সুলতানুল হিন্দ হযরত খাজা মুঈন উদ্দীন চিশতির জীবনদর্শন
মাওলানা মুহাম্মদ মুনিরুল হাছান>
রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় পূণ্যবান সাহাবাগণ ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েন। হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষে এবং তৃতীয় শতাব্দীর প্রারম্ভে তাবেয়ী পরবর্তী যুগে আরব, পারস্য, বুখারা, বাগদাদ প্রভৃতি অঞ্চলে মুসলমানদের মধ্যে উদ্ভব হয় সুফিবাদ নামক নতুন একটি ধারার। আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসার শিক্ষা দিতে এবং মানুষকে আল্লাহর প্রেমের মন্ত্রের দীক্ষিত করার জন্য পৃথিবীতে আগমন করেন অসংখ্য সূফী সাধক,পীর বুজুর্গ ও আউলিয়ায়ে কেরাম। সুফিগণ আল্লাহ তাআলার একটি বাণীকে লালন করে ইসলামের প্রচার প্রসারের জন্য পৃথিবীর নানা প্রান্তে হিজরত করেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, আর তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল যেন থাকে যারা কল্যাণের দিকে আহবান করবে এবং সৎকাজের নির্দেশ দেবে ও অসৎ কাজে নিষেধ করবে, আর তারাই সফলকাম। (সূরা আলে ইমরান-১০৪)
কল্যাণময় কাজের পথনির্দেশনা দেওয়াই হলো আউলিয়ায়ে কেরামগণের অন্যতম ব্রত। ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের শান্তি ও মুক্তির মশাল নিয়ে যে সকল আধ্যাত্মিক মহাপুরুষগণের আগমন ঘটেছিল তাদের মধ্যে এক ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ হলেন হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশতী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। কথিত আছে, পাক ভারত উপমহাদেশে ওই সময়ে ৩৩ কোটি দেবতার অস্তিত্ব ছিল। এই নাজুক পরিস্থিতিতে ইমান ইসলামের দাওয়াত দেওয়াটা ছিল অত্যন্ত কঠিন ও দূরুহ। আউলিয়ায়ে কেরামগণ মানুষের আত্মা জয় করার মিশনে এগিয়ে যান। হযরত খাজা গরীবে নেওয়াজ হলেন উপমহাদেশে সর্বসাধারণের আত্মা জয়কারী এমনই একজন ইসলাম প্রচারক। যার হাতে উপমহাদেশে প্রায় ৯০ লক্ষ মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন।
প্রাথমিক জীবন
হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) ৫৩৬ হিজরী মতান্তরে ৫৩৭ হিজরীতে /১১৪২ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ব পারস্যের সিস্থান প্রদেশের সঞ্জর শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার মূল নাম হাসান। উপমহাদেশে তিনি মঈনুদ্দীন চিশতী নামে সমধিক পরিচিত। পিতার নাম সৈয়দ গিয়াস উদ্দিন, মাতার নাম সৈয়দা উম্মুল ওয়ারা মাহিনুর ।
মাতৃকুলের ধারায় তিনি হাসানী আর পিতৃকুলের ধারায় তিনি হোসাইনি। তার আম্মাজান বলেন, যখন মঈনউদ্দিন আমার গর্ভে আসেন তখন থেকেই আল্লাহ তায়ালার রহমতে আমার পরিবারের সকল কিছুই বরকতম-িত হয়ে উঠে। দুঃখ কষ্ট দূরীভূত হয়ে যায়। শত্রুরা বন্ধুতে পরিণত হয়। খাজা গরীবে নেওয়াজের আম্মাজান আরো বলেন, আমার গর্ভে সন্তানের রুহ আসার পর থেকে আমি অর্ধরাত্রি থেকে ফজর পর্যন্ত সময়ে কালিমার জিকির শুনতে পেতাম। এমনকি আমার সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর আমার পুরো ঘর আলোকিত হয়ে যায়।
শিক্ষা জীবন
খাজা গরীবে নেওয়াজ প্রথমে নিজের পরিবারেই প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন। নয় বছর বয়সে পবিত্র কোরআন হিফজ সম্পন্ন করার পরে সাঞ্জরের একটি মাদ্রাসায় তাফসীর, হাদিস ও ফিকাহ শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। এছাড়াও তিনি প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ ইমামুল হারামাইন হযরত আবুল মা’আলী রহমাতুল্লাহি আলায়হির নিকট শরীয়তের বিভিন্ন বিষয়ে পান্ডিত্য লাভ করেন। জ্ঞান অর্জনের জন্য তিনি বিভিন্ন দেশে সফর করতে থাকেন। সমরকন্দের প্রখ্যাত আলেম হযরত শরফুদ্দীন রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ও বোখারার প্রখ্যাত মুহাদ্দিস হযরত হুসামুদ্দীন রাহমাতুল্লাহি আলায়হির নিকট দীর্ঘ পাঁচ বছর অধ্যয়ন করে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার কৃতিত্বপূর্ণ পূর্ণতা অর্জন করেন।তিনি ভারতবর্ষে এসেছিলেন রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়াসাল্লামের নায়েব হিসাবে।
জীবনের পটপরিবর্তন
পনেরো বছর বয়সে তার পিতা-মাতা মৃত্যুবরণ করলে পিতার কাছ থেকে একটি ফলের বাগান উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেন। একদিন তিনি তার ফলবাগানে বসে ছিলেন। এমন সময় তার ফলবাগানে আসেন বিখ্যাত সুফিসাধক শেখ ইবরাহিম কুন্দুজী (রহঃ)। খাজা গরীবে নেওয়াজ তাকে কিছু ফল দিয়ে আপ্যায়ন করেন। এর প্রতিদান স্বরূপ কুন্দুজী (রহঃ) গরীবে নেওয়াজকে এক টুকরা রুটি নিজের মুখে চিবিয়ে খেতে দেন । এটি খাওয়ার পর তার মধ্যে আমূল পরিবর্তন সূচিত হয়। দুনিয়া থেকে তার মন উঠে গিয়ে আল্লাহর প্রেমের সুধায় নিজেকে হারিয়ে ফেলেন তিনি। সমুদয় সম্পত্তি এবং অন্যান্য জিনিসপত্র গরীবদের মাঝে বিতরণ করে দেন। এসময় তিনি দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে জ্ঞানার্জন ও উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশ বিদেশ পরিভ্রমণ করেন। অতঃপর নিশাপুরে হারওয়ান শহরে এসে তৎকালীন বিখ্যাত দরবেশ হযরত ওসমান হারওয়ানি রাহমাতুল্লাহি আলায়হির কাছে বাইয়াত গ্রহণ করে। ভারত আসার পথে তিনি লাহোরে প্রখ্যাত সূফীসাধক হযরত আলী উসমান হাজভিরী (দাতা গঞ্জে বখ্শ) রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর মাজারে চল্লিশ দিন অবস্থান করেন।
ভারত বর্ষে আগমন
খাজা গরীবে নেওয়াজ বাগদাদ শরীফে গিয়ে গাউছুল আজম হযরত আব্দুল কাদির জিলানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর সাহচর্যে ৫৭ দিন অবস্থান করেন। এ সময় গাউসে পাক রহমাতুল্লাহি আলাইহি খাজা গরীবে নেওয়াজকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ইরাকের দায়িত্ব শায়েখ শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দীকে আর হিন্দুস্থানের দায়িত্ব আপনাকে দেওয়া হলো। একই সুসংবাদ খাজা গরীবে নেওয়াজ মদীনা শরীফে রওজায়ে আকদাস জিয়ারতকালে হযরত রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা এর পক্ষ থেকে পেয়েছিলেন। এ কারণেই তাকে “আতায়ে রসূল” বলা হয়ে থাকে।
প্রিয় নবীর দরবারে
খাজা গরীবে নেওয়াজ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি হজ পালনের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন মক্কায়। হজ পালন শেষে মক্কা শরীফ থেকে হযরত খাজা গরীবে নেওয়াজ মদিনা শরীফে আসেন এবং অতি শ্রদ্ধাভক্তি এবং নম্রতার সাথে হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মাজার শরীফে হাজির হন। একদিন খাদেম সাহেবকে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ করলেন: মঈনুদ্দিন চিশতি কে উপস্থিত কর”। হযরত খাজা গরীবে নেওয়াজ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এ খবর শুনা মাত্রই খাদেম সাহেবের নিকটে পৌঁছলেন। খাদেম সাহেব তাকে রওজা শরীফে পৌঁছিয়ে আরজ করলেন, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা মঈন উদ্দীন চিশতি উপস্থিত। এ কথা বলা মাত্রই রওজা শরীফ এর দরজা নিজে নিজেই খুলে গেল। হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নুরানী চেহারায় আবির্ভুত হয়ে বলেন, হে কুতুবে মাশায়েখ, ভিতরে এসো। হযরত খাজা গরীবে নেওয়াজ আত্মহারা হয়ে রওজা শরীফের ভিতরে প্রবেশ করলেন। তথায় রাহমাতুল্লিল আলামীনের নুরানী সাক্ষাৎ পেয়ে তিনি বিমুগ্ধ ও বিমূঢ় হয়ে যান। যখন খাজা গরীবে নেওয়াজ এর জ্ঞান ফিরল তখন হুকুম হলো, “হে মঈনুদ্দিন, তুমি আমার দ্বীনের মঈন (সাহায্যকারী)। আজ আমি তোমাকে হিন্দের বেলায়েত দান করলাম। তুমি হিন্দুস্থানে যাও এবং আজমির নামক স্থানে দ্বীনের প্রচার কর। আল্লাহ তায়ালা তোমাকে বরকত দান করবেন”। রাওজায়ে পাক থেকে নির্দেশশুনে পরিতৃপ্ত হলেন খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি। পরক্ষণেই চিন্তিত হলেন তিনি। কোথায় আজমির? বিশাল হিন্দুস্হানের কোন দেশে আছে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশিত আজমীর? চিন্তিত অবস্হায় তিনি তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে গেলেন। সেই অবস্হায় তিনি দেখলেন, হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর শিয়রে উপবিষ্ট। তিনি তাঁকে আজমীর শহরের দৃশ্য দেখিয়ে দিলেন। সেই সঙ্গে দিয়ে দিলেন প্রয়োজনীয় পথ নির্দেশনা। এরপর রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর হাতে দিলেন একটি আনার।
চিশতিয়া তরিকা
চিশতিয়া তরিকার প্রতিষ্ঠাতা হলেন হযরত খাজা আবু ইসহাক শামি। বাগদাদের বিখ্যাত এক ওলি ছিলেন হযরত মুমশাদ আল দিনওয়ারী রাহমাতুল্লাহি আলায়হির। তারই শিষ্য হলেন হযরত আবু ইসহাক শামি। তিনি একদিন আবু ইসহাক কে জিজ্ঞেস করলেন তোমার নাম কী? তিনি বলেন,আবু ইসহাক। শায়খ বলেন না, বরং তোমার নাম আবু ইসহাক চিশতী। তোমার বংশধরদের মধ্যে অনাদিকাল জ্বলতে থাকবে চিশতী চেরাগ। উপমহাদেশে সুলতানুল হিন্দ হযরত খাজা গরিবে নেওয়াজ মঈন উদ্দিন হাসান চিশতী সানজরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি হলেন সেই ছিলছিলার একজন মহান ওলি। তিনি ভারতীয় উপমহাদেশে নবীন রাজশক্তির সঙ্গে নতুন ভাবধারা প্রচলনের ক্ষেত্রে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন। খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রাহমাতুল্লাহি আলায়হির সূফী তরীকার মূলনীতি হলো সকলের প্রতি প্রেম-ভালোবাসা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থান। বিশেষ করে গরীব ও অভাবীদের সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে তার তুলনা তিনি নিজেই। এজন্য উনাকে বলা হয় গরীবে নেওয়াজ। পৃথিবীতে সকল তরিকতের উদ্ভব ঘটেছে ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলী রাদিআল্লাহু আনহু হতে। চিশতিয়া তরিকার শাজারা অনুযায়ী রাসূল পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুরু করে হজরত মাওলা আলী শেরে খোদা রাদিআল্লাহু আনহু হয়ে হজরত খাজা মঈন উদ্দিন চিশতী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি হলেন সপ্তদশ খলিফা। খাজা মঈন উদ্দিন চিশতী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি শরিয়তের সকল বিধি-নিষেধ পালনের প্রতি সর্বদা সজাগ থাকতেন। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনোভাবেই শরিয়তের কোনো ব্যত্যয় তিনি সহ্য করতেন না। তিনি ভক্ত-অনুসারীদেরকে শরিয়তের পাবন্দী থাকার জন্য কঠোর নির্দেশ দিতেন। এমনকি চিশতিয়া তরিকার অনুসারীগণ যেন কখনো শরিয়তের বরখেলাপ না করতে পারে, সেই জন্য তার অনুসারীদের পালনীয় একটি অজিফা রচনা করে তাঁরই যোগ্য উত্তরসূরী হজরত খাজা কুতুব উদ্দিন বখতিয়ার কাকী (রহঃ) কে প্রদান করেছিলেন।
ইন্তেকাল
হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ৬৩৩ হিজরীর ৫ই রজব দিবাগত রাত অর্থাৎ ৬ই রজব সুবহে সাদেকের সময় ৯৭ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। ওফাতের সাথে সাথে তাঁর পবিত্র কপাল শরীফে স্পষ্টভাবে আরবীতে স্বর্ণোজ্বল নুরানী অক্ষরে লিখা হয়ে যায় “হাযা হাবীবুল্লাহ মা-তা ফি হুব্বিল্লাহ” অর্থাৎ,ইনি আল্লাহ তাআলার বন্ধু, আল্লাহ তাআলার মুহব্বতেই তিনি বিসাল লাভ করেছেন। (শাহ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী (রাহমাতুল্লাহি আলায়হি), আখবারুল আখয়ার)।
গরীবে নেওয়াজের বড় সাহেবজাদা হযরত খাজা ফখরুদ্দীন চিশতী রাহমাতুল্লাহি আলায়হির তাঁর নামাজে জানাজায় ইমামতি করেন। জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি হযরত খাজা কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার খাকী রহমাতুল্লাহি আলাইহিকে খিলাফতের দায়িত্ব অর্পন করে যান। তিনিই পরবর্তীতে সিলসিলার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখেন। তার প্রচেষ্টায় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চিশতিয়া তরিকতের ব্যাপক প্রসারতা লাভ করে।
লেখক : সিনিয়র শিক্ষক (ইসলাম শিক্ষা), চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল এন্ড কলেজ।