজা।’’ একথা বলে কি রাসূলুল্লাহ্ হযরত আলী ও অন্যান্য সাহাবাদের মধ্যে পার্থক্য করেননি? ইবনে আবদুল ওহাব বলেন- যদি ব্যাপার এ রকমই হয়, তবে রাসূলের বলা উচিত ছিলো, ‘আমি তোমাদের নিকট দু’টি জিনিস রেখে গেলাম, একটি কিতাব আর দ্বিতীয়টি আলী ইবনে আবি তালিব’।
কুম্মী- ‘নিশ্চয়, রাসূলুল্লাহ্ এ কথাও যথাস্থানে বলেছেন- تركت فيكم الثقلين كتاب الله وعزتى اهل بيتى অর্থাৎ আমি তোমাদের মধ্যে কিতাব ও আহলি বায়তকে রেখে গেলাম।’ নিশ্চয়ই হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু আহলে বায়তের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি।’ ইবনে আবদুল ওয়াহাব এ হাদীসকে মিথ্যা বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু শায়খ কুম্মী উসূলে কাফীর ইসনাদের ভিত্তিতে হাদীসটির সত্যতা প্রমাণ করেন। তখন ইবনে আবদুল ওহাব চুপ থাকতে বাধ্য হলেন ও নিরোত্তর রইলেন। অতঃপর বলে উঠলেন, নবী করীম যদি আমাদের জন্য শুধু কিতাব ও আহলে বাইত রেখে গিয়ে থাকেন, তাহলে সুন্নত কোথায় গেল? কুম্মী বলেন- সুন্নত কিতাবের তাফসীর ও তাশরীহকে বলে; অন্য কিছুকে নয়। ইবনে ওহাব বলেন- আপনার মতানুযায়ী ইতরত অথবা আহলে বাইতই কালামে ইলাহীর তাফসীর। তবে কেন হাদীসের ‘মতন’ বৃদ্ধি করা হল? কুম্মী বলেন- রাসূলুল্লাহ্’র ওফাত শরীফের পর উম্মতে মোহাম্মদীকেও কোরআন বুঝাবার অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল। এ জন্য রাসূলুল্লাহ্ গায়বী ইলমের ভিত্তিতে কিতাবে ইলাহীর মূল ধরে আর ইতরত (বংশধর) কে কোরআনের ভাষ্যকার ও কিতাবের ব্যাখ্যা ঠিক মত উম্মতের নিকট পেশ করার জন্য হাওয়ালা করেছেন। ইবনে আবদুল ওয়াহাব এরপর পিঞ্জরাবদ্ধ পাখির ন্যায় ছটফট করতে থাকেন।
ইবনে আবদুল ওয়াহাবের সাথে দীর্ঘকাল মেলা-মেশা ও দেখা সাক্ষাতে বুঝতে পারলাম যে, বৃটিশ সরকারের উদ্দেশ্যাবলীকে কার্যকরী করার জন্য এ ব্যক্তি অত্যন্ত উপযোগী হবে। তবে উচ্চাভিলাষ, খ্যাতি কামনা, অহংকার ও অহমিকার কারণে ওলামায়ে কেরাম, মাশায়েখে ইসলামের ও সাহাবায়ে কেরাম এমনকি খোলাফায়ে রাশেদীন পর্যন্ত তার নগ্ন সমালোচনার লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত হয়। কোরআন হাদীস থেকে রাজনৈতিক ফায়দা লাভ করাই তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল।
আমি চিন্তা করলাম কোথায় এ অহংকারী যুবক, আর কোথায় ইস্তাম্বুলের ওই তুর্কী বৃদ্ধ ব্যক্তি, (আহমদ আফেন্দী) যার চিন্তা ধারায় ও কর্ম তৎপরতার যেন হাজার বছর আগেকার লোকদের ছবি ফুটে ওঠে। সময়ের পরিবর্তনের সাথে তিনি নিজের মধ্যে সামান্যতম পরিবর্তনও আনেননি। হানাফী মাযহাবের অনুসারী সে বয়োবৃদ্ধ লোকটি আবু হানীফার নাম উচ্চারণ করার আগে ওযু করে নিতেন। আহলে সুন্নতের নিকট হাদীসের সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও প্রামাণিক কিতাব সহী বোখারী অধ্যয়ন করা তিনি ফরয মনে করতেন এবং ওযু ছাড়া তিনি এ কিতাবটি স্পর্শ করতেন না। তাঁর সম্পূর্ণ বিপরীত হল মোহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাব। তিনি আবু হানীফাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতেন আর তাকে বিশ্বস্ত মনে করতেন না। তিনি বলতেন, আমি আবু হানীফার চেয়ে বেশী জানি। তিনি বলেন- ‘সহী বোখারী বেহুদা কিতাব বৈকিছু নয়।’
যা হোক আমি ইবনে ওহাবের সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপন করে নিলাম। এতে আমাদের বন্ধুত্ব অস্বাভাবিকভাবে দৃঢ় হল। আমি বার বার তাকে এ কথা শুনাতাম, ‘আল্লাহ্ আপনাকে হযরত আলী ও হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর চেয়ে বেশী উপযুক্ত করে বানিয়েছেন ও তাঁদের তুলনায় বেশী সম্মান ও সাহায্য প্রদান করেছেন। আপনি যদি রাসূলের সমসাময়িক লোক হতেন, তবে রাসূলের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার গৌরব অর্জন করতে পারতেন। আমি সব সময় আশা ভরা সুরে তাকে বলতাম আমি চাই ইসলামে যে বিপ্লব সাধিত হবে, তা আপনার দ্বারাই সাধিত হোক। আপনি এমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তি যে, একমাত্র আপনিই ইসলামকে অবনতি হতে রক্ষা করতে পারেন, এ ব্যাপারে সকলের আশা আকাক্সক্ষা আপনার সাথে জড়িত।
আমি ইবনে আবদুল ওহাবের সাথে ঠিক করলাম আমরা দু’জন মজলিসে বসে ওলামা, মুফাস্সিরীন, ধর্মীয় নেতা, মাযহাব ও সাহাবাদের থেকে ভিন্ন পন্থায় নুতন চিন্তা ধারার ভিত্তিতে কোরআন মজীদ সম্পর্কে আলোচনা করব। আমি ক্বোরআন পড়তাম আর আয়াতের অর্থ সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করতাম। আমার কর্মতৎপরতার উদ্দেশ্য ছিল, যে কোন প্রকারে তাঁকে ইংরেজ উপনিবেশবাদী সংস্থার ফাঁদে জড়িয়ে দেয়া।
আমি ক্রমে ক্রমে এ উচ্চাভিলাষী, আত্মপুজারী লোকটিকে জড়িয়ে ফেলতে লাগলাম। এমনকি তিনি বাস্তবতার ঊর্ধ্বে স্বাধীনচেতা হওয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন।
একদিন তাঁকে জিজ্ঞেস করলামঃ জেহাদ করা কি ওয়াজিব? তিনি বললেন অবশ্যই। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেছেন, ‘কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর’। আমি বললাম, আল্লাহ্ তা‘আলা বলেছেন কাফির ও মুনাফিক উভয়ের সাথে যুদ্ধ কর। আর কাফির ও মুনাফিকদের সাথে যুদ্ধ করা ওয়াজিব হলে রসূলুল্লাহ্ কেন মুনাফিকদের সাথে যুদ্ধ করেননি। ইবনে আবদুল ওয়াহাব বলেন- জিহাদ শুধু যুদ্ধের ময়দানে নয়, বরং রসূলুল্লাহ নিজ চলাফিরা কথাবার্তার দ্বারা মুনাফিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। আমি বললাম, তাহলে এ অবস্থায় কাফিরদের সাথেও কথাবার্তা ও চলাফিরার দ্বারা যুদ্ধ করা ওয়াজিব। তিনি বললেন, না, ঃ পয়গাম্বর যুদ্ধের ময়াদনে তাদের সাথে জিহাদ করেছেন। আমি বললাম রাসূলুল্লাহ্ কাফিরদের সাথে আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ করেছেন। কেননা কাফিরগণ তার জানের দুশমন ছিল। ইবনে আবদুল ওহাবও এ কথার ওপর মাথা নাড়ালেন। আমি বুঝতে পারলাম, আমার কাজে আমি সফল হয়েছি।
অন্য দিনের ঘটনা- আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম মহিলাদের সাথে ‘মুতআ বিবাহ্’ (সুনির্দিষ্ট সময়ের শর্তে বিবাহ্) জায়েজ কিনা? তিনি বললেন, ‘কখনো না’। আমি বললাম, তাহলে কোরআন এটা জায়েয বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছে কেন? ‘‘আর যখন তোমরা তাদের সাথে মুতয়া করবে তখন তাদের মুহর আদায় করে দাও।’’ [সূরা নিসা, আয়াত-২৪) তিনি বললেন, হাঁ, আয়াত নিজের জায়গায় ঠিকই আছে। কিন্তু হযরত ওমর বলেছেন মুতয়া রাসূলুল্লাহর যামানায় হালাল ছিল; আমি আজকে এটাও হারাম সাব্যস্ত করলাম। এখন যদি কেউ এতে লিপ্ত হয় তাকে আমি শাস্তি দিব।
আমি বললাম, আশ্চর্যের বিষয় আপনি হযরত ওমরকে অনুসরণ করেন, অথচ নিজেকে তার চেয়ে বেশী জ্ঞানী বলে মনে করেন। হযরত ওমর এর কি অধিকার আছে যে, তিনি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক হালালকৃত বস্তুকে হারামে পরিণত করবেন? আপনি কোরআনের সিদ্ধান্ত বাদ দিয়ে হযরত ওমরের সিদ্ধান্ত মেনে নিলেন।
ইবনে আবদুল ওয়াহাব একথা শুনে চুপ হয়ে গেলেন তার চুপ থাকাই সম্মতির লক্ষণ বলে প্রতীয়মান হত। এ বিষয়ে তার চিন্তাধারা শুধরিয়ে আমি তার যৌন উত্তেজনাকে উদ্বুদ্ধ করতে লাগলাম। তিনি তখনও অবিবাহিত ছিলেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম: আপনি কি মুতয়ার দ্বারা নিজের জীবনকে আনন্দদায়ক করতে চান? ইবনে আবদুল ওয়াহাব সম্মত ও আশান্বিত হয়ে নিজের মাথা নাড়লেন।
আমার দায়িত্বের শেষ সীমানায় আমি পৌঁছে গেলাম। আমি তার সাথে ওয়াদা করলাম যে, যে কোন ভাবেই আমি আপনার জন্য এর ব্যবস্থা করব। আমার একটা ভয় ছিল ইবনে আবদুল ওয়াহাব যেন বসরার সুন্নীদের ভয়ে ভীত হয়ে না পড়েন। কেননা সুন্নীরা মুতয়া বিরোধী। আমি তাকে আশ্বাস দিলাম যে, আমার প্রোগ্রাম একেবারেই গোপনীয় থাকবে। এমনকি মহিলাটিকেও আপনার নাম বলা হবে না। এ কথা বার্তার পরক্ষণেই আমি নির্দিষ্ট এলাকায় চলে গেলাম বসরায় ইংরেজ উপনিবেশ সরকারের পক্ষ হতে চরিত্র হননের জন্য খ্রিস্টান এক মহিলা নিয়োজিত ছিল। সে মুসলিম নওজোয়ানদের পথভ্রষ্টতার জন্য উৎসাহ্ যোগাত। সে মহিলার কাছে আমি সবিস্তারে পরিকল্পনার কথা বললাম যখন সে সম্মত হল তখন সাময়িকভাবে তার নাম সুফিয়া রাখলাম। আর বললাম, আমি যথাসময়ে ইবনে আবদুল ওয়াহাবকে নিয়ে তোমার কাছে আসব।
নির্দিষ্ট দিনে ইবনে আবদুল ওয়াহাবকে নিয়ে সুফিয়ার ঘরে পৌঁছলাম। আমরা মাত্র দু’জন, সেখানে আর কেউ ছিলনা। ইবনে আবদুল ওয়াহাব একটি আশরফী (স্বর্ণমুদ্রা) বিনিময়ে এক সপ্তাহের জন্য সুফিয়াকে বিবাহ করলেন। মোটকথা, আমি বাইরে আর সুফিয়া ভিতরে ইবনে আবদুল ওয়াহাবকে আগামী প্রোগ্রামের জন্য তৈরী করছিলাম। ধর্মীয় বিধান নিধন আর স্বাধীন চিন্তাধারার নতুন স্বাদ তাঁকে পান করাল সুফিয়া।
এ অনুষ্ঠানের পর তৃতীয় দিন পুনরায় ইবনে আবদুল ওয়াহাবের সাথে দেখা করলাম। আমার কথাবার্তার ধারা অব্যাহত রাখলাম। এবার শরাব যে হারাম এ সম্পর্কে আলোচনা চলল। আমি চেষ্টা করলাম, যে সমস্ত আয়াতে শরাবকে হারাম করা হয়েছে, যে আয়াতগুলো ইবনে আবদুল ওয়াহাবের নিকট প্রমাণ হিসেবে স্বীকৃত, সেগুলোর খ-ন করি। আমি বললাম ইয়াযীদ, খোলাফায়ে বনু উমাইয়া ও বনী আব্বাসের শরাব নূশী আমাদের জানা কথা তাহলে এটা কি করে হতে পারে যে, এ সকল ধর্মীয় মাযহাবের নেতারা গোমরাহীর জীবন যাপন করতেন, আর শুধু আপনিই সঠিক পথের উপর আছেন? নিশ্চয় আমাদের চেয়ে আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতের জ্ঞান তাঁদের বেশী ছিল। সুতরাং একথা পরিস্কার যে, আল্লাহ্ ও রসূলের বাণী থেকে তাঁরা যা কিছু বের করছেন তাহল শরাব যে হারাম তা নয়, বরং এটা মাকরূহ। এ ছাড়া ইয়াহুদী নাসারার পবিত্র কিতাবসমূহে পরিস্কার ভাবে শরাব পান করার অনুমতি রয়েছে। অথচ ওটাও দ্বীন-ই এলাহী। ইসলাম ওই সমস্ত দ্বীনের পয়গম্বরদের ওপর বিশ্বাসী। এটা কি করে সম্ভব যে, শরাব আল্লাহ্ প্রদত্ত এক ধর্মে হালাল আর অপর ধর্মে হারাম। এসব ধর্ম কি মহা সত্য এক আল্লাহ্ কর্তৃক প্রেরিত নয়?
আমাদের নিকট রেওয়ায়তী প্রমাণ আছে যে, হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ওই সময় পর্যন্ত শরাব পান করেছেন, যে পর্যন্ত এ আয়াত অবতীর্ণ না হয়েছে, ‘তোমরা কি শরাব ও জুয়া থেকে বিরত থাকবে না?’ (সূরা মায়েদা, আয়াত-৯১)
যদি শরাব হারাম হত, তাহলে রাসূলূল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে শরাব পানের কারণে শাস্তি প্রদান করতেন। কিন্তু তাঁকে শাস্তি প্রদান না করা এ কথার প্রমাণ যে, শরাব হারাম নয়।
ইবনে আবদুল ওয়াহাব অত্যন্ত মনযোগের সাথে আমার কথাবার্তা শুনছিলেন। হঠাৎ হুশ ফিরে পেলেন আর বললেন, বর্ণিত আছে যে হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু শরাবে পানি মিশিয়ে পান করতেন, যাতে নেশার ঘোর থাকতো না। তিনি বলতেন, শরাবের নেশা হারাম, মূলতঃ শরাব হারাম নয়। ওই শরাব যাতে নেশা হয় না, তা হারাম নয়।
ইবনে আবদুল ওহাব হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর দৃষ্টিভঙ্গীকে এ আয়াতের আলোকে সঠিক বলে মনে করতেন। সেখানে বলা হয়েছে, যদি শরাবে মস্তী ও নেশা না থাকে তাহলে পানকারীর উপর তার প্রভাব কার্যকর হবে না আর এ জন্যে যে শরাবে মস্তী নাই তা হারাম নয়। সূরা মায়েদা ৯১ আয়াতে এ কথার প্রতিধ্বনি করা হয়েছে।
আমি ইবনে আবদুল ওহাবের সাথে শরাব প্রসঙ্গে চলা- কথা সুফিয়ার কানে পৌঁছিয়ে দিলাম। আর তাগিদ দিলাম, সুযোগ পেলেই ইবনে আবদুল ওহাবকে নেশার চুর করে দিবে। আর যত পার শরাব পান করাবে।
পরের দিন সুফিয়া আমাকে জানাল যে, সেদিন ইবনে আবদুল ওহাব প্রাণভরে শরাব পান করেছেন। এমন কি তিনি আত্মহারা হয়ে চিৎকার করতে থাকেন। শেষ রাতে তিনি তার সাথে কয়েকবার মেলামেশা করেন। এখনো তার নেশার ভাব কাটেনি। চেহারার সৌন্দর্যও লোপ পেয়েছে। এ সময় নতুন আবাদী এলাকার ঔপনিবেশিক সরকারের উযীরের মূল্যবান কথা মনে পড়ল, যা’ তিনি আমাকে বিদায় জানাবার প্রাক্কালে বলেছিলেন, ‘আমরা স্পেনকে মুসলমানদের থেকে শরাব ও জুয়ার বিনিময়ে পুনরায় ফিরে পেয়েছি। এখন এ দু’শক্তির মাধ্যমে অন্যান্য এলাকারও ফেরত আনতে হবে। ইবনে আবদুল ওহাবের সাথে ধর্মীয় বিষয় আলোচনার সময় একদিন আমি রোযা প্রসঙ্গে উত্থাপন করলাম। আমি বললাম আল্লাহ্ তা‘আলা তো বলেনি রোযা রাখা জরুরী।
কাজেই ইসলামে রোযা রাখা মুস্তাহাব। এ সময় ইবনে আবদুল ওয়াহাব ক্রোধান্বিত হলেন। তিনি বললেন, তুমি আমাকে ধর্মচ্যুত করতে চাও? আমি বললাম: হে ইবনে আবদুল ওহাব! দ্বীন বলতে অন্তরের পবিত্রতা, জীবনের নিরাপত্তা ও মধ্যম পন্থাকে বুঝায়। এ সমস্ত অবস্থা মানুষকে অন্যের উপর যুল্ম অত্যাচার থেকে বিরত রাখে। হযরত ঈসা আলায়হিস সালাম কি বলেননি: ধর্ম প্রেম ও ভালবাসাকে বুঝায়? কোরআনে আছে -‘এবং নিজ রবের এবাদত করতে থাকুন, যে পর্যন্ত না ইয়াকীন এসে উপস্থিত হয়।’ (সূরা আল-হিজর, আয়াত-৯৯)
মানুষ যদি কামিল বিশ্বাসের মনযিলে পৌঁছে যায়, তখন আল্লাহর নেয়ামত তার হৃদয়ে দৃঢ় হয়ে যায়, আর সে যদি সদাচারী হয়ে যায় তাহলে রোযার আর কি প্রয়োজন থাকে? এ মনযিলে সে মানবিক উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হয়।
ইবনে আবদুল ওহাব এবার আমার উপর ভীষণ রাগ করলেন ও নিজের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন। আরেকদিনে সুযোগমত আমি বললাম, নামায জরুরী নয়? তিনি বললেন, কেন? আমি বললাম, আল্লাহ্ তা‘আলা কোরআনে বলেছেন, ‘এবং আমাকে স্মরণ করার জন্য নামায পড়–ন।’ (সূরা তাহা, আয়াত-১৪)।
সুতরাং নামাযের উদ্দেশ্য হল যিকরে ইলাহী। আর আপনার উচিত তাঁর নাম নিজ মুখে জারী রাখা। ইবনে আবদুল ওহাব বললেন, ‘‘হ্যাঁ, আমি শুনেছি কোন কোন ধর্মীয় আলিম নামাযের সময় আল্লাহর নাম বার বার উচ্চারণ করতে থাকেন, আর তারা নামায পড়ে না। ইবনে আবদুল ওহাবের স্বীকৃতিতে আমি অত্যন্ত আনন্দিত হলাম। কিন্তু সতর্কতা অবলম্বন করে কিছুক্ষণ পর্যন্ত আমি তাঁকে নামায পড়তে উৎসাহ্ দিলাম। এর পরিমাণ হল- নামাযের পাবন্দী তার থেকে ছুটে গেল। এখন তিনি কখনো নামায পড়েন কখনো পড়েন না। বিশেষ করে সকালের (ফজরের) নামায তিনি প্রায়ই তরক করতে লাগলেন। আমরা গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকি। এ কারণে ভোরে উঠে ওযু করার সাহস তাঁর হত না।
প্রকৃতপক্ষে আমি ইবনে আবদুল ওহাবের শরীর থেকে ঈমানী পোষাক ছাড়াতে কামিয়াব হলাম। প্রত্যহ তার সাথে মধুর আলাপ-আলোচনা অব্যাহত রাখলাম। পরিশেষে এক দিন আমি কথাবার্তার পরিধি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র ‘জাত’ পর্যন্ত নিয়ে গেলাম। হঠাৎ তাঁর চেহরার পরিবর্তন দেখা দিল। এ বিষয়ে কিছু বলতে তৈরী হলেন না। তিনি আমাকে বললেন, রাসূলুল্লাহর শানে তুমি যদি কোন প্রকার বে-আদবী কর তাহলে তোমার ও আমার বন্ধুত্বের দরজা চির দিনের জন্য এখানেই বন্ধ হয়ে যাবে। আমি পরিশ্রমের ফসল ব্যর্থ হবার উপক্রম দেখে হঠাৎ আমার আলোচ্য বিষয়বস্তুর মোড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিলাম। এরপর এ প্রসঙ্গে কোন প্রকার আলোচনা হয়নি।
এরপর থেকে ইবনে আবদুল ওহাবকে নেতৃত্ব প্রদানের ব্যাপারে চিন্তিত হলাম। তাঁর দিল ও রূহে প্রবেশ করে, শিয়া, সুন্নী ফেরকার বাইরে ইসলামের তৃতীয় ফেরকার নেতৃত্বের জন্য তাকে আগে বাড়াবার জন্য আমলের যোগ্য করে তোলার প্রয়োজন দেখা দিল। এ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য দরকার ছিল তার মনকে অন্যায় ভালবাসা ও অন্ধ পক্ষপাতিত্ব থেকে মুক্ত করে দেওয়া। আর এ জন্য তাঁর স্বাধীন চিন্তাধারা, উচ্চাভিলাসকে শক্তি যোগানোর প্রয়োজন দেখা দেয়। এ কাজে সুফিয়াও আমার সহযোগি ছিল। কেননা ইবনে আবদুল ওহাব তাকে অত্যন্ত ভালবাসত, আর সপ্তাহ সপ্তাহ্ করে মুতয়ার মুদ্দত বাড়াত। মূলতঃ সুফিয়া ইবনে আবদুল ওহাবের সবর, স্থিতি এমনকি তার সমস্ত ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছিল।
আমি একবার ইবনে আবদুল ওহাবকে বললাম এটা কি ঠিক নয় যে, রাসূলুল্লাহ্র সাথে তার সমস্ত সাহাবীর বন্ধুত্ব ছিল। তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমি বললাম, ইসলামের কানূন স্থায়ী না কি অস্থায়ী? তিনি বললেন, অবশ্যই স্থায়ী। কেননা রাসূলুল্লাহ্ বলেছেন, মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপর হালালকৃত কিয়ামত পর্যন্ত হালাল থাকবে, আর মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপর হারামকৃত কিয়ামত পর্যন্ত হারাম থাকবে।
আমি সংগে সংগে বললাম, সুতরাং আমাদেরও তার সুন্নতের উপর আমল করে একে অপরের বন্ধু ও ভাই হওয়া উচিৎ। তিনি আমার প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। এরপর থেকে আমরা উভয়ে প্রবাসে ও নিবাসে একে অপরের সাথে থাকতে লাগলাম। আমি এ প্রচেষ্টায় ছিলাম যে, বীজ বপনে আমি আমার যৌবনের দিনগুলো ব্যয় করেছি, এখন যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি এর ফল থেকে উপৃকত হব।…আমি তাকে আশ্বাস দিতাম যে, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আপনার অপেক্ষায় আছে।
একদিন আমি তাকে একটি মিথ্যা স্বপ্নের কথা বয়ান করলাম, ‘‘রাত্রে রাসূলুল্লাহ্কে আমি কুরসীর উপর বসা অবস্থায় দেখলাম। ঠিক যিকিরকারী ও ওয়াজকারী যে রকমভাবে মিম্বরের উপর বসে বয়ান করেন। বড় বড় আলিম ও বুযুর্গানে দ্বীন যাদের আমি চিনিনা তার চারদিক থেকে তারা তাকে ঘিরে রেখেছেন। তখন আমি দেখলাম আপনি সে মজলিশে প্রবেশ করেছেন। আপনার চেহারা থেকে রৌশনি বের হচ্ছিল। যখন আপনি রাসূলুল্লাহ্র সামনে পৌঁছলেন, তখন তিনি দাঁড়িয়ে আপনাকে সম্মান প্রদর্শন করলেন, আপনার মাথায় চুমু খেলেন এবং বললেন-হে আমার একই নামের অধিকারী মোহাম্মদ তুমি আমার ইলমের ওয়ারিশ, মুসলমানদের দ্বীন দুনিয়াকে সামাল দিবার জন্য তুমি আমার যথার্থ খলিফা। এ কথা শুনে আপনি বললেন ইয়া রাসূলাল্লাহ্। লোকের কাছে ইলম জাহির করতে আমার ভয় হয়। হুযুর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন, মনে ভয়কে স্থান দিওনা। তুমি যা কিছু নিজের ব্যাপারে চিন্তা করেছ, এর চেয়ে তুমি অনেক বেশী মর্যাদাশীল।’’
ইবনে আবদুল ওয়াহাব আমার মনগড়া স্বপ্ন শুনে আনন্দে আটখানা। তিনি বারবারই আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন; তোমার স্বপ্ন কি সত্য? আমি তাকে এ ব্যাপারে শান্তনা দিতে থাকি। আমি লক্ষ্য করলাম স্বপ্নের আলোচনার পর তার মনোভাব এক নতুন মাযহাব সৃষ্টির দৃঢ় ইচ্ছা নিয়ে কাজ শুরু করে দিল।
ইবনে আবদুল ওয়াহাব আমাকে বললেন যে, ইস্পাহানে অবস্থানকালে আবদুল করীম নামের এক ব্যক্তির সাথে তার বন্ধুত্ব হয়। তিনি নিজকে একজন লেখক হিসেবে প্রচার করতেন। তিনি ইবনে আবদুল ওহাবের উপর বেশ প্রভাব বিস্তার করে তার সমস্ত গোপনীয় তথ্য জেনে নেন। তার সাথে সুফিয়াও কিছু দিনের জন্য ইস্পাহানে আসে। আর সে আরো দু’ মাসের জন্য ইবনে আবদুল ওহাবের সাথে মুতয়ার মেয়াদ বাড়িয়ে নেয়। সিরাজ এলাকায় সফরের সময় সে তার সাথে ছিল। সিরাজে অবস্থানকালে আবদুল করীম ইবনে আবদুল ওহাবের জন্য সুফিয়া থেকেও সুন্দরী একটি মেয়ের ব্যবস্থা করেন। সে সিরাজ শহরে এক ইয়াহুদী পরিবারের অত্যন্ত সুন্দরী মেয়ে ছিল। তার নাম ছিল আসিয়া। আবদুল করীম ইস্পাহানের এক অখ্যাত মাতা-পিতার সন্তান। সে আসিয়ার মত ইরানে ব্রিটিশ উপনিবেশিক পুনর্বাসন এলাকার মন্ত্রণালয়ের কর্মচারী ছিল।
মোটকথা, আবদুল করীম, সুফিয়া, আসিয়া ও আমি এক সাথে দিন রাত চেষ্টা করে ইবনে আবদুল ওহাবকে আমাদের মন্ত্রণালয়ের ইচ্ছা মাফিক প্রস্তুত করে নিলাম এবং ভবিষ্যতের কর্মসূচীর অনুকুল করে গড়ে তুললাম।
ব্রিটিশ সরকার শায়খ মোহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাবকে অস্ত্র দিয়ে ভাল করে প্রস্তুত করার পর প্রয়োজনে তাকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেয়। শায়খের ইচ্ছানুযায়ী জযীরাতুল আরবের অন্তর্গত নজদের নিকটবর্তী এলাকায় তার নেতৃত্বের প্রথম পদক্ষেপ সূচিত হয়।
ব্রিটিশ উপনিবেশিক পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের সেক্রেটারির পরামর্শ নি¤েœাক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা হয়।
১. শায়খের মাযহাবে যারা শামিল হবে না তাদেরকে কাফির বলা, তাদের মাল-সামান, ইজ্জত সম্মান বিনষ্ট করা বৈধ মনে করা, অপরাধীদেরকে গ্রেফতার করে পশুর হাট-বাজারে নিয়ে গিয়ে দাস-দাসীদের মত বিক্রয় করা।
২. মূর্তি পূজার বাহানায় যথাসম্ভব কাবা ঘর ধ্বংস করা, মুসলমানদেরকে হজ্জ থেকে বিরত রাখা, আর হাজীদের জান-মাল লুণ্ঠনের জন্য আরব উপজাতিদের উত্তেজিত করা।
৩. আরব উপজাতিদের উসমানিয়া খলিফার আদেশাবলী পালন থেকে বিরত থাকার জন্য উৎসাহ্ প্রদান করা, আর অসন্তুষ্ট লোকদেরকে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করা। এ কাজ সমাধা করার জন্য কিছু সংখ্যক সশস্ত্র ফৌজ তৈরী করা। হিজাজের আশরাফদের প্রভাব প্রতিপত্তি ধ্বংসের জন্য যথাসম্ভব পন্থা গ্রহণ করে তাদেরকে বিব্রত করা।
৪. রাসূলুল্লাহ্ এবং তাঁর খলীফাদের এবং বিশেষ করে মহৎ ব্যক্তিদেরকে অবহেলার দোহায় দিয়ে এবং এমনিভাবে শিরক ও মুর্তি পূজার চিহ্ণসমূহ মেটানোর বাহানায় মক্কা, মদীনা ও অন্যান্য শহরে যতটা সম্ভব মাযার ও কবরগুলো ধ্বংস করা।
৫. যতটুকু সম্ভব মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে ফিৎনা-ফ্যাসাদ, হট্টগোল ও নিরাপত্তাহীনতা ছড়ানো।
৬. কোরআন নতুনভাবে প্রচার করা ও হাদীস বর্ণনায় যেনতেন নীতিমালা তৈয়ার করা।
আমাদের পূর্ব পরামর্শ ও পরিচিতি অনুযায়ী নজদের লোকেরা আমাকে মোহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাবের গোলাম (দাস) মনে করত। শায়খের দাওয়াতী পরিবেশ তৈরী করতে আমাদের দু’ বছর সময় লেগেছে। ১১৪৩ হিজরী সনের মাঝামাঝি সময়ে মোহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাব জযীরাতুল আরবে নুতন ধর্মমত ঘোষণার জন্য চুড়ান্ত ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং তার মতাদর্শী ও সাহায্যকারী বন্ধু-বান্ধবদেরকে একত্রিত করেন। এসব লোক তার সাথে কাজ করার প্রতিজ্ঞা করেছিল। প্রথম প্রথম তিনি শুধু নিজের সাথী ও ভক্তদের মধ্যে অস্পষ্ট ও অপ্রকাশ্য বাক্যের দ্বারা অত্যন্ত সংক্ষিপ্তভাবে এ দাওয়াতের সূচনা করেন। কিছু দিন পর নজদের সব চিন্তাবিদ লোকদেরকে বড় ধরনের দাওয়াতনামা পাঠানো হয়। ধীরে ধীরে অর্থের বিনিময়ে শায়খের পক্ষের ও সমমনাদেরকে একটি বড় জনগোষ্ঠীকে একত্রিত করতে থাকি। তাদেরকে বিপক্ষদের সাথে মোকাবেলার জন্য অবতীর্ণ হওয়ার ও পরীক্ষার দীক্ষা দেই। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, জযীরাতুল আরবে শায়খের দাওয়াত প্রচারের সংগে সংগে তার শত্রু ও বিরোধীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। বিরোধীতার চরমক্ষণে শায়খের পদঙ্খলনের সম্ভাবনা দেখা দেয়। বিশেষ করে নজদে তার সম্পর্কে অত্যন্ত মারাত্মক কথা প্রচারিত হয়েছিল। আমি তাঁকে দৃঢ়তার সাথে অটল থাকার জন্য উৎসাহ্ প্রদান করি এবং তাঁর আকাক্সক্ষায় ভাটা পড়তে দেইনি। আমি তাকে বললাম, নবুয়তের প্রাথমিক দিনগুলোতে রসূলুল্লাহর এত দুশমন আপনার দুশমনদের চাইতে বেশি শক্তিশালী ছিল। কিন্তু তিনি তাদের সৃষ্ট সমস্যা ও বিপদাপদগুলোকে অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে সহ্য করতে থাকেন। এ কষ্ট, অপবাদ, দুর্নাম রটনাকারীদের সহ্য করা ছাড়া কোন দীর্ঘ পথ অতিক্রম ও উচ্চ মর্যাদা লাভ করা দুরূহ ব্যাপার। আমার সফলতার অন্য দিক হল শায়খের বিরোধীদের থেকে অর্থের বিনিময়ে তাদের চক্রান্তগুলো জেনে নেয়া। একবার শায়খের বিরোধী পক্ষের ১২৬ ব্যক্তি শায়খকে হত্যার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। আমি দ্রুততার সাথে হস্তক্ষেপ করে তাদের চক্রান্তকে নস্যাত করে দেই। এমনকি তাদেরকে এমনভাবে লজ্জিত করি যে, তারা শায়খের অনুকুল হয়ে যায়। আর অনেকেই চক্রান্তকারীদের সহযোগিতা পরিত্যাগ করে।
অবশেষে ইবনে আবদুল ওহাব আমাকে শান্ত¦না দিলেন যে, পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের দেয়া ছয় দফা প্রোগ্রামকে কার্যকরী করার জন্য নিজের পূর্ণ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবেন। তবে দু’টি দফা সম্পর্কে তিনি আশানুরূপ আশ্বাস দেননি। তন্মধ্য একটি হল-মক্কা বিজয়ের পর কাবা ঘর ধ্বংস করা; শায়খের নিকট এ কাজটি অত্যন্ত ভয়ংকর ছিল। কেননা মুসলমানগণ এত তাড়াতাড়ি তাকে মানতে রাজী ছিল না। আর এ ব্যবস্থায় হজ্জকে মূর্তি পূজা বলে গণ্য করার চেষ্টা নিহিত ছিল। দ্বিতীয় যে কাজটি তার সাধ্যের বাইরে ছিল, তা হল নতুন কোরআন লিপিবদ্ধ করা। তিনি কোরআনের মোকাবিলা করতে নারাজী ছিলেন না। এছাড়াও তিনি মক্কা ও ইস্তাম্বুলের শাসকদের অত্যন্ত ভয় করতেন। তিনি বলতেন আমি যদি কাবা ঘর ধ্বংস করি, নতুন কোরআন তৈরী করি, তাহলে আশংকা রয়েছে যে, উসমানী সরকার আমার বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠাবে। আমি এদের সাথে এঁটে উঠতে সক্ষম হব না। আমি তার কৈফিয়ত যুক্তি সংগত মনে করলাম। আর অনুমান করলাম এ সময়ের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পরিবেশ এ কাজের অনুপযুক্ত।
মোহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাবের দাওয়াতের কয়েক বছর পর যখন ছয় দফা প্রোগ্রাম সফলতার চরম মনযিল অতিক্রম করল, তখন পুনর্বাসন মন্ত্রণালয় সংস্থা ইচ্ছা প্রকাশ করল যে রাজনৈতিকভাবে জযীরাতুল আরবে কিছু করা প্রয়োজন। এ কারণেই সংস্থা নিজ কর্মচারী মোহাম্মদ ইবনে সউদকে ইবনে ওহাবের সাথে কাজ করার নির্দেশ দেন। তিনি সউদী বংশের প্রথম বংশধর ছিলেন। তিনি ১১৪৭ হিজরীতে ওহাবী মাযহাব গ্রহণ করেন। এ কাজ সমাধা করার জন্য মোহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাবের নিকট গোপনে একটি সাক্ষাৎকারী দল পাঠানো হয়। উদ্দেশ্য, তার কাছে ব্রিটিশ সরকারের পরিকল্পনাগুলো ব্যাখ্যা করা। তারা মোহাম্মদী দ্বীনের (ওহাবী মতবাদের) কাজে অংশ গ্রহণের ওপর জোর দেয় এবং তাকিদ দেয় যে, দ্বীনি বিষয়ের ফয়সালার ভার পুরোপুরি শায়খের হাতেই থাকবে। রাজনৈতিক বিষয়ে দেখা শুনার ভার মোহাম্মদ ইবনে সাউদের জিম্মায় থাকবে। এরা উভয়ই নজদের নিকটবর্তী ‘দরইয়াহ্’ শহরকে নিজেদের কর্মস্থল করে নেন। এভাবে কেন্দ্রীয় সরকার (বৃটিশ সরকার) সমস্ত আরবে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে কামিয়াব হয়।
লেখক: প্রভাষক- রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ, ঢাকা।