Anjuman-E Rahmania Ahmadia Sunnia Trust

ইখলাস (ইবাদতের রূহ)

ইখলাস (ইবাদতের রূহ)

ইখলাস (ইবাদতের রূহ)

অধ্যাপক মাওলানা
সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল-আযহারী
সহকারী অধ্যাপক, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ
খতীব, মুসাফির খানা জামে মসজিদ, নন্দনকানন, চট্টগ্রাম।

সম্পাদনা
মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান
মহাপরিচালক-আনজুমান রিসার্চ সেন্টার

প্রকাশকাল
১০ রবিউস সানী, ১৪৪১ হিজরী
২৪ অগ্রহায়ন, ১৪২৬ বাংলা
০৮ ডিসেম্বর, ২০১৯ খ্রিস্টাব্দ

সর্বস্বত্ত্ব প্রকাশকের

হাদিয়া: ৫০ /- (পঞ্চাশ) টাকা

প্রকাশনায়
আন্জুমান-এ-রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট [প্রচার ও প্রকাশনা বিভাগ]
৩২১, দিদার মার্কেট (৩য় তলা দেওয়ান বাজার, চট্টগ্রাম-৪০০০, বাংলাদেশ। ফোন : ০৩১-২৮৫৫৯৭৬,

০১. মুখবন্ধ ৫
০২. ইখ্লাসের পরিচিতি ৭
০৩. ইখলাসের আভিধানিক অর্থ ৮
০৪. ইখলাসের পারিভাষিক অর্থ ৯
০৫. নিয়্যত ও ইখলাস ১১
০৬. ইখলাস ও সত্যবাদিতা ১১
০৭. রিয়া, সুম’আহ ও ঔজব ১২
০৮. ইখলাস একটি কঠিন কাজ ১২
০৯. সালফে সালেহীনের ভাষায় ইখলাস ১৪
১০. ইখলাসের স্তরসমূহ ১৮
১১. ইখলাস ক্বোআন করীমে ১৯
১২. ইখলাস পরম সম্মানিত নবী-রাসূলগণ আলাইহিমুস সালামের অনন্য বৈশিষ্ট্য ২৪
১৩ ইখলাস হাদীস শরীফে ২৬
১৪. ইখলাসের সুফল ৩০
১৫. ইখলাস না থাকার ক্ষতি ৪৩
১৬. সালফে সালেহীনের নিকট ইখলাসের গুরুত্ব ৪৯
১৭. ইখলাস বিষয়ে সালফে সালেহীনের অবস্থান ৫২
১৮. ইখলাস থাকা সত্ত্বেও মুখলিস বলে দাবী না করা ৫৩
১৯. ইখলাস থাকা সত্ত্বেও আমলকে গোপন করা ৫৫
২০. গ্রাম্যলোক ও গনীমত ৫৯

২১. লৌকিকতা কৃত্রিমতার ভয় ৬১
২২. জ্ঞান ও কান্নাকে গোপন করা ৬২
২৩. ইমাম আল- মাওয়ারদির কিতাব লিখা ৬৩
২৪. ইমাম যয়নুল আবেদীনের দান রাতে ৬৪
২৫. ইখলাস অর্জনের উপায় সমূহ ৬৫
২৬. ইখলাস শিক্ষা ও অনুশীলন ৬৬
২৭. আত্ম জিজ্ঞাসা ও অধ্যাবসায় ৬৮
২৮. আত্মতৃপ্তি পরিহার করা ৭১
২৯. সৎ ও মুখলিস লোকের সঙ্গ অবলম্বন ৭২
৩০. রিয়ার কাফ্ফারা থেকে বাচাঁর দো‘আ ৭৬
৩১. মুখলিসদের আলামত সমূহ ৭৮
৩২. আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা ৭৮
৩৩. ভিতরের দিক বাহ্যিত দিক থেকে উত্তম ৮২
৩৪. সৎকর্ম প্রত্যাখ্যাত হবার ভয় ৮৩
৩৫. কতিপয় মাসআলা ৮৬
৩৬ রিয়ার আশঙ্কায় আমল ছেড়ে দেয়ার বিধান ৮৮
৩৭ রিয়া থেকে বাচাঁর জন্য মিথ্যার আশ্রয় নেয়া ৯১
৩৮ ইখলাস সম্পর্কে সতকর্তার প্রয়োজনীয়তা ৯২
৩৯ গুনাহের কথা আলোচনা না করা ও গোপন রাখাও ইখলাসের পরিচায়ক ৯৪
৪০ পরিশিষ্ট ৯৬

মুখবন্ধ

بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ

নাহ্মাদুহূ ওয়ানুসাল্লী ওয়া নুসাল্লিমু ‘আলা হাবীবিহিল কারীম
ওয়া ‘আলা- আ-লিহী ওয়া সাহ্বিহী আজমা‘ঈন

রূহ বিহীন কায়া যেমন অচল, ফল বিহীন বৃক্ষ যেমন অকেজো, লবণ বিহীন ব্যঞ্জন যেমন স্বাদহীন, বৃষ্টিহীন মেঘ যেমন নিষ্ফল, ‘ইখলাস’ বা নিষ্ঠাবিহীন ‘আমল’ বা কর্মও তেমনি আল্লাহর দরবারে অগ্রহনযোগ্য ও সাওয়াব শূন্য। তাই, পবিত্র ক্বোরআন ও হাদীস শরীফে কর্মে ইখলাস বা নিষ্ঠার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আর এ ‘ইখলাস’ বা নিষ্ঠা হচ্ছে কোন আমল বা কর্ম নিরেট আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সম্পাদন করা। এটার মধ্যে নিছক পার্থিব কোন উদ্দেশ্য কিংবা লোক দেখানোর মনোভাব থাকতে পারবে না। যদি কোন কর্ম এ ইখলাস ব্যতীত সম্পাদন করা হয়, আল্লাহর সন্তুষ্টির পরিবর্তে পার্থিব কোন উদ্দেশ্য সম্পন্ন হয় কিংবা তাতে লোক দেখানো ভাব থাকে, যেমন ওই কাজের বিনিময়ে পার্থিব নাম বা খ্যাতি ইত্যাদি অর্জনই মূখ্য উদ্দেশ্য থাকে, তবে তাতে হয়তো এ ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীতে ক্ষণস্থায়ী কিছুটা নাম- খ্যাতি লাভ করা যায়, কিন্তু মহান আল্লাহর দরবারে, পরকালে এর বিনিময়ে কোন ফল পাওয়া যাবে না। এর বহু অকাট্য প্রমাণও রয়েছে কোরআন, হাদীস এবং ইসলামী প্রসিদ্ধ গ্রন্থ -পুস্তকে। তাই এ বিষয়টির প্রচুর সংখ্যক প্রমাণ সহকারে আলোচনা করা গেলে অনেক নিষ্ঠাবিহীন আমলকারী এ মারাত্মক ব্যাধি থেকে মুক্ত থাকার চেষ্টা করবে এবং ইখলাস বা নিষ্ঠার সাথে আমল করে এজন্য ব্যয়কৃত শ্রম, অর্থ ও মূল্যবান সময় ইত্যাদির যথার্থ প্রতিদান লাভ করে উভয় জগতে ধন্য হবার সুযোগ পাবেন।
সুখের বিষয় যে, অধ্যাপক মাওলানা সৈয়্যদ মুহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল-আযহারী ‘ইখলাস: ইবাদতের রূহ’ শিরোনামে এ বিষয়ের উপর একটি প্রামাণ্য পুস্তক প্রণয়ন করেছেন, যা ‘আন্জুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট’ চট্টগ্রাম- প্রচার ও প্রকাশনা বিভাগ প্রকাশ করে পাঠক সমাজকে উপহার দিয়েছে। বিজ্ঞ লেখক, তাঁর এ পুস্তকে পুস্তকটির নামের স্বার্থকতা প্রমাণ করতে সমর্থ হয়েছেনে। আমি অধম পুস্তকটিকে সুন্দর অবয়বে আরো সুপাঠ্যভাবে সম্মানিত পাঠক সমাজের হাতে উপস্থাপনের কাজে অংশগ্রহণ করে নিজেকে ধন্য করেছি।

আশাকরি, পুস্তকটি পাঠক সমাজের সমাদর পাবে। আর এতেই আমাদের প্রচেষ্টা ও অংশগ্রহণ সার্থক হবে। মুদ্রণ প্রমাদ থাকতে পারে, আগামীতে এ পূণ্যময় প্রকাশনাকে স্বার্থকভাবে অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে আপনাদের আন্তরিক ও গঠনমূলক পরামর্শ সাদরে গৃহীত হবে। ইনশা-আল্লাহ! ইতি-

সালামান্তে

(মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান)
মহাপরিচালক, আন্জুমান রিসার্চ সেন্টার,
আলমগীর খানক্বাহ শরীফ, ষোলশহর, চট্টগ্রাম

বিসমিল্লাাহির রাহমানির রাহীম

অন্তরের আমলসমূহের প্রথম আমল হল ইখলাস, যা ইবাদতের মগজ ও রূহ এবং আমল কবুল হওয়া কিংবা না হওয়ার মানদ-। আর ইখলাস অন্তরের আমলসমূহের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও সর্বোচ্চ চূড়া এবং আমলসমূহের প্রধান ভিত্তি। আর এটিই হল, সমস্ত নবী ও রাসূলগণের দাওয়াতের চাবিকাঠি।

আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন, وَمَآ أُمِرُوٓاْ إِلَّا لِيَعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ “”] ’=[’][]আর তাদেরকে কেবল এই নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহর ‘ইবাদাত করে তারই জন্য দ্বীনকে একনিষ্ঠ করে”। [সূরা আল-বায়্যিনাহ,আয়াত: ৫]

আল্লাহ তা‘আলা আরও এরশাদ করেন, أَلَا لِلَّهِ ٱلدِّينُ ٱلۡخَالِصُ “জেনে রাখ, খালেস দ্বীন তো আল্লাহরই”। [সূরা আয-যুমার: ৩]

ইখলাস পরিচিতি
ইখলাসের শাব্দিক অর্থ হল অন্য জিনিসের সংমিশ্রণ থেকে মুক্ত হয়ে নির্মল, পরিচ্ছন্ন ও আলাদা হওয়া, খালি করা, পরিস্কার করা। যেমন বলা হয়, هذا الشيء خالص لك: أي لا يشاركك فيه غيرك والخالص من الألوان عندهم ما صفا ونصع. ويقولون خالصة في العشرة: صافاه “এ জিনিসটি খালেসভাবে তোমার। অর্থাৎ এতে কারো অংশীদারিত্ব নেই। খালেস রং বলতে বুঝায়, যা নির্মল ও পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। যেমন আরো বলা হয়, এটি খালেসভাবে দশজনের, অর্থাৎ শুধু দশজনের জন্যই বিশেষিত। ( )
যেমন কুরআনে পাকে এসেছে,وَلَا يُشۡرِكۡ بِعِبَادَةِ رَبِّهِۦٓ أَحَدَۢا “এবং তার রবের ইবাদতে যেন কাউকে শরীক না করে”। [সূরা: আল-কাহফ: ১১০]

ইখলাসের আভিধানিক অর্থ
ইখলাস শব্দটি আরবি خلَص ক্রিয়ার ক্রিয়ামূল (মাসদার)। এ শব্দের مضارع [মুদ্বারে] হল, يُخْلِص আর এর অর্থ হলো, নিরেট বা খাঁটি বস্তু; কোনো বস্তু নির্ভেজাল ও খাঁটি হওয়া এবং তার সাথে কোন কিছুর সংমিশ্রণ না থাকাকে ইখলাস বলে। যেমন, বলা হয় وأخلص الرجل دينه لله অর্থাৎ, লোকটি তার দ্বীনকে কেবল আল্লাহর জন্যই খাস করল। লোকটি তার দ্বীনের বিষয়ে আল্লাহর সাথে কাউকে অংশীদার বা শরীক করেনি।

ক্বোরআন মজীদে মহান আল্লাহ তা‘আলা ইখলাসের কথা উদ্বৃত করে এরশাদ করেন, ‘সে বলেছে আমি অবশ্যই অবশ্যই আদম সন্তানদের পথভ্রষ্ট করে ছাড়বো।” إِلَّاعِبَادَكَ مِنٛهُمُ ٱلٛمُخٛلَصِينَ “তাদের মধ্য থেকে আপনার মুখলিস বা একান্ত বান্দাগণ ছাড়া”। এখানে مخلَصين শব্দটির লাম ‘যবর’ সহকারে রয়েছে। তবে কোনো কোনো ক্বিরাআতে مخلِصين অর্থাৎ লামের নিচে ‘যের’ সহকারেও পড়া হয়েছে।

সা‘লাব রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, مخلِصِين (লাম এর নিচে ‘যের’ সহকারে) এর অর্থ যারা ইবাদতকে কেবল আল্লাহর জন্যই করে থাকেন। আর مُخلَصِينَ (লামের উপর ‘যবর’ সহকারে) এর অর্থ, যাদেরকে আল্লাহ একান্তভাবে নিজের করে নিয়েছেন।

যাজ্জাজ রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আল্লাহর তা‘আলার বাণী-
وَٱذٛكُرۡ فِي ٱلٛكِتَٰبِ مُوسَىٰٓۚ إِنَّهُۥ كَانَ مُخٛلَصٗا وَكَانَ رَسُولٗا نَّبِيّٗا
“আর স্মরণ করুন কিতাবে হযরত মূসাকে। অবশ্যই তিনি ছিলেন ‘মুখলাস’ (একান্ত করে নেওয়া) এবং তিনি ছিলেন রাসূল ও নবী”। [সূরা মারয়াম,আয়াত: ৫১]

এখানে مخلَصاً শব্দটির লাম ‘যবর’ সহকারে রয়েছে। তবে কোনো কোনো ক্বিরাআতে مخلِصاً অর্থাৎ লামের নিচে ‘যের’ সহকারেও পড়া হয়েছে। আর مخلَص শব্দের অর্থ: আল্লাহ যাকে খাঁটি করেছেন এবং ময়লা-আবর্জনা হতে মুক্ত করে যাকে নির্বাচন করেছেন। আর মুখলিস مخلِص শব্দের অর্থ: যে একান্তভাবে আল্লাহর এককত্ব বা তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করেছে।

এ কারণেই قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ [হে হাবীব! আপনি বলুন, আল্লাহ এক]। এ সূরাটিকে সূরা ইখলাস নামে নামকরণ করা হয়েছে। [কারণ, এ সূরাটিতে আল্লাহর এককত্বের ঘোষণা রয়েছে] আল্লামা ইবনুল আসীর রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, এ সূরাটিকে সূরা ইখলাস বলে নাম রাখার কারণ হল, এ সূরাটি আল্লাহ তা‘আলার সিফা-ত বা গুণাবলী বর্ণনার জন্য নির্দিষ্ট। অথবা এ জন্যে যে, এ সূরার তিলাওয়াতকারী আল্লাহর জন্য খালেসভাবে তাওহীদ বা তাঁর এককত্বকে স্বীকার করে।
আর ‘কালিমাতুল ইখলাস’ বলতে ‘কালেমাতুত তাওহীদকেই’ বুঝানো হয়ে থাকে।
খালেস বস্তু বলতে বুঝায়- ওই পরিষ্কার বস্তুকে, যা থেকে যাবতীয় মিশ্রণ দূরীভূত করা হয়েছে।( )

আল্লামা ফিরোযাবাদী বলেন, أخلص لله এ কথার অর্থ হল, “সে রিয়া তথা প্রদর্শনেচ্ছা বা লৌকিকতা ছাড়ল।”( ) আল্লামা জুরজানী বলেন, ইখলাসের আভিধানিক অর্থ: “ইবাদত-আনুগত্যে রিয়া তথা প্রদর্শনেচ্ছা পরিহার করা।”( )

ইখলাসের পারিভাষিক অর্থ
আলেমগণ ইখলাসের একাধিক সংজ্ঞা বর্ণনা করেছেন। ওই গুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সংজ্ঞা নিম্নে উল্লেখ করা হল:
আল্লামা জুরজানী বলেন, “মানবাত্মার পরিচ্ছন্নতায় বিঘœ ঘটায় এ ধরনের যাবতীয় ময়লা-আবর্জনা থেকে অন্তর খালি করাকেই ইখলাস বলে। আর সেটার মূলকথা হচ্ছে, প্রতিটি বস্তুর ক্ষেত্রে এ কথা চিন্তা করা যায় যে, তার সাথে কোনো না কোনো বস্তুর সংমিশ্রণ থাকতে পারে, তবে যখন কোনো বস্তু অন্য কিছুর সংমিশ্রণ থেকে মুক্ত হয়, তখন তাকে খালেস বা খাঁটি বস্তু বলা হয়। আর এ খাঁটি করার কাজটি সম্পাদন করার নাম হচ্ছে ইখলাস।”

আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
وَإِنَّ لَكُمۡ فِي ٱلۡأَنۡعَٰمِ لَعِبۡرَةٗۖ نُّسۡقِيكُم مِّمَّا فِي بُطُونِهِۦ مِنۢ بَيۡنِ فَرۡثٖ وَدَمٍ لَّبَنًا خَالِصٗا سَآئِغٗا لِّلشَّٰرِبِينَ
“আর নিশ্চয় চতুষ্পদ জন্তুতে রয়েছে তোমাদের জন্য শিক্ষা। তার পেটের ভেতরের গোবর ও রক্তের মধ্যখান থেকে তোমাদেরকে আমি দুধ পান করাই, যা খাঁটি এবং পানকারীদের জন্য স্বাচ্ছন্দ্যকর”। [সূরা নাহল, আয়াত: ৬৬]

এখানে দুধ খাঁটি হওয়ার অর্থ তার মধ্যে রক্ত ও গোবর ইত্যাদির কোনো প্রকার সংমিশ্রণ থাকার অবকাশ না থাকা।( )

আবার কেউ কেউ বলেন, ইখলাস হল, “আমলগুলো যাবতীয় ময়লা-আবর্জনা মুক্ত ও নির্ভেজাল করা।”( )

হুযাইফা আল মুরআশী বলেন, “বান্দার ইবাদত প্রকাশ্য ও গোপনে উভয় অবস্থাতে একই পর্যায়ের হওয়ার নাম ইখলাস”।( )

আবার কেউ কেউ বলেন, ইখলাস হচ্ছে, আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে স্বীয় আমলের উপর সাক্ষ্য হিসেবে তালাশ না করা, আর বিনিময়দাতা হিসেবেও কেবল তাঁকেই গ্রহণ করা।”( )

‘নিয়ত’ ও ‘ইখলাস’
মুখলিস ওই ব্যক্তি, যে আল্লাহর সাথে তার আত্মা খাঁটি ও সংশোধিত হওয়ায়, মানুষের অন্তর থেকে তার মান-মর্যাদা পুরোপুরি বের হওয়াতে কোনো প্রকার পরওয়া করে না। তার আমলের একটি কণা বা বিন্দু পরিমাণ বিষয়েও মানুষ অবগত হোক, তা সে পছন্দ করে না।

অনেক সময় দেখা যায়, মানুষের কথায় ও শরীয়তের ভাষায়, ‘নিয়্যত’ শব্দটি ‘ইখলাস’ এর স্থানে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে ফিকহবিদদের মতে নিয়্যতের মূল হচ্ছে, স্বাভাবিক কর্মকা- থেকে ইবাদতকে পৃথক করা এবং এক ইবাদতকে অপর ইবাদত থেকে আলাদা করা।( )

স্বাভাবিক কর্ম থেকে ইবাদতকে পৃথক করা, যেমন- পরিচ্ছন্নতার জন্য গোসল করা থেকে নাপাক হওয়ার কারণে গোসল করাকে আলাদা করা।
এক ইবাদত থেকে অপর ইবাদতকে পৃথক করা। যেমন- যোহরের নামাযকে আসরের নামায থেকে পৃথক করা।

উল্লেখিত সংজ্ঞার আলোকে বলা যায় যে, নিয়্যতের বিষয়টি আমাদের আলোচনার আলোচ্য বিষয় নয়। কিন্তু যদি কেউ নিয়ত শব্দ বলে, আমল দ্বারা উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা বুঝায় এবং আমলটি মহান আল্লাহ- যার কোনো শরীক নাই- তার জন্য, নাকি আল্লাহ ও গাইরুল্লাহ উভয়ের জন্য? (তা নির্ধারণ করা বুঝায়) তাহলে এ ধরনের ‘নিয়ত’ ‘ইখলাস’- এর অর্থের অন্তর্ভুক্ত (আর তখন তা আমাদের আলোচ্য বিষয় হিসেবে গণ্য হবে)।

‘ইখলাস’ ও ‘সত্যবাদিতা’
ইবাদতে ‘ইখলাস’ ও ‘সত্যবাদিতা’ উভয় শব্দ অর্থের দিক বিবেচনায় প্রায় কাছাকাছি। তবে উভয়ের মাঝে সামান্য পার্থক্য আছে।

প্রথম পার্থক্য: সত্যবাদিতা হল মূল এবং তা সর্বাগ্রে। আর ইখলাস হল, তার শাখা ও অনুগামী।
দ্বিতীয় পার্থক্য: যতক্ষণ পর্যন্ত বান্দা তার আমলে প্রবেশ করে না ইখলাস ততক্ষণ পর্যন্ত অস্তিত্বে আসে না। আমলে প্রবেশ করার পরই ইখলাসের প্রশ্ন আসে। পক্ষান্তরে ‘সত্যবাদিতা’ তা আমলে প্রবেশ করার পূর্বেও হতে পারে।( )

রিয়া, সুম‘আ ও ‘উজব
ইখলাসের অভাবে মানুষের অনেক ইবাদত নষ্ট হয়ে যায়। এটা হয়ত রিয়া, সুনাম সুখ্যাতি, অহমিকা ইত্যাদির কারণে হতে পারে।
রিয়া: রিয়া হলো লোক দেখানোর জন্য ইবাদত করা, যাতে লোক তার প্রশংসা করে এবং সে এর দ্বারা নিজের বড়ত্ব, প্রশংসা, আকাঙ্ক্ষা ও ভীতি প্রকাশ করেন।
সুম‘আ: সুম‘আ বলতে বুঝায় মানুষের সুনাম সুখ্যাতি শোনার জন্য ইবাদত করা। অতএব রিয়া মানুষের চোখের সাথে সম্পৃক্ত আর সুম‘আ শ্রবণের সাথে সম্পৃক্ত।
‘উজব: আর ‘উজব তথা অহমিকা বিষয়টি রিয়ার কাছাকাছি।

ইখলাস একটি কঠিন কাজ

ইখলাসের গুরুত্ব ও মর্যাদা সত্বেও, আমরা জানি, নি:সন্দেহে ইখলাস নফসের জন্য কঠিন একটি বিষয়। কারণ, নফস এবং প্রবৃত্তি ও নফসের আকাঙ্খার মাঝে ইখলাস এক কঠোর দেয়াল ও বাধা হয়ে নিজেকে উপস্থিত করে।
নিজ প্রবৃত্তি, সামাজিক অবস্থা ও শয়তানের কুমন্ত্রণা মুকাবিলা করে ইখলাস ধরে রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এর উপর অটল থাকতে সংগ্রাম ও অধ্যবসায়ের প্রয়োজন। এ সংগ্রাম শুধু সাধারণ মানুষ করবে তা কিন্তু নয় বরং আলেম-উলামা, পীর-মাশায়েখ, ইসলাম প্রচারক ও নেককার-মুত্তাকী-সকলের প্রয়োজন।

হযরত সূফিয়ান আস-সাওরী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন: আমার কাছে নিজের নিয়্যত ঠিক করার কাজটা যত কঠিন মনে হয়েছে অন্য কোন কাজ আমার জন্য এত কঠিন ছিল না। কতবার নিয়্যত ঠিক করেছি কিন্তু কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই আবার পাল্টে গেছে। ( )

হযরত ইউসূফ ইবনে হুসাইন রাযী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন: দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন কাজ হল ইখলাসের উপর অটল থাকা। আমি আমার অন্তর থেকে রিয়া (লোক দেখানো ভাবনা) দূর করার জন্য কত প্রচেষ্টা চালিয়েছি, সে দূর হয়েছে বটে তবে আবার ভিন্ন আকৃতিতে, ভিন্ন রূপে উপস্থিত হয়েছে।( )

হযরত সাহ্ল ইবনে আব্দুল্লাহ রহমাতুল্লাহি আলাইহিকে প্রশ্ন করা হল, আপন প্রবৃত্তির নিকট কঠিনতম কর্ম কি? তিনি বললেন, ইখলাস। কেননা, প্রবৃত্তি কখনো ইখলাস গ্রহণ করতে চায় না। ( )
তাই, মন্দকর্মে প্রণোদনাদাতা নফস বান্দার কাছে ইখলাসকে মন্দরূপে উপস্থাপন করে, দৃশ্যমান করে তোলে এমন রূপে, যা সে ঘৃণা করে মনেপ্রাণে। সে দেখায়, ইখলাস অবলম্বনের ফলে তাকে ত্যাগ করতে হবে বিলাসী মনোবৃত্তির দাসত্ব, তোষামোদী স্বভাব।

সুতরাং, বান্দা যখন তার আমলকে একনিষ্ঠতায় নিবিষ্ট করে, আল্লাহ ব্যতীত ভিন্ন কেউ তার কর্মের উদ্দেশ্য হয় না, তখন বাধ্য হয়েই বিশাল একটি শ্রেণীর সাথে তাকে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হয়, তারাও তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে, একে অপরের ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়।

এ জন্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অধিকাংশ সময় এ দো‘আ পাঠ করে উম্মতকে সতর্ক করে দিয়েছেন অন্তরের পরিবর্তনের বিষয়ে:
عن أَنَسٍ رضى الله عنه قَالَ: كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يُكْثِرُ أَنْ يَقُولَ: يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلَى دِينِكَ
“হে অন্তর পরিবর্তনকারী ! আমার অন্তর আপনার দ্বীনের উপর অবিচল রাখুন!”( )

সালাফে সালেহীনের ভাষায় ইখলাস

ইখলাসের অর্থে হযরাতে সালাফে সালেহীন থেকে বহু উক্তি বর্ণিত রয়েছে, যেমন-
হযরত ইয্য ইবন আব্দুস সালাম রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ইখলাস হচ্ছে, বান্দাহ কর্তৃক একমাত্র আল্লাহর জন্যই আনুগত্য করা, এতে মানুষের থেকে কোনো সম্মান ও মর্যাদা প্রত্যাশা না করা, দীনি কোনো ফায়েদা কামনা বা দুনিয়াবী কোন ক্ষতি থেকে রক্ষার কোনো আশা না করা। ( )

হযরত সাহল ইবন আব্দুল্লাহ তসতরী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
“الإخلاص أن يكون سكون العبد وحركاته لله تعالى خاصة”
“বান্দাহর স্থিরতা, নড়াচড়া সব কিছুই একমাত্র মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে করার নাম হলো ইখলাস।

কেউ কেউ বলেন, অন্তরকে একমাত্র আল্লাহর জন্য নিবদ্ধ করাকে ইখলাস বলে। অর্থাৎ তিনি ব্যতীত অন্য কারো জন্য কোনো ব্যস্ততা না রাখা। আর এটা সর্বোচ্চ দরজার ইখলাস। ( )

হযরত হারওয়ী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ইখলাস হচ্ছে, সংমিশ্রণ থেকে মুক্ত থেকে পরিচ্ছন্ন আমল করা।

হযরত আবু আব্দুল্লাহ তুসতারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি কে জিজ্ঞেস করা হলো, “কোন জিনিসটি নফসের সবচেয়ে বেশি কঠিন? তিনি বললেন, ইখলাস; কেননা এতে নফসের কোনো অংশ নেই”।

হযরত সুফইয়ান সাওরী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
مَا عَالَجْتُ شَيْئًا أَشَدَّ عَلَيَّ مِنْ نِيَّتِي، إِنَّهَا تَقَلَّبُ عَلَيَّ .
“আমার নিয়্যাতের চেয়ে কোন কিছুতে বেশি প্রচেষ্টা চালাই নি। এটা খুব দ্রুত পরিবর্তনশীল”। ( )
হযরত আবূ সুলাইমান আদদারানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “যার একটিমাত্র কদম (আমল) সহীহ হয়েছে এবং তা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই করেছে তার জন্য সুসংবাদ”।

হযরত হামদুল ইবন আহমদ রহমাতুল্লাহি আলাইহিকে বলা হলো সালাফদের কথা আমাদের কথার চেয়ে কল্যাণকর ছিল কেন? তিনি বলেন, “তাঁরা ইসলামের মর্যাদা বৃদ্ধি, নিজের নাজাত লাভ ও রহমানের সন্তুষ্টি লাভের জন্য কথা বলতেন, আর আমরা নিজের মর্যাদা বৃদ্ধি, দুনিয়া লাভ ও সৃষ্ট মানুষের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কথা বলি”।

হযরত তামীম আদ-দারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি: এক ব্যক্তি তামীম আদ-দারী রহমাতুল্লাহি আলাইহিকে তাঁর রাতের সালাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি অত্যন্ত রাগান্বিত হলেন। তিনি বললেন, “গভীর রাতে গোপনে এক রাক‘আত সালাত আদায় করা সারারাত সালাতের চেয়েও আমার কাছে উত্তম। অতঃপর তিনি একথা মানুষকে বলতেন”।

হযরত আইয়ূব আস-সাখতিয়ানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “যে ব্যক্তি নিজে বিখ্যাত হতে চায় সে কখনও প্রকৃত বান্দাহ হতে পারবে না”।

হযরত আইয়ুব আসসাখতিয়ানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি আরও বলেছেন, “সব কাজের মধ্যে নিয়্যাতের বিশুদ্ধতা সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার”।

হযরত ফুদাইল ইবন ‘ইয়াদ্ব রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “মানুষের কারণে আমল বাদ দেওয়া রিয়া (লৌকিকতা), আর মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে আমল করা শির্ক, এ দুটি থেকে আল্লাহ মুক্ত করলে তা হলো ইখলাস”।

ইমাম শাফে‘য়ী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, “আমার ইচ্ছা হয় যে, মানুষ আমার লিখিত কিতাবসমূহ পড়ে ইলম অর্জন করুক তবে তারা যেন এগুলো আমার দিকে নিসতব না করে অর্থাৎ আমার নাম উল্লেখ না করে”।

তিনি আরো বলেন, “আমি কখনও কারো উপর জয়লাভ করতে বিতর্ক করিনি, একমাত্র সত্যকে প্রকাশ করার জন্যই তর্ক বিতর্ক করেছি”।

তিনি আরো বলেন, “আমি যখন কারো সাথে কথা বলেছি তখন তাকে সংশোধন ও সত্যের ব্যাপারে সাহায্য করতে চেয়েছি, আর আশা করেছি যে, তার উপর আল্লাহর রক্ষণাবেক্ষণ ও হেফাযত থাকুক”।

ইমাম শাফে‘য়ী রহমাতুল্লাহি আলাইহির এসব কথা মুখলিসীনের ইখলাসের কথাই প্রমাণ করে। আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দাদের আলামত হলো তাঁরা নিজেদের জন্য কোনো আমল করতেন না, বরং তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছিল মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন।
আর তাঁরা সর্বদা সত্য শিক্ষা দেওয়া ও প্রকাশ করতে ব্রতী ছিলেন। কারো সাথে সংলাপ করলে তাতে বিজয়ের মানসিকতা ছিল না, বরং সত্য প্রকাশই ছিল তাঁদের লক্ষ্য। তাঁরা সর্বদা আশা করতেন যে, আল্লাহ যেন আলোচনার মাধ্যমে হককে প্রকাশ করে দেন।
তাঁরা আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে মানুষের অন্তর থেকে সব সম্মান এবং মর্যাদাও যদি শেষ হয়ে যায় তাতে মুখলিস ব্যক্তি কোনো পরোয়া করেন না। আর তাঁরা তাঁদের সামান্য আমলও মানুষের কাছে প্রকাশ করতে পছন্দ করেন না।
হযরত বিশর আল-হাফী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “দ্বীনের বিনিময়ে দুনিয়ার কিছু চাওয়ার চেয়ে বাঁশি বাজিয়ে দুনিয়ার কিছু চাওয়া আমার কাছে উত্তম”।

হযরত ইয়াহইয়া ইবনে আবু কাসীর রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “তোমরা নিয়্যত শিক্ষা কর। কেননা তা আমলের চেয়েও অধিক জরুরী”।

হযরত ইবন ‘আক্বীল রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “আবূ ইসহাক ফাইরুযাবাদী গরীবকে কিছু দান করার আগে নিয়্যত করতেন। কোন মাসয়ালা সম্পর্কে কিছু বলার আগে আল্লাহর সাহায্য চাইতেন ও মানুষের কাছে সাজিয়ে ও রাঙ্গিয়ে কিছু বলা ছাড়াই সঠিক রায়ের জন্য ইখলাস কামনা করতেন। দু’রাক‘আত সালাত আদায় করা ব্যতীত তিনি কোন মাসয়ালা লেখেননি। ফলে তাঁর ইখলাসের বদৌলতে সারা দুনিয়ায় তাঁর গ্রন্থাদি প্রসিদ্ধি লাভ করেছে”।( )

কোনো এক সালাফ বলেন, “আমি সব কাজে নিয়্যত করতে পছন্দ করি; এমনকি আমার খাওয়া দাওয়া, পান করা, ঘুমানো ও বাথরুমে যাওয়া ইত্যাদি কাজে”।

আবার কেউ কেউ বলেন, ইখলাস হলো সৃষ্টজগতের কারো পর্যবেক্ষণ ও সমালোচনার ভয় না করে একমাত্র আল্লাহর জন্য আমল করা।

আবার কেউ কেউ বলেন, মুখলিস হলো যিনি তাঁর অন্তরের সঠিকতা ও সততার জন্য আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনে মানুষের সম্মান বা অসম্মানের কোনো পরোয়া করেন না। তার আমলের সামান্য পরিমাণও মানুষের কাছে প্রকাশ করেন না।

আবার কেউ কেউ বলেন, যাবতীয় আমল একমাত্র আল্লাহর জন্য করা; যাতে গাইরুল্লাহ বা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও জন্য সেখানে কোনো অংশ না থাকে।

আবার কেউ কেউ বলেন, আমলকে সৃষ্টিকুলের সবার পর্যবেক্ষণ মুক্ত করে স্বচ্ছ করা (কেবল আল্লাহর পর্যবেক্ষণে রাখা)।

আবার কেউ কেউ বলেন, আমলকে যাবতীয় (রিয়া, সুম্আহ্ ইত্যাদির) মিশ্রণ থেকে স্বচ্ছ রাখা।”( )

মোটকথা হলো, ইবাদত-বন্দেগী, যাবতীয় সৎকর্ম সম্পাদন ও অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি সব কিছুই মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করার নাম ইখলাস।

ইখলাসের স্তরসমূহ

প্রথম স্তর: আমলের মধ্যে লৌকিকতা বর্জন করা ও তা আল্লাহর দয়ায় ও তাওফীক্বে হয়েছে বলে বিশ্বাস করা, প্রতিদান না চাওয়া এবং আমলের কারণে আত্মসন্তুষ্ট না হওয়া; বরং নিজের অক্ষমতা ও স্বল্পতার জন্য সর্বদা লজ্জিত থাকা। আল্লাহর বাণী,
وَلَوۡلَا فَضۡلُ ٱللَّهِ عَلَيۡكُمۡ وَرَحۡمَتُهُۥ مَا زَكَىٰ مِنكُم مِّنۡ أَحَدٍ أَبَدٗا وَلَٰكِنَّ ٱللَّهَ يُزَكِّي مَن يَشَآءُۗ
“আর যদি তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর দয়া না থাকত, তাহলে তোমাদের কেউই কখনো পবিত্র হতে পারত না; কিন্তু আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন পবিত্র করে দেন”। [সূরা আন্-নূর: ২১]

দ্বিতীয়ত: আমলকারীর মনে রাখা উচিত যে সে আল্লাহর একজন বান্দা। আর বান্দা যা করে তার বিনিময়ে মুনিব ও মাওলার কাছে কিছু প্রত্যাশা করতে পারে না।
তৃতীয়ত: নিজের আমলের মধ্যে দোষত্রুটি ও কমতি সর্বদা তালাশ করা।

দ্বিতীয় স্তর: নিজের সাধ্যমত চেষ্টা করার পরেও আমল কবুল হবার বিষয়ে শংকিত থাকা, নিজেকে মনে করা যে আল্লাহর জন্য যথাযথভাবে কাজটি করা হয়নি। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন,
وَٱلَّذِينَ يُؤۡتُونَ مَآ ءَاتَواْ وَّقُلُوبُهُمۡ وَجِلَةٌ أَنَّهُمۡ إِلَىٰ رَبِّهِمۡ رَٰجِعُونَ
“আর যারা যা দান করে তা ভীত-কম্পিত হৃদয়ে করে থাকে এজন্য যে, তারা তাদের রবের দিকে প্রত্যাবর্তনশীল”। [সূরা আল-মুমিনূন: ৬০]

সুতরাং মু’মিন সর্বদা আল্লাহর দয়া কামনা করবে এবং নিজের কমতির জন্য নিজেকে দোষারোপ করবে।
তৃতীয় স্তর: আমলটি ইলম অনুযায়ী বিশুদ্ধ হওয়া, মনগড়া বা নিজ খেয়াল খূশী হতে মুক্ত হওয়া। ( )

ইখলাস ক্বোরআনুল করীমে

আল্লাহ তা‘আলা তার কিতাবের একাধিক জায়গায় তার বান্দাদের ইখলাস অবলম্বন করার নির্দেশ দেন। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
وَمَآ أُمِرُوٓاْ إِلَّا لِيَعۡبُدُواْ ٱللهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ حُنَفَآءَ وَيُقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَيُؤۡتُواْ ٱلزَّكَوٰةَۚ وَذَٰلِكَ دِينُ ٱلۡقَيِّمَةِ
“আর তাদেরকে কেবল এই নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহর ‘ইবাদাত করে তারই জন্য দ্বীনকে একনিষ্ঠ করে, নামায কায়েম করে এবং যাকাত দেয়; আর এটিই হল সঠিক দ্বীন”। [সূরা আল-বায়্যিনাহ, আয়াত: ৫]

আল্লাহ তা‘আলা তার প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ইবাদতে মুখলিস বলে দাবী করার নির্দেশ দেন এবং বলেন,
قُلِ ٱللهَ أَعۡبُدُ مُخۡلِصٗا لَّهُ دِينِي বলুন, ‘আমি আল্লাহর-ই ইবাদত করি, তারই জন্য আমার আনুগত্য একনিষ্ঠ করে’। [সূরা যুমার, আয়াত: ১৪]

আল্লাহ তা‘আলা আরও এরশাদ করেন,
قُلۡ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحۡيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ . لَا شَرِيكَ لَهُۥۖ وَبِذَٰلِكَ أُمِرۡتُ وَأَنَا۠ أَوَّلُ ٱلۡمُسۡلِمِينَ
“বলুন, নিশ্চয় আমার নামায, আমার ক্বোরবানী, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু আল্লাহর জন্য, যিনি সকল জাহানের রব। তাঁর কোনো শরীক নেই এবং আমাকে এরই নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। আর আমি মুসলিমদের মধ্যে প্রথম’। [সূরা আন‘আম, আয়াত: ১৬১, ১৬২]

আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিজের সম্পর্কে বর্ণনা দিতে গিয়ে এরশাদ করেন, তিনি মানুষের হায়াত ও মওতকে সৃষ্টি করেছেন, যাতে তিনি মানুষকে পরীক্ষা করেন, তাদের মধ্যে উত্তম ও সুন্দর আমলকারী কে?
আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
ٱلَّذِي خَلَقَ ٱلۡمَوۡتَ وَٱلۡحَيَوٰةَ لِيَبۡلُوَكُمۡ أَيُّكُمۡ أَحۡسَنُ عَمَلٗاۚ وَهُوَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡغَفُورُ
“যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন যাতে তিনি তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন যে, কে তোমাদের মধ্যে আমলের দিক থেকে উত্তম। আর তিনি মহাপরাক্রমশালী, অতিশয় ক্ষমাশীল”। [সূরা মুলুক, আয়াত: ২]

হযরত ফুদ্বাইল ইবনে আয়াদ্ব রহমাতুল্লাহি আলাইহি সুন্দর আমল সম্পর্কে বলেন,
قال الفضيل بن عياض رحمه الله في قوله تعالى: لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا )الملك: ২(، قال: “أخلصه وأصوبه” قالوا: يا أبا علي وما أَخْلَصُهُ ؟ وما أَصْوَبُهُ؟ قال: إِنَّ الْعَمَلَ إِذَا كَانَ خَالِصًا وَلَمْ يَكُنْ صَوَابًا لَمْ يُقْبَلْ، وَإِذَا كَانَ صَوَابًا وَلَمْ يَكُنْ خَالِصًا لَمْ يُقْبَلْ حَتَّى يَكُونَ خَالِصًا صَوَابًا، وَالْخَالِصُ إِذَا كَانَ لِلَّهِ، وَالصَّوَابُ: إِذَا كَانَ عَلَى السُّنَّةِ ” )حلية الأولياء: ৩/৩৯৪(.
“যাতে তিনি তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন যে, কে তোমাদের মধ্যে আমলের দিক থেকে সবচেয়ে বেশী সুন্দর” (মুলক, আয়াত-০২)
এ আয়াত প্রসঙ্গে হযরত ফুদ্বাইল ইবনে আয়াদ্ব রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “সেটা (সুন্দর আমল)হচ্ছে, বেশি ইখলাস অবলম্বনকারী ও সঠিক আমলকারী।
লোকেরা তাকে জিজ্ঞাসা করল, হে আবূ আলী! বেশি ইখলাস অবলম্বনকারী ও সঠিক আমলকারী’ এ কথার অর্থ কি? উত্তরে তিনি বললেন, “আমল যদি খালেসভাবে একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে হয়, কিন্তু তা সঠিক না হয়, তা হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। আর যদি সঠিক হয় কিন্তু খালেসভাবে একমাত্র আল্লাহর জন্য না হয়, তবে তাও গ্রহণযোগ্য হবে না।
আমল অবশ্যই খালেস ও সঠিক হতে হবে। কেবল আল্লাহর জন্য আমল করাকে খালেস বলে। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত অনুযায়ী আমল করাকে সঠিক বলে”। ( )

তাই প্রতিটি আমল ক্ববূল হওয়ার জন্য নিম্মোল্লেখিত দু’টি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত পূর্ণ হতে হবে:
১- ব্যক্তি কাজটি একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করবে।
২- কাজটি ক্বোরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী হতে হবে।
উপরোক্ত দু’টি শর্তের কোনো একটি পাওয়া না গেলে কাজটি বিশুদ্ধ ও কবুল হবে না।

এ ব্যাপারে ক্বোরআনের দলিল হলো,
فَمَن كَانَ يَرۡجُواْ لِقَآءَ رَبِّهِۦ فَلۡيَعۡمَلۡ عَمَلٗا صَٰلِحٗا وَلَا يُشۡرِكۡ بِعِبَادَةِ رَبِّهِۦٓ أَحَدَۢا
“সুতরাং যে তার রবের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার রবের ইবাদাতে কাউকে শরীক না করে”। [সূরা আল-কাহফ: ১১০]

হাফিয ইবনে কাসীর রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “এ দু’টি কাজ আমল ক্ববূল হওয়ার শর্ত। তাই আমলটি একমাত্র মহান আল্লাহর জন্যই হতে হবে এবং তা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরীয়ত অনুযায়ী হতে হবে।”

মহান আল্লাহ তা‘আলার বাণী,
فَمَن كَانَ يَرۡجُواْ لِقَآءَ رَبِّهِۦ فَلۡيَعۡمَلۡ عَمَلٗا صَٰلِحٗا وَلَا يُشۡرِكۡ بِعِبَادَةِ رَبِّهِۦٓ أَحَدَۢا
“সুতরাং যে তার রবের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার রবের ইবাদাতে কাউকে শরীক না করে।” [সূরা কাহাফ, আয়াত: ১১০]

আমীর আস-সানআনী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
تقَضَّتْ بكَ الأَعْماُر في غَيْرِ طَاعَةٍ سِوَى عَمَل تَرْضَاُه وَهْوَ سَرابُ
إذِا لَم يَكنْ للهِ فعِلُكَ خَالِصاً فَكلُّ بنَاءٍ قَدْ بنيَتَ خَرابُ
فَلِلْعَمَلِ الِإخْلَاصُ شَرْطٌ إذِا أَتَى وَقَدْ وَافَقَتْهُ سُنَّةٌ وَكِتَابُ
“তোমার সারা জীবন আল্লাহর নাফরমানিতে অতিবাহিত হল। কেবল এমন কিছু আমল যা তোমার সন্তুষ্টি বিধান করে, আসলে তা মরিচিকা,
যখন তোমার কর্ম খালেসভাবে আল্লাহর জন্য হবে না তখন তুমি যত ঘরই বানাও না কেন, তা বিরান ঘর।
আমলের জন্য তো ইখলাস শর্ত। যখন তুমি আমলে ইখলাস নিশ্চিত করার সাথে তা ক্বোরআন ও সূন্নাহ অনুযায়ী কর।”

আল্লাহর জন্য সর্বাঙ্গিন আত্মসমর্পন এবং ইহসান তথা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নতের অনুসরণ করাকে আল্লাহ তা‘আলা ‘সর্বাধিক সুন্দর দ্বীন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
তিনি বলেন,
وَمَنْ أَحْسَنُ دِينًا مِّمَّنْ أَسْلَمَ وَجْهَهُۥ لِلَّهِ وَهُوَ مُحْسِنٌ وَٱتَّبَعَ مِلَّةَ إِبْرَٰهِيمَ حَنِيفًا ۗ وَٱتَّخَذَ ٱللَّهُ إِبْرَٰهِيمَ خَلِيلًا
“আর দ্বীনের ব্যাপারে তার তুলনায় কে উত্তম, যে সৎকর্ম পরায়ণ অবস্থায় আল্লাহর কাছে নিজকে পূর্ণ সমর্পণ করল এবং একনিষ্ঠ ভাবে ইবরাহীমের আদর্শ অনুসরণ করল? আর আল্লাহ ইবরাহীমকে পরম বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছেন।” [সূরা নিসা, আয়াত: ১২৫] এখানে আল্লাহর জন্য পূর্ণাঙ্গ আত্মসমর্পণ বা আনুগত্য করার অর্থ ইখলাস, আর এহসান অর্থ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের অনুসরণ।

আল্লাহ তা‘আলা তার প্রিয় নবী ও তার প্রিয় নবীর উম্মতকে মুখলিসদের সাথে থাকার নির্দেশ দেন। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
وَٱصۡبِرۡ نَفۡسَكَ مَعَ ٱلَّذِينَ يَدۡعُونَ رَبَّهُم بِٱلۡغَدَوٰةِ وَٱلۡعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجۡهَهُۥۖ وَلَا تَعۡدُ عَيۡنَاكَ عَنۡهُمۡ تُرِيدُ زِينَةَ ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَاۖ
“আর আপনি নিজেকে তাদের সংসর্গে আবদ্ধ রাখুন যারা সকাল-সন্ধ্যা নিজেদের রবকে ডাকে তাঁর সন্তুষ্টি হাছিলের জন্য এবং আপনি তাদের থেকে আপনার দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবেন না দুনিয়াবী জীবনের সৌন্দর্য কামনায়। [সূরা কাহ্ফ, আয়াত: ২৮]

আর যাঁরা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করেন, তাঁদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন, “অবশ্যই তারা সফলকাম”। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
فَـَٔاتِ ذَا ٱلْقُرْبَىٰ حَقَّهُۥ وَٱلْمِسْكِينَ وَٱبْنَ ٱلسَّبِيلِ ۚ ذَٰلِكَ خَيْرٌ لِّلَّذِينَ يُرِيدُونَ وَجْهَ ٱللهِ ۖ وَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلْمُفْلِحُونَ
“অতএব আত্মীয়-স্বজনকে তাদের হক দিয়ে দাও এবং মিসকিন ও মুসাফিরকেও। এটি উত্তম তাদের জন্য, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি চায় এবং তারাই সফলকাম।” [সূরা রোম, আয়াত: ৩৮]

আর আল্লাহ তা‘আলা মুখলিসকে জাহান্নাম হতে মুক্তি দেয়ার ও কিয়ামতের দিনে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের প্রতিশ্রুতি দেন। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
وَسَيُجَنَّبُهَا ٱلۡأَتۡقَى. ٱلَّذِي يُؤۡتِي مَالَهُۥ يَتَزَكَّىٰ . وَمَا لِأَحَدٍ عِندَهُۥ مِن نِّعۡمَةٖ تُجۡزَىٰٓ . إِلَّا ٱبۡتِغَآءَ وَجۡهِ رَبِّهِ ٱلۡأَعۡلَىٰ . وَلَسَوۡفَ يَرۡضَىٰ .
“তা (জাহান্নাম) থেকে দূরে রাখা হবে পরম মুত্তাকীকে। যে তার সম্পদ দান করে আত্ম-শুদ্ধির উদ্দেশ্যে, আর তার প্রতি কারো এমন কোন অনুগ্রহ নেই, যার প্রতিদান দিতে হবে। কেবল তার মহান রবের সন্তুষ্টির প্রত্যাশায় আর অচিরেই সে সন্তোষ লাভ করবে। [সূরা লাইল, আয়াত: ১৭-২১]

আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতিদের গুণাবলী বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, “তারা দুনিয়াতে মুখলিস।” আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
إِنَّمَا نُطۡعِمُكُمۡ لِوَجۡهِ ٱللَّهِ لَا نُرِيدُ مِنكُمۡ جَزَآءً وَلَا شُكُورًا
“তারা বলে, ‘আমরা তো আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তোমাদেরকে খাদ্য দান করি। আমরা তোমাদের থেকে কোনো প্রতিদান চাই না এবং কোন শোকরও না।” [সূরা ইনসান, আয়াত: ৯]

আর আল্লাহ তা‘আলা মুখলিসদের ক্বিয়ামতের দিন মহা বিনিময় দেয়ার ঘোষণা দেন। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
لَّا خَيۡرَ فِي كَثِيرٖ مِّن نَّجۡوَىٰهُمۡ إِلَّا مَنۡ أَمَرَ بِصَدَقَةٍ أَوۡ مَعۡرُوفٍ أَوۡ إِصْلَـٰحٍ بَيۡنَ ٱلنَّاسِۚ وَمَن يَفۡعَلۡ ذَٰلِكَ ٱبۡتِغَآءَ مَرۡضَاتِ ٱللَّهِ فَسَوۡفَ نُؤۡتِيهِ أَجۡرًا عَظِيمٗا
“তাদের গোপন পরামর্শের অধিকাংশে কোনো কল্যাণ নাই। তবে [কল্যাণ আছে] যে নির্দেশ দেয়, সদক্বা কিংবা ভালো কাজ অথবা মানুষের মধ্যে মীমাংসার। আর যে তা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে করবে তবে অচিরেই আমি তাকে মহা পুরস্কার দান করব।” [সূরা নিসা, আয়াত: ১১৪]

আল্লাহ তা‘আলা আরও এরশাদ করেন,
مَن كَانَ يُرِيدُ حَرۡثَ ٱلۡأٓخِرَةِ نَزِدۡ لَهُۥ فِي حَرۡثِهِۦۖ وَمَن كَانَ يُرِيدُ حَرۡثَ ٱلدُّنۡيَا نُؤۡتِهِۦ مِنۡهَا وَمَا لَهُ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ مِن نَّصِيبٍ
“যে আখিরাতের ফসল কামনা করে, আমি তার জন্য তার ফসলে প্রবৃদ্ধি দান করি, আর যে দুনিয়ার ফসল কামনা করে, আমি তাকে তা থেকে কিছু দেই এবং আখিরাতে তার জন্য কোন অংশই থাকবে না”। [সূরা শূরা, আয়াত: ২০]

ইখলাস পরম সম্মানিত নবী-রাসূলগণ আলাইহিমুস সালামের অনন্য বৈশিষ্ট্য

ইখলাস হলো দ্বীনের মূলভিত্তি। এটা ছিল পরম সম্মানিত সকল নবী-রাসূলের দাওয়াতের বিষয়বস্তু ।
আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন,
وَمَآ أُمِرُوٓاْ إِلَّا لِيَعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ حُنَفَآءَ وَيُقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَيُؤۡتُواْ ٱلزَّكَوٰةَۚ وَذَٰلِكَ دِينُ ٱلۡقَيِّمَةِ
“আর তাদেরকে কেবল এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহর ‘ইবাদাত করে তাঁরই জন্য দ্বীনকে একনিষ্ঠ করে, সালাত কায়েম করে এবং যাকাত দেয়; আর এটিই হল সঠিক দ্বীন”। [সূরা আল্-বায়্যিনা: ৫]

আল্লাহ তা’আলা আরো এরশাদ করেন,
قُلۡ إِنِّيٓ أُمِرۡتُ أَنۡ أَعۡبُدَ ٱللَّهَ مُخۡلِصًا لَّهُ ٱلدِّينَ . وَأُمِرۡتُ لِأَنۡ أَكُونَ أَوَّلَ ٱلۡمُسۡلِمِينَ
“বলুন, ‘নিশ্চয় আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে আমি যেন আল্লাহর ইবাদাত করি তাঁর-ই জন্য আনুগত্যকে একনিষ্ঠ করে’। আমাকে আরো নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যেন আমি প্রথম মুসলিম হই”। [সূরা: আয্-যুমার: ১১-১২]

আল্লাহ তা’আলা আরো এরশাদ করেন,
أَلَا لِلَّهِ ٱلدِّينُ ٱلۡخَالِصُۚ وَٱلَّذِينَ ٱتَّخَذُواْ مِن دُونِهِۦٓ أَوۡلِيَآءَ مَا نَعۡبُدُهُمۡ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَآ إِلَى ٱللَّهِ زُلۡفَىٰٓ إِنَّ ٱللَّهَ يَحۡكُمُ بَيۡنَهُمۡ فِي مَا هُمۡ فِيهِ يَخۡتَلِفُونَۗ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَهۡدِي مَنۡ هُوَ كَٰذِبٞ كَفَّارٞ
“জেনে রেখ, আল্লাহর জন্যই বিশুদ্ধ ইবাদাত-আনুগত্য। আর যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরকে অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করে তারা বলে, ‘আমরা কেবল এজন্যই তাদের ‘ইবাদাত করি যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেবে।’ যে বিষয়ে তারা মতভেদ করছে আল্লাহ নিশ্চয় সে ব্যাপারে তাদের মধ্যে ফয়সালা করে দেবেন। যে মিথ্যাবাদী কাফির, নিশ্চয় আল্লাহ তাকে হিদায়াত দেন না।” [সূরা আয্-যুমার: ৩]

আল্লাহ অন্যত্র এরশাদ করেন,
ٱلَّذِي خَلَقَ ٱلۡمَوۡتَ وَٱلۡحَيَوٰةَ لِيَبۡلُوَكُمۡ أَيُّكُمۡ أَحۡسَنُ عَمَلٗاۚ وَهُوَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡغَفُورُ
“যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন যাতে তিনি তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন, কে তোমাদের মধ্যে আমলের দিক থেকে উত্তম। আর তিনি মহাপরাক্রমশালী, অতিশয় ক্ষমাশীল”। [সূরা আল্-মুলক:২]

হযরত মূসা আলাইহিস সালামের প্রশংসায় আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন,
وَٱذۡكُرۡ فِي ٱلۡكِتَٰبِ مُوسَىٰٓۚ إِنَّهُۥ كَانَ مُخۡلَصٗا وَكَانَ رَسُولٗا نَّبِيّٗا
“আর স্মরণ করুন এই কিতাবে হযরত মূসাকে। অবশ্যই তিনি ছিলেন মনোনীত এবং তিনি ছিলেন রাসূল, নবী”। [সূরা মারইয়াম: ৫১]

হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন,
وَلَقَدۡ هَمَّتۡ بِهِۦۖ وَهَمَّ بِهَا لَوۡلَآ أَن رَّءَا بُرۡهَٰنَ رَبِّهِۦۚ كَذَٰلِكَ لِنَصۡرِفَ عَنۡهُ ٱلسُّوٓءَ وَٱلۡفَحۡشَآءَۚ إِنَّهُۥ مِنۡ عِبَادِنَا ٱلۡمُخۡلَصِينَ
“আর ওই মহিলা তার প্রতি আসক্ত হল, আর তিনিও তার প্রতি ইচ্ছা করতেন, যদি না তার রবের স্পষ্ট প্রমাণ প্রত্যক্ষ করতেন। এভাবেই, যাতে আমি তার থেকে অনিষ্ট ও অশ্লীলতা দূর করে দেই। নিশ্চয় তিনি আমার খালেস বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত”। [সূরা: ইউসুফ: ২৪]

এমনিভাবে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন,
قُلۡ أَتُحَآجُّونَنَا فِي ٱللَّهِ وَهُوَ رَبُّنَا وَرَبُّكُمۡ وَلَنَآ أَعۡمَٰلُنَا وَلَكُمۡ أَعۡمَٰلُكُمۡ وَنَحۡنُ لَهُۥ مُخۡلِصُونَ
“বলুন, ‘তোমরা কি আমাদের সাথে আল্লাহর ব্যাপারে বিতর্ক করছ অথচ তিনি আমাদের রব ও তোমাদের রব? আর আমাদের জন্য রয়েছে আমাদের আমলসমূহ এবং তোমাদের জন্য রয়েছে তোমাদের আমলসমূহ এবং আমরা তাঁর জন্যই একনিষ্ঠ”। [সূরা আল-বাকারা: ১৩৯]

ইখলাস হাদীস শরীফে

নিয়্যতে সত্যবাদিতা ও ইখলাসের গুরুত্ব সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাধিক হাদীস বর্ণনা করেন এবং তিনি আমলের ভিত্তি এ দু’টিকেই নির্ধারণ করেন। যেমন- হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন,
إنَّمَا الأعْمالُ باِلنِّيَّاتِ، وَإنَّمَا لكِّل امْرِئ مَا نَوَى
“সমস্ত আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল, প্রতিটি মানুষ যা নিয়ত করে, সে তাই পাবে।( )

এ হাদীস শরীফ হাদীসসমূহ হতে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাদীস। কারণ, শরঈ বিধানের জন্য এটি একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক হাদীস। সকল ধরনের ইবাদত এরই অন্তর্ভুক্ত, কোন ইবাদত এ হাদীসের বাহিরে নয়। যেমন- নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত, জিহাদ, সদক্বা-খায়রাত ইত্যাদি সব- ইবাদত বিশুদ্ধ নিয়্যত ও ইখলাসের মুখাপেক্ষী।

এখানে ‘মানুষের সব আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল’ এ হাদীসটিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু গুরুত্বপূর্ণ কায়দাটির কথা বলেই থেমে যাননি, বরং নিয়ত ও ইখলাসের গুরুত্ব বিবেচনা করে, তিনি কতেক আমলের কথা উল্লেখ করেন এবং নিয়তকে বিশুদ্ধ করার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেন। যেমন-

‘লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন,
مَا قَالَ عَبْدٌ: لا إلَهَ إلِا الله قَطُّ مُخلصًا إلا فُتحتْ لَهُ أَبْوَابُ الَّسَماءِ حَّتى تُفْضِي إِلَى العَرْشِ مَا اجْتَنَب الكَبَائِرَ

“আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে যখনই কোন বান্দা “লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ” বলবে, তার জন্য আসমানের দরজাসমূহ আরশ পর্যন্ত খুলে দেয়া হবে, যতক্ষণ না পর্যন্ত সে কবিরা গুনাহ করবে।( )

মসজিদসমূহে গমন করা: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন,
صَلاةُ الرَّجُلِ فِي الجَمَاعَةِ تُضَعَّفُ عَلَى صَلاتهِ فِي بَيْتهِ وَفِي سُوقهِ خَمسَةً وَعِشِرينَ ضعْفاً، وذلكَ أنه إذَا تَوَضَّأَ فَأحسَنَ الوضوءَ ثُمَّ خَرَجَ إلَى المَسْجِدِ لا يخرِجُهُ إلِا الصَّلاَةُ لَم يخط خَطوَةً إلِاَّ رُفعَتْ لَهُ بِها دَرَجةٌ، وَحُطَّ عَنُه بِها خَطيِئَةٌ، فَإذِا صَلَّى لَمْ تَزَلِ المَلَائكَةُ تُصَلِّي عَلَيهِ مَا دَامَ فِي مُصَلُّاه: اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَيْهِ، اللَّهُمَّ ارحَمهُ. وَلا يَزَالُ أَحَدُكُم فِي صَلاةٍ مَا انْتَظَرَالصَّلاَةَ .
“জামাতে নামায আদায় করলে, স্বীয় ঘরে বা দোকানে নামায আদায় করা হতে পঁচিশগুণ বেশি সাওয়াব দেয়া হবে। কারণ, যখন কোন ব্যক্তি সুন্দর করে ওযু করে শুধুমাত্র নামায আদায় করার উদ্দেশ্যেই মসজিদের দিক রওয়ানা হয়, প্রতিটি কদমে তার মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয় এবং তার গুনাহগুলো ক্ষমা করা হয়। আর যখন নামায আদায় করে, ফেরেশতারা তার উপর রহমত বর্ষণ করতে থাকে। ফেরেশতারা বলতে থাকে, হে আল্লাহ তুমি তার উপর দয়া কর, তাকে তুমি রহম কর। যখন কোন ব্যক্তি নামাযের অপেক্ষায় থাকে, সে নামাযেই থাকে।( ) [নামায আদায় করার সাওয়াব পেতে থাকে]

রোযা রাখা: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন,
مَنْ صام رَمَضَانَ إِيمَاناً وَاحْتسِاباً غُفِرَلَهُ مَا تَقَّدمَ مِنْ ذَنْبهِ
“যে ব্যক্তি ঈমান ও ইখলাস নিয়ে রমযানের রোযা রাখে, তার অতীতের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হয়”।( )

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও এরশাদ করেন,
من صامَ يوْماً فِي سَبِيلِ الله بعَّدَ الله وجْهه عَن الناَّرِ سَبْعِيَن خَرِيفاً
“যে ব্যক্তি আল্লাহর রাহে একদিন রোযা রাখে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে জাহান্নামের আগুন হতে সত্তর খারিফ (খারিফ একটি ঝতুর নাম, অর্থ্যাৎ: সত্তর বছরের দূরত্ব) পর্যন্ত দূরে সরিয়ে দেন”।( )

কিয়ামুল-লাইল: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন,
مَنْ قَامَ رمَضَانَ إِيمَاناً وَاحْتسَاباً غُفِرَ لهُ مَا تَقَّدمَ مِنْ ذَنْبه
“যে ব্যক্তি ঈমান ও ইখলাস নিয়ে সাওয়াবের আশায় রমযান মাসে রাত জেগে আল্লাহর ইবাদত করে, তার অতীত জীবনের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হবে”।( )

লাইলাতুল ক্বদর: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন,
مَنْ قَامَ ليلة القدر إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لهُ مَا تَقَّدمَ مِنْ ذَنْبه
“যে ব্যক্তি ঈমান ও ইখলাস নিয়ে সাওয়াবের আশায় লাইলাতুল ক্বদরে রাত জেগে আল্লাহর ইবাদত করে, তার অতীত জীবনের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হবে”।( )

সদক্বাহ: হযরত আবু হুরাইরা রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু হতে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন,
عَنْ حَفْصِ بْنِ عَاصِمٍ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمُ اللَّهُ تَعَالَى فِي ظِلِّهِ يَوْمَ لاَ ظِلَّ إِلَّا ظِلُّهُ: إِمَامٌ عَدْلٌ، وَشَابٌّ نَشَأَ فِي عِبَادَةِ اللَّهِ، وَرَجُلٌ قَلْبُهُ مُعَلَّقٌ فِي المَسَاجِدِ، وَرَجُلاَنِ تَحَابَّا فِي اللَّهِ، اجْتَمَعَا عَلَيْهِ وَتَفَرَّقَا عَلَيْهِ، وَرَجُلٌ دَعَتْهُ امْرَأَةٌ ذَاتُ مَنْصِبٍ وَجَمَالٍ فَقَالَ: إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ، وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ فَأَخْفَاهَا حَتَّى لاَ تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ، وَرَجُلٌ ذَكَرَ اللَّهَ خَالِيًا، فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ .
“আল্লাহ তা‘আলা সাত শ্রেণীর ব্যক্তিকে কিয়ামতের দিন তার (আরশে আযীমের) বিশেষ ছায়া তলে আশ্রয় দেবেন, যেদিন আল্লাহর (আরশে আযীমের) ছায়া ছাড়া আর কোন আশ্রয় থাকবে না।
এক- ন্যায় পরায়ণ বাদশাহ।
দুই- যে যুবক তার যৌবনকে আল্লাহর ইবাদতে কাটিয়েছেন,
তিন- ওই ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত।
চার- ওই ব্যক্তি যারা একে অপরকে আল্লাহর ওয়াস্তে ভালোবাসেন, তারই ভিত্তিতে একত্র হন এবং তারই ভিত্তিতে পৃথক হন।
পাঁচ- ওই ব্যক্তি যাকে কোন সুন্দর ও বংশীয় যুবতী অপকর্মের প্রতি আহ্বান করলে, সে বলে আমি আল্লাহকে ভয় করি।
ছয়- ওই ব্যক্তি যে আল্লাহ রাহে এত গোপনে দান করে, তার বাম হাত টের পায়না ডান হাত কি দান করল।
সাত- ওই ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করল এবং তার চোখ থেকে অশ্রু নির্গত হল। ( )

জিহাদ: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন,
مَنْ غَزَا فِي سَبِيلِ الله وَلَمْ يَنْوِ إِلاَّ عِقَالا فَلَهُ مَا نَوَى
“যে ব্যক্তি আল্লাহর রাহে একটি উটের রশি লাভের উদ্দেশ্যে জিহাদ করল, সে তাই পাবে যার নিয়ত সে করল”।( )
নামাযে জানাযায় অংশগ্রহণ: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন,
من اتَّبَعَ جناَزَةَ مُسْلم إيِمَاناً واحْتسَاباً، وَكَاَن مَعَهُ حَتّٰى يُصَلِّىَ عَليْهَا، وَيفْرغَ مِنْ دفْنهِا؛ فَإنه يَرْجِعُ مِن الأجر بقِيٛراطَيْنِ، كُلُّ قِيٛراطٍ مثْلُ أُحُدٍ، وَمَن صَلَّى عَلَيْهَا ثُمَّ رجَعَ قبلَ أَنْ تُدْفَنَ فَإِنَّهُ يَرْجع بقيراط
“যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের জানাযায় ঈমান ও সাওয়াবের আশায় শরীক হয় এবং জানাযার নামায আদায় ও দাফন করা পর্যন্ত মুর্দার সাথে থাকে, সে দুই ক্বীরাত সাওয়াব নিয়ে বাড়ি ফিরবে। প্রতিটি ক্বীরাত উহুদ পাহাড়ের সমান। আর যে ব্যক্তি জানাযার নামায আদায় করে এবং দাফন করার পূর্বে ফেরত আসে, তাহলে সে এক ক্বীরাত সাওয়াব নিয়ে বাড়ি ফিরবে”। ( )

ইখলাসের সুফল

নেককার মুমিন বান্দার অন্তরে যখন ইখলাস পাওয়া যাবে, তখন সে ইখলাসের যে সকল উপকারিতা ও গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল রয়েছে তা লাভ করবে। যেমন:

আমল কবুল হওয়া
হযরত আবু উমামা আল-বাহেলী রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন,
إِنَّ الله لاَ يَقْبَلُ من العَمَلِ إِلاَّ مَا كَانَ لَهُ خَالِصاً، وَابتغي بهِ وَجْهُه
“আল্লাহ তা‘আলা শুধু ওই আমল ক্ববূল করবেন, যে আমল কেবল আল্লাহর জন্য করা হবে এবং যে আমল দ্বারা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা উদ্দেশ্য হবে”। ( )
আল্লাহর সাহায্য লাভ করা
আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন,
يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِذَا لَقِيتُمۡ فِئَةٗ فَٱثۡبُتُواْ وَٱذۡكُرُواْ ٱللَّهَ كَثِيرٗا لَّعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُونَ وَأَطِيعُواْ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ وَلَا تَنَٰزَعُواْ فَتَفۡشَلُواْ وَتَذۡهَبَ رِيحُكُمۡۖ وَٱصۡبِرُوٓاْۚ إِنَّ ٱللَّهَ مَعَ ٱلصَّٰبِرِينَ وَلَا تَكُونُواْ كَٱلَّذِينَ خَرَجُواْ مِن دِيَٰرِهِم بَطَرٗا وَرِئَآءَ ٱلنَّاسِ وَيَصُدُّونَ عَن سَبِيلِ ٱللَّهِۚ وَٱللَّهُ بِمَا يَعۡمَلُونَ مُحِيط
“হে মুমিনগণ, যখন তোমরা কোন দলের মুখোমুখি হও, তখন অবিচল থাক, আর আল্লাহকে অধিক স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফল হও। আর তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর এবং পরস্পর ঝগড়া করো না, তাহলে তোমরা সাহসহারা হয়ে যাবে এবং তোমাদের শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাবে। আর তোমরা ধৈর্য ধর, নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।
আর তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা তাদের ঘর থেকে অহঙ্কার ও লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে বের হয়েছে এবং আল্লাহর রাস্তায় বাধা প্রদান করে, আর তারা যা করে, আল্লাহ তা পরিবেষ্টন করে আছেন”। [সূরা আল- আনফাল: ৪৫-৪৭]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শাফা‘আত লাভ:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، أَنَّهُ قَالَ: قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، مَنْ أَسْعَدُ النَّاسِ بِشَفَاعَتِكَ يَوْمَ القِيَامَةِ؟ فَقَالَ: ” لَقَدْ ظَنَنْتُ، يَا أَبَا هُرَيْرَةَ، أَنْ لاَ يَسْأَلَنِي عَنْ هَذَا الحَدِيثِ أَحَدٌ أَوَّلُ مِنْكَ، لِمَا رَأَيْتُ مِنْ حِرْصِكَ عَلَى الحَدِيثِ، أَسْعَدُ النَّاسِ بِشَفَاعَتِي يَوْمَ القِيَامَةِ مَنْ قَالَ: لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، خَالِصًا مِنْ قِبَلِ نَفْسِهِ ”
হযরত আবূ হুরায়রা রিাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আরয করলাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ্! কিয়ামতের দিন সমস্ত মানুষ থেকে আপনার শাফা’আত দ্বারা কোন লোকটি বেশি সৌভাগ্যবান হবে? তখন তিনি এরশাদ করলেন, হে আবূ হুরায়রা! আমি জানতাম যে তোমার আগে কেউ এ সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞাসা করবে না। কারণ হাদীসের ব্যাপারে তোমার চেয়ে অধিক আগ্রহী আর কাউকে আমি দেখিনি। ক্বিয়ামতের দিন আমার শাফা‘আত দ্বারা সর্বাধিক সৌভাগ্যবান হবে ঐ ব্যক্তি যে খালেস অন্তর থেকে বলে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”। ( )

সাওয়াব লাভ করা
হযরত সা’আদ ইবনে আবী ওয়াক্বক্াস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন,
إنكَ لَنْ تُنْفِقَ نَفَقَةً تَبَتغِي بِها وَجْهَ الله إلِا أُجِرتَ عَلَيْهَا
“যখনই তুমি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে কোন কিছু ব্যয় করবে, তখন তার উপর তোমাকে সাওয়াব দেয়া হবে”।( )

ছোট আমলকে বড় আমলে পরিণত করা
যে কোন ছোট আমলকে বড় মনে করার ফলে তা বড় আমলে পরিণত হয়। আল্লামা ইবনুল মুবারক রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, অনেক ছোট আমল আছে নিয়ত তাকে বড় করে দেয়, আবার অনেক বড় আমল আছে, নিয়ত তাকে ছোট করে দেয়।( )

গুনাহসমূহ ক্ষমা:
ইখলাস গুনাহ মাফের অনেক বড় কারণ। এক প্রকার আমল এমন আছে, যখন কোন মানুষ আমলটি পরিপূর্ণ ইখলাস ও আল্লাহর আনুগত্যের সাথে করে থাকে, আল্লাহ তা‘আলা এ আমল দ্বারা তার কবিরা গুনাহগুলোও ক্ষমা করে দেন। যেমন- হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন,
يُصاُح برَجل مِنْ أُمَّتيِ يَوْم القِيَامَة عَلَى رُؤوسِ الَخلَائقِ، فَيُنشْر لَهُ تسْعةٌ وتسْعونَ سِجلا، كُلُّ سِجِل مَدّ الَبصَرِ، ثُمَّ يقُولُ الله هَلْ تُنْكِرُ منْ هذَا شَيْئاً؟ فَيَقُولُ: لاَ يَا ربِّ. فَيَقُولُ: لا ظُلمَ عَلَيْكَ. فَتخْرج لُه بِطَاقَةٌ قدْرُ الكَفِّ فيِهَا شَهادَةُ أَن لا إلَهَ إلِاَّ الله. فَيَقُولُ: أَيْنَ تَقع هذِهِ البطِاقَةُ مَع هَذِهِ السِّجِلاَّتِ؟! فتوضُع هذِهِ البطِاقَةُ فِي كَفَّةٍ وَالسِّجِلَّاتُ فِي كَفَّةٍ، فَثَقُلَتِ البِطَاقَةُ، وَطَاشَتِ السِّجِلاَّتُ
“ক্বিয়ামতের দিন এক ব্যক্তিকে সমগ্র মাখলুকের সামনে উপস্থিত করা হবে, তারপর তার জন্য নিরানব্বইটি দপ্তর খোলা হবে, প্রতিটি দপ্তর চোখের দৃষ্টির দূরত্ব সমান দীর্ঘ হবে। তারপর আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, তুমি কি এর কোন কিছুকে অস্বীকার কর, তখন সে বলবে, না, হে আমার রব। তখন আল্লাহ বলবেন, তোমার উপর কোন যুলুম করা হবে না। তারপর তার জন্য হাতের তালুর সমপরিমাণ একটি কাগজের টুকরা বা কার্ড বের করা হবে, তাতে লিপিবদ্ধ থাকবে, “আশহাদু আন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নাই) তখন সে মনে মনে বলবে, এতগুলো বড় বড় দপ্তরের মুকাবেলায় এ কাগজের টুকরা বা কার্ডটি দিয়ে কী আর হবে? কোথায় পড়ে থাকবে? তারপর এ কাগজের টুকরাটি একটি পাল্লায় রাখা হবে এবং দপ্তরসমূহ অপর পাল্লায় রাখা হবে। তখন কাগজের টুকরার পাল্লাটি ভারি হয়ে যাবে এবং দপ্তরসমূহ হালকা হয়ে পড়বে। ( )

এ হল ওই ব্যক্তির অবস্থা যে এ কালেমা শরীফ ইখলাস ও ইয়াক্বীনের সাথে বলবে যেমনটি উল্লেখিত লোকটি বলেছিল। অন্যথায় যারা কবীরা গুনাহ করার কারণে জাহান্নামে প্রবেশ করবে, তাদের সবাই এ কালেমা শরীফ বলে থাকে। কিন্তু তাদের কথা তাদের গুনাহের উপর ভারী হয় নাই, যেমনটি ভারী হয়েছিল এ লোকটির কথা।
অপর একটি হাদিসে বর্ণিত,
إنَّ امْرَأَةً بَغِيا رَأْت كَلباً فِي يَوْم حَارٍّ يطيِفُ ببِئر قَدْ أَدلَعَ لسِانَهُ مِن العَطَشِ، فنَزَعْت لَه بمُوقِهَا – أي: سقته بخفها- فَغُفِرَ لهَا
“এক ব্যভিচারী মহিলা একটি কুকুরকে একটি কূপের নিকট দেখতে পেল যে পানির পিপাসায় কাতরাচ্ছে। মহিলাটি তার পায়ের মোজা খুলে তাকে পানি পান করালে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন”।( )

যেহেতু মহিলাটি তার অন্তরে গাঁথা বিশুদ্ধ ও পরিপূর্ণ ঈমান ও ইখলাস নিয়ে কুকুরটিকে পানি পান করিয়েছে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে ক্ষমা করে দিলেন। অন্যথায় যত ব্যভিচারী মহিলা কোন কুকুরকে পানি করাবে সবাইকে ক্ষমা করে দেবেন এমন কথা এখানে বলা হয়নি।

আমলের বিনিময় লাভ করা যদিও আমলটি করতে অক্ষম হয়
ইখলাসের দ্বারা মানুষ আমলের সাওয়াব পেয়ে থাকে যদিও সে আমলটি করতে অক্ষম হয়। বরং অনেক সময় মুজাহিদ ও শহীদদের মর্তবা লাভ করবে যদিও সে বিছানায় মারা যায়। যাদেরকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিহাদে নিয়ে যেতে পারেননি তাদের প্রশংসা করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَلَا عَلَى ٱلَّذِينَ إِذَا مَآ أَتَوۡكَ لِتَحۡمِلَهُمۡ قُلۡتَ لَآ أَجِدُ مَآ أَحۡمِلُكُمۡ عَلَيۡهِ تَوَلَّواْ وَّأَعۡيُنُهُمۡ تَفِيضُ مِنَ ٱلدَّمۡعِ حَزَنًا أَلَّا يَجِدُواْ مَا يُنفِقُونَ
“আর তাদের উপরও কোন দোষ নেই, যারা আপনার কাছে আসে, যাতে আপনি তাদের বাহন জোগাতে পারেন। আপনি বললেন, আমি তোমাদেরকে বহন করানোর জন্য কিছু পাচ্ছি না, তখন তারা ফিরে গেল, তাদের চোখ অশ্রুতে ভেসে যাওয়া অবস্থায়, এ দু:খে যে, তারা পাচ্ছে না এমন কিছু যা তারা ব্যয় করবে।” (তাওবা, আয়াত-৯২)

হযরত আনাস ইবনে মালেক রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন,
إن أَقْوَاماً باِلمدينةَ خلْفَناَ مَا سَلَكْناَ شعباً وَلا وَادِياً إلِا وَهُمْ معَناَ فيِهِ،حَبَسُهْم العُذْرُ
“মদিনায় আমরা কতেক লোককে রেখে এসেছি, আমরা যত পাহাড়ের চুড়া ও গ্রাম অতিক্রম করিনা কেন, তাদেরকে আমাদের সাথে সাথে পাই। তাদেরকে তাদের অপারগতা আমাদের সাথে অংশ গ্রহণ করা হতে বিরত রেখেছে”।( )

অপর এক বর্ণনায় রয়েছে,إلا شَركوُكمْ فِي الأَجْرِ “কিন্তু তারা তোমাদের সাথে সাওয়াবের মধ্যে শরীক”।( )

হযরত আনাস ইবনে মালেক রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন,
مَن سَأَلَ الشَّهَادَةَ بصِدْقٍ بَلَّغَه الله مَنَازِلَ الشُّهَدَاءِ؛ وَإنْ مَاتَ عَلَى فرِاشهِ
“যে ব্যক্তি অন্তর থেকে আল্লাহ তা‘আলার নিকট শাহাদাত কামনা করবে, আল্লাহ তাকে শহীদদের মর্যাদা দান করবে; যদিও লোকটি নিজ বিছানায় মারা যায়।( )

অনুরূপ, ধনী লোক তার সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে যে পরিমাণ সাওয়াব লাভ করে থাকে, একজন গরীব লোক তার নিয়ত ভালো হওয়ার কারণে সে আল্লাহর রাস্তায় দান না করেও অনুরূপ সাওয়াব লাভ করবে। হযরত আবু কাবশা আল-আনমারী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন,
مَثَلُ هَذِهِ الأمُّةِ كَمثَلِ أَرْبَعَةِ نَفَرٍ: رَجُلٌ آتَاهُ الله مَالا وَعِلْمًا، فَهُوَ يْعَملُ فِي مَالهِ يُنفِقُهُ فِي حَقِّهِ، وَرَجلٌ آتَاهُ الله عِلْمًا وَلَم يُؤْتهِ مَالا فَهُوَ يَقُولُ: لَوْ كَانَ لِي مِثْلُ هَذَا عَمِلْتُ فِيهِ مِثْلَ الَّذي يْعَملُ قَال فَهُمَا فِي الأجر سَواءٌ
“এ উম্মতের উপমা চার শ্রেণীর লোকের অনুরূপ। এক ব্যক্তি যাকে আল্লাহ তা‘আলা মাল ও জ্ঞান উভয়টি দান করেছেন। লোকটি তার মালকে যথাযথ ব্যয় করে। আর এক ব্যক্তি যাকে আল্লাহ তা‘আলা জ্ঞান দান করেছেন, তাকে মাল দেন নাই। সে মনে মনে বলে, যদি আমার নিকট লোকটির মত সম্পদ থাকত, তাহলে আমিও তার মত ব্যয় করতাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, তারা উভয়ে সমান সাওয়াবের অধিকারী হবেন।( )

এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করা প্রয়োজন, তা হল, একজন লোক আমলে অক্ষম নয়, তবে সে কাজ করার আশা রাখে, কিন্তু করে না। আর সে ধারণা করে, তাকে তার ভালো কাজের আশার কারণে সাওয়াব দেয়া হবে। সে তার এ ধরনের নিয়তকে নেক নিয়ত বলে বিবেচনা করে। কিন্তু বাস্তবতা হল, এ ধরনের নিয়ত ও আশা শয়তানের ওয়াসওসাহ্ ও আত্মার ধোঁকাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়।

একজন মানুষ মসজিদে নামাযের জামাতে উপস্থিত না হয়ে, ঘরে বসে থাকে বা বিছানায় শুয়ে থাকে, আর বলতে থাকে আমি নামাযে যাওয়াকে পছন্দ করি বা নামাযে উপস্থিত হতে চাই। সে ধারণা করে যে, তার এ কথা দ্বারা, মসজিদে গিয়ে জামাতের সাথে নামায আদায় করার সাওয়াব সে লাভ করবে। এ ধরনের ভ্রান্ত ধারণা আমাদের উল্লেখিত বিষয়সমূহের সাথে কোন সম্পর্ক নাই এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসসমূহের সাথেও এর কোন সম্পর্ক নাই।

মুবাহ ও স্বাভাবিক কর্মসমূহকে ইবাদতে পরিণত করা
হযরত সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু হতে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন,
إنِّكَ لَنْ تُنْفِقَ نَفَقَةً تَبْتغِي بها وَجْهَ الله إلِا أُجِرْتَ عَلَيْهَا، حَتَّى مَا تَجعَلُ فِي فَمِ امْرَأَتِكَ
“আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে তুমি যে দান কর, তার উপর অবশ্যই তুমি সাওয়াব পাবে। এমনকি তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে খাওয়ারের যে লোকমাটি তুলে দাও।” [তাতেও সাওয়াব পাবে] ( )

এটি কল্যাণের অধ্যায়সমূহ হতে একটি বিশাল অধ্যায়। যখনই একজন বান্দা তাতে প্রবেশ করবে, সে মহা কল্যাণ ও অসংখ্য প্রতিদান লাভ করবে। আর আমরা যদি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বৈধ কর্মগুলো ও স্বাভাবিক কাজকর্ম দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভের ইচ্ছা করি, তাহলে আমরা বিশাল প্রতিদান ও অধিক সাওয়াবের অধিকারী হব। এমনকি খানা-দাওয়ায়ও নিয়ত করা প্রয়োজন। যেমন:
অনেকেই এমন আছে, সে সুগন্ধি ব্যবহার করতে অধিক পছন্দ করেন। সে যদি মসজিদে যাওয়ার পূর্বে সুগন্ধি ব্যবহার করে আল্লাহর ঘরের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নিয়ত করে এবং মানুষ ও ফেরেশতাদের কষ্ট রোধ করার নিয়ত করে তাহলে সে অবশ্যই সাওয়াবের অধিকারী হবে।

আমরা সবাই খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করতে বাধ্য। কিন্তু আমরা যদি আমাদের খাদ্য ও পানীয় দ্বারা আল্লাহর ইবাদত বন্দেগী করার উপর শক্তি লাভ করার নিয়ত করে থাকি তাহলে আমরা অবশ্যই সাওয়াব লাভ করব।

অধিকাংশ মানুষ বিবাহ করতে বাধ্য। যদি একজন লোক বিবাহ দ্বারা এ নিয়ত করে, নিজের ও স্ত্রীর সতীত্বের হেফাযত করা এবং এমন নেক সন্তান রেখে যাওয়া যারা তারপর আল্লাহর জমিনে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করবে এবং মা-বাবার জন্য দোয়া করবে, তাহলে তাকে অবশ্যই সাওয়াব দেয়া হবে।

যদি একজন ডাক্তার ডাক্তারি শিক্ষা দ্বারা মুসলিম জনসাধারণ ও দুস্থ মানবতার স্বাস্থ্য-সেবা দেয়ার নিয়ত করে। অনুরূপভাবে একজন ইঞ্জিনিয়ার মুসলিমদের সেবা করার নিয়ত করে তথা, ইসলাম ও মুসলিমদের খেদমত করার নিয়ত করে, তাহলে সে তার অধ্যয়ন ও পড়া-লেখা দ্বারা অবশ্যই সাওয়াবের অধিকারী হবে।

আমরা সবাই আয়-রোজগার ও পরিবার-পরিজনের জন্য খরচ করতে বাধ্য। এ ধরনের যাবতীয় কর্মসমূহ হতে কোন কর্মকেই ছোট মনে করা সাওয়াবে আশা না করা বা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়ত না করা উচিত নয়। কারণ, হতে পারে এটিই ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর আযাব হতে নাজাত দেবে।

শয়তানের কু-মন্ত্রণা হতে নফসকে হেফাযত করা
শয়তান মুখলিস বান্দাদের গোমরাহ করতে পারেনা। আল্লাহ বলেন, “সুতরাং যাদের আল্লাহ তা‘আলা ইখলাসের মাধ্যমে হেফাযত করেন তাদের কেউ গোমরাহ করতে পারে না।”
হযরত মারুফ আল-কারখী রহমাতুল্লাহি আলাইহি স্বীয় আত্মাকে সম্বোধন করে বলেন, হে আত্মা! তুমি ইখলাস অবলম্বন কর, তবে তুমি রেহাই পাবে।( )

ওয়াসওয়াসাহ্ ও রিয়া থেকে দূর হওয়া
হযরত আবু সুলাইমান আদ-দারমী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
قَالَ أَبُو سُلَيْمَانَ الدَّارَانِيُّ : إِذَا أَخْلَصَ الْعَبْدُ انْقَطَعَتْ عَنْهُ كَثْرَةُ الْوَسَاوِسِ وَالرِّيَاءِ
যখন কোন বান্দা ইখলাসকে অবলম্বন করে, তখন তার থেকে ওয়াসওয়াসাহ্ ও রিয়া দূর হয়ে যায়।( )

ফিতনা হতে নাজাত লাভ
ইখলাসের মাধ্যমে একজন বান্দা ফিতনা হতে নাজাত লাভ করে। ইখলাস নাফসের চাহিদায় পতিত হওয়া এবং ফাসেক্ব ও ফাজেরদের অপরাধে জড়িত হওয়া হতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। আল্লাহ তা‘আলা ইখলাসের কারণে হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামকে আযীয-এ মিসরের স্ত্রীর ফিতনা হতে রক্ষা করেন। ফলে, তিনি অশ্লীল ও অনৈতিক কোন কাজে জড়িত হননি।
হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন,
وَلَقَدۡ هَمَّتۡ بِهِۦۖ وَهَمَّ بِهَا لَوۡلَآ أَن رَّءَا بُرۡهَٰنَ رَبِّهِۦۚ كَذَٰلِكَ لِنَصۡرِفَ عَنۡهُ ٱلسُّوٓءَ وَٱلۡفَحۡشَآءَۚ إِنَّهُۥ مِنۡ عِبَادِنَا ٱلۡمُخۡلَصِينَ
“আর সে মহিলা তার প্রতি আসক্ত হল, আর তিনিও তার প্রতি ইচ্ছা করতেন, যদি না তার রবের স্পষ্ট প্রমাণ প্রত্যক্ষ করতেন। এভাবেই, যাতে আমি তার থেকে অনিষ্ট ও অশ্লীলতা দূর করে দেই। নিশ্চয় তিনি আমার খালেস বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত”। [সূরা: ইউসুফ: ২৪]

দুশ্চিন্তা ও পেরেশানি দূর হওয়া এবং রিয্ক বৃদ্ধি পাওয়া
হযরত আনাস ইবনে মালেক রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন,
مَنْ كانتِ الآخرةُ هُمَّه جعَلَ الله غِنَاهُ فِي قَلْبِه، وَجَمَع لَهُ شَمْلَهُ، وَأَتَتْهُ الدُّنْيَا وَهِيَ راغمة، ومَنْ كانْت الدُّنيَا هَّمُه؛ جعَلَ الله فَقْرُه بيْنَ عَينيه، وَفَرَّقَ عَلَيْهِ شَملَهُ، وَلَمْ يَأْتِهِ مِنْ الدُّنْيَا إلِا مَا قُدِّرَ لَه
“যার লক্ষ্য হবে আখেরাত অর্জন করা, আল্লাহ তা‘আলা তার অন্তর থেকে অভাবকে দূর করে দেবেন। আর তার জন্য যাবতীয় উপকরণ সহজ করে দেবে এবং দুনিয়া তার নিকট অপদস্থ হয়ে ধরা দেবে। আর যার লক্ষ্য বস্তু হবে দুনিয়া অর্জন করা, আল্লাহ তা‘আলা অভাবকে তার চোখের সামনে তুলে ধরবেন এবং যাবতীয় উপকরণকে তার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবেন। আর দুনিয়া তার ভাগ্যে ততটুকু মিলবে, যতটুকু তার জন্য লিপিবদ্ধ করা হয়েছে”।( )

বিপদ-আপদ দূর হওয়া
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহুমা হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন,
عَنْ نَافِعٍ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ ـ رضى الله عنهما ـ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏ “‏ بَيْنَمَا ثَلاَثَةُ نَفَرٍ يَمْشُونَ أَخَذَهُمُ الْمَطَرُ، فَأَوَوْا إِلَى غَارٍ فِي جَبَلٍ، فَانْحَطَّتْ عَلَى فَمِ غَارِهِمْ صَخْرَةٌ مِنَ الْجَبَلِ فَانْطَبَقَتْ عَلَيْهِمْ، فَقَالَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ انْظُرُوا أَعْمَالاً عَمِلْتُمُوهَا صَالِحَةً لِلَّهِ فَادْعُوا اللَّهَ بِهَا لَعَلَّهُ يُفَرِّجُهَا عَنْكُمْ‏.‏
قَالَ أَحَدُهُمُ اللَّهُمَّ إِنَّهُ كَانَ لِي وَالِدَانِ شَيْخَانِ كَبِيرَانِ، وَلِي صِبْيَةٌ صِغَارٌ كُنْتُ أَرْعَى عَلَيْهِمْ، فَإِذَا رُحْتُ عَلَيْهِمْ حَلَبْتُ، فَبَدَأْتُ بِوَالِدَىَّ أَسْقِيهِمَا قَبْلَ بَنِيَّ، وَإِنِّي اسْتَأْخَرْتُ ذَاتَ يَوْمٍ فَلَمْ آتِ حَتَّى أَمْسَيْتُ، فَوَجَدْتُهُمَا نَامَا، فَحَلَبْتُ كَمَا كُنْتُ أَحْلُبُ، فَقُمْتُ عِنْدَ رُءُوسِهِمَا، أَكْرَهُ أَنْ أُوقِظَهُمَا، وَأَكْرَهُ أَنْ أَسْقِيَ الصِّبْيَةَ، وَالصِّبْيَةُ يَتَضَاغَوْنَ عِنْدَ قَدَمَىَّ، حَتَّى طَلَعَ الْفَجْرُ، فَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنِّي فَعَلْتُهُ ابْتِغَاءَ وَجْهِكَ فَافْرُجْ لَنَا فَرْجَةً نَرَى مِنْهَا السَّمَاءَ‏.‏ فَفَرَجَ اللَّهُ فَرَأَوُا السَّمَاءَ‏.‏
وَقَالَ الآخَرُ اللَّهُمَّ إِنَّهَا كَانَتْ لِي بِنْتُ عَمٍّ أَحْبَبْتُهَا كَأَشَدِّ مَا يُحِبُّ الرِّجَالُ النِّسَاءَ، فَطَلَبْتُ مِنْهَا فَأَبَتْ حَتَّى أَتَيْتُهَا بِمِائَةِ دِينَارٍ، فَبَغَيْتُ حَتَّى جَمَعْتُهَا، فَلَمَّا وَقَعْتُ بَيْنَ رِجْلَيْهَا قَالَتْ يَا عَبْدَ اللَّهِ اتَّقِ اللَّهَ، وَلاَ تَفْتَحِ الْخَاتَمَ إِلاَّ بِحَقِّهِ، فَقُمْتُ، فَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنِّي فَعَلْتُهُ ابْتِغَاءَ وَجْهِكَ فَافْرُجْ عَنَّا فَرْجَةً‏.‏ فَفَرَجَ‏.‏
وَقَالَ الثَّالِثُ اللَّهُمَّ إِنِّي اسْتَأْجَرْتُ أَجِيرًا بِفَرَقِ أَرُزٍّ، فَلَمَّا قَضَى عَمَلَهُ قَالَ أَعْطِنِي حَقِّي‏.‏ فَعَرَضْتُ عَلَيْهِ، فَرَغِبَ عَنْهُ، فَلَمْ أَزَلْ أَزْرَعُهُ حَتَّى جَمَعْتُ مِنْهُ بَقَرًا وَرَاعِيهَا فَجَاءَنِي فَقَالَ اتَّقِ اللَّهَ‏.‏ فَقُلْتُ اذْهَبْ إِلَى ذَلِكَ الْبَقَرِ وَرُعَاتِهَا فَخُذْ‏.‏ فَقَالَ اتَّقِ اللَّهَ وَلاَ تَسْتَهْزِئْ بِي‏.‏ فَقُلْتُ إِنِّي لاَ أَسْتَهْزِئُ بِكَ فَخُذْ‏.‏ فَأَخَذَهُ، فَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنِّي فَعَلْتُ ذَلِكَ ابْتِغَاءَ وَجْهِكَ فَافْرُجْ مَا بَقِيَ، فَفَرَجَ اللَّهُ ‏”‏‏.‏ قَالَ أَبُو عَبْدِ اللَّهِ وَقَالَ ابْنُ عُقْبَةَ عَنْ نَافِعٍ فَسَعَيْتُ‏.‏
হযরত ‘আবদুল্লাহ ইবনে ‘উমার রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহুমা হতে বর্ণিত,নবী করীম(সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরশাদ করেন, একবার তিন জন লোক পথ চলছিল, তারা বৃষ্টিতে আক্রান্ত হল। অতঃপর তারা এক পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিল। হঠাৎ পাহাড় হতে এক খন্ড পাথর পড়ে তাদের গুহার মুখ বন্ধ হয়ে গেল। তারা একে অপরকে বলল, নিজেদের কৃত কিছু সৎকাজের কথা চিন্তা করে বের কর, যা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা হয়েছে এবং তার ওয়াসীলা করে আল্লাহর নিকট দু’আ কর। তাহলে হয়ত আল্লাহ তোমাদের উপর হতে পাথরটি সরিয়ে দিবেন।

তাদের একজন বলতে লাগল, হে আল্লাহ! আমার আব্বা-আম্মা খুব বৃদ্ধ ছিলেন এবং আমার ছোট ছোট সন্তানও ছিল। আমি তাদের ভরণ-পোষণের জন্য পশু পালন করতাম। সন্ধ্যায় যখন আমি বাড়ি ফিরতাম তখন দুধ দোহন করতাম এবং আমার সন্তানদের আগে আমার আব্বা-আম্মাকে পান করাতাম। একদিন আমার ফিরতে দেরী হয় এবং সন্ধ্যা হওয়ার আগে আসতে পারলাম না। এসে দেখি তাঁরা ঘুমিয়ে পড়েছেন। তখন আমি দুধ দোহন করলাম, যেমন প্রতিদিন দোহন করি। তারপর আমি তাঁদের শিয়রে (দুধ নিয়ে) দাঁড়িয়ে রইলাম। তাঁদেরকে জাগানো আমি পছন্দ করিনি এবং তাদের আগে আমার বাচ্চাদেরকে পান করানোও অসঙ্গত মনে করি। অথচ বাচ্চাগুলো দুধের জন্য আমার পায়ের কাছে পড়ে কান্নাকাটি করছিল। এভাবে ভোর হয়ে গেল। হে আল্লাহ! আপনি জানেন আমি যদি শুধু আপনার সন্তুষ্টির জন্যই এ কাজটি করে থাকি তবে আপনি আমাদের হতে পাথরটা খানিক সরিয়ে দিন, যাতে আমরা আসমানটা দেখতে পাই। তখন আল্লাহ পাথরটাকে একটু সরিয়ে দিলেন এবং তারা আসমান দেখতে পেল।

দ্বিতীয় ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহ! আমার এক চাচাতো বোন ছিল। পুরুষরা যেমন মহিলাদের ভালবাসে, আমি তাকে তার চেয়েও অধিক ভালবাসতাম। একদিন আমি তার কাছে চেয়ে বসলাম (অর্থাৎ খারাপ কাজ করতে চাইলাম) কিন্তু তা সে অস্বীকার করল যে পর্যন্ত না আমি তার জন্য একশ’ দিনার নিয়ে আসি। পরে চেষ্টা করে আমি তা যোগাড় করলাম (এবং তার কাছে এলাম)। যখন আমি তার দু’পায়ের মাঝে বসলাম (অর্থাৎ সম্ভোগ করতে তৈরী হলাম) তখন সে বলল, হে আল্লাহর বান্দা! আল্লাহকে ভয় কর। অন্যায়ভাবে মাহ্র (পর্দা) ছিঁড়ে দিয়ো না। (অর্থাৎ আমার কুমারীর সতীত্ব নষ্ট করো না) তখন আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। হে আল্লাহ! আপনি জানেন আমি যদি শুধু আপনার সন্তুষ্টির জন্য এ কাজটি করে থাকি, তবে আপনি আমাদের জন্য পাথরটা সরিয়ে দিন। তখন পাথরটা কিছু সরে গেল।
তৃতীয় ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহ! আমি এক ফারাক চাউলের বিনিময়ে একজন শ্রমিক নিযুক্ত করেছিলাম। যখন সে তার কাজ শেষ করল আমাকে বলল, আমার পাওনা দিয়ে দাও। আমি তাকে তার পাওনা দিতে গেলে সে তা নিল না। আমি তা দিয়ে কৃষি কাজ করতে লাগলাম এবং এর দ্বারা অনেক গরু ও তার রাখাল জমা করলাম। বেশ কিছু দিন পর সে আমার কাছে আসল এবং বলল, আল্লাহকে ভয় কর (আমার মজুরী দাও)। আমি বললাম, এই সব গরু ও রাখাল নিয়ে নাও। সে বলল, আল্লাহকে ভয় কর, আমার সাথে ঠাট্টা করো না। আমি বললাম, আমি তোমার সাথে ঠাট্টা করছি না, ওইগুলো নিয়ে নাও। তখন সে তা নিয়ে গেল। হে আল্লাহ! আপনি জানেন, যদি আমি আপনার সন্তুষ্টি লাভের জন্য এ কাজটি করে থাকি, তবে পাথরের বাকীটুকু সরিয়ে দিন। তখন আল্লাহ পাথরটাকে সরিয়ে দিলেন।( )

মুখলিস ব্যক্তির জন্য আল্লাহই যথেষ্ট
হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বলেন, হকের বিষয়ে যার নিয়ত খাঁটি হবে, যদিও স্বীয় আত্মার উপর, আল্লাহ তা‘আলা তার মাঝে ও মানুষের মাঝে যথেষ্ট হবে।( )

মুখলিস ব্যক্তি হিকমত দ্বারা সজ্জিত:
হযরত মাকহুল রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
مَا أَخْلَصَ عَبْدٌ قَطُّ أَرْبَعِينَ يَوْمًا إِلَّا ظَهَرَتْ يَنَابِيعُ الْحِكْمَةِ مِنْ قَلْبِهِ عَلَى لِسَانِهِ .
যে ব্যক্তি চল্লিশ দিন পর্যন্ত ইখলাস অবলম্বন করে, তার অন্তর থেকে হেকমতের নহরসমূহ মুখের উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে।( )

মুখলিস ব্যক্তি ভুল করলেও সাওয়াব:
ইখলাসের কারণে বান্দাকে সাওয়াব দেয়া হয়ে থাকে যদিও সে ভুল করে। যেমন, মুজতাহিদ, আলেম, ফক্বীহ-ইত্যাদি। যখন তাঁরা তাঁদের ইজতিহাদ দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সত্য উদঘাটন ও মানবতার কল্যাণ সাধন করার নিমিত্তে কাজ করেন, তখন সে ভুলের উপরও তাঁদেরকে সাওয়াব দেয়া হবে।

যাবতীয় কল্যাণ ইখলাসের মধ্যেই নিহিত
হযরত দাঊদ আত-তায়ী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
رأيت الخير كله إنما يجمعه حسن النية وكفاك به خيراً وإن لم تنضب
আমি যাবতীয় কল্যাণকে একত্র করতে কেবল সুন্দর নিয়তকেই দেখেছি। ভালো নিয়তই যাবতীয় কল্যাণ লাভের জন্য যথেষ্ট।( )

সুতরাং, যেহেতু যাবতীয় কল্যাণ ও উপকারিতা মুখলিসদের জন্যই। তাই আমাদের উচিত, আমরা যেন ইখলাসের অধিকারী হই।

ইখলাস না থাকার ক্ষতি
যেমনি ভাবে ইখলাসের অনেক উপকারিতা ও ফলাফল রয়েছে, যা একজন মুসলিম স্বীয় ইখলাস থেকে অর্জন করতে পারে, অনুরূপভাবে ইখলাস না থাকারও অনেক ক্ষতি রয়েছে, যেগুলোতে একজন গাইরে মুখলিস ব্যক্তি আক্রান্ত হয়। এ সব ক্ষতিসমূহ হতে কতেক নিম্নে আলোচনা করা হল।

জান্নাতে প্রবেশে প্রতিবন্ধকতা
হযরত আবূ হুরাইরা রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন,
مَن تَعلَّمَ عِلْمًا مِمَّا يُبْتَغَى بهِ وَجْهُ الله لا يَتَعلَّمُه إلِا ليُصيبَ بِه عرضاً مِنْ الدُّنْيَا لَم يَجدْ عَرف الجَنةَّ يْوَم القياَمةِ يعْنِي رِيحَهَا
“যে ইলম দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন হয়ে থাকে, সে ইলমকে যদি কোন ব্যক্তি দুনিয়াবি কোন উদ্দেশ্য হাছিলের জন্য শেখে, কিয়ামতের দিন সে জান্নাত তো পাবেই না, এমনকি জারন্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না”।( )

জাহান্নামে প্রবেশের কারণ
হযরত আবূ হুরাইরা রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন,
إن أَولَ الناَّسِ يقضى يْوَم القيامِة عَلَيْهِ: رَجل اسُتشِهَد فَأُتَي بهِ فَعَرَّفُه نعمَه فَعرَفهَا، قَالَ: فَمَا عَمِلْتَ فيِهَا؟ قَالَ: قَاتلتُ فيِكَ حتَّى اسُتشِهْدتُ. قَالَ: كَذَبْتَ، وَلَكنكَّ قَاتَلْتَ لأن يُقَالَ: جَرِيءٌ، فَقَدْ قِيلَ. ثُّم أُمِر بهِ فَسحبَ عَلى وَجههِ حَتَّى أُلْقِيَ فِي الناَّرِ .
وَرجل تَعَلَّمَ الْعلمَ وَعَلَّمه وقَرَأَ القُرْآنَ، فَأُتِي بهِ فَعَّرَفُه نعَمَه فَعرَفهَا، قَالَ: فَمَا عَمِلْتَ فيِهَا؟ قَالَ: تَعَلَّمْت العِلْمَ وَعَّلمْتُهُ وقَرَأْتُ فيِكَ القُرْآنَ. قَالَ: كَذَبْتَ، وَلَكنكَ تَعَلَّمْت العلَم ليُقَالَ: عَالِمٌ، وَقَرَأْتَ القُرْآنَ ليقَالَ: هُوَ قَارِئٌ، فَقَدْ قِيلَ.ثم أُمَر بهِ فَسحبَ عَلى وَجْههِ حَتَّى أُلْقِيَ فِي النَّارِ.
وَرَجلٌ وَسَّع الله عَلَيْهِ وَأَعطَاهُ مِن أَصناَفِ المَالِ كُلِّهِ، فَأُتِيَ بهِ فَعرَّفُه نعَمَه فَعرَفهَا، قَالَ: فَمَا عَمِلْتَ فيِهَا؟ قَالَ: مَا تَرَكْتُ مِنْ سَبيِلٍ تُحبُّ أَنْ يُنفْقَ فيِهَا إلا أَنْفَقْتُ فيِهَا لكَ. قَالَ: كَذَبْتَ، وَلَكنِكَّ فَعَلْتَ ليُقَالَ: هُوَ جَوَاٌد، فَقَدْ قِيلَ. ثُّم أُمِرَ بهِ فَسحبَ عَلى وَجْهِهِ ثُمَّ أُلْقِيَ فِي الناَّرِ
“ক্বিয়ামতের দিন সর্ব প্রথম যে ব্যক্তির বিচার করা হবে, সে হল, যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয়, তারপর তাকে ডাকা হবে এবং তার নিকট আল্লাহর নি’মাতসমূহ তুলে ধরা হলে সে তা চিনতে পারবে। তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, তুমি এ সব নি’মাতের মুকাবালায় কি আমল করেছ? সে বলবে, তোমার রাহে আমি যুদ্ধ কেরেছি এবং শহীদ হয়েছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ, তুমি যুদ্ধ করেছ, যাতে মানুষ তোমাকে বাহাদুর বলে। তা তোমাকে বলা হয়েছে। তারপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপের নির্দেশ দেয়া হলে, তাকে তার চেহারার উপর উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

এক ব্যক্তি ইলম অর্জন করল, মানুষকে শেখাল এবং কুরআন পড়ল। তারপর তাকে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত করা হল এবং তার উপর আল্লাহর নিয়ামতসমূহ তুলে ধরা হলে, সে তা চিনতে পেল। তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, তুমি এ বিষয়ে কি আমল করেছ? বলবে, আমি ইলম শিখেছি এবং শিখিয়েছি। তোমার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে কুরআন পড়েছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ, তুমি ইলম শিখেছ, যাতে তোমাকে আলেম বলা হয়। আর কুরআন তিলাওয়াত করেছ, যাতে তোমাকে এ কথা বলা হয়, লোকটি ক্বারী। আর দুনিয়াতে তোমাকে তা বলা হয়েছে। তারপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপের নির্দেশ দেয়া হলে, তাকে তার চেহারার উপর উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

এক ব্যক্তি তাকে আল্লাহ তা‘আলা সামর্থবান করেছেন এবং তাকে বিভিন্ন ধরনের ধন-সম্পদ দিয়েছেন। তারপর তাকে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত করা হল এবং তার উপর আল্লাহর নি’মাতসমূহ তুলে ধরা হলে সে তা চিনতে পেল। তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, তুমি এ বিষয়ে কি আমল করেছ? সে বলবে, তোমার জন্য তুমি যে পথে ব্যয় করাকে পছন্দ কর, সে ধরনের কোন পথ আমি ছাড়িনি যেখানে আমি তোমার জন্য ব্যয় করিনি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ, তবে তা করেছ, যাতে লোকেরা তোমাকে এ কথা বলে যে, লোকটি দানবীর। আর দুনিয়াতে তোমাকে তা বলা হয়েছে। তারপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপের নির্দেশ দেয়া হলে, তাকে তার চেহারার উপর উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।( )

হযরত আবু হুরাইরা রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু যখনই এ হাদীসটি বর্ণনা করার ইচ্ছা করতেন, হাদীসের ভয়াবহতার কারণে তিনি বেহুঁশ হয়ে পড়তেন।

হযরত সুফাই আল আসবাহী রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি একবার মদিনা শরীফে প্রবেশ করে দেখতে পান যে, একজন লোককে কেন্দ্র করে অনেক মানুষ একত্র হয়। তখন সে বলল, লোকটি কে? লোকেরা বললেন, লোকটি হযরত আবু হুরাইরা (রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু)। আমি তাঁর নিকটে গিয়ে তাঁর সামনে বসলাম। তিনি মানুষকে হাদীস শোনাচ্ছেন। যখন তিনি চুপ করলেন এবং একা হলেন, আমি তাঁকে বললাম, আমি তোমাকে সত্যের শপথ দিয়ে বলছি। তুমি আমাকে এমন একটি হাদীস বলবে, যা তুমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জবান পাক থেকে শুনেছ, বুঝেছ এবং জেনেছ।

তখন হযরত আবু হুরাইরা রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বললেন, আমি তাই করব, আমি তোমাকে একটি হাদীস শোনাবো যে হাদীসটি আমাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করেছেন এবং আমি হাদীসটি তাঁর থেকে বুঝেছি এবং শিখেছি।
এ কথা বলে কিছু সময় হযরত আবু হুরাইরা রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বেহুশ হয়ে পড়লেন এবং কিছুক্ষণ পর হুশ ফিরে আসলে তিনি বলেন, আমি তোমাকে একটি হাদীস শোনাবো যে হাদীসটি আমাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার নিকট এ ঘরের মধ্যে বর্ণনা করেছেন, যেখানে আমি ও তিনি ছাড়া আর কেউ ছিলেন না।

তারপর আবু হুরাইরা রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু আবারও বেহুশ হয়ে পড়লেন এবং কিছুক্ষণ পর হুঁশ ফিরে পেলেন। তিনি তাঁর চেহারা মুছলেন এবং বললেন, আমি তোমাকে একটি হাদীস শোনাবো যে হাদীসটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বর্ণনা করেছেন, যখন আমি ও তিনি এ ঘরে ছিলাম। আমাদের সাথে আমি ও তিনি ছাড়া আর কেউ ছিল না।

তারপর আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু আবারও বেহুশ হয়ে পড়লেন এবং কিছুক্ষণ পর হুশ ফিরে পেলেন। তিনি তাঁর চেহারা মুছলেন এবং বললেন, আমি তোমাকে একটি হাদীস শোনাবো যে হাদীসটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বর্ণনা করেছেন, যখন আমি ও তিনি এ ঘরের মধ্যে ছিলাম। আমাদের সাথে আমি ও তিনি ছাড়া আর কেউ ছিল না।
তারপর আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু আবারও কঠিন ভাবে বেহুঁশ হয়ে পড়লেন এবং তিনি তাঁর চেহারার উপর ঢলে পড়লেন, আমি তাকে লম্বা করে আমার উপর হেলান দেওয়ালাম, কিছুক্ষণ পর তিনি হুঁশ ফিরে পেলেন এবং বললেন, আমাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীস বর্ণনা করেন তিনি উল্লেখিত হাদীসটি বর্ণনা করেন।

হাদীসের শেষ অংশে বর্ণিত, “অত:পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার উভয় হাঁটুর উপর আঘাত করে বলেন, হে আবূ হুরায়রা! এরা তিনজনই আল্লাহ তা‘আলার প্রথম মাখলুক যাদের দ্বারা কিয়ামতের দিন জাহান্নামকে প্রজ্বলিত করা হবে।( )

আগুনকে যেদিন প্রথম প্রজ্বলিত করা হবে, সেদিন হত্যাকারী, ব্যভিচারী, চোর ও মদ্যপানকারী দ্বারা প্রজ্বলিত করা হবে না, বরং ক্বোরআন তিলাওয়াতকারী, দানকারী, মুজাহিদ প্রমুখ দ্বারা প্রজ্বলিত করা হবে। আর এ গুলো সবই হবে রিয়ার কারণে।

হযরত কা’ব ইবনে মালেক রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন,
مَنْ طَلَبَ العِلَم ليِجَاري بهِ العُلَمَاءَ، أَوْ ليِمَارِيَ بهِ السُّفَهَاءَ، أَوْيَصْرِفَ بِهِ وجُوَه الناَّسِ إِلَيْهِ؛ أَدْخَلَهُ الله النَّارَ
“যে ব্যক্তি এলম অন্বেষণ করে, যাতে ইলম দ্বারা আলেমদের মুকাবালা করে অথবা জাহেলদের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে অথবা মানুষের দৃষ্টি তার প্রতি আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবে।”( )

আমল কবুল না হওয়া
“আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
أَنَا أَغْنىَ الشركَاءِ عَنْ الشِّركِ، مَنْ عِمَل عَمَلًا أَشرك فِيهِ مِعي غَيْري تَرَكْتُه وشَركهُ
তোমরা আমার সাথে যে সব শরীকদের শরীক সাব্যস্ত কর, আমি তা হতে পবিত্র ও অমুখাপেক্ষী। যে ব্যক্তি কোন আমল করে, তাতে আমার সাথে অন্য কাউকে শরীক করে, আমি তার আমল ও শিরক উভয়টিকে ছুঁড়ে ফেলে দেই।( )

হযরত আবু উমামা আল বাহেলী রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
” جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ: أَرَأَيْتَ رَجُلا غَزَا يَلْتَمِسُ الأَجْرَ وَالذِّكْرَ مَا لَهُ؟ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لا شَيْءَ لَهُ، فَأَعَادَهَا ثَلاثَ مَرَّاتٍ، يَقُولُ لَهُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لا شَيْءَ لَهُ، ثُمَّ قَالَ: إِنَّ اللَّهَ لا يَقْبَلُ مِنَ الْعَمَلِ إِلا مَا كَانَ لَهُ خَالِصًا وَابْتُغِيَ بِهِ وَجْهُهُ
“এক ব্যক্তি রাসূল করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে এসে আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এক ব্যক্তি আল্লাহর রাহে যুদ্ধ করে এবং সে এর বিনিময়ে সুনাম অর্জন ও সাওয়াব কামনা করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সে কিছুই পাবে না। লোকটি তিনবার জিজ্ঞাসা করলেন, প্রতিবারই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তার জন্য কিছুই মিলবেনা। আল্লাহ তা‘আলা কেবল ঐসব আমল কবুল করেন, যা একমাত্র আল্লাহর জন্য করা হয় এবং যে আমল দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করা হয়।( )

হযরত আবু হুরাইরা রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَجُلا قَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، رَجُلٌ يُرِيدُ الْجِهَادَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ، وَهُوَ يَبْتَغِي عَرَضًا مِنَ الدُّنْيَا، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: “لا أَجْرَ لَهُ”، فَأَعْظَمَ ذَلِكَ النَّاسُ، فَقَالُوا لِلرَّجُلِ: عُدْ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَلَعَلَّكَ لَمْ تُفْهِمْهُ، فَقَالَ الرَّجُلُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، رَجُلٌ يُرِيدُ الْجِهَادَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ، وَهُوَ يَبْتَغِي مِنْ عَرَضِ الدُّنْيَا، فَقَالَ: “لا أَجْرَ لَهُ”، فَأَعْظَمَ ذَلِكَ النَّاسُ، فَقَالُوا لِلرَّجُلِ: عُدْ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ لَهُ الثَّالِثَةَ: رَجُلٌ يُرِيدُ الْجِهَادَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ، وَهُوَ يَبْتَغِي عَرَضَ الدُّنْيَا، قَالَ: “لا أَجْرَ لَهُ “.
“এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল! একজন ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় পার্থিব বা দুনিয়ার কিছু সম্পদ লাভের উদ্দেশ্যে জিহাদ করতে চায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, তার জন্য কোন সাওয়াব মিলবে না। লোকেরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথায় আশ্চর্য হলেন এবং লোকটিকে বললেন, তুমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আবার যাও এবং জিজ্ঞাসা কর, হতে পারে তুমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কথাটি বুঝিয়ে বলতে পারনি।
তারপর লোকটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে গিয়ে আবারও আরয করল, হে আল্লাহর রাসূল! একজন ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় দুনিয়ার কিছু সম্পদ লাভের উদ্দেশ্যে জিহাদ করতে চায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, তার জন্য কোন সাওয়াব মিলবে না।
লোকেরা বলল, তুমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আবার যাও, লোকটি আবার গিয়ে আরয করলে, তৃতীয় বার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, তার জন্য সাওয়াব ও বিনিময় কিছুই নাই।( )

আমলের সাওয়াব নষ্ট হওয়া
আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
وَقَدِمۡنَآ إِلَىٰ مَا عَمِلُواْ مِنۡ عَمَلٖ فَجَعَلۡنَٰهُ هَبَآءٗ مَّنثُورًا
“আমি তাদের কৃতকর্মের প্রতি লক্ষ্য করব, অতপর সেগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করব।(সূরা ফুরক্বান, আয়াত-২৩)

হাদীসে কুদসীতে বর্ণিত, আল্লাহ তা‘আলা রিয়াকারীদের বিষয়ে বলবেন,
اذْهَبُوا إِلَى الَّذِينَ كُنْتُم تُراءُونَ فِي الدُّنيَا، فَانْظُرُوا هَلْ تِجدُونَ عِنْدَهُمْ جَزَاءً
“দুনিয়াতে তোমরা যাদের দেখানোর জন্য আমল করতে তাদের নিকট যাও, দেখ, তাদের নিকট কোন বিনিময় পাও কিনা”? ( )

সালফে সালেহীনদের নিকট ইখলাসের গুরুত্ব

আল্লাহ তা‘আলার বাণীসমূহের তিলাওয়াত ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসসমূহ অধ্যয়ন করার পর সালফে সালেহীন ইখলাসের গুরুত্ব সম্পর্কে মুসলিম জাতিকে অধিক সতর্ক করেন। তাঁরা ইখলাসের গুরুত্ব ও ইখলাস না থাকার ক্ষতি উপলব্ধি করত: ইখলাসের প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। ফলে দেখা যায়, তাঁরা তাঁদের লিখনীতে প্রথমে নিয়ত বিষয়ে আলোচনা দিয়ে আরম্ভ করেন। যেমন-
ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি إنِّمَا الأعَمَالُ باِلنيِّاتِ “সমস্ত আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল”।( ) হাদীসটি দিয়ে তাঁর কিতাব আরম্ভ করেন।

আব্দুর রহমান ইবনে মাহদী বলেন,“বিভিন্ন অধ্যায়ের উপর যদি আমি কোন কিতাব লিখতাম, তাহলে প্রতিটি অধ্যায়ের শুরুতে আমি হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর হাদীস-“যাবতীয় আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল” কে উল্লেখ করতাম”।( )

অনুরূপ তাঁরা বলেন, নিয়ত আমল হতেও গুরুত্বপূর্ণ। ইয়াহয়া বিন আবি কাসীর রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, তোমরা নিয়ত শেখ, কারণ, তা আমল হতেও অধিক গুরুত্বপূর্ণ।( )

মানুষকে ইখলাস শেখানোর বিষয়ে ওলামাগণ সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন। আল্লামা ইবনু আবি জামরাহ রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আমি পছন্দ করি যে, যদি কতক ফক্বীহ এমন হতেন, তাঁরা মানুষকে তাদের আমলের উদ্দেশ্য শেখানো নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন এবং তাদের আমলের নিয়ত শেখানোর উদ্দেশ্যে এক জায়গায় বসে থাকবেন; তাঁরা আর কোন কাজ করবেন না।( )

কারণ, অধিকাংশ মানুষকে দেখা যাচ্ছে তারা নিয়তের কারণে তাদের আমলকে নষ্ট করছে।
অপর দিকে আমরা দেখতে পাই, আল্লাহ তা‘আলা রিয়াকারী তথা যারা তাদের আমল দ্বারা পার্থিব স্বার্থ লাভের ইচ্ছা পোষণ করে, তাদের ভৎসনা ও তিরস্কার করছেন এবং রিয়ার পরিণতি সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করছেন। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
مَن كَانَ يُرِيدُ ٱلۡحَيَوٰةَ ٱلدُّنۡيَا وَزِينَتَهَا نُوَفِّ إِلَيۡهِمۡ أَعۡمَٰلَهُمۡ فِيهَا وَهُمۡ فِيهَا لَا يُبۡخَسُونَ . أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ لَيۡسَ لَهُمۡ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ إِلَّا ٱلنَّارُۖ وَحَبِطَ مَا صَنَعُواْ فِيهَا وَبَٰطِل مَّا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ
“যে ব্যক্তি দুনিয়ার জীবন ও তার জৌলুস কামনা করে, আমি সেখানে তাদেরকে তাদের আমলের ফল পুরোপুরি দিয়ে দেই এবং সেখানে তাদেরকে কম দেয়া হবে না। এরা তারাই, আখিরাতে যাদের জন্য আগুণ ছাড়া আর কিছুই নেই এবং তারা সেখানে যা করে তা বরবাদ হয়ে যাবে আর তারা যা করত, তা সম্পূর্ণ বাতিল”। [সূরা হুদ, আয়াত: ১৫, ১৬]

আল্লাহ তা‘আলা আরও এরশাদ করেন,
مَّن كَانَ يُرِيدُ ٱلۡعَاجِلَةَ عَجَّلۡنَا لَهُۥ فِيهَا مَا نَشَآءُ لِمَن نُّرِيدُ ثُمَّ جَعَلۡنَا لَهُۥ جَهَنَّمَ يَصۡلَىٰهَا مَذۡمُومٗا مَّدۡحُورٗا
“যে দুনিয়া চায় আমি সেখানে তাকে দ্রুত দিয়ে দেই, যা আমি চাই, যার জন্য চাই। তারপর তার জন্য নির্ধারণ করি জাহান্নাম, সেখানে সে প্রবেশ করবে নিন্দিত, বিতাড়িত অবস্থায়”। [সূরা ইসরা, আয়াত: ১৮]

আল্লাহ তা‘আলা আরও এরশাদ করেন,
مَن كَانَ يُرِيدُ حَرۡثَ ٱلۡأٓخِرَةِ نَزِدۡ لَهُۥ فِي حَرۡثِهِۦۖ وَمَن كَانَ يُرِيدُ حَرۡثَ ٱلدُّنۡيَا نُؤۡتِهِۦ مِنۡهَا وَمَا لَهُۥ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ مِن نَّصِيبٍ
“যে আখিরাতের ফসল কামনা করে, আমি তার জন্য তার ফসলে প্রবৃদ্ধি দান করি, আর যে দুনিয়ার ফসল কামনা করে, আমি তাকে তা থেকে কিছু দেই এবং আখিরাতে তার জন্য কোন অংশই থাকবে না”। [ সূরা শুরা, আয়াত: ২০]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন,
إنِ أَخْوَف مَا أَخَافُ عَلَيْكُم الشِّرْكُ الأَصْغَرُ قَالُوا: وَمَا الشِّركُ الأصْغَرُ يَا رَسُولَ الله؟ قَالَ الرِّيَاءُ، يَقُولُ الله لهْم يْوَم القَياَمِة إذِا جزي الناَّسُ بِأَعْمَالهِمْ: اذْهَبُوا إِلَى الَّذِينَ كُنْتم تُراءُونَ فِي الدُّنيَا، فَانْظُرُوا هَلْ تَجدُونَ عِنْدَهْم جَزَاءً
“আমি তোমাদের উপর যে জিনিষটিকে বেশি ভয় করি, তা হল, ছোট শিরক। সাহাবীগন আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! ছোট শিরক কি? তিনি উত্তরে বললেন, রিয়া। আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন যখন মানুষকে তাদের আমলের বিনিময় দেবেন, তখন রিয়াকারীকে বলবেন, যাও দুনিয়াতে যাদেরকে তোমরা তোমাদের আমল দেখাতে, দেখ তাদের নিকট কোন সাওয়াব পাও কিনা”? ( )

আর আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, মানুষকে কিয়ামতের দিন তাদের নিয়ত অনুযায়ী দাঁড় করানো হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, إِّنَما يُبْعَثُ النَّاسُ عَلَى نياتِهمِ “অবশ্যই মানুষকে তাদের নিয়তের উপর ভিত্তি করে পূনরুস্থান করা হবে”।( )

ইখলাস বিষয়ে সালফে সালেহীনের অবস্থান

আল্লাহর ক্বেরআন ও প্রিয় নবীর হাদীসের পাশাপাশি সালফে সালেহীন ইখলাস বিষয়ে তাঁদের একটি সু-স্পষ্ট অবস্থান ছিল যা অন্যদের ছিল না। ইখলাস বিষয়ে তাঁদের অবস্থান ছিল একটি অনুকরণীয় আদর্শ। কারণ, তাঁরা ইখলাসের গুরুত্ব সম্পর্কে জানতেন এবং ইখলাসের গুণে গুণান্বিত ছিলেন।

হযরত ফুদ্বাইল বিন আয়ায রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
إنما يريد الله عز وجل منك نيتك وإرادتك
“আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের থেকে তোমাদের নিয়ত ও ইচ্ছাকেই চান”।( )

হযরত আব্দুল্লাহ আত-তাসতরী রহমাতুল্লাহি আলাইহিকে জিজ্ঞাসা করা হল, প্রবৃত্তির জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ কোনটি। তিনি বলেন, ইখলাস। কারণ, তার মধ্যে নফসের কোন অংশ নাই।( )

হযরত ইউসুফ বিন আসবাত রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
تخليص النية من فسادها أشد على العاملين من طول الاجتهاد.
আমলকারীদের জন্য নিয়তকে নষ্ট করা হতে বিশুদ্ধ করা, দীর্ঘ ইজতেহাদ করা হতে কঠিন।

ক্স তাঁরা ইখলাসের গুণে গুণান্বিত হবার পরও নিজেদের মুখলিস বলে দাবি করতেন না

মানুষের জীবনে ইখলাস অর্জন করা একটি কঠিন কাজ। একজন মুসলিম ইখলাস অর্জন করতে হলে, তাকে অবশ্যই প্রকৃত জিহাদ করতে হবে। এ কথা জেনেই সালফে সালেহীন নিজেদেরকে মুখলিস দাবি করা হতে বিরত থাকেতেন। তাঁরা নিজেরা মুখলিস এ কথা কখনো প্রমাণ করতে চাননি।

হযরত হিশাম আত-দোস্তওয়াঈ যাঁর সম্পর্কে শুবা ইবনুল হুজ্জাজ রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, একমাত্র হিশাম আত-দোস্তওয়াঈ ছাড়া আর কাউকে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে হাদীস তালাশ করতে আমি দেখিনি।
অথচ তিনি হাদীসের অনুসন্ধানে স্বীয় আত্মাকে দোষারোপ করে বলছেন,
“والله ما أستطيع أن أقول إني ذهبت يوماً قط أطلب الحديث أريد به وجه الله عزوجل”.
আমি কখনো এ কথা বলতে পারি না যে, আমি কোন দিন কেবল আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে হাদীসের সন্ধান করতে বের হয়েছি।( )

যাঁর সম্পর্কে শাজ ইবনুল ফাইয়ায রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, হিশাম আত-দোস্তওয়াঈ এত বেশি কাঁদতেন যে, তাঁর চক্ষুদ্বয় নষ্ট হয়ে যায়।

হযরত হিশাম রহমাতুল্লাহি আলাইহি তার নিজের সম্পর্কে বলেন, যখন আমি বাতির আলো হারিয়ে ফেলতাম, তখন কবরের অন্ধকারের কথা চিন্তা করতাম।
তিনি আরও বলেন, আমি আলেম সম্পর্কে অবাক হই, সে কীভাবে হাসে।( )

হযরত আবু সুফিয়ান রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আমি আমার উপর নিয়তের চেয়ে কঠিন কিছুর সম্মুখীন হই নাই। কারণ, তা আমার উপর বার বার পরিবর্তন হয়।( )

আর হযরত ইউসুফ ইবনুল হুসাইন রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, দুনিয়াতে সর্বাধিক প্রিয় বস্তু হল, ইখলাস।
كم أجتهد في إسقاط الرياء من قلبي فينبت لي على لون آخر
আমি আমার অন্তর থেকে রিয়াকে দূর করার জন্য কতনা পরিশ্রম করে থাকি। কিন্তু তা যেন ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রকাশ পায়।( )

হযরত মুতার-রাফ বিন আব্দুল্লাহ রহমাতুল্লাহি আলাইহির দু’আ হল,
” اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْتَغْفِرُكَ مِمَّا تُبْتُ إِلَيْكَ مِنْهُ ثُمَّ عُدْتُ إِلَيْهِ، وَأَسْتَغْفِرُكَ مِمَّا جَعَلْتُهُ لَكَ عَلَى نَفْسِي ثُمَّ لَمْ أُوَفِّ بِهِ، وَأَسْتَغْفِرُكَ مِمَّا زَعَمْتُ أَنِّي أَرَدْتُ بِهِ وَجْهَكَ فَخَالَطَ قَلْبِي فَيهِ مَا قَدْ عَلِمْتَ ” .
“হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি ওই গুনাহ হতে, যে গুনাহ হতে তোমার নিকট তাওবা করার পর, তা পুনরায় করেছি। আর আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি, তুমি আমার উপর যে দায়িত্ব দিয়েছ, কিন্তু আমি তা পূরণ করিনি। আর আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি ঐ সব কাজ হতে, যে সব কাজে আমি আমার ধারণা মতে তোমার সন্তুষ্টি কামনা করেছি, কিন্তু তুমি জান, আমার অন্তর অন্য কিছুকে তোমার সাথে শরীক করেছে।” ( )

তাঁরা ছিলেন, অনুকরণ যোগ্য ইমাম। তা সত্ত্বেও তাঁরা নিজেদের প্রবৃত্তিকে দোষারোপ করার ব্যাপারে সব মানুষের তুলনায় অধিক কঠোর ছিলেন।

তাঁরা ইখলাসের গুণে গুণান্বিত হবার পরও নিজেদের আমলকে গোপন রাখতেন
হযরত হাসান বসরী রহমাতুল্লাহি আলাইহি সালফে সালেহীন তাঁদের আমল কীভাবে গোপন রাখতেন সে বিষয়ে বলতে গিয়ে বলেন, দেখা যেত তাঁদের কেউ পুরো ক্বোরআনকে একত্র করতেন: অথচ তাঁর প্রতিবেশীরা জানত না।
একজন লোক অনেক বেশি ফিকাহ জানতেন, কিন্তু মানুষের মধ্যে তাঁর কোন সুনাম ছিল না।
আবার একজন লোক দেখা গেল, স্বীয় ঘরে দীর্ঘ সময় নামায আদায় করতেন, তাঁর ঘরে মেহমান আসত, কিন্তু তারা জানতে পারত না।
জমিনের উপর এমন কোন আমল ছিলনা যা গোপনে করা যেত, তা না করে প্রকাশ্যে করা হত।

হযরত হাসান রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “লোকদের কাছে মেহমান থাকত, সে ব্যক্তি রাতে সালাত আদায় করলে তাঁর মেহমান তা জানত না। তাঁরা বেশি বেশি দু‘আ করতেন কিন্তু তাঁদের আওয়াজ কেউ শুনতনা। এক ব্যক্তি একই বিছানায় তাঁর স্ত্রীর সাথে রাতে ঘুমাতো, সারারাত সে আল্লাহর কাছে কাঁদত কিন্তু তাঁর স্ত্রী তা বুঝতে পারত না”।

হযরত সুফইয়ান রহমাতুল্লাহি আলাইহি থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমাকে মারিয়া রবি‘ ইবন খুসাইম বলেছেন, “রবি‘ এর সব আমল গোপনীয় ছিল। কুরআন তিলাওয়াতের সময় কেউ আসলে তিনি কাপড় দিয়ে তা ঢেকে রাখতেন”।

তাঁরা বেশি বেশি দু’আ করতেন, কিন্তু তাঁদের দু’আর আওয়াজ শোনা যেত না। তাঁদের আওয়াজ তাঁর মধ্যে ও তাঁর আল্লাহর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
ٱدۡعُواْ رَبَّكُمۡ تَضَرُّعٗا وَخُفۡيَةًۚ إِنَّهُۥ لَا يُحِبُّ ٱلۡمُعۡتَدِينَ
“তোমরা তোমাদের রবকে ডাক অনুনয় বিনয় করে ও চুপিসারে। নিশ্চয় তিনি পছন্দ করেননা সীমালঙ্ঘন কারীদেরকে”(আ’রাফ, আয়াত-৫৪) ( )

এমনকি তাঁরা স্ত্রী ও পরিবার-পরিজন থেকেও আমলকে গোপন করতেন

হযরত হাসান বিন আবু সিনানের স্ত্রী তাঁর স্বামী সম্পর্কে বলেন, সে ঘরে এসে আমার সাথে একসাথে বিছানায় প্রবেশ করত। তারপর সে একজন মা তার বাচ্চাকে ঘুম পারিয়ে যেভাবে উঠে যায়, সে সেভাবে উঠে গিয়ে আমাকে ধোঁকা দিত। যখন সে বুঝতে পারত, আমি ঘুমিয়ে পড়েছি তখন সে বিছানা থেকে উঠে যেত এবং নামায আদায়ে লিপ্ত হত। তিনি বলেন, আমি তাকে বললাম, হে আবু আব্দুল্লাহ! তুমি তোমার নফসকে আর কত কষ্ট দেবে? তোমার আত্মাকে আর কত শাস্তি দেবে। তখন সে বলে, তুমি চুপ কর। হতে পারে আমি এমন একটি ঘুম দেব, তার থেকে আর কখনো জাগবো না।( )

وهكذا صام داود بن أبي هند أربعين سنة لا يعلم به أهله فكان يأخذ إفطاره ويتصدق به على المساكين ويأتي على العشاء
অনুরূপভাবে হযরত দাউদ বিন আবু হিন্দ রহমাতুল্লাহি আলাইহি চল্লিশ বছর পর্যন্ত রোযা রাখেন কিন্তু তাঁর স্ত্রী জানত না। সকাল বেলা তাঁর স্ত্রী তাঁর জন্য খানা তৈরি করে দিত। কিন্তু রাস্তায় তিনি খানাটি কাউকে দান করে দিতেন এবং সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে ইফতার খেতেন।( )

তাঁরা জিহাদ চলাকালীন সময়েও নিজেদের গোপন রাখতেন

জিহাদ এমন একটি জায়গা যেখানে রিয়া করা বা ইখলাস না থাকার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। মুসলিমদের সাথে যারা অস্ত্র বহন করে এবং যুদ্ধ করে, তাদের সবাই মুখলিস হবে এমন কোন কথা নাই। এ কারণে আমরা দেখতে পাই উপরে এমন কতক হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে, যাতে জিহাদে নিয়ত খাঁটি করা ও ইখলাসের গুরুত্ব সম্পর্কে বিশেষ তাকিদ দেয়া হয়েছে। আমাদের সালফে সালেহীনের নিকট জিহাদের মধ্যেও ইখলাসের চিত্র ছিল, তাঁরা তাঁদের জিহাদকে এমন গোপন করতেন, তাঁদের চেনাই যেত না। এখানে দুটি ঘটনা তুলে ধরা হল।

প্রথম ঘটনা
عَنْ أبي حاتم الرازي، قَالَ: سمعت عبدة بْن سُلَيْمَان، يَقُول: ” كنا فِي سرية مَعَ عَبْد اللَّهِ بْن الْمُبَارَك فِي بلاد الروم فصادفنا العدو، فلما التقى الصفان خرج رجل من العدو فدعا إِلَى البراز، فخرج إليه رجل فطارده ساعة فطعنه فقتله، ثم آخر فقتله، ثم آخر فطعنه فقتله، ثم آخر فقتله، ثم دعا إِلَى البراز، فخرج إليه رجل فطارده ساعة فطعنه الرَّجُل فقتله، فازدحم الناس عَلَيْهِ فكنت فيمن ازدحم عَلَيْهِ، فَإِذَا هو ملثم وجهه بكمه فأخذت بطرف كمه فمددته، فَإِذَا هو عَبْد اللَّهِ بْن الْمُبَارَك، فَقَالَ: وأنت يا أبا عمرو ممن يشنع علينا
হযরত আবদাহ বিন সুলাইমান রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, একদা আমরা হযরত আব্দুল্লাহ বিন মুবারকের সাথে রুম শহরে একটি যুদ্ধে ছিলাম। আমরা দুশমনদের দেখা পাই। যখন যুদ্ধের ময়দানে দুটি কাতার মুখোমুখি হল, তখন দুশমনদের থেকে এক লোক বের হয়ে, মোকাবেলা করার আহ্বান করলে একজন মুসলিম ব্যক্তি বের হল এবং তার সাথে মোকাবিলা করে তাকে আঘাত করে হত্যা করে ফেলল।
তারপর অপর এক লোক বের হল এবং সে চ্যালেঞ্জ চুড়ে দিল। তখন মুসলিমটি তার সাথে মোকাবিলা করল এবং তাকেও হত্যা করল।
তারপর তৃতীয় ব্যক্তি আসল এবং তাকেও হত্যা করল।
এরপর লোকেরা মুসলিম ব্যক্তিটি কে জানার জন্য ভিড় করলে লোকটি তার চেহারা ডেকে ফেলল।
হযরত আবদা রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, যারা লোকটিকে চেনার জন্য ভিড় করছিল, আমিও তাদের সাথে ছিলাম। আমি লোকটির জামার একটি হাতা ধরে টান দিলে দেখতে পাই লোকটি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক। তখন তিনি বকা দিয়ে বললেন, এ জন্যই কি চেহারা খোলা হল: হে আবু ওমর তুমি এমন লোক যে আমাদের বিরুদ্ধে বিপদ ডেকে আন!?। ( )

দ্বিতীয় ঘটনা [পরিখা খননকারীর ঘটনা]:
حاصر المسلمون حصناً واشتد عليهم رمي الأعداء، فقام أحد المسلمين وحفر نفقاً فانتصر المسلمون، ولا يُعرَف من هو هذا الرجل، وأراد مَسْلَمَة يريد أن يعرف الرجل لمكافأته،ولما لم يجده سأله بالله أن يأتيه، فأتاه طارق بليل وسأله شرطاً وهو أنه إذا أخبره من هو لا يبحث عنه بعد ذلك أبداً، فعاهده، و كان يقول: ” اللهم احشرني مع صاحب النفق”.
একবার মুসলিম সৈন্যরা দুশমনদের একটি ঘাটি ঘেরাও করে ফেললে দুশমনরা মুসলিমদের উপর তীর নিক্ষেপ করতে আরম্ভ করে। এ অবস্থা দেখে একজন মুসলিম সৈন্য নিজ উদ্যোগে পরিখা খনন আরম্ভ করেন। পরিখা খনন করে তিনি দুশমনদের দূর্ঘের ভিতরে পৌঁছতে সক্ষম হন এবং দুশমনদের বিরুদ্ধে মুসলিমরা বিজয় লাভ করে। কিন্তু লোকটি কে ছিল কেউ তা জানত না।

মুসলিম সেনাপতি মাসলামাহ লোকটিকে পুরস্কার দেয়ার জন্য খোঁজাখুঁজি করছিলেন। কিন্তু না পেয়ে তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করেন, আল্লাহ যাতে লোকটির সন্ধান দেন। রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ল, তখন মাসলামার নিকট একজন আগন্তুক এসে তাকে একটি শর্ত দিয়ে বলল, যদি সে লোকটি সম্পর্কে তাকে সংবাদ দেয়, সে যেন তার পর থেকে আর কোন দিন তাকে তালাশ না করে। তখন মাসলামাহ তার সাথে প্রতিশ্রুতি দিলে তাকে লোকটি সম্পর্কে জানানো হল, লোকটি কে। মাসলামা রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু সব সময় এ কথা বলতেন, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে পরিখা খননকারীর সাথে হাশর কর।( )

গ্রাম্য লোক ও গনিমত
হযরত শাদ্দাদ ইবনুল হাদ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
عَنْ شَدَّادِ بْنِ الْهَادِ، أَنَّ رَجُلًا مِنَ الْأَعْرَابِ جَاءَ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَآمَنَ بِهِ وَاتَّبَعَهُ، ثُمَّ قَالَ: أُهَاجِرُ مَعَكَ , فَأَوْصَى بِهِ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَعْضَ أَصْحَابِهِ، فَلَمَّا كَانَتْ غَزْوَةٌ، غَنِمَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ سَبْيًا فَقَسَمَ وَقَسَمَ لَهُ، فَأَعْطَى أَصْحَابَهُ مَا قَسَمَ لَهُ وَكَانَ يَرْعَى ظَهْرَهُمْ، فَلَمَّا جَاءَ دَفَعُوهُ إِلَيْهِ , فَقَالَ: مَا هَذَا ؟ قَالُوا: قِسْمٌ قَسَمَهُ لَكَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَأَخَذَهُ، فَجَاءَ بِهِ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: مَا هَذَا ؟ قَالَ: ” قَسَمْتُهُ لَكَ ” , قَالَ: مَا عَلَى هَذَا اتَّبَعْتُكَ، وَلَكِنِّي اتَّبَعْتُكَ عَلَى أَنْ أُرْمَى إِلَى هَاهُنَا وَأَشَارَ إِلَى حَلْقِهِ بِسَهْمٍ فَأَمُوتَ فَأَدْخُلَ الْجَنَّةَ، فَقَالَ: ” إِنْ تَصْدُقِ اللَّهَ يَصْدُقْكَ ” ,
فَلَبِثُوا قَلِيلًا ثُمَّ نَهَضُوا فِي قِتَالِ الْعَدُوِّ، فَأُتِيَ بِهِ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُحْمَلُ قَدْ أَصَابَهُ سَهْمٌ حَيْثُ أَشَارَ، فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ” أَهُوَ هُوَ ؟ ” , قَالُوا: نَعَمْ , قَالَ: ” صَدَقَ اللَّهَ فَصَدَقَهُ ” ثُمَّ كَفَّنَهُ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي جُبَّةِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، ثُمَّ قَدَّمَهُ فَصَلَّى عَلَيْهِ فَكَانَ فِيمَا ظَهَرَ مِنْ صَلَاتِهِ: ” اللَّهُمَّ هَذَا عَبْدُكَ خَرَجَ مُهَاجِرًا فِي سَبِيلِكَ فَقُتِلَ شَهِيدًا أَنَا شَهِيدٌ عَلَى ذَلِكَ ” .
“গ্রাম থেকে একজন লোক এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ঈমান আনে এবং তাঁর অনুকরণ করে। তাপর লোকটি বলল, আমি আপনার সাথে হিজরত করব। তার কথা শোনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদেরকে লোকটির বিষয়ে অসিয়ত করেন।
তারপর কোন একটি যুদ্ধে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছু গণিমত লাভ করলে তা তিনি বণ্টন করেন এবং লোকটির জন্যও একটি অংশ নির্ধারণ করা হয়। লোকটি তার সাথীদের নিকট তার অংশটি সমর্পণ করল। লোকটি তাদের পিছনে থাকত। যখন সে আসল, তাকে তার অংশটি হস্তান্তর করা হলে, সে বলল, এ কি? তারা বলল, এটি তোমার অংশ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমার জন্য এ অংশ নির্ধারণ করেছেন।

লোকটি তার অংশটি নিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! এ কি? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি তোমার জন্য তোমার অংশ বণ্টন করে দিয়েছি। লোকটি বলল, আমি এ জন্য আপনার অনুকরণ করিনি। কিন্তু আমি আপনর অনুকরণ করেছি যাতে আমি আমার গলায় তীর দ্বারা আঘাত প্রাপ্ত হই। তারপর আমি যখন মারা যাব, তখন জান্নাতে প্রবেশ করব।

এ কথা বলার পর, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যদি তুমি সত্য বল, আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে সত্য পরিণত করবেন।

তারপর সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে কিছু সময় অপেক্ষা করল এবং দুশমনদের মোকাবেলায় যুদ্ধ করার জন্য উঠে দাঁড়াল। তারপর তাকে যুদ্ধের ময়দান থেকে বহন করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে নিয়ে আসা হল, তখন সে যে জায়গাটি ইশারা করে দেখিয়েছিল, সে জায়গায় তীরের আঘাত প্রাপ্ত হল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে দেখে বললেন, সে কি সে লোক? তারা বলল, হ্যাঁ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, লোকটি সত্য বলেছে এবং আল্লাহ তাআলও তা সত্যে পরিণত করলেন।

তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় জামা মুবারক দ্বারা লোকটিকে আবৃত করে দাফন করলেন এবং তাকে সামনে এগিয়ে দিয়ে তার নামাযে জানাযা আদায় করলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার নামায আদায়ে যে দোয়া পড়েন তা ছিল-
اللُّهُمَّ هَذَا عَبْدُك، خَرَجَ مُهَاجِراً فِي سَبيلكَ، فَقُتلَ شَهِيداً، أَنَا شَهِيدٌ عَلَى ذَلِكَ
হে আল্লাহ! এ তোমার বান্দা, তোমার রাস্তায় হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিল অত:পর সে শহীদ হয়ে মৃত্যু বরণ করল। আমি এর উপর সাক্ষী।( )

তাঁরা লৌকিকতা ও কৃত্রিমতাকে ভয় করতেন
হযরত আলী ইবনে বুকার আল-বাসরী আয-যাহেদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
أَنْ أَلْقَى الشَّيْطَانَ عِيَانًا أَحَبُّ إِلَيَّ مِنْ أَنْ يَلْقَانِي وَأَلْقَاهُ ” قُلْتُ لَهُ فِي ذَلِكَ ، فَقَالَ: ” أَخَافُ أَنْ أَتَصَنَّعَ لَهُ فَأَتَزَيَّنَ لِغَيْرِ اللَّهِ فَأَسْقُطَ مِنْ عَيْنِ اللَّهِ
শয়তানের সাথে সাক্ষাত করা আমার নিকট অমুকের সাথে সাক্ষাত করা হতে অধিক প্রিয়। আমি তার জন্য কৃত্রিম উপায় অবলম্বন করব আর এর কারণে আল্লাহর দৃষ্টি হতে দূরে সরে যাব।( )

তাঁরা নিজেদেরকে জ্ঞানী বলে প্রকাশ করতেন না
হযরত আবুল হাসান আল-কাত্তান হতে ইবনে ফারেস রহমাতুল্লাহি আলাইহি উল্লেখ করে বলেন,
قال الذهبي: يقول ابن فارس عن أبي الحسن القطان: ” أصبت ببصري وأظن أني عوقبت بكثرة كلامي أثناء الرحلة” قال الذهبي: صدق والله فإنهم كانوا مع حسن القصد وصحة النية غالباً يخافون من الكلام وإظهار المعرفة.
আমার চোখ আক্রান্ত হল, আমার বিশ্বাস আমার সফরে অধিক কথা বলার কারণে শাস্তির সম্মুখীন হই। অর্থাৎ, তাঁর ধারণা যে, তাঁর অসুস্থতা তাঁর ইলমকে প্রকাশ করার শাস্তিস্বরূপ।

ইমাম যাহবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, তিনি অবশ্যই সত্য বলেছেন, কারণ, পূর্বেকার মনিষীরা তাঁদের নিয়ত সঠিক হওয়া ও ইচ্ছা সুন্দর হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা -অধিকাংশ সময়- কথা বলতে, তাঁদের ইলমকে প্রকাশ করতে ও বুজুর্গি প্রকাশ করতে ভয় করতেন।

কিন্তু বর্তমানে, জ্ঞান কম হওয়া এবং নিয়ত খারাপ হওয়া সত্ত্বেও মানুষ কথা বেশি বলে। তারপর আল্লাহ তা‘আলা অবশ্যই তাদের অপমান করেন, তাদের অজ্ঞতা ও খারাবিকে প্রকাশ করেন তারা যা জানে সে বিষয়ে তাদের ঝগড়া-বিবাদ প্রকাশ করেন।( )

তাঁরা কান্নাকে গোপন করতেন
يقول حماد بن زيد: كان أيوب ربما حدث في الحديث فيرقّ وتدمع عيناه، فيلتفت و ينتخط ويقول ما أشد الزكام!!، فيظهر الزكام لإخفاء البكاء
হযরত হাম্মাদ বিন যায়েদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, হযরত আইউব রহমাতুল্লাহি আলাইহি যখন কোন হাদীস বর্ণনা করতেন, তখন তিনি কাঁদতেন এবং তাঁর চক্ষুদ্বয় থেকে অশ্রু নির্গত হত। তখন আবার এসে নাক ঝাড়তেন এবং বলতেন, কত সর্দি!! কান্নাকে গোপন করার কারণে সর্দির প্রকাশ করতেন।( )

হযরত হাসান বসরী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
“إن كان الرجل ليجلس المجلس فتجيئه عبرته فيردها فإذا خشي أن تسبقه قام وذهب وبكى في الخارج”.
এমন এমন লোক ছিল, যাঁরা মজলিসে বসতেন, তখন তাঁদের চোখের পানি আসলে, তাঁরা তা প্রতিহত করতে চেষ্টা করতেন। কিন্তু তারপরও যখন তাঁরা চোখের পানি বের হওয়া আশঙ্কা করতেন, তখন তাঁরা মজলিস থেকে উঠে যেতেন।

হযরত মুহাম্মাত বিন ওয়াসে রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
إن كان الرجل ليبكي عشرين سنة وامرأته لا تعلم.
এমন লোকও ছিলেন, যে বিশ বছর পর্যন্ত কান্নাকাটি করতেন অথচ তাঁর স্ত্রী তাঁর সাথে থেকেও তাঁর কান্না সম্পর্কে জানত না।( )

তিনি আরও বলেন, আমি কতেক লোক এমন পেলাম, তাঁদের চেহারা চোখের পানি দ্বারা ভিজে যেত, কিন্তু একই বালিশে হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের কান্না-কাটি সম্পর্কে তাঁদের স্ত্রীরা একটুও টের পেত না। আরও কিছু লোক এমন দেখতে পেলাম, তাঁরা একই কাতারে দাঁড়াতেন, আর তাঁদের চোখের পানি তাঁদের চেহারার উপর দিয়ে প্রবাহিত হত, অথচ তাঁর পাশের লোক বুঝতে পারত না। ( )

ইমাম আল-মাওয়ারদি ও তাঁর কিতাব লিখা:
للإمام الماوردي قصة في الإخلاص في تصنيف الكتب، فقد ألف المؤلفات في التفسير والفقه وغير ذلك ولم يظهر شيء في حياته لما دنت وفاته قال لشخص يثق به: الكتب التي في المكان الفلاني كلها تصنيفي وإنما إذا عاينت الموت و وقعت في النزع فاجعل يدك في يدي فإن قبضت عليها فاعلم أنه لم يقبل مني شيء فاعمد إليها وألقها في دجلة بالليل وإذا بسطت يدي فاعلم أنها قبلت مني وأني ظفرت بما أرجوه من النية الخالصة، فلما حضرته الوفاة بسط يده، فأظهرت كتبه بعد ذلك.
ইমাম আল-মাওয়ারদী ও তাঁর কিতাব লিখা বিষয়ে একটি আশ্চর্য ঘটনা বর্ণিত আছে। তিনি তাফসীর, ফিকাহ ইত্যাদি বিষয়ে একাধিক কিতাব লিখেন। তাঁর কোন কিতাবই তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশ পায়নি। তিনি কিতাব লিখেছেন এবং এমন জায়গায় গোপন করেছেন, তিনি ছাড়া আর কেউ তা জানে না।

আর যখন তাঁর মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসল, তাঁর একজন বিশ্বস্ত লোককে ডেকে বললেন, অমুক জায়গায় যে কিতাবগুলো আমি দেখছি এগুলো সবই আমার লিখিত কিতাব। আমি এগুলোকে প্রকাশ করিনি, কারণ আমি নিজেকে খালেস নিয়তকারী হিসেবে পাইনি। আমি যখন মৃত্যুর মুখোমুখি হই এবং মৃত্যু যন্ত্রণায় পতিত হই, তুমি তোমার হাতকে আমার হাতের উপর রাখবে, যদি আমি এ অবস্থায় মারা যাই তাহলে মনে রাখবে আমার কোন লেখাই আল্লাহর দরবারে কবুল হয় নাই। তখন তুমি আমার সমস্ত লেখনী নিয়ে রাতের অন্ধকারে দিজলা নদীতে নিক্ষেপ করবে।
আর যদি আমি আমার হাতকে প্রশস্ত করি এবং এ অবস্থায় মারা না যাই তাহলে, তুমি মনে করবে আমার লিখনি আল্লাহর দরবারে কবুল হয়েছে এবং আমি আল্লাহর নিকট থেকে যা আশা করেছি, তাতে আমি কামিয়াব হয়েছি।

লোকটি বলল, যখন তাঁর মৃত্যু উপস্থিত হল, আমি আমার হাতকে তাঁর হাতের উপর রাখি, তখন তিনি তাঁর হাতকে প্রশস্ত করলেন এবং আমার হাতে তাঁর মৃত্যু হয়নি। তাতে আমি জানতে পারলাম যে এ ছিল কবুল হওয়ার আলামত। তারপর আমি তাঁর কিতাবসমূহকে প্রকাশ করলাম।( )

হযরত আলী যয়নুল আবেদীন বিন ইমাম হুসাইন রহমাতুল্লাহি আলাইহিমার রাতে দান করা:
كان علي بن الحسن يحمل الخبز بالليل على ظهره يتبع به المساكين بالظلمة، فالصدقة تطفيء غضب الرب، وكان أهل بالمدينة يعيشون لا يدرون من أين معاشهم، فلما مات عرفوا، و رأوا على ظهره آثاراً مما كان ينقله من القرب والجرب بالليل فكان يعول مائة بيت .
হযরত ইমাম জয়নুল আবেদ্বীন আলী বিন ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহুমা রাতের বেলা তাঁর পিঠের উপর রুটির বস্তা বহন করে মিসকিনদের খুঁজে বেড়াতেন। তিনি বলতেন, রাতের অন্ধকারে সদকা করা আল্লাহর ক্ষোভকে নিবিয়ে দেয়। মদিনাতে কিছু লোক ছিল, তাদের খাবার রাতের বেলায় পৌঁছে যেত; তারা জানত না যে তাদের খাওয়ার কোথা হতে আসত। যখন হযরত ইমাম যয়নুল আবেদ্বীন আলী বিন হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহুমা ইন্তিকাল করলেন তখন তারা তাদের রাতের বেলায় যে খাওয়ার পৌঁছানো হত তা আর পেতো না। তাঁর ইন্তিকালের পর তারা তাঁর পিঠে রাতের বেলা আটা ও রুটির বস্তা বহন করার দাগ দেখতে পেল। তিনি দৈনিক একশটি পরিবারের নিকট খাদ্য পৌঁছাতেন।( )

এ ধরনের অবস্থা ও ঘটনাবলী যেগুলো তাঁরা গোপন রাখতে চাইতেন, আল্লাহ তা‘আলা তা প্রকাশ করে দিতেন, যাতে তাঁরা উম্মতের অনুকরণ যোগ্য ও ইমাম হয়ে থাকেন।

ইখলাস অর্জনের উপায়সমূহ
ইখলাস অর্জনের কিছু পদ্ধতি আছে যার প্রধান কয়েকটি পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করা হল:-
১-যথাযথভাবে আল্লাহর পরিচয়
আমাদের বিশ্বাস রাখতে হবে যে, আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ, তিনি মহান, তিনি ধনী, কারো মুখাপেক্ষী নন, সর্ববিষয় তার ক্ষমতাধীন, তিনি সকল বিষয়ে সর্বশক্তিমান। মানুষ যা করে, অন্তর দিয়ে যা কল্পনা করে, সবই তার জানা। সকল ধরনের লাভ ও ক্ষতি; কল্যাণ ও অকল্যাণ তারই হাতে। তার কোন অংশীদার নেই। তিনি যা ইচ্ছে করেন তা-ই হয়, তার ইচ্ছার বাইরে কোন কিছুই হতে পারেনা।

সাথে সাথে বান্দাহ মনে প্রাণে ইয়াকিনের সাথে বিশ্বাস করবে যে সে শুধু আল্লাহর বান্দা, আর বান্দা খিদমতের বিনিময়ে মুনিবের কাছে কিছু প্রত্যাশা করতে পারে না। যেহেতু সে বান্দা হিসেবে মুনিবের খিদমত করবে। অতএব মুনিবের কাছে যে প্রতিদান ও সাওয়াব পায় তা শুধু তার অনুগ্রহ, দয়া ও ইহসান। কোন কিছুর বিনিময় বা প্রতিদান নয়।

পাশাপাশি বান্দাহর উপর আল্লাহর অনুগ্রহ, দয়া ও তাওফিক সর্বদা লক্ষ্য করা, একথা ভাবা যে এ সব কিছু মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে, তার নিজের থেকে কিছুই হয়নি। আল্লাহর ইচ্ছায়ই তার আমল করতে হবে, নিজের ইচ্ছায় নয়। সব কল্যাণ একমাত্র আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়ায়।

এ ধরনের ভাবনা মানুষকে আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ বা মুখলিস হতে সাহায্য করে।

২- ইখলাস শিক্ষা ও অনুশীলন
ইখলাস কী, কেন ও কীভাবে অর্জন সম্ভব-এ বিষয়টি ভালভাবে রপ্ত করতে হবে। হযরত ইয়াহইয়া ইবনে কাসীর রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন: তোমরা নিয়্যত শিক্ষা কর, কারণ এটা আমলের চেয়ে বেশী গুরূত্বপূর্ণ। ( )

ইমাম আল-মাকদাসী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন: যে নিয়্যতের স্বরূপ জানে না সে কি করে নিয়্যতকে বিশুদ্ধ করবে। যে নিয়্যত বিশুদ্ধ করল, কিন্তু ইখলাস সম্পর্কে জানলো না সে কি করে ইখলাস অবলম্বন করবে। কাজেই প্রথম কাজ হল নিয়্যতকে শুদ্ধ করা তারপর ইখলাস অবলম্বন করা। ( )

৩- ইখলাসের সওয়াব ও পুরস্কার স্মরণ করা:
ইখলাসের তাৎপর্য ও তার প্রতিদানের কথা স্মরণ করা। মনে রাখা, ইখলাস হল আমল কবুলের শর্ত। জান্নাতে প্রবেশের রাস্তা। আর শয়তানের কুমন্ত্রণা ও ধোঁকা থেকে বাঁচার একটা মজবুত কেল্লা।

যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এরশাদ করেন,
قَالَ رَبِّ بِمَا أَغْوَيْتَنِي لَأُزَيِّنَنَّ لَهُمْ فِي الْأَرْضِ وَلَأُغْوِيَنَّهُمْ أَجْمَعِينَ. إِلَّا عِبَادَكَ مِنْهُمُ الْمُخْلَصِينَ
“শয়তান বলল, হে আমার প্রতিপালক! আপনি যে আমাকে বিপথগামী করলেন সে জন্য আমি পৃথিবীতে মানুষের নিকট পাপকর্মকে অবশ্যই শোভনীয় করে দেব এবং আমি তাদের সকলকে বিপথগামী করব, তবে তাদের নয়, যারা আপনার ইখলাস অবলম্বনকারী (একনিষ্ঠ ) বান্দা। (সূরা আল-হিজর: ৩৯-৪০)

আল্লাহ তা’আলা আরো এরশাদ করেন,
إِنَّكُمْ لَذَائِقُو الْعَذَابِ الْأَلِيمِ . وَمَا تُجْزَوْنَ إِلَّا مَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ . إِلَّا عِبَادَ اللَّهِ الْمُخْلَصِينَ . أُولَئِكَ لَهُمْ رِزْقٌ مَعْلُومٌ . فَوَاكِهُ وَهُمْ مُكْرَمُونَ . فِي جَنَّاتِ النَّعِيمِ . عَلَى سُرُرٍ مُتَقَابِلِينَ .
“তোমরা অবশ্যই মর্মšুÍদ শাস্তির স্বাদ গ্রহণ করবে এবং তোমরা যা করবে তারই প্রতিফল পাবে। তবে তারা নয় যারা আল্লাহর একনিষ্ঠ (মুখলিস) বান্দা। তাদের জন্য আছে নির্ধারিত রিযক-ফলমূল; আর তারা হবে সম্মানিত, সুখময় কাননে তারা মুখোমুখি হয়ে আসীন হবে। (সূরা আস-সাফফাত: ৩৮-৪৪)

যে ব্যক্তি কোন নেক আমল দ্বারা শুধু পার্থিব স্বার্থ অর্জন করার নিয়্যত করবে তাকে পার্থিব সে স্বার্থ দেয়া হবে পূর্ণভাবে। কিন্তু আখেরাতে থাকবে তার জন্য শাস্তি। কারণ তার নিয়্যত ও পুরো চিন্তাভাবনা ছিল দুনিয়াকে ঘিরে। আল্লাহ তো তার বান্দাদের অন্তরের নিয়্যত অনুযায়ী প্রতিদান দিবেন।

যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এরশাদ করেন,
مَنْ كَانَ يُرِيدُ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَزِينَتَهَا نُوَفِّ إِلَيْهِمْ أَعْمَالَهُمْ فِيهَا وَهُمْ فِيهَا لَا يُبْخَسُونَ . أُولَئِكَ الَّذِينَ لَيْسَ لَهُمْ فِي الْآَخِرَةِ إِلَّا النَّارُ وَحَبِطَ مَا صَنَعُوا فِيهَا وَبَاطِلٌ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ .
“যে পার্থিব জীবন ও তার শোভা কামনা করে, দুনিয়াতে আমি তাদের কর্মের পূর্ণ ফল দান করি এবং সেথায় তাদেরকে কম দেয়া হবে না। তাদের জন্য আখেরাতে আগুন ব্যতীত অন্য কিছুই নেই। আর তারা যা করে আখেরাতে তা নিষ্ফল হবে এবং তারা যা করে থাকে তা নিরর্থক। (সূরা হুদ: ১৫-১৬)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন,
عن ابن عباس –رضي الله عنهما- قال: قال النبي-صلى الله عليه وسلم-:” مَنْ سَمّعَ سَمَّعَ اللهُ بِهِ، وَمَنْ يُرَائِي يُرَائِي اللهُ بِهِ”
“যে মানুষকে শোনানোর জন্য কাজ করল আল্লাহ তা মানুষকে শুনিয়ে দেবেন। আর যে মানুষকে দেখানোর জন্য কাজ করল আল্লাহ তা মানুষকে দেখিয়ে দেবেন।( )

৪- আত্ম-জিজ্ঞাসা ও অধ্যবসায় করা
যে কোন কাজ শুরু করার পূর্বে নিজেকে জিজ্ঞাসা করতে হবে এ কাজ দ্বারা আমার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী? উত্তর যদি নিজের কাছে সঠিক ও শুদ্ধ মনে হয়, তবে কাজ শুরু করা যায়। আর উত্তর যদি নিজের কাছে সঠিক ও শুদ্ধ মনে না হয় তাহলে নিয়্যত ঠিক করে নিতে হবে কাজটি শুরু করার পূর্বে।
আমাদের পূর্ববর্তী ইমামগণ এমনিভাবে কাজের পূর্বে মুরাকাবা বা আত্ম-জিজ্ঞাসা করে নিতেন।

হযরত হাসান রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, কোন ব্যক্তি যদি একটি সদ্কা করার নিয়্যত করত তখন নিজেকে প্রশ্ন করে নিত। যদি দেখত যে তার সদকাটা আল্লাহর জন্যই করা হচ্ছে তখন সে অগ্রসর হত। আর যদি দেখত তার নিয়্যতে কোন সন্দেহ আছে তাহলে সে বিরত থাকত। ( )

হযরত সালমান রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলতেন, প্রত্যেক কাজের শুরুতে তোমার প্রতিপালককে স্মরণ করবে যখন তুমি সংকল্প কর ও প্রত্যেক বিচারে তাকে স্মরণ করবে তখন তুমি রায় দেবে।

এর অর্থ এ নয় যে নিয়্যত খারাপ দেখলে কাজটি পরিত্যাগ করব বরং নিয়্যতকে বিশুদ্ধ করে কাজটি শুরু করব। এটা হল সঠিক নিয়্যতের অনুশীলন।

৫- আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা
মানুষ আল্লাহর কাছে বেশী করে ধর্ণা দিয়ে তাঁর কাছে বেশী করে দুআ-প্রার্থনা করে ইখলাস অবলম্বনের তাওফীক কামনা করবে। এ জন্য তো আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দৈনিক পাঁচ বার সালাতের মাধ্যমে আমাদের বলতে শিখিয়েছেন, إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ “আমরা তোমারই ইবাদত করি আর তোমারই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি।”
অর্থাৎ একমাত্র উপাসনার মালিক তিনি, অন্য কেহ নয় এবং প্রকৃত সাহায্যের হাক¦ীক্বী মালিক তিনিই, অন্যরা হল রূপক অর্থে। তার সাহায্য ছাড়া কেউ ভাল কাজ করতে পারে না এবং তার সাহায্য ছাড়া কেউ খারাপ কাজ থেকে ফিরে থাকতে পারে না।

হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম আল্লাহ তাআলার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করে বলেন, وَاجْنُبْنِي وَبَنِيَّ أَنْ نَعْبُدَ الْأَصْنَامَ “আমাকে ও আমার সন্তানদেরকে প্রতিমা পুজা থেকে দূরে রেখ। (সূরা ইবরাহীম: ৩৫)

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করার শিক্ষা দিয়েছেন বহু হাদীসে। যেমন:-
عَنْ أَبِي عَلِيٍّ رَجُلٍ مِنْ بَنِي كَاهِلٍ، قَالَ: خَطَبَنَا أَبُو مُوسَى الْأَشْعَرِيُّ، فَقَالَ: خَطَبَنَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذَاتَ يَوْمٍ فَقَالَ: ” أَيُّهَا النَّاسُ , اتَّقُوا الشِّرْكَ، فَإِنَّهُ أَخْفَى مِنْ دَبِيبِ النَّمْلِ” فَقَالَ لَهُ مَنْ شَاءَ أَنْ يَقُولَ: وَكَيْفَ نَتَّقِيهِ وَهُوَ أَخْفَى مِنْ دَبِيبِ النَّمْلِ يَا رَسُولَ اللَّهِ؟، قَالَ قُولُوا: ” اللَّهُمَّ إِنَّا نَعُوذُ بِكَ أَنْ نُشْرِكَ بِكَ شَيْئًا نَعْلَمُهُ وَنَسْتَغْفِرُكَ لِمَا لَا نَعْلَمُ ”
“সাহাবী হযরত আবু মূসা আল-আশআরী রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। তিনি এরশাদ করলেন: হে মানব সকল! তোমরা শিরক থেকে নিজেদের রক্ষা কর। কেননা তা অনুভবে পিঁপড়ার চলার শব্দের চেয়েও সুক্ষ¥। একজন ব্যক্তি আরয করলো, হে আল্লাহর রাসূল! যা পিঁপড়ার চলার শব্দের চেয়েও হাল্কা-আমরা অনুভব করতে পারি না-তা থেকে কিভাবে বেঁচে থাকব? তিনি বললেন: তোমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে, হে আল্লাহ! আমরা এমন শিরক থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাচ্ছি যা আমরা জানি এবং এমন শিরক থেকেও তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি, যা আমরা জানি না। ( )

তাই শিরক থেকে বেঁচে থাকতে এবং ইখলাসের উপর কায়েম থাকতে সর্বদা আল্লাহর কাছে সাহায্য ও সামর্থ প্রার্থনা করা উচিত।

৬- অধিকহারে ইবাদত-বন্দেগীতে আত্মনিয়োগ করা
মানুষের কাছে শয়তানের প্রত্যাশা করে যেন মানুষ সর্বতোভাবে আল্লাহর আনুগত্য পরিত্যাগ করে। কিন্তু শয়তান যখন জানতে পারে যে, বান্দা তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে, তার আনুগত্য বর্জন করছে; এবং যখনি সে বান্দাকে কুমন্ত্রণা দিচ্ছে তখন তার ইবাদত-বন্দেগী ও ইখলাস আরও বেড়ে যাচ্ছে, তখন সে ক্ষান্ত হয়, কারণ বান্দার এ অটলতাই তার জন্য প্রভূত কল্যাণের কারণ হবে সন্দেহ নেই।

হযরত হাসান বসরী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, শয়তান তোমার দিকে দৃষ্টি দিয়ে যখন দেখে যে তুমি সর্বদা আল্লাহর আনুগত্যে অটল, তখন সে তোমাকে প্রত্যাখ্যান করে চলে যায়। আর যখন দেখে তুমি কখনো আনুগত্য করছো, আবার কখনো ছেড়ে দিচ্ছ তখন সে তোমার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠে। ( )

৭-আত্মতৃপ্তি পরিহার করা
আমি খুব ভাল মানুষ, বা আমি অনেক লোকের চেয়ে সৎকর্ম বেশী করি- এ ধরণের অনুভূতি লালন করার নাম হল আত্মতৃপ্তি। এটা একটি খারাপ আচরণ। শয়তান এ পথ দিয়ে মানুষকে প্রতারিত করে থাকে, ঢুকে পড়ে তার অন্তকরণে সন্তর্পণে।
যে আত্মতৃপ্তিতে ভোগে, সে ধারনা পোষণ করে যে, সে আল্লাহর প্রতি অনুগ্রহ করছে। যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আত্মতৃপ্তিতে পতিত হওয়া কতিপয় মানুষের কথা বলেছেন এভাবে,
يَمُنُّونَ عَلَيْكَ أَنْ أَسْلَمُوا قُلْ لَا تَمُنُّوا عَلَيَّ إِسْلَامَكُمْ بَلِ اللَّهُ يَمُنُّ عَلَيْكُمْ أَنْ هَدَاكُمْ لِلْإِيمَانِ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ .
তারা ইসলাম গ্রহণ করে আপনাকে ধন্য করেছে বলে মনে করে। বলুন, তোমাদের ইসলাম গ্রহণ আমাকে ধন্য করেছে বলে মনে করো না, বরং আল্লাহ ঈমানের দিকে পরিচালিত করে তোমাদেরকে ধন্য করেছেন, যদি তোমরা সত্যবাদী হও। (সূরা হুজুরাত: ১৭)

ইমাম নববী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ইখলাস অবলম্বনে যতগুলো বাধা আছে তার মধ্যে আত্মতৃপ্তি হল অন্যতম। আত্মতৃপ্তি যাকে পেয়ে বসবে তার আমল নিষ্ফল হয়ে যাবে। এমনিভাবে যে অহংকার করবে তার আমল নিষ্ফলতায় পর্যবসিত হবে। ( )

মানুষের সমালোচনা ও প্রশংসার প্রতি লক্ষ্য রেখে প্রকৃত মুখলিস বান্দা ইবাদত-বন্দেগী করতে পারে না। কেননা সে মানুষের ভাল-মন্দ কথার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করেনা। কারণ সে জানে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন,
عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ كُنْتُ خَلْفَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمًا فَقَالَ: ৃوَاعْلَمْ أَنَّ الْأُمَّةَ لَوْ اجْتَمَعَتْ عَلَى أَنْ يَنْفَعُوكَ بِشَيْءٍ لَمْ يَنْفَعُوكَ إِلَّا بِشَيْءٍ قَدْ كَتَبَهُ اللَّهُ لَكَ وَلَوْ اجْتَمَعُوا عَلَى أَنْ يَضُرُّوكَ بِشَيْءٍ لَمْ يَضُرُّوكَ إِلَّا بِشَيْءٍ قَدْ كَتَبَهُ اللَّهُ عَلَيْكَ رُفِعَتْ الْأَقْلَامُ وَجَفَّتْ الصُّحُفُ
“…জেনে রাখ! পুরো জাতি যদি তোমাকে উপকার করতে একত্র হয় তবুও তোমার কোন উপকার করতে পারবে না, তবে আল্লাহ তোমার জন্য যা লিখে রেখেছেন (তা অবশ্যই ঘটবে)। এমনিভাবে, পুরো জাতি যদি তোমার ক্ষতি করার জন্য একত্র হয় তবুও তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তবে আল্লাহ যা তোমার বিপক্ষে লিখে রেখেছেন (তা নিশ্চয় ঘটবে)। কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছে আর খাতা শুকিয়ে গেছে। ( )

৮- সৎ ও মুখলিস লোকদের সঙ্গ অবলম্বন
মানুষ যার সাথে উঠা-বসা ও চলাফেরা করে তার দ্বারা প্রভাবিত হয়। যদি কেউ মুখলিস লোকদের সঙ্গ অবলম্বন করে তবে তার মধ্যে ইখলাসের ধারনা প্রবল হবে। আর যদি কোন ব্যক্তি লোক দেখানো ভাবনাধারী বা লোক শুনানো ধারণার বাহকের সাথে চলাফেরা করে তবে তার চিন্তা-ধারণা তার সঙ্গীর মতই হবে। এটা সকলের কাছে বোধগম্য। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন,
عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا , قَالَتْ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: الْمَرْءُ عَلَى دِينِ خَلِيلِهِ فَلْيَنْظُرْ أَحَدُكُمْ مَنْ يُخَالِلْ
“মানুষ তার সঙ্গী-সাথীর দৃষ্টিভংগি গ্রহণ করে। তাই তোমরা খেয়াল করে দেখবে কার সাথে চলাফেরা করছ। ( )

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো এরশাদ করেন,
الصحابي الجليل أبو موسى الأشعري رضي الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: إِنَّمَا مَثَلُ الجَلِيسِ الصَّالحِ والجَلِيسِ السّوءِ كَحَامِلِ الْمِسْكِ وَنَافِخِ الْكِير، فَحَامِلُ الْمِسْكِ إمَّا أنْ يُحْذِيَكَ وَإِمَّا أنْ تَبْتَاعَ مِنْهُ وَإِمَّا أَنْ تَجِدَ مِنْهُ رِيحًا طَيِّبَةً، وَنَافِخُ الكِيرِ إِمَّا أَنْ يُحْرِقَ ثِيَابَكَ وَإِمَّا أَنْ تَجِدَ رِيحًا خَبِيثَةً
“সৎসঙ্গ অবলম্বনকারী ও অসৎসঙ্গ গ্রহণকারীদের দৃষ্টান্ত হল যথাক্রমে সুগন্ধি বিক্রেতা ও কামারের মত। সুগন্ধি বিক্রেতা হয়ত তোমাকে কিছু সুগন্ধি দেবে অথবা তুমি তার থেকে সুগন্ধি কিনবে। যদি কোনটিই না হয়, তবে কমপক্ষে তার থেকে সুঘ্রাণ এমনিতেই পাবে। আর কামারের ব্যাপারটা হল, হয়ত তার আগুনের ফুলকিতে তোমার কাপড় পুরে যাবে অথবা তার হাপরের দুর্গন্ধ তোমাকে পেয়ে বসবে। ( )
তাই যিনি ইখলাস অবলম্বন করতে চান তাকে অবশ্যই সৎ-সঙ্গ নির্বাচন করতে হবে।

৯- মুখলিস ও সৎ-কর্মপরায়ণদের আদর্শ রূপে গ্রহণ করা
ইখলাসের মূর্তপ্রতিক নবী-রাসূল আলাইহিমুস সালাম, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন ও ইমামগণকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করলে ইখলাস অবলম্বনে সহায়ক হবে। প্রতিটি কাজে তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করা উচিত। যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এরশাদ করেন,
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآَخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيرًا
“তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখেরাতকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্বরণ করে, তাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। (সূরা আহযাব: ২১)

আল্লাহ আরো এরশাদ করেন, أُولَئِكَ الَّذِينَ هَدَى اللَّهُ فَبِهُدَاهُمُ اقْتَدِهِ “তাদেরকে আল্লাহ সৎপথে পরিচালিত করেছেন। সুতরাং আপনিও তাদের পথের অনুসরণ করুন। (সূরা আল-আনআম: ৯০)

আল্লাহ আরো এরশাদ করেন, قَدْ كَانَتْ لَكُمْ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ فِي إِبْرَاهِيمَ وَالَّذِينَ مَعَهُ “তোমাদের জন্য ইবরাহীম ও তার অনুসারীদের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। (সূরা আল-মুমতাহিনা: ৯)

এমনিভাবে সৎকর্মপরায়ণদের অনুসরণ করার ব্যাপারে হাদীসেও নির্দেশ এসেছে:
فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيينَ، عَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ،
“তোমরা আমার সুন্নাহ ও খোলাফায়ে রাশেদার আদর্শ দৃঢ়ভাবে আকরে ধরবে।( )

এ জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবাদের সীরাত বা জীবনী অধ্যয়ন করা প্রয়োজন। তাঁদের সীরাত অধ্যয়ন ব্যতীত তাঁদের আদর্শ জানা যাবেনা।

১০- ইখলাসকে জীবনের একটি লক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করা
ইখলাস অবলম্বন করতে আগ্রহী মানুষের সংখ্যা অনেক। কিন্তু সত্যিকার মুখলিসদের সংখ্যা খুবই কম। এর কারণ ইখলাস অবলম্বনে প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্বেও তারা ইখলাসকে জীবনের একটি লক্ষ্য হিসেবে নিতে পারেনি। একে একটি লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করলে এর অনুশীলনের প্রশ্ন আসে, মুহাসাবা বা আত্মসমালোচনার বিষয় আসে। এ ভাবনাগুলো ইখলাস অবলম্বন করতে সহায়তা করে। যদি কেউ এটাকে অতিরিক্তি সওয়াবের বিষয় বা নফল কাজ হিসেবে মুল্যায়ন করে, তাবে সে হয়ত কখনো ইখলাস অবলম্বনে সফল হতে পারবে না।

১১- ব্যক্তি নিজের দোষত্রুটি, কমতি, নফসের ও শয়তানের অংশিদারিত্ব সর্বদা স্মরণ করা
কেননা অনেক আমলেই কম বেশি নফসের ও শয়তানের অংশ থাকে।
عَنْ عَائِشَةَ، رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ: سَأَلْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنِ الْتِفَاتِ الرَّجُلِ فِي الصَّلَاةِ؟ فَقَالَ: ্রإِنَّمَا هُوَ اخْتِلَاسٌ يَخْتَلِسُهُ الشَّيْطَانُ مِنْ صَلَاةِ الْعَبْدِগ্ধ
হযরত আয়েশা রাদি¦য়াল্লাহু ‘আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সালাতের মধ্যে (ঘাড় ফিরিয়ে) এদিক ওদিক তাকানোর ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করি। জবাবে তিনি বলেন, “এটা শয়তানের ছোঁ মারা, সে মানুষের সালাত হতে কিছু অংশ ছো মেরে নিয়ে যায়”।( )

সামান্য এদিক ওদিক তাকালে যদি এমন সতর্ক করা হয় তাহলে আল্লাহ ছাড়া অন্য দিকে অন্তর ফিরালে কি অবস্থা হবে? ( )

১২- নাফসের ধোঁকা থেকে মুক্ত থাকার সর্বদা চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া
কেননা ইখলাস ও মানুষের প্রশংসা, লোভ লালসা ইত্যাদি অন্তরে একত্রিত হতে পারে না, যেমনিভাবে পানি ও আগুন একত্রিত হতে পারে না।
তাই ইখলাস চাইলে লোভ লালসাকে দমন করতে হবে, মানুষের প্রশংসা ও সুনাম সুখ্যাতির কামনা বাসনা ত্যাগ করতে হবে এবং দুনিয়ার মায়া মমতা ত্যাগ করে আখিরাতের ভালবাসা মনে লালন করতে হবে, তাহলে ইখলাস অর্জন সহজ হবে। আর লোভ লালসা ধ্বংসের জন্য এটা জানাই যথেষ্ট যে, দুনিয়াতে লোভনীয় যা কিছুই আছে তা আল্লাহর হাতেই রয়েছে, তিনি যাকে ইচ্ছা তাকেই দান করেন।

১৩- অধ্যবসায়ী ও আত্মসংযমী হওয়া
আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন,
وَٱلَّذِينَ جَٰهَدُواْ فِينَا لَنَهۡدِيَنَّهُمۡ سُبُلَنَاۚ وَإِنَّ ٱللَّهَ لَمَعَ ٱلۡمُحۡسِنِينَ
“আর যারা আমার পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়, তাদেরকে আমি অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করব। আর নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সাথেই আছেন”। [সূরা আল্-আনকাবূত: ৬৯]

অতএব, রিয়ার ভয়াবহতা ত্যাগ করতে হলে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। ধাপে ধাপে রিয়া ত্যাগ করে যখন নিম্নোক্ত স্তরে পৌঁছবে তখন আল্লাহর আনুগত্য করতে নাফস প্রশান্তি পাবে।
إِنَّ عِبَادِي لَيۡسَ لَكَ عَلَيۡهِمۡ سُلۡطَٰنٌ إِلَّا مَنِ ٱتَّبَعَكَ مِنَ ٱلۡغَاوِينَ
“নিশ্চয় আমার বান্দাদের উপর তোমার (শয়তানের) কোন ক্ষমতা নেই, তবে পথভ্রষ্টরা ছাড়া যারা তোমাকে অনুসরণ করেছে”। [সূরা আল-হিজর: ৪২]

১৪- রিয়ার কাফফারা থেকে বেঁচে থাকার জন্য দু‘আ করা
হাদীসে এসেছে,
أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا هَذَا الشِّرْكَ؛ فَإِنَّهُ أَخْفَى مِنْ دَبِيبِ النَّمْلِ “. فَقَالَ لَهُ: مَنْ شَاءَ اللهُ أَنْ يَقُولَ وَكَيْفَ نَتَّقِيهِ، وَهُوَ أَخْفَى مِنْ دَبِيبِ النَّمْلِ يَا رَسُولَ اللهِ؟ قَالَ: قُولُوا: ” اللهُمَّ إِنَّا نَعُوذُ بِكَ مِنْ أَنْ نُشْرِكَ بِكَ شَيْئًا نَعْلَمُهُ، وَنَسْتَغْفِرُكَ لِمَا لَا نَعْلَمُ”
রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,, “হে লোক সকল, তোমরা এ খফি শির্ক (রিয়া) থেকে বেঁচে থাকো, কেননা এটা পিপীলিকা চলার চেয়েও সূক্ষ¥। সাহাবীগণ আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা এর থেকে কিভাবে বেঁচে থাকব? তিনি এরশাদ করেন, তোমরা বল, হে আল্লাহ আমরা জানা শির্ক থেকে পানাহ চাই এবং অজানা শির্ক থেকেও ক্ষমা প্রার্থনা করছি”।( )

এ ছাড়াও নিন্মোক্ত আমলসমূহ ইখলাস অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে। যেমন,
* অন্তরের সংশোধন ও ইখলাসের জন্য আল্লাহ যেসব আদেশ দিয়েছেন সেগুলো স্মরণ করা। লোক দেখানো ব্যক্তিরা আল্লাহর তাওফিক থেকে বঞ্চিত হয়।
* আল্লাহর ক্রোধ ও আযাবের ভয় যখন বান্দাহর অন্তরে থাকবে তখন সে রিয়া থেকে বিরত থাকবে।
* গোপনে বেশি বেশি আল্লাহর ইবাদত বন্দেগী করা, যেমন: তাহাজ্জুদের সালাত, গোপনে দান সদকা করা ও আল্লাহর ভয়ে নির্জনে কাঁদা।
* আল্লাহর বড়ত্ব ও মহত্ব মনে বাস্তবায়ন করা। আসমাউল হুসনা (আল্লাহর সুন্দর নামসমূহ) ও আল্লাহর সিফাত যেমন: ‘আলীউল ‘আযীম, ‘আলীম, রাযযাক, খালিক ইত্যাদি নামসমূহের দ্বারা আল্লাহর তাওহীদ ও ‘উবুদিয়াত বাস্তবায়ন করা।
* সর্বদা একথা মনে রাখা যে, সে মহান আল্লাহর শুধুমাত্র একজন অক্ষম বান্দা।
* আল্লাহর সুন্দর জাতী ও গুণবাচক নামসমূহ জানা ও আল্লাহকে যথাযথ সম্মান করা।
* মৃত্যু ও এর ভয়াবহতা স্মরণ করা।
* রিয়ামুক্ত ভাল মানুষের অনুসরণের মাধ্যমে রিয়াকে ত্যাগ করা।
* রিয়ার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে জানা।
* দু‘আর মাধ্যমে আল্লাহর কাছে বেশি বেশি কাকুতি-মিনতি পেশ করা।
* গভীর চিন্তা ও গবেষণাসহ কুরআন তিলাওয়াত করা।
* ইবাদত প্রকাশ না করা।
* মানুষ কে কি বলে সে ব্যাপারে বেশি গুরুত্ব না দেওয়া।
* সব ধরণের নাফরমাণী থেকে বেঁচে থাকা ও সতর্ক থাকা।
* ওয়ায নসিহত, যিকরের মজলিস ও মুখলিস ব্যক্তিদের সাথে উঠা বসা ও চলা ফেরা করা।
* ব্যক্তির উপর আল্লাহর অপরিসীম নি‘আমতের কথা স্মরণ করা ও সেগুলোর শুকরিয়া আদায় করা। প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য সবসময়ই তা স্বীকার করা।
* ধারাবাহিকভাবে নিয়মিত ইবাদত বন্দেগী করা এবং একে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গ্রহণ করা।

মুখলিসদের আলামতসমূহ:

যারা ইখলাস অবলম্বন করেন, তাদের বলা হয় মুখলিস। তাদের কিছু গুণাবলি রয়েছে যা দেখে বুঝা যাবে যে তারা ইখলাসের গুণে সমৃদ্ধ। তারা প্রসিদ্ধি লাভ, প্রশংসা কুড়ানো ও গুণাগুণ করাকে পছন্দ করেন না, তারা দ্বীনের জন্য আমল করতে পছন্দ করেন। তারা নেক আমলের প্রতি প্রতিযোগিতা করেন, আমলের বিনিময় আল্লাহর কাছে চান, তারা ধৈর্য ধারণ করেন, কোন প্রকার অভিযোগ করতে তারা পছন্দ করেন না। তারা তাদের আমলকে গোপন করতে পছন্দ করেন, তারা গোপনে আমল করেন এবং তাদের অধিকাংশ আমল হয়ে থাকে লোক চক্ষুর আড়ালে। তাদের গোপন আমলের সংখ্যা অধিক হয়ে থাকে প্রকাশ্য আমল থেকে।

এ সকল গুণাবলির মধ্যে প্রধান প্রধান কয়েকটি আলোচনা করা হল:-

১-আল্লাহর সন্তুষ্টিই তাঁদের একান্ত কাম্য
ইখলাসের উঁচু স্থানে অবস্থান করেন যাঁরা, তাঁদের অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে যাবতীয় কাজে-কর্মে তাঁরা একমাত্র আল্লাহকেই উদ্দেশ্য করেন; খ্যাতি, প্রশংসা, কিংবা নশ্বর পার্থিব সম্পদের কিছুই তাঁদের উদ্দেশ্য নয়। তাঁদের এ অবস্থার কথা বহু আয়াত ও হাদীসে এসেছে:-
আল্লাহ তার প্রতি সমর্পিত বান্দাদের কথা উল্লেখ করে বলেন:-
وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ
আপনি নিজেকে ধৈর্য সহকারে রাখবেন তাদের সংসর্গে যারা সকাল ও সন্ধায় ডাকে তাদের প্রতিপালকে তাঁর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে। (সূরা আল-কাহাফ: ২৮)

অর্থাৎ তাঁরা তাঁদের দুআ ইবাদতের মাধ্যমে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি চায়, পার্থিব কোন স্বার্থ চায় না।

হাদীসে এসেছে-
عَنْ أَبِي مُوسَى رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، قَالَ: جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ الرَّجُلُ: يُقَاتِلُ لِلْمَغْنَمِ، وَالرَّجُلُ يُقَاتِلُ لِلذِّكْرِ، وَالرَّجُلُ يُقَاتِلُ لِيُرَى مَكَانُهُ، فَمَنْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ؟ قَالَ: ্রمَنْ قَاتَلَ لِتَكُونَ كَلِمَةُ اللَّهِ هِيَ العُلْيَا فَهُوَ فِي سَبِيلِ اللَّهِগ্ধ
সাহাবী হযরত আবু মুসা আশআরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে আরয করল, জনৈক ব্যক্তি জিহাদ করছে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ পাওয়ার জন্য, আরেক ব্যক্তি জিহাদ করছে লোকেরা তাকে স্মরণ করবে এ জন্য, অন্য এক ব্যক্তি জিহাদ করছে তার মর্যাদা বেড়ে যাবে সে জন্য। এর মধ্যে কে আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর বাণীকে সর্বশীর্ষে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে লড়াই করছে সে-ই আল্লাহর পথ জিহাদ করছে। ( )

মুখলিস ব্যক্তি তার সকল কাজের উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে আল্লাহর দ্বীনকে সর্বশীর্ষে প্রতিষ্ঠিত করা ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা।

২-তাঁরা গোপনে কাজ করা পছন্দ করেন
মুখলিস বান্দারা নিজেদের সৎকর্মগুলো গোপনে সম্পাদন করতে ভালবাসেন। এমনিভাবে তাঁরা অন্যের দোষ-ত্রুটি গোপন করতে পছন্দ করেন। আল্লাহ তাআলাও এ ধরনের লোকদের পছন্দ করেন।
যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন:-
فقد روى مسلم في صحيحه من حديث عامر بن سعد قال سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ: ্রإِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْعَبْدَ التَّقِيَّ الْغَنِيَّ الْخَفِيَّগ্ধ

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ভালবাসেন এমন বান্দাকে যে মুত্তাকী ও অন্তরের দিক থেকে ধনী এবং দানশীলতায় গোপনীয়তা রক্ষাকারী। ( )

ইমাম মাকদাসী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন: যারা ভাল ও নেক কাজ করেন তারা কখনো নিজেদের প্রচার ও সুখ্যাতি চান না। যে সকল কাজে সুখ্যাতি অর্জন করা যায় কখনো তার পিছনে ছুটেন না। কখনো যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে তা তাদের সামনে এসে লুটিয়ে পড়ে, তবে তারা ছুটে পালান। এক ধরনের বৈরাগ্য ও নিস্কৃয়তা তারা পছন্দ করেন।

যেমন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, একদিন তিনি তাঁর বাসস্থান হতে বের হলেন, অপেক্ষমান একটি দল তাঁকে অনুসরণ করে এগিয়ে যাচ্ছিল। তিনি তাদের দিকে মুখ করে বললেন, কী কারণে তোমরা আমার অনুসরণে লিপ্ত? আল্লাহর শপথ! যদি জানতে আমি গৃহে কি রেখে এসেছি, তবে তোমরা আমার অনুসরণ হতে বিরত থাকতে। ( )

হযরত সালমান ইবনে দীনার রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন: তুমি তোমার মন্দ বিষয় গোপন করার তুলনায় ভাল কাজগুলো বেশী গোপন করো।

হযরত বিশ্র আল-হাফী রহমাতুল্লাহি আলাইহি মন্তব্য করেন, খ্যাতি ও উত্তম খাদ্য বর্জন কর। এমন ব্যক্তি আখেরাতের আস্বাদ হতে বঞ্চিত হবে, পার্থিব জগতে যার একান্ত অভিলাষ ছিল মানুষের মাঝে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ুক।

ইমাম শাফেঈ রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন: আমার ভাল লাগে মানুষ আমার কাছ থেকে শিখবে, কিন্তু আমার নাম বলবে না। ( )

আমাদের পূর্ববর্তী সাহাবা ও ইমামগণ শুধু কথা বলে যাননি। তাঁরা নিজেদের ভাল কাজগুলো গোপন রাখার উজ্জল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
যেমন হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু মদীনার পল্লীর এক অন্ধ অসহায় বৃদ্ধা মহিলার সেবা করতেন প্রতি রাতে এসে। তার জন্য পানি বহন করতেন, খাদ্য তৈরী করে দিতেন, কাপড়-চোপড় পরিস্কার করতেন। একদিন তিনি দেখলেন তার আসার পূর্বে কেউ এসে তার কাজগুলো করে দিয়ে গেছে। পরের দিন তিনি আরো আগে আসলেন যাতে অন্য কেউ তার কাজ করার সুযোগ না নেয়। তিনি এসে দেখলেন, হযরত আবু বকর সিদ্দীক্ব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বৃদ্ধার কাজগুলো গুছিয়ে দিচ্ছেন। আবু বকর সিদ্দীক্বরাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তখন ছিলেন খলীফার দায়িত্বে। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাঁকে দেখে বললেন, হে তুমি! আমার জীবন তোমার জন্য কুরবান হোক। ( )

আরকেটি ঘটনা বর্ণিত আছে যে, একরাতে হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ঘর থেকে বের হলেন। হযরত তালহা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাঁকে অনুসরণ করে দেখতে পেলেন, হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু একটি গৃহে প্রবেশ করলেন। কিছুক্ষণ পর সেখান থেকে বের হয়ে আরেকটি গৃহে ঢুকলেন। তালহা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ঘর দুটো চিনে রাখলেন। যখন ভোর হল তখন তিনি ঐ ঘরে প্রবেশ করলেন, দেখলেন এক অন্ধ বৃদ্ধা বসে আছে। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা ঐ লোকটি যে গত রাতে তোমার কাছে এসেছিল সে কি কাজে এসেছিল? বৃদ্ধা বলল, লোকটি আমার সাথে ওয়াদা করেছে যে, সে প্রতি রাতে এসে আমার কাজ করে দেবে; খাবার তৈরী করবে, কাপড়-চোপড় ধুয়ে দেবে। ( )

হযরত ইমাম যাইনুল আবেদ্বীন বিন আলী ইবনুল হুসাইন রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তিনি মদীনার একশটি ঘরে খাদ্য দান করতেন। রাতে তিনি খাদ্য নিয়ে আসতেন এবং খাদ্যগুলো বিতরণ করে চলে যেতেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় ছিল, কেউ জানতো না যে কে খাদ্য দিয়ে গেছে। তিনি যখন ইন্তেকাল করলেন, তখন খাদ্য আসা বন্ধ হলে লোকজন বুঝতে পারল যে হযরত যইনুল আবেদ্বীন রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুই এ কাজ করে যাচ্ছিলেন। তাঁর গোসলের সময় দেখা গেল তাঁর পিঠে খাদ্যের বস্তা বহনের দাগ পড়ে গেছে। ( )

অবশ্য গোপনে আমল করার বিষয়টি নফল আমলের বেলায় প্রযোজ্য; ফরয বা ওয়াজিবের বেলায় নয়। ফরয ও ওয়াজিব প্রকাশ্যে আদায় করতে হয়।

৩- তাঁদের ভিতরের দিকটা বাহ্যিক দিকের চেয়ে ভাল থাকে
মুখলিস এমন হতে পারেন না যে, মানুষ যা দেখে, এমন কাজগুলো খুব ভাল করে আদায় করেন আর যা মানুষ দেখে না- শুধু আল্লাহ দেখেন সে সকল বিষয় যেনতেন করে আদায় করেন। তিনি যে কোন কাজ মুরাকাবার সাথে সম্পন্ন করবেন। মুরাকাবার সাথে সম্পন্ন করার অর্থ হল- সকল কাজে সর্বদা এ ভাবনা থাকা যে, আমি যা করছি আল্লাহ তা অবশ্যই দেখছেন।

হযরত ইবনে আতা রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন: সবচেয়ে উত্তম ইবাদত হল সব সময় আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের মুরাকাবা করা। ( ) যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন: وَالَّذِينَ يَبِيتُونَ لِرَبِّهِمْ سُجَّدًا وَقِيَامًا “এবং তারা রাত অতিবাহিত করে তাদের প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সাজ্দাবনত হয়ে ও দাঁড়িয়ে থেকে। (সূরা আল-ফুরকান: ৬৪)

যারা প্রকাশ্যে ভাল কাজ করে আর গোপনে পাপে জড়িয়ে পরে তারা কখনো মুখলিস হতে পারে না। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন:-
عَنْ ثَوْبَانَ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم أَنَّهُ قَالَ: لأَعْلَمَنَّ أَقْوَامًا مِنْ أُمَّتِي يَأْتُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِحَسَنَاتٍ أَمْثَالِ جِبَالِ تِهَامَةَ بِيضًا فَيَجْعَلُهَا اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ هَبَاءً مَنْثُورًا قَالَ ثَوْبَانُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ صِفْهُمْ لَنَا، جَلِّهِمْ لَنَا أَنْ لاَ نَكُونَ مِنْهُمْ وَنَحْنُ لاَ نَعْلَمُ، قَالَ: أَمَا إِنَّهُمْ إِخْوَانُكُمْ وَمِنْ جِلْدَتِكُمْ وَيَأْخُذُونَ مِنَ اللَّيْلِ كَمَا تَأْخُذُونَ وَلَكِنَّهُمْ أَقْوَامٌ إِذَا خَلَوْا بِمَحَارِمِ اللَّهِ انْتَهَكُوهَا
“আমার উম্মতের মধ্যে অনেকের কথা আমি জানি যারা কিয়ামতের দিন তিহামা অঞ্চলের সাদা পর্বতমালা পরিমাণ সৎকর্ম নিয়ে উপস্থিত হবে, কিন্তু আল্লাহ তাদের সৎ কর্মগুলো বিক্ষিপ্ত ধুলিকণায় পরিণত করে দিবেন। এ কথা শুনে সাওবান রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু আরয করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! তাদের পরিচয় দিন, আমরা যেন নিজেদের অজান্তে তাদের অন্তর্ভূক্ত না হয়ে যাই। তিনি বললেন: তারা তোমাদেরই ভাই, তোমাদের সাথেই থাকে। তোমরা যেমন রাত জেগে ইবাদত কর, তারাও করে। কিন্তু যখন একাকী হয় তখন আল্লাহর সীমা লংঘন করে (পাপে লিপ্ত হয়) ( )

এ জাতীয় মানুষ কখনো মুখলিস হতে পারে না; সমাজে ভাল মানুষ হিসেবে পরিচিত, কিন্তু ব্যক্তিজীবন তাদের পাপে কলুষিত। কিভাবে তারা মুখলিস হবে? যদি তারা সর্বাবস্থায় ও সকল কাজে আল্লাহর সন্তুষ্টির কথা চিন্তা করত তাহলে কি করে লোকচক্ষুর অন্তরালে পাপে লিপ্ত হয়?

৪- তাঁরা তাঁদের সৎকর্ম প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয় করে
মুখলিস ব্যক্তি যত বেশী ইবাদত-বন্দেগী ও নেক আমল করেন না কেন তাঁরা সর্বদা এ ভয় রাখেন যে, আমার কর্মগুলো আল্লাহ কবুল করবেন, না কি প্রত্যাখ্যান করবেন, তা আমি অবগত নই। তাদের এ গুণের কথা আল-কুরআনে বর্ণনা করা হয়েছে:- وَالَّذِينَ يُؤْتُونَ مَا آَتَوْا وَقُلُوبُهُمْ وَجِلَةٌ أَنَّهُمْ إِلَى رَبِّهِمْ رَاجِعُونَ “যারা তাদের যা দান করার তা দান করে ভীত-কম্পিত হৃদয়ে যে তারা তাদের প্রতিপালকের কাছে ফিরে যাবে। (সূরা মুমিনুন: ৬০)

হাদীসে এসেছে, হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহা এ আয়াতের অর্থ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলে তিনি এরশাদ করেন,
سَأَلْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ هَذِهِ الْآيَةِ: )وَالَّذِينَ يُؤْتُونَ مَا آتَوْا وَقُلُوبُهُمْ وَجِلَةٌ( قَالَتْ عَائِشَةُ: أَهُمْ الَّذِينَ يَشْرَبُونَ الْخَمْرَ وَيَسْرِقُونَ؟ قَالَ: لَا يَا بِنْتَ الصِّدِّيقِ! وَلَكِنَّهُمْ الَّذِينَ يَصُومُونَ وَيُصَلُّونَ وَيَتَصَدَّقُونَ وَهُمْ يَخَافُونَ أَنْ لَا يُقْبَلَ مِنْهُمْ أُولَئِكَ الَّذِينَ يُسَارِعُونَ فِي الْخَيْرَاتِ
আল্লাহ এ কথা কাদের জন্য বলেছেন, যারা মদ্যপান করে, চুরি করে তাদের জন্য? তিনি উত্তরে বললেন: না, হে সত্যবাদীর কন্যা (আয়েশা)! তারা হল, যারা সিয়াম পালন করে, নামায আদায় করে, দান-সাদকা করে; সাথে সাথে এ ভয় রাখে যে, হয়ত আমার এ আমলগুলো আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। তারাই দ্রুত সম্পাদন করে কল্যাণকর কাজ এবং তারা তাতে অগ্রগামী।( )

৫- তাঁরা মানুষের প্রশংসার অপেক্ষা করে না
যখন তাঁরা কোন সৃষ্টিজীবের কল্যাণের জন্য কাজ করেন বা কোন মানুষকে বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য নিয়োজিত হন, তাদের দু:খ কষ্ট দূর করতে নেমে পরেন, তখন তাঁরা কারো কাছ থেকে নিজের পারিশ্রমিক আশা করেন না। কারো প্রশংসা কামনা করেন না। শুধু আশা করেন আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টি। রাসূলগণের বক্তব্য এ বক্তব্যকে সমর্থন করে। যেমন তাঁরা বলেন,
وَمَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ مِنْ أَجْرٍ إِنْ أَجْرِيَ إِلَّا عَلَى رَبِّ الْعَالَمِينَ
“আমি তোমাদের নিকট এর জন্য কোন প্রতিদান চাই না ; আমার পুরস্কার তো জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট আছে। (সূরা আশ-শুআরা: ১০৯)

এ জন্য যারা তাঁদের সাথে দুর্ব্যবহার করেছে, তাদের কিছু বলতেন না। যারা তাঁদের বাধা দিত তাদের সাথে বৈরিতা পোষণ করতেন না। এমনকি, মানুষ তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুক তাও কামনা করতেন না। যেমন আল্লাহ তাঁদের সম্পর্কে বলেন, তাঁরা বলেন,
إِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللَّهِ لَا نُرِيدُ مِنْكُمْ جَزَاءً وَلَا شُكُورًا
“এবং তারা বলে, কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আমরা তোমাদের আহার্য দান করি, তোমাদের নিকট কোন প্রতিদান চাই না এবং কৃতজ্ঞতাও কামনা করি না। (সূরা আল-ইনছান: ৯)

৬- তাঁরা নিজেদের জন্য পদ-মর্যাদা ও সুযোগ সুবিধা কামনা করেন না
অনেক মানুষ আছেন, যারা ভাল কোন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। ইখলাস অবলম্বন ও দায়িত্ব কর্তব্য সঠিকভাবে আদায় করেই কাজ করেন। কিন্তু যদি তার পদমর্যাদা কমিয়ে দেয়া হয় বা সুযোগ সুবিধায় ঘাটতি হয়, তবে তিনি অস্থির হয়ে যান। আসলে যিনি সত্যিকার মুখলিস তার এমন হওয়ার কথা নয়। সাহাবায়ে কেরামের ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই যে হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু ও হযরত উমার রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর মত শীর্ষস্থানীয় সাহাবাদের যখন হযরত উসামা ইবনে যায়দ রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর অধীনস্থ করা হল তখন তাঁদের মধ্যে সামান্য প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি।
এমনিভাবে যখন খালিদ বিন ওয়ালীদ রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহুকে সেনাপতির দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হল তখন তিনি পূর্বের মতই কাজ করতে থাকলেন। মুখলিস যখন আল্লাহর কাছ থেকে প্রতিদান আশা করেন তখন এ সকল বিষয় নিয়ে মন খারাপ করেন না।

এ বিষয়টি একটি হাদীসে দু ব্যক্তির চরিত্রের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে এভাবে:
عَنْ أَبِي صَالِحٍ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏ “‏ تَعِسَ عَبْدُ الدِّينَارِ وَعَبْدُ الدِّرْهَمِ وَعَبْدُ الْخَمِيصَةِ، إِنْ أُعْطِيَ رَضِيَ، وَإِنْ لَمْ يُعْطَ سَخِطَ، تَعِسَ وَانْتَكَسَ، وَإِذَا شِيكَ فَلاَ انْتَقَشَ، طُوبَى لِعَبْدٍ آخِذٍ بِعِنَانِ فَرَسِهِ فِي سَبِيلِ اللَّهِ، أَشْعَثَ رَأْسُهُ مُغْبَرَّةٍ قَدَمَاهُ، إِنْ كَانَ فِي الْحِرَاسَةِ كَانَ فِي الْحِرَاسَةِ، وَإِنْ كَانَ فِي السَّاقَةِ كَانَ فِي السَّاقَةِ، إِنِ اسْتَأْذَنَ لَمْ يُؤْذَنْ لَهُ، وَإِنْ شَفَعَ لَمْ يُشَفَّعْ ‏”‏‏
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন: টাকা-পয়সার দাস ধ্বংস হোক, রেশম কাপড়ের দাস ধ্বংস হোক, ধ্বংস হোক পোশাকের দাস। এদের অবস্থা এমন, প্রদান করা হলে খুশী হয় আর না দিলে অসন্তুষ্ট হয়। ধ্বংস হোক! অবনত হোক! কাঁটা বিঁধলে তা যেন উঠাতে না পারে।
তবে সৌভাগ্যবান আল্লাহর ঐ বান্দা যে আল্লাহর পথে ঘোড়ার লাগাম ধরেছে, মাথার চুল এলোমেলো করেছে ও পদদ্বয় ধুলায় ধূসরিত করেছে। যদি তাকে পাহারার দায়িত্ব দেয়া হয় তবে সে পাহারার দায়িত্ব পালন করে। যদি তাকে বাহিনীর পিছনে দায়িত্ব দেয়া হয় তবে তা পালন করে। যদি সে নেতার সাথে সাক্ষাত করার অনুমতি চায় তবে তাকে অনুমতি দেয়া হয় না। যদি সে কারো জন্য সুপারিশ করে তবে তার সুপারিশ গ্রহণ করা হয় না। ( )

এগুলো সবই হল, একজন মানুষের মধ্যে ইখলাস থাকার নিদর্শন। আল্লাহর নিকট আমাদের কামনা আল্লাহ যেন আমাদেরকে মুখলিসদের অন্তর্ভুক্ত করেন, আর আমাদের অন্তরকে এবং আমাদের আমলসমূহকে রিয়া ও নিফাক থেকে হেফাযত করেন। আ-মী-ন।

মাসআলা

আমল প্রকাশ করা কখন বৈধ?
আমরা সালফে সালেহীনের অবস্থা উল্লেখ করেছি যে, তাঁরা কীভাবে তাঁদের আমলসমূহকে গোপন করার প্রতি লালায়িত ছিলেন। আমরা আরও উল্লেখ করেছি যে, ইখলাসের আলামত হল, আমলসমূহকে গোপন করা এবং প্রকাশ না করা। তা সত্ত্বেও কখনো কখনো আমলকে প্রকাশ করা বৈধ হয়ে থাকে এবং তা গোপন করা হতে প্রকাশ করা উত্তম হয়ে থাকে।

আল্লামা ইবনে কুদামাহ রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
فصل في بيان الرخصة في قصد إظهار الطاعات” قال: وفي الإظهار فائدة الإقتداء، ومن الأعمال ما لا يمكن الإسرار به كالحج والجهاد، والمظهر للعمل ينبغي أن يراقب قلبه حتى لا يكون فيه حب الرياء الخفي بل ينوي الإقتداء به
আমলকে প্রকাশ করার মধ্যে অনুকরণ করার উপকারিতা রয়েছে এবং এতে রয়েছে মানুষকে কল্যাণের প্রতি উৎসাহ দেয়া। আর কতক আমল আছে, যেগুলো গোপন করার কোন উপায় থাকে না। যেমন- হজ, জিহাদ ইত্যাদি। যিনি আমলকে প্রকাশ করবেন, তাকে অবশ্যই তার অন্তরের দিক লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে তার মধ্যে গোপন শিরক অর্থাৎ রিয়ার মহব্বত না থাকে বরং মানুষ তার অনুকরণ করবে, এ কথারই নিয়ত করবে।

আমলকে প্রকাশ করা ও গোপন করার মধ্যে দুটি অবস্থা

প্রথম অবস্থা: কতক আমল আছে যেগুলো গোপন করা সুন্নত। সেগুলোকে গোপন করতে হবে। যেমন, তাহাজ্জুদ।
দ্বিতীয় অবস্থা: কতক আমল আছে, যে গুলো প্রকাশ করা সুন্নত। যেমন জুমার নামায, জামাতে নামায আদায় করা, সত্য প্রকাশ করা ইত্যাদি।
তৃতীয় অবস্থা: কতক আমল আছে যেগুলো গোপন করা ও প্রকাশ করা উভয়ের মাঝামাঝি অবস্থান করে। প্রকাশ করার কারণে যে ব্যক্তি রিয়ার আশঙ্কা করে সে আমলকে গোপন করবে, আর যে মানুষকে শেখানো বা তারা যাতে তার অনুকরণ করে এ ধরনের ইচ্ছা রাখে সে প্রকাশ করবে।

যেমন, নফল সদক্বা
কোন মানুষ এ বিশ্বাস রাখে যে, যখন মানুষ তাকে দান করতে দেখবে, তখন তার অন্তরে কিছু হলেও রিয়া ও লৌকিকতা আসবে, তখন তার জন্য উচিত হল, সদকাকে গোপন করা। আর যদি তার উদ্দেশ্য হয়, মানুষ দেখার কারণে সে অনুকরণীয় হবে এবং লোকেরা তাকে দেখে দান করা শিখবে এবং রিয়াকে সে প্রতিহত করতে সক্ষম হবে, তাহলে তার জন্য সুন্নত হল, সদকাকে প্রকাশ করা।

যেমন, একজন আলেম মসজিদে প্রবেশ করে নফল নামায আদায় করা দ্বারা মানুষ নফল নামায আদায় করার পদ্ধতি ও রাকাত সম্পর্কে জানতে পারবে। আমাদের কতেক সালফে সালেহীন হতে বর্ণিত, তাঁরা তাঁদের কতেক আমলকে প্রকাশ করতেন, যাতে মানুষ তাঁদের অনুকরণ করে। যেমন কেউ কেউ মৃত্যু উপস্থিত হলে, তাদের পরিবারকে বলতেন,
لا تبكوا علي فإني ما لفظت سيئة منذ أسلمت
তোমরা আমার উপর কান্না-কাটি করিও না, আমি যেদিন থেকে ইসলাম গ্রহণ করি সেদিন থেকে কোন খারাপ কথা বলিনি।

হযরত আবু ইবনে আইয়াশ রহমাতুল্লাহি আলাইহি তার ছেলেকে অসিয়ত করে বলেন, يا بني إياك أن تعصي الله في هذه الغرفة فإني ختمت القرآن فيها اثنتا عشرة ألف ختمة হে ছেলে! এ কামরার মধ্যে আল্লাহর নাফরমানি করা হতে বিরত থাক। কারণ, আমি এ ঘরের মধ্যে বার হাজার বার ক্বোরআন খতম করেছি।( )

এখানে একটি বিষয়ে সতর্ক থাকা খুবই জরুরি
যে ব্যক্তি সব মানুষ থেকে সব ধরনের আমল গোপন করতে বলে, তার বিষয়ে হুশিয়ার থাকা জরুরী। কারণ, মুনাফেকরা যখন কোন লোককে বেশি দান করতে দেখত, তখন বলত লোকটি মানুষকে দেখানোর জন্য দান করছে। আর যদি কোন লোক অল্প দান করত, তখন বলত আল্লাহ তা‘আলা তোমার এ দানের প্রতি মুখাপেক্ষী নন। তাদের এ সব কথা বলা দ্বারা উদ্দেশ্য, সমাজ হতে ভালো কাজগুলো তুলে দেয়া, যাতে কোন মানুষ নেককার লোকদের অনুকরণ করতে না পারে। এ কারণেই আমরা দেখতে পাই, যখন কোন ভালো লোক তাদের নেক আমল হতে কোন আমলকে প্রকাশ করে, তখন সে মুনাফেকদের পক্ষ থেকে নানাবিধ কষ্টের সম্মুখীন হয়। এমন কোন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে, তখন মুনাফেকদের নির্যাতনের উপর ধৈর্য ধারণ করতে হবে। তাদের বিরোধিতা, অপবাদ ও নির্যাতনের প্রতি কোন প্রকার ভ্রূক্ষেপ করা যাবে না। মনে রাখতে হবে, সে অবশ্যই মহা কল্যাণের উপর প্রতিষ্ঠিত।

রিয়ার আশঙ্কায় আমল ছেড়ে দেয়ার বিধান

হযরত ফুদ্বাইল বিন আয়ায রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
عن الفضيل بن عياض رحمه الله، قال: ” تَرْكُ الْعَمَلِ مِنْ أَجْلِ النَّاسِ رِيَاءٌ، وَالْعَمَلُ مِنْ أَجْلِ النَّاسِ شِرْكٌ، وَالْإِخْلَاصُ أَنْ يُعَافِيَكَ اللهُ عَنْهُمَا ” .
মানুষের কারণে আমল ছেড়ে দেয়া রিয়া। আর মানুষের জন্য আমল করা, শিরক। আর আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে এ দুটি থেকে ক্ষমা করা ইখলাস।( )

ইমাম নববী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
من عزم على عبادة وتركها مخافة أن يراه الناس فهو مرائي لأنه ترك لأجل الناس
কোন ব্যক্তি কোন একটি ইবাদত করার প্রতিজ্ঞা করল কিন্তু মানুষ তাকে দেখবে এ আশঙ্কায় সে ইবাদত করা ছেড়ে দিল, তাহলে সে একজন রিয়াকারী।

এটি যখন কোন ব্যক্তি সম্পূর্ণরূপে আমল করাকে ছেড়ে দেয়। আর যদি কোন ব্যক্তি গোপনে আমল করার উদ্দেশ্যে মানুষের সামনে আমল করা ছেড়ে দেয় তাতে কোন অসুবিধা নাই।

রিয়া করা ও আমলে কাউকে শরীক করার মধ্যে পার্থক্য

শরয়ী আমল করা দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়ত না করে গাইরুল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন কামনা করাকে রিয়া বলা হয়। আর আমল করা দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করার সাথে অন্য কিছুর সন্তুষ্টির নিয়ত করাকে আমলে অংশীদার করা বলে।
উল্লেখিত দুটি বিষয়ের দিক তাকিয়ে আমরা বলি, শরয়ী আমল বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করা যায়:

প্রথম প্রকার: আমল একমাত্র আল্লাহর জন্য করা আর কোন কিছুর প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করা।আর এ প্রকার আমল হল, সবোর্চ্চ ও সর্বোত্তম আমল।

দ্বিতীয় প্রকার: আমল আল্লাহর জন্য করবে এবং অন্য কোন বৈধ বিষয়ের প্রতিও ভ্রুক্ষেপ করবে। যেমন, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রোযা রাখা এবং সাথে সাথে দৈহিক সুস্থতার প্রতিও লক্ষ্য রাখা। অনুরূপভাবে কোন ব্যক্তি আল্লাহ সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে হজ করতে বের হল এবং সাথে সাথে ব্যবসারও নিয়ত করল।

অনুরূপভাবে কোন ব্যক্তি আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশে পায়ে হেটে মসজিদে গমন করে আবার সাথে সাথে শরীর চর্চার নিয়তও করে।

উপরে উল্লেখিত দৃষ্টান্ত গুলোতে যে ধরনের নিয়তের কথা বলা হয়েছে, সে ধরনের নিয়তের কারণে আমল নষ্ট হয় না, তবে সাওয়াব কম হয়। উত্তম হল আল্লাহর নৈকট্য লাভ ছাড়া আর কোন কিছুর নিয়ত না করা।

তৃতীয় প্রকার: আমল আল্লাহর জন্যই, কিন্তু আমল দ্বারা এমন কিছু উদ্দেশ্য থাকে বা নিয়ত করে যেগুলোর উদ্দেশ্য থাকা বা নিয়ত করা বৈধ নয়। যেমন, আমল দ্বারা উদ্দেশ্য হয়, মানুষের প্রশংসা কুড়ানো এবং আমলের বিনিময়ে টাকা-পয়সা উপার্জন করা। এ ধরনের আমলের কয়েকটি অবস্থা হয়ে থাকে:

যদি আমল শুরু করার আগেই তার অন্তরে এ ধরনের উদ্দেশ্যের উদ্রেক হয় এবং আমল এ উদ্দেশ্যেই করে থাকে, তাহলে এ আমল ফাসেদ তার কোন মূল্য নাই। যেমন কোন ব্যক্তি মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে নফল নামায আদায় করে।

আর যদি আমলের মাঝে এ ধরনের চিন্তার উদ্রেক হয়, তখন তাকে প্রতিহত করবে এবং প্রতিরোধ করবে। যেমন, কোন ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আমল করা শুরু করল, তারপর কাউকে দেখল, একজন লোক তার দিকে তাকাচ্ছে, এ দেখে সে খুশি হল এবং তাদের প্রশংসা ও সুনামের আশা বা আগ্রহ করল, তারপর সে এ আকাঙ্ক্ষা ও আগ্রহকে প্রতিহত ও প্রতিরোধ করতে করতে নামায শেষ করল, তাহলে তার আমল বিশুদ্ধ হবে এবং এ ধরনের সংগ্রাম করার কারণে সে বিনিময় পাবে।

আমল করার মাঝখানে পার্থিব কোন উদ্দেশ্য বা রিয়া দেখা দিল কিন্তু তা প্রতিহত বা প্রতিরোধ কোনটাই করেনি। এ ধরনের অবস্থা আমলকে বাতিল করে দেবে।

চতুর্থ প্রকার: আমল দ্বারা শরিয়ত ঘোষিত ছাওয়াব ও বিনিময় কোন কিছুর প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে, এমন কিছু ইচ্ছা করা যার তলব করা বৈধ। যেমন, কোন ব্যক্তি আত্ম-রক্ষার জন্য রোযা রাখল অথবা গণিমতের মালামাল হাসিল করার জন্য জিহাদ করল এবং শুধু মাল বাড়ানোর উদ্দেশ্যে মালের যাকাত দিল।এ ধরনের আমল বাতিল।
পঞ্চম প্রকার: আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের প্রতি কোন প্রকার ভ্রূক্ষেপ না করে, আমল দ্বারা এমন কিছুর ইচ্ছা করা যার তলব শরয়ীভাবে যায়েয নাই। যেমন, শুধু মানুষকে দেখানোর জন্য নামায আদায় করা। এ ধরনের আমলকারীর আমল বাতিল এবং সে অপরাধী।

রিয়া হতে দূরে থাকার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নেয়া

কোন কোন মুসলিম রিয়া হতে দূরে থাকার জন্য মিথ্যা কথা বলা বৈধ বলে দাবি করেন। এটি সম্পূর্ণ ভুল ও অন্যায় কাজ। কারণ, মিথ্যা বলা মুসলিমের চরিত্র হতে পারে না।
যেমন, এক লোক আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে মসজিদ বানাল, তারপর যখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, সে সরাসরি মিথ্যা কথা বলল; অর্থাৎ, “আমি মসজিদটি নির্মাণ করিনি, অমুক বানিয়েছে” এ ধরনের কথা বলে। এ ক্ষেত্রে সরাসরি মিথ্যা না বলে অস্পষ্ট কোন কথা বলা যেতে পারে। যেমন বলবে, একজন মুসলিম ভাইয়ের টাকা দিয়ে মসজিদটি বানানো হয়েছে।

কিছু বিষয় আছে যা মানুষ রিয়া মনে করে কিন্তু বাস্তবে তা রিয়া নয়

ইচ্ছার বাইরে কোন ভাল কাজের উপর প্রশংসা করা। [এটি রিয়া নয়] বরং এটি মুমিনদের জন্য নগদ সু-সংবাদ।

ইচ্ছার বাইরে সুনাম অর্জন করা। যেমন, একজন আলেম বা তালেবে ইলম, যে মানুষকে দ্বীন শিক্ষা দেয়, তাদের দ্বীন বিষয়ে তাদের তালীম দেয়,তাদের বিভিন্ন সমস্যার শরয়ী সমাধান বা ফতওয়া দেয়, তারা কিছুটা হলেও প্রসিদ্ধি পায়। তারা যেন রিয়া থেকে দূরে থাকার নামে এ ধরনের জন কল্যাণমুলক কর্ম হতে বিরত না থাকে। বরং তার কর্তব্য হল, তার মধ্যে যাতে রিয়া বা অহংকার না আসে সে জন্য সংগ্রাম করা এবং এ ধরনের কর্মগুলো চালিয়ে যাওয়া।

কোন ব্যক্তিকে আল্লাহর ইবাদত বন্দেগীতে তৎপর দেখে, লোকটির মত আল্লাহর ইবাদতে তৎপর হওয়া রিয়া নয়। যদি ইবাদত দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করা হয়, তবে সে সাওয়াব পাবে।

কাপড় সুন্দর রাখা, সুন্দর কাপড় পরিধান করা, সুন্দর জুতা পরিধান করা, সু-গন্ধি ব্যবহার করা ইত্যাদি রিয়া নয়।

গুনাহকে গোপন করা, গুনাহের আলোচনা না করা, রিয়া নয়। বরং আমরা আমাদের নিজেদের অপরাধ বা অন্য কোন ভাইয়ের অপরাধকে গোপন করা বিষয়ে আমরা শরিয়ত কর্তৃক নির্দেশিত। অনেকে ধারণা করে, গুনাহ করে জানিয়ে দেয়া ভাল, তাতে লোকটি মুখলিস বলে প্রমাণিত হয়। এ ধরণের ধারণা সম্পূর্ণ অমূলক এবং ইবলিসের ধোঁকা বৈই আর কিছুই নয়। কারণ, গুনাহ সম্পর্কে জানানো, মুমিনদের মাঝে অন্যায়কে ছড়ানো বা প্রচার করা ও নিজের অন্যায় কাজে অন্যকে সাক্ষী রাখার নামান্তর।

তাই ইখলাস সম্পকে নি¤েœাক্ত সতর্কতা অবলম্বন করা অতীব জরুরী

১- ভালো কাজে কাউকে প্রশংসা করা ইখলাসের পরিপন্থী নয়। যেমন:
عَنْ أَبِي ذَرٍّ، قَالَ: قِيلَ لِرَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَرَأَيْتَ الرَّجُلَ يَعْمَلُ الْعَمَلَ مِنَ الْخَيْرِ، وَيَحْمَدُهُ النَّاسُ عَلَيْهِ؟ قَالَ: ্রتِلْكَ عَاجِلُ بُشْرَى الْمُؤْمِنِগ্ধ
হযরত আবু যার রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আরয করা হল, সেই ব্যক্তি সম্পর্কে কি অভিমত, যে নেক আমল করে এবং লোকেরা তার প্রশংসা করে? তিনি বললেন, এতো মুমিন ব্যক্তির জন্য তা আগাম সুসংবাদ (এতে কাজটি কবুল হওয়ার লক্ষণ বুঝা যায়)। ( )

২- নিজের গুনাহ সম্পর্কে আলোচনা করা ইখলাসের পরিচায়ক নয়, কারণ আল্লাহ গুনাহ প্রকাশ করাকে অপছন্দ করেন এবং গোপন রাখা পছন্দ করেন। হাদীসে এসেছে, فَمَنْ أَصَابَ مِنْ هَذِهِ الْقَاذُورَاتِ شَيْئًا، فَلْيَسْتَتِرْ بِسِتْرِ اللَّهِ “যে ব্যক্তি আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজে লিপ্ত হয়েছে সে যেন আল্লাহর গোপনীয়তায় নিজেকে গোপন রাখে”।( )

৩- রিয়া তথা লোক দেখানো ভয়ে ভালো কাজ ছেড়ে দেওয়া ইখলাসের পরিচায়ক নয় কেননা এটা শয়তানের ষড়যন্ত্র। হযরত ইবরাহীম নাখ‘য়ী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, “যখন তুমি সালাতে থাকো তখন শয়তান এসে বলে তুমি তো মানুষকে দেখানোর জন্য সালাত পড়ছ, তখন তুমি সালাত আরো দীর্ঘ করো”।

৪- আবেদ বান্দাহকে দেখে ইবাদতের প্রতি আগ্রহ জন্মানো ইখলাসের পরিপন্থী নয়। ইমাম মাকদিসী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “কেউ অধিক ইবাদতকারীর সাথে রাত্রি যাপন করলে তার অল্প ইবাদত করার অভ্যাস থাকলে সে যদি উক্ত ব্যক্তির দ্বারা উৎসাহিত হয়ে বেশি সালাত ও সাওম পালন করে তবে কেউ হয়ত ভাবতে পারে এটা রিয়া তথা লৌকিকতা। আসলে ব্যাপারটা মোটেও এরূপ নয়। বরং এতে ফায়েদা আছে। মূলত সব মু’মিনই আল্লাহর ইবাদত করতে চায়, কিন্তু অনেক সময় বিভিন্ন বাধা-বিপত্তি ও অলসতার কারণে সম্ভব হয়ে উঠে না, তখন অন্যের কারণে সে অলসতা দূর হয়ে যায়”।( )
নিজেকে ইখলাস থেকে নিরাশ মনে করা উচিত নয়, যেমন বলা যে, এটা শক্তিশালী মুখলিস বান্দাই করতে সক্ষম, আমি তাদের তুলনায় কোথায়? এতে ইখলাস অর্জনে সে চেষ্টা ছেড়ে দেয়। অথচ যার মধ্যে ইখলাসের ঘটতি আছে তার ইখলাস সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। ( )

৫- গুনাহের কথা আলোচনা না করা ও গোপন রাখা ইখলাসের পরিচায়ক
عَنْ سَالِمِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ، قَالَ: سَمِعْتُ أَبَا هُرَيْرَةَ، يَقُولُ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: ” كُلُّ أُمَّتِي مُعَافًى إِلَّا المُجَاهِرِينَ، وَإِنَّ مِنَ المُجَاهَرَةِ أَنْ يَعْمَلَ الرَّجُلُ بِاللَّيْلِ عَمَلًا، ثُمَّ يُصْبِحَ وَقَدْ سَتَرَهُ اللَّهُ عَلَيْهِ، فَيَقُولَ: يَا فُلاَنُ، عَمِلْتُ البَارِحَةَ كَذَا وَكَذَا، وَقَدْ بَاتَ يَسْتُرُهُ رَبُّهُ، وَيُصْبِحُ يَكْشِفُ سِتْرَ اللَّهِ عَنْهُ ”
হযরত আবূ হুরায়রা রিাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, “আমার সকল উম্মত মাফ পাবে, তবে প্রকাশকারী ব্যতীত। আর নিশ্চয়ই এ বড় ধৃষ্টতা যে, কোনো ব্যক্তি রাতে অপরাধ করলো যা আল্লাহ গোপন রাখলেন। কিন্তু সে ভোর হলে বলে বেড়াতে লাগলো, হে অমুক! আমি আজ রাতে এমন এমন কর্ম করেছি। অথচ সে এমন অবস্থায় রাত অতিবাহিত করলো যে, আল্লাহ তার কর্ম গোপন রেখেছিলেন, আর সে ভোরে উঠে তার উপর আল্লাহর পর্দা খুলে ফেলল”।( )

৬- প্রত্যাশা ছাড়াই সুনাম সুখ্যাতি অর্জিত হলে, শির্কের ভয়ে আমল ছেড়ে দেওয়া ইখলাসের পরিচায়ক নয়।
হযরত ফুদাইল ইবন ‘ইয়াদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “লোক দেখানোর ভয়ে আমল ছেড়ে দেওয়া রিয়া, আর লোক দেখানোর জন্য আমল করা শির্ক, আল্লাহ তোমাকে এ থেকে মুক্ত রাখা হলো ইখলাস”।( )

ইমাম নাওয়াবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এ কথার ব্যাখ্যায় বলেন, তার কথার উদ্দেশ্য হলো কেউ কোনো ইবাদত করার ইচ্ছা পোষণ করলে লৌকিকতার ভয়ে তা ছেড়ে দিলে রিয়া হিসেবে গণ্য হবে, কেননা মানুষের কারণে আমল ছেড়ে দিলে নফল আমল হলে হয়ত সে নির্জনে তা আদায় করবে, আর তা মুস্তাহাবও বটে, কিন্তু ফরয সালাত হলে অথবা ফরয যাকাত হলে বা উক্ত ব্যক্তি এমন বিজ্ঞ আলেম হলে যাকে মানুষ অনুসরণ করে, এরূপ অবস্থায় প্রকাশ্যে ইবাদত করাই উত্তম।( )

৭- ব্যক্তির ইচ্ছা ছিল ইবাদত গোপনভাবে করা এবং একমাত্র আল্লাহর জন্যই করা, কিন্তু মানুষ যদি জেনে যায় তবে বুঝতে হবে আল্লাহ তা‘আলা তার ইবাদতের সৌন্দর্য মানুষের মাঝে প্রকাশ করেছেন, তখন মানুষের প্রশংসা ও সম্মানের আশা না করে আল্লাহর এ সুন্দর কাজে খুশি হওয়া এবং আল্লাহ তার গুনাহ গোপন করায় আনন্দিত হওয়া প্রয়োজন।
عَنْ أَبِي ذَرٍّ، قَالَ: قِيلَ لِرَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَرَأَيْتَ الرَّجُلَ يَعْمَلُ الْعَمَلَ مِنَ الْخَيْرِ، وَيَحْمَدُهُ النَّاسُ عَلَيْهِ؟ قَالَ: ্রتِلْكَ عَاجِلُ بُشْرَى الْمُؤْمِنِগ্ধ
হযরত আবু যার রিাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আরয করা হল, সেই ব্যক্তি সম্পর্কে কি অভিমত, যে নেক আমল করে এবং লোকেরা তার প্রশংসা করে? তিনি বললেন, এতো মুমিন ব্যক্তির জন্য তা আগাম সুসংবাদ (এতে কাজটি কবুল হওয়ার লক্ষণ বুঝা যায়)। ( )

পরিশিষ্ট

আজ আমরা এবং মুসলিম জাতি যে মহা সংকট ও নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে বসবাস করছে, তার থেকে পরিত্রাণ, মুক্তি ও সংশোধনে আমাদের এখলাসের খুবই প্রয়োজন।

আমরা দেখতে পাই অনেক বড় বড় দাওয়াতি সংস্থা, সেবামুলক সংস্থা গড়ে উঠেছিল, কিন্তু ইখলাস না থাকার কারণে খুব কম সময়ের মধ্যে সেগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছে। এ সব সংস্থাসমূহের কোন কোন দায়িত্বশীলের মধ্যে কোন ইখলাস ছিল না, তাদের ইচ্ছা ছিল লোক দেখানো, সুনাম অর্জন ও পার্থিব কোন স্বার্থ হাসিল। ফলে তারা এমন সব কর্মে জড়িত হয়, যার ফলে তাদের সব অর্জন নষ্ট হয়ে যায় এবং সংস্থাগুলো ধ্বংস হয়ে যায়।

প্রতিটি ব্যক্তির জন্য তার আমলে ইখলাস থাকা জরুরি। তবে আফসোস সে ব্যক্তির জন্য যে নিয়তের হাকিকত কি তা জানে না, সে কিভাবে নিয়তকে ঠিক করবে।

হে আল্লাহ তুমি আমাদের ইখলাস দান কর এবং ইখলাসকে আমাদের অন্তরে অটুট রাখ। আ-মী-ন।

وصلى الله على نبينا محمد، وعلى آله وصحبه وسلم