Anjuman-E Rahmania Ahmadia Sunnia Trust

যুগবরেণ্য ইসলামী মনীষী: ইমাম গাজ্জালী

যুগবরেণ্য ইসলামী মনীষী: ইমাম গাজ্জালী

মুফতি মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসান আলকাদেরী>

শরিয়ত-তরিকত ও মারেফাতের অগাধ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি। তিনি যেমন এক অনন্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন, তেমনি ছিলেন অকুতোভয় মনীষী, তরিকতপন্থীদের মধ্যমণি, সুফি সমাজের শিরোমণি। ধর্মতত্ত্বের মর্মোদ্ধারে অতুলনীয় দক্ষ ও বিজ্ঞ দার্শনিক হিসেবে বরেণ্য মুসলিম মনীষী ছিলেন তিনি। তাপসলোকের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক এ মহান মনীষী ৪৫০ হিজরী সনে খোরাসানের তুস নগরে জন্মগ্রহণ করেন।

শিক্ষাজীবন
ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি আলায়হি শৈশবকালেই পিতৃহীন হন, তারপরও লেখা-পড়া চালিয়ে যেতে তেমন অসুবিধা হয়নি। অতি অল্পকালের মধ্যেই পবিত্র কুরআন হিফজ সমাপ্ত করে নিজ শহরের একটি মাদরাসায় ভর্তি হন।
আল্লামা আবু হামিদ আসকারায়েনি, আল্লামা আবু মোহাম্মদ যোবায়লি প্রমুখ মহাজ্ঞানী উস্তাদের নিকট তিনি শিক্ষা লাভ করেন। খ্যাতনামা ফিক্ব্হবিদ আল্লামা আহমদ বিন মোহাম্মদ রাযকানীর নিকট তিনি ফিকহ শাস্ত্রের প্রাথমিক কিতাবসমূহ অধ্যয়ন করেন। তেহরানে শিক্ষা সমাপ্তির পর ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি উচ্চ শিক্ষার জন্য জুরজান শহরে গমন করে হযরত আবু নসর ইসমাঈল রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির তত্ত্বাবধানে শিক্ষা গ্রহণ আরম্ভ করেন। তাঁর তীক্ষè মেধা ও অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় পেয়ে উস্তাদ সর্বশক্তি নিয়োগ করে তাকে শিক্ষাদানে প্রবৃত্ত হন।

নিযামিয়া মাদরাসায় অধ্যয়ন
খোরাসানের অন্তর্গত নিশাপুরে অবস্থিত তৎকালে বিশ্বের সর্বোচ্চ শিক্ষা কেন্দ্র ছিল নিযামিয়া মাদরাসা। সেখানে তিনি বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ আলিম ইমামুল হারামাইন ইমাম আবুল মু‘আলী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির নিকট উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন। হযরত আবুল মা‘আলী এত গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন যে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সুলতানগণও তাঁর নিকট হাজির হতেন উচ্চ শিক্ষা লাভের আশায়। ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি উপযুক্ত শিক্ষক পেয়ে তাঁর তীব্র জ্ঞান পিপাসা মিটাতে লাগলেন। ইমামুল হারামাইনও ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হিকে দর্শন ও জ্ঞানের বিভিন্ন স্তরে খুব আগ্রহের সাথে শিক্ষা দিতে থাকেন।

বায়আত গ্রহণ
তিনি উপলব্ধি করলেন যে, কেবল জাহেরি ইলম অর্জন আল্লাহ প্রাপ্তির জন্য যথেষ্ট নয়। এর জন্য দিব্য জ্ঞানসম্পন্ন উস্তাদের প্রয়োজন। হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, ‘‘আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম থেকে জ্ঞানের দু’টি পাত্র অর্জন করেছি। একটি তোমাদের মাঝে বিতরণ করেছি অন্যটি করিনি। যদি করতাম তবে আমার কণ্ঠদেশ কর্তিত হতো। দ্বিতীয় প্রকার কুরআনের ভাষায় ইলমে তাযকিয়া, হাদিসের ভাষায় ইহসান আর কিতাবের আলোকে তা হচ্ছে ইলমে বাত্বেন তথা আত্মিক জ্ঞান। তাইতো ইমাম মালেক বলেন, যে ব্যক্তি তাসাউফ গ্রহণ করলো কিন্তু ফিকহ গ্রহণ করলো না নিশ্চয় যিন্দিক্ব তথা কাফের। আর যে ব্যক্তি ফিক্বহ গ্রহণ করলো; কিন্তু তাসাউফ গ্রহণ করলো না তিনি নিশ্চয় ফাসেক্ব। আর যিনি উভয় জ্ঞান অর্জন করলেন এবং সেই অনুযায়ী আমল করলেন তিনি মুহাক্কেক বা প্রকৃত দ্বীন গ্রহণ করলেন। কাজেই তিনি তৎকালীন প্রখ্যাত ইলমে তাসাউফধারী বুযুর্গ কামেল ওলী শায়খ আবু আলী ফারমেদী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির হস্তে বায়আত হয়ে দিব্য জ্ঞান আহরণ করতে থাকেন।
ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি যাহেরী জ্ঞান অর্জন করার পর প্রথম দিকে তাসাউফের প্রতি আগ্রহী ছিলেন না।
আল্লাহ্ – রসূলের দয়ায় তিনি তৎকালীন বিখ্যাত ওলী শায়খ ইউসুফ নাসসাজ রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির সাহচর্যে এসে তাসাউফের স্বাদ আস্বাদন করেন। [ইতহাফুস্ সাদাতিল মুত্তাক্বীন, কৃত- ইমাম যুবাইদী, ১:৯]
এতে পরিষ্কার বুঝা যায় সঠিক পথ প্রাপ্তির জন্য কামেল পীরের হাতে বায়আতের মাধ্যমে তরিকত চর্চার বিকল্প নেই। এ জন্য ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এক পর্যায়ে বলেন ইলমে তাসাউফের জন্য কামেল ব্যক্তির হাতে বায়আত গ্রহণ করা ফরযে আইন তথা অপরিহার্য।
[শরহুল হেকাম, কৃত. ইবনু আজিবাহ্, ১:৭]

তাঁর বিখ্যাত কিতাব এহইয়াউ উলুুমুদ্দীন
বহু অমূল্য দ্বীনী গ্রন্থ রচয়িতা ছিলেন ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি। তাঁর লিখিত মূল্যবান গ্রন্থ ‘ইহইয়াউ উলুমুদ্দীন’ বা দ্বীনী ইলমের সঞ্জিবনী সুধা একটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ। তাঁর রচিত এ গ্রন্থে তাঁর অসাধারণ প্রতিভার সুস্পষ্ট ছাপ রয়েছে। এ গ্রন্থের প্রভাবেই ৬ষ্ঠ শতকের সূচনাকালে ইসলামের ইতিহাসে একটা পটপরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। নুরুদ্দীন যঙ্গী, সালাউদ্দীন আইয়ুবী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি প্রমুখ ইসলামের বহু বীর সন্তান যাদের নিয়ে মুসলিম উম্মাহ্ গর্ব করে থাকেন তাঁরা সবাই ছিলেন ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির ভাবশীষ্য, এহইয়াও উলুমুদ্দীন-এর ভক্ত পাঠক।
বিশ্ববরেণ্য মনীষীদের অভিমত
দর্শন, তর্ক, ইলমে কালাম, ধর্মতত্ত্ব, স্বভাব-বিজ্ঞান, নীতি-বিজ্ঞান, আধ্যাত্মিক তত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে তিনি গ্রন্থ রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। তবে তাঁর রচিত এহইয়াউ উলুমুদ্দীন গ্রন্থখানি ইসলামি জগতে বিশেষ সমাদৃত। বিশ্বজোড়া মনীষীগণ এর উচ্চ প্রশংসা করেছেন। এ সম্পর্কে শীর্ষস্থানীয় কতিপয় মনীষীর উক্তি হল ‘‘জগতের সমস্ত জ্ঞান প্রদীপ নির্বাপিত করে দিলে কেবল ‘এহইয়াউ উলুমুদ্দীন’ দ্বারাই ওটা পুনরুদ্ধার করা যাবে। এর পূর্বে এরূপ গ্রন্থ জগতে আর লিখিত হয়নি।

পঞ্চম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ
ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমাজ সংস্কারক ছিলেন পঞ্চম শতাব্দীর বিশ্বখ্যাত আলেম আবু হামিদ গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক অঞ্চলেই তিনি ইমাম গাজ্জালী নামে বেশি পরিচিত। সে সময়ে ইসলামের নামে প্রচলিত ভয়ংকর মতবাদ ও ভ্রান্ত দর্শন মুসলমানদের আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি মূলত সেসবের বিরুদ্ধে কার্যকর বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই করেছিলেন বিধায় তাঁকে হুজ্জাতুল ইসলাম বা ইসলামের দলিল কিংবা ইসলামের সাক্ষ্য উপাধি দেওয়া হয়। গ্রিক দর্শন থেকে শুরু করে শিয়া মতবাদের উত্থান ও জোয়ার সবকিছুর বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। তাজদিদী কার্যকলাপের মাধ্যমে ভ্রান্ত মতবাদকে খ-ন করে সেই সময় মুসলিম মিল্লাতকে বাতিলের কালো হাত থেকে রক্ষা করে ইসলামের পতাকা উড্ডয়ন করেন।
হিজরী ৫০৫ সনে জমাদিউস্ সানী মাসের ১৪ তারিখ সোমবার ফজরের নামায সমাপনান্তে সমগ্র বিশ্বের বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী, অপ্রতিদ্বন্দ্বি দার্শনিক, বিশ্ব মানবতার দিশারী, সূফীকুল শিরমণি, হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ৫৫ বছর বয়সে দুনিয়াবাসীকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে দয়াময় আল্লাহর সান্নিধ্যে হাজির হন। বর্ণিত আছে, অতি প্রত্যুষে শয্যা ত্যাগ করে তিনি অজু করে ফজরের নামায আদায় করেন। অতঃপর পূর্বপ্রস্তুত করা কাফনের কাপড়টি চেয়ে নিজেই পরিধান করে নেন। সেই মুহূর্তেই ইহজগত ত্যাগ করেন মুসলিম মিল্লাতকে চিরঋণী করেন।

লেখক: প্রধান ফকিহ্, কাদেরিয়া তৈয়্যেবিয়া আলিয়া মাদরাসা, মুহাম্মদপুর, ঢাকা।