গেয়ারভী শরীফের ফজিলত
তরজুমান ডেস্ক
হুযূর গাউসে আ‘যম যেমন অনন্য, তাঁর গেয়ারভী শরীফের ফযীলতও বর্ণনাতীত। গাউসে পাকের গেয়ারভী শরীফ পাঠ করা বস্তুতঃ আল্লাহ তা‘আলার রহমত, সম্মানিত নবীগণ ও ওলীগণের ফুয়ূযাত, বরকাত ও তাঁদের শুভদৃষ্টি লাভের একটি ওসীলা। [মানাক্বিবে গাউসিয়া, ক্বালাইদুল জাওয়াহির]
প্রথম ফযীলত-
শাহ্ ওলী উল্লাহ্ মুহাদ্দিস দেহলভী মুযহেরে জানে জাঁনা’র মকত‚বাত থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি স্বপ্নে একটা উঁচু জায়গা দেখলাম, যেখানে অনেক ওলী বৃত্তাকারে বসে মোরাক্বাবা করছেন। তাঁদের মধ্যে হযরত বাহাউদ্দীন নক্বশবন্দ এবং হযরত জুনাইদ বাগদাদী রাহমাতুলাহি তা‘আলা আলায়হিকে হেলান দিয়ে বসা অবস্থায় দেখলাম। তাঁরা আল্লাহর ধ্যানে বিমুগ্ধ অবস্থায় রয়েছেন। আমি তাঁদেরকে বললাম, ‘‘আপনাদের একি ঘটনা?’’ তাঁদের মধ্যে একজন বললেন, ‘‘হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে এস্তেক্ববাল করার জন্য যাচ্ছি।’’ হযরত আলীর সাথে এক ব্যক্তি রয়েছেন, যিনি চাদর মুড়ি দিয়ে আছেন। আমি বললাম, ‘‘ইনি কে?’’ উত্তর আসলো, ‘‘তিনি হযরত ওয়াইস্ ক্বরনী রাহমাতুলাহি আলায়হি।’’ এরপর একটি হুজুরা শরীফের মধ্যে সব ওলী প্রবেশ করলেন, যেখানে আল্লাহর নূর বিচ্ছুরিত হচ্ছে। তন্মধ্যে একজন বুযুর্গ বললেন, ‘‘আজকে গাউসে পাকের গেয়ারভী শরীফ পালিত হচ্ছে। সেখানে উপস্থিত হবার জন্য এসব ওলী উপস্থিত হচ্ছেন।’’ [কালেমা তাইয়্যেবাহ্, কৃত. শাহ ওলী উল্লাহ ্ দেহলভী]
দ্বিতীয় ফযীলত-
হযরত মাওলানা ওয়াহিদ ক্বাদেরী ‘মীলাদে শায়খ’ কিতাবে বর্ণনা করেন, গেয়ারভী শরীফের ফযাইল ও কামালাত বে-শুমার। আমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি নিয়মিতভাবে গেয়ারভী শরীফ নিশ্চিতভাবে পালন করে তার কোন অভাব থাকে না। সাথে সাথে আধ্যাত্মিকতায়ও উন্নতি লাভ করে।
তৃতীয় ফযীলত-
এক ব্যক্তি গেয়ারভী শরীফের বরকতে দোযখ থেকে রক্ষা পেয়ে বেহেশতী হয়ে গেল; এমনকি চিতার আগুনও তাকে জ্বালাতে পারেনি। মাওলানা ক্বারী এমাত আলভী ক্বাদেরী বর্ণনা করেন, হিন্দুস্তানের বোরহানপুরে, আমাদের বাড়ীর নিকট এক হিন্দু গাউসে পাকের ভক্ত ছিলো। সে প্রত্যেক মাসের ১১ তারিখে খাবার তৈরি করে গাউসে পাকের গেয়ারভী শরীফে পেশ করতো এবং গরীব-মিসকীনদের মধ্যে তা বন্টন করতো। যখন ওই ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলো, তখন হিন্দুরা তাদের প্রথা অনুযায়ী তাকে জ্বালানোর জন্য শ্মশানে নিয়ে গেলো। তারা তাকে আগুন দিয়ে জ্বালানোর জন্য খুব চেষ্টা করলো। কিন্তু আগুন তাকে জ্বালায়নি। অনন্যোপায় হয়ে হিন্দুরা তাকে এক নদীতে ভাসিয়ে দিলো। ইতোমধ্যে এক দরবেশকে হুযূর গাউসে পাক স্বপ্নে নির্দেশ দিলেন- ‘অমুক জায়গায় এক হিন্দু আমার আওলাদের হাতে গোপনে মুসলমান হয়েছিলো, মনেপ্রাণে ইসলামের প্রতি আশেক্ব ছিলো সে অতি গোপনে আমার ক্বাদেরিয়া তরীক্বার অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলো। এখন সে মৃত্যুবরণ করেছে। তুমি গিয়ে তার কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করো।’ ওই দরবেশ হিন্দুস্তানের বোরহানপুরে এসে ওই লাশ সংগ্রহ করে ইসলামী তরীক্বায় তা দাফন করলেন।
[মানাক্বিবে গাউসিয়া ইত্যাদি]
চতুর্থ ফযীলত-
গেয়ারভী শরীফের মধ্যে গাউসে পাকের ওই ওয়াদার প্রতিফলন রয়েছে, যা তাঁকে আল্লাহ তা‘আলা দিয়েছেন- ‘তোমার মুরীদদের মধ্যে কাউকেও আমি দুনিয়া ও আখেরাতের কোন আগুনে বন্দী করব না।’
[তাফরীহুল খাত্বির, ফুয়ূযাতে রাব্বানিয়া, মাযহারে জামালে মোস্তফাঈ]
পঞ্চম ফযীলত-
যারা গেয়ারভী শরীফ পালন করবে তাদের রক্ষার জন্য গাউসে পাক যামিন। ‘হাক্বীক্বতে যিন্দেগী’ নামক পুস্তিকায়, যার শামসুল হক দেওবন্দী আফ্গানী সত্যায়ন করেছেন, উল্লেখ করা হয়েছে- হুযূর গাউসে পাক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আন্হু হাসানী এবং হোসাইনী। এ নূরানী দু’ ধারার ফযীলতে তিনি অনন্য আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী হয়েছেন। এ প্রভাবে তিনি কয়েক বছরের ডুবন্ত বরযাত্রীসহ নব দুলহা ও দুলহানকে পুনরায় জীবিতাবস্থায় দাজলা নদী হতে বের করে এনেছিলেন, যাদের শরীর পানিতে টুকরা টুকরা হয়ে বিক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিলো। এসব কিছু করতে গাউসে পাক সক্ষম হয়েছেন এজন্য যে, তিনি ফয়যে মুহাম্মদী ও আলে মুহাম্মদীর বরকতের অধিকারী ছিলেন। উক্ত ঘটনাটি প্রসিদ্ধ ও প্রামাণ্য কিতাবের মধ্যে রয়েছে।
ওই নব দুলহার নাম কবীর উদ্দীন, প্রকাশ ‘শাহ্ দুলহা’। পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের গুজরাটে তাঁর মাযার অবস্থিত। হুযূর গাউসে পাকের দো‘আর বরকতে সে ছয়শ’ বছর হায়াত পেয়েছে।
ষষ্ঠ ফযীলত-
মাসিক ‘আস্তানা-ই দেহলী’র এক সংখ্যায় (১৯৫৪ইং) উল্লেখ করা হয়েছে যে, লাহোরে শিখদের রাজত্বকালে রনজিৎ সিং এক ক্ষমতাবান শাসক ছিলেন। এক হিন্দু পরিবার গাউসে পাক ও গেয়ারভী শরীফের ভক্ত ছিলো। প্রতিবেশী এক বদ-আক্বীদা সম্পন্ন খারেজী ওই হিন্দুর স্ত্রীর উপর কুদৃষ্টি দিল এবং সে সুযোগের সন্ধানে ছিলো। একদা ওই হিন্দু তার স্ত্রীকে নিয়ে তার শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছিলো। ওই খারেজী সংবাদ পেয়ে তাদের পিছনে ঘোড়া নিয়ে ছুটলো। জঙ্গলে গিয়ে তাদের সাক্ষাৎ পেলো। ওই হিন্দু ও তার স্ত্রী পায়ে হেঁটে যাচ্ছিল। তখন ওই বদ-আক্বীদা সম্পন্ন লোকটি হিন্দুকে বলল, ‘‘তোমার স্ত্রীকে আমার ঘোড়ার উপর উঠিয়ে দাও।’’ এতে হিন্দু লোকটি রাজী হলো না। খারেজী চাপ সৃষ্টি করতে লাগলো এবং ওই মহিলাকে বলল, ‘‘শুধু শুধু এত কষ্ট করে পায়ে হেঁটে যাওয়ার দরকার কি? আমার ঘোড়ার উপর আরোহণ করো।’’ কিন্তু মহিলাটিও রাজী হয়নি। ওই খারেজী বারবার চাপ সৃষ্টি করতে থাকলে হিন্দু লোকটি বললো, ‘‘তোমার নিশ্চয়তা কি? যদি তুমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাও। এ জন্য কাউকে যামিন পেশ করো।’’ তখন ওই বদ-আক্বীদা সম্পন্ন লোকটি বললো, ‘‘আমি এ জঙ্গলের মধ্যে যামিন কোথায় পাবো?’’ তখন মহিলাটি বললো, ‘‘গেয়ারভী শরীফওয়ালা বড়পীরই তোমার যামিন হবেন।’’ এ কথায় খারেজী রাজী হয়ে গেলো। মহিলাটি ঘোড়ায় আরোহণ করে ওই খারেজীর পেছনে বসলো। অতঃপর খারেজী তরবারি বের করে হিন্দুকে হত্যা করে তার স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে যেতো লাগলো। তখন মহিলা পেছনের দিকে বারংবার তাকাচ্ছিলো। তখন ওই খারেজী বলতে লাগল, ‘‘পেছনে কি দেখছো? তোমার স্বামীতো নিহত হয়েছে।’’ তখন হিন্দু মহিলাটি বললো, ‘‘আমি বড়পীরের দিকে দেখছি। তিনি আসছেন কি-না?’’ ওই খারেজী বিদ্রƒপ করে বললো, বড়পীর তো মৃত্যুবরণ করেছেন কয়েকশ’ বছর আগে। ওই বড়পীর কি তোমাকে সাহায্য করতে পারবেন?’’ কিছুক্ষণ পর দেখা গেলো দু’জন নেকাব পরিহিত ব্যক্তি উপস্থিত হলেন। তন্মধ্যে একজন ওই খারেজীকে হত্যা করলো। এরপর ওই মহিলা ঘোড়ার পাশে বসে রইলেন এবং মুখোশ পরিহিত ওই ব্যক্তি মহিলাকে নিয়ে ওই স্থানে আসলেন, যেখানে ওই হিন্দুর লাশ পড়ে রয়েছে। আর এ হিন্দুর মাথা নিয়ে তার মৃতদেহের সাথে একত্রিত করে বললেন, ‘ক্বুম্ বিইয্নিল্লাহ্’ (আল্লাহর হুকুমে ওঠ)।’ এতে ওই হিন্দু জীবিত হয়ে গেলো। এরপর ওই দুই ব্যক্তি অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
হিন্দু তার স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি ফিরলো। ওই ঘোড়াটি খারেজীর ওয়ারিশরা খালি দেখে ওই হিন্দু পরিবারের বিরুদ্ধে রনজিৎ সিং-এর আদালতে খুনের মামলা দায়ের করলো। তার প্রমাণ হিসেবে বললো যে, তাদের নিকট ওই ব্যক্তির ঘোড়া আছে। এ দুইজন আদালতে হাযির হয়ে পুরো ঘটনার বিবরণ দিলেন এবং ওই দু’ নেকাব পরিহিত ব্যক্তির মধ্যে এক ব্যক্তিকে চিনেন বলে স্বীকারোক্তি দিলো। তিনি হলেন গুল মুহাম্মদ নামের একজন মজযূব দরবেশ, যিনি লাহোরে অবস্থান করেন। তখন আদালতে গুল মুহাম্মদ শাহ্ সাহেবকে তলব করা হলো। হযরত গুল মুহাম্মদ শাহ্ আদালতে এসে বললেন, ‘‘অপরজন ছিলেন হুযূর গাউসুল আ’যম দস্তগীর, যাঁর যিম্মায় ওই মহিলা ওই খারেজীর ঘোড়ার উপর সাওয়ার হয়েছিলো এবং পেছনে তাকাচ্ছিলো- গাউসুল আ’যম কখন আসছেন সাহায্যের জন্য। তখন আমি ও গাউসে পাক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তার সাহায্যের জন্য উপস্থিত হয়ে ওই ভণ্ডকে উপযুক্ত শাস্তি দিয়েছি। এটাই ছিলো ওই বদ-আক্বীদার উপযুক্ত শাস্তি। আর দম্পত্তি নিরপরাধ।’’ তখন রনজিৎ সিং ওই দরবেশকে এবং এ হিন্দু স্বামী-স্ত্রীকে মামলা থেকে বেকসুর খালাস দিলেন এবং পুরস্কৃত করলেন।
সপ্তম ফযীলত-
এক ব্যবসায়ীর কাজ-কারবার জাহাজের মাধ্যমে চলছিলো। কয়েকটি জাহাজে ভর্তি করে ব্যবসায়ী তার মাল সমুদ্র পথে পাঠালো। হঠাৎ করে ওই জাহাজ তার মালসহ সমুদ্রে ডুবে গেলো। কর্মচারীরা ব্যবসায়ীকে পত্র মারফত দুর্ঘটনার কথা জানালো। ব্যবসায়ী চিঠির উত্তরে লিখলো, ‘‘তোমরা চিন্তা করো না। আমার পূর্ণ বিশ্বাস যে, আমার মাল নষ্ট হবে না। কেননা, আমি হুযূর গাউসে পাকের গেয়ারভী শরীফ পালন করি।’’ এ চিঠি পাওয়া মাত্র ওই কর্মচারীরা পানিতে নিমজ্জিত জাহাজটির খোঁজ নিতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর জাহাজটি মালামালসহ অক্ষত অবস্থায় সমুদ্র তীরে ভেসে উঠলো। তারা জাহাজের সামগ্রী বিক্রয় করে অনেক লাভবান হল। তখন ওই ব্যবসায়ী খুশী হয়ে হুযূর গাউসে পাকের জন্য গেয়ারভী শরীফের মাধ্যমে ফাতেহা-নেয়াযের ব্যবস্থা করলো। [মিলাদে শায়খঃ পৃ. ১১৭৯]
সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, গেয়ারভী শরীফও উম্মত-ই মুহাম্মদী সালালাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসালাম-এর বরকত লাভের একটি বড় ওসীলা।
এ মাসের কিছু নফল এবাদত-
২৫ ও ২৯ তারিখ এশার নামাযের পর দুই রাকাত বিশিষ্ট চার রাকাত নামায আদায় করার জন্য অনেক বুজুর্গানে দ্বীন উৎসাহিত করেছেন, যাতে অনেক কল্যাণ নিহিত।
এর প্রতি রাকাতে সূরা ফাতেহার সাথে পাঁচবার সূরা ইখলাছ দ্বারা এ নামায আদায় করবেন। অন্যান্য রাতেও অধিকহারে দরূদ শরীফ, তিলাওয়াত ও নফল নামায আদায়ান্তে গুনাহ্র ক্ষমা প্রার্থনা এবং বিশ্ব মুসলিমের ঐক্য ও সংহতির দোয়া করবেন।
বিশেষতঃ ১১তারিখ খতমে গাউসিয়া, গাউসে পাকের জীবনী আলোচনা, ওয়াজ মাহফিল এবং গরীব মিসকীনগণকে আহার করানোর ব্যবস্থা করে তার সাওয়াব গাউসে পাকের প্রতি প্রেরণের দোয়া করা অতঃপর নিজের জন্য, দেশ ও জাতির জন্য বিশেষ মুনাজাত করবেন।