Anjuman-E Rahmania Ahmadia Sunnia Trust

খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী ’র চারিত্রিক গুণাবলী ও উপদেশসমূহ

খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী ’র চারিত্রিক গুণাবলী ও উপদেশসমূহ

শেখ মুহাম্মদ ইব্রাহীম>

হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহি আলায়হি খুবই সাদাসিধে জীবনযাপন করতেন। তবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত উচ্চতর চিন্তাশক্তির অধিকারী। তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা, কঠোর অধ্যবসায়, অপরিসীম সাহস, সুশৃঙ্খল আত্মনিয়ন্ত্রণবোধ, ধৈর্য, মানবতা, পরোপকারিতা, দানশীলতা, পূতপবিত্র জীবনযাপন পদ্ধতি- এসব গুণের সমন্বয় তাঁকে অভূতপূর্ব সম্মান-মর্যাদা ও অমরত্ব দান করেছে।
তিনি একান্তে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি, ধ্যান ও তপস্যায় কালাতিপাত করতেন। তিনি সকল লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে ছিলেন। তাঁর ছিল না কোনো ক্ষমতার মোহ্, নামের সুখ্যাতি অর্জন, সম্পদের আকাক্সক্ষা। তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টি ব্যতীত অন্য কিছু কামনা করতেন না।
তিনি তাঁর পীরে মুর্শিদ হযরত খাজা উসমান হারুনী রহমাতুল্লাহি আলায়হির একান্ত প্রিয়ভাজন ছিলেন। বস্তুত হযরত খাজা উসমান হারুনী রহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর সম্পর্কে গর্ব করে বলেন, আমাদের মঈনুদ্দীন আল্লাহর একজন প্রিয়পাত্র এবং আমি গর্ব অনুভব করি সে আমারই মুরিদ।
হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহি আলায়হি চারিত্রিক গুণাবলী অর্জনে তাঁর বিভিন্ন ধরনের কার্যকলাপ যথাযথ সহায়তা করেছে।

নামাজের প্রতি একাগ্রতা
তিনি নামাযের প্রতি গভীরভাবে নিমগ্ন হতেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমাদের আল্লাহর প্রতি কৃতার্থ হওয়া উচিত।’ এ কথার মর্মকথা গরীবে নেওয়াজের মধ্যে নিহিত ছিল। তিনি সারা জীবন নামাজ ও ইবাদত-বন্দেগীতে কাটিয়ে দেন। সুদীর্ঘ সত্তর বছর তিনি কখনো বিশ্রাম গ্রহণ করেননি। এমনকি রাতের অবসরকালীন সময়েও। প্রকৃতির টানে সাড়া দেয়া ছাড়া বাকি সময়টুকু তিনি অযু অবস্থায় থাকতেন। সচরাচর তিনি মধ্য রাত্রির অযু দিয়ে সকালের নামায সারতেন। তিনি কোরআনে পাক তেলাওয়াত খুবই পছন্দ করতেন। প্রত্যহ দিনে একবার এবং রাতে একবার কোরআন শরীফ খতম করতেন।
হযরত খাজা গরীবে নেওয়ায রহমাতুল্লাহি আলায়হির মধ্যে দু’ধরনের হালত দেখা যেতো। কখনো তিনি বিষণœভাবে থাকতেন, বিশেষ করে গভীর ধ্যান-মগ্ন অবস্থায়। তিনি এতোবেশি ধ্যানমগ্ন থাকতেন যে, তাঁর চতুর্দিকে কি হচ্ছে তা তিনি অবগত হতেন না। তিনি হুজরা বন্ধ করে দিয়ে ইবাদতে মশগুল হয়ে পড়তেন। আবার মাঝে মাঝে তিনি শাগরেদ, মুরিদ ও ভক্তদের নিয়ে মজলিশে অমূল্য বাণী ও উপদেশ প্রদান করতেন। তিনি রাসূলের সুন্নাত ও আদর্শ যথাযথভাবে পালন করতেন। তাঁর প্রাত্যহিক জীবনে রাসূলের আদর্শ প্রতিফলিত হতো।

তিনি ছিলেন খুবই ক্ষমাশীল, ধৈর্যশীল এবং কঠোর সাধনাকারী। তাঁর ছিলো স্বচ্ছ হৃদয় এবং পূত-পবিত্র মন। কখনো তাঁর অন্তরে খারাপ চিন্তা স্থান পেতো না। তিনি কাউকে আঘাত করতেন না, তাঁর বাক্যালাপের মাধ্যমে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকলের প্রতি ছিলো তাঁর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও নম্রতা। তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিলো সবার থেকে ব্যতিক্রম। তিনি কখনো কারো প্রতি রাগান্বিত হতেন না। তিনি অত্যন্ত দয়ালু ও কোমল হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন। গরিব-দুঃখীদের সাহায্য করতেন। নিরীহ্-অসহায় লোকদের প্রতি তিনি সহযোগিতা ও সান্তনা দিতেন। তাঁর আধ্যাত্মিক রুহানি ফায়েজের বরকতে অনেকে আধ্যাত্মিক জগতের শীর্ষে গমন করেছেন। তিনি

হযরত কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকী রহমাতুল্লাহি আলায়হিকে ‘কুতুবুল আকতাব’ এবং হযরত সুফী হামিদ উদ্দিন নাগোরী রহমাতুল্লাহি আলায়হিকে সুলতান-উৎ-তারেকীন’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তাঁর কাছে আসা দর্শনার্থীদের আরজ অনুযায়ী তাদের জন্য ইহলৌকিক এবং পরলৌকিক মঙ্গলের জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করতেন এবং দোয়া ফলপ্রসূ হতো। তাঁর দরবারে আসলে কেউ খালি হাতে ফেরত যেতো না। তার ফয়ূজাত-এর ধারা অপরিসীম। তাঁর প্রিয় শিষ্যদের মঙ্গলের জন্য তিনি সদা চিন্তিত থাকতেন এবং আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করতেন। একদিন তিনি পবিত্র কাবাগৃহে ইবাদতে মগ্ন আছেন তখন গায়েবি আওয়াজ আসলো: হে মঈনুদ্দীন, আমি তাদের ওপর সন্তুষ্ট হয়ে তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছি এবং তাদেরকে গ্রহণ করেছি। তুমি যা চাও তা আরজ করতে পার। প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, হে পাক পরওয়ারদিগার! মঈনুদ্দীনের তরিকার আধ্যাত্মিক শিষ্যদের প্রশান্তি দাও। সাথে সাথে জবাব এলো, হে মঈনুদ্দীন! আমার প্রিয়পাত্র হিসেবে তোমার আধ্যাত্মিক শিষ্যদের করুণা বর্ষণ করছি এবং কিয়ামত দিবসে তারা তোমার সঙ্গে থাকবে।
তাঁর মুখায়বে সর্বদা দুঃখ ও যাতনা ফুটে উঠতো। হযরত কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকী রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, সুদীর্ঘ বিশ বছর তাঁর খেদমতে কাটানোর পর কখনো শুনিনি নিজের সুখ-শান্তি, সুস্বাস্থ্যের জন্য আরজি পেশ করতে। তিনি বলতেন, ‘হে প্রভু! প্রেমের দুঃখ ও যাতনা এ অধম মঈনুদ্দীনকে প্রদান কর।
তাঁর আধ্যাত্মিক ও পথপ্রদর্শক হযরত খাজা উসমান হারুনি রহমাতুল্লাহি আলায়হি সম্পর্কে যথেষ্ট শ্রদ্ধা পোষণ করতেন। একদিন তিনি কয়েকজন বন্ধুবান্ধব নিয়ে আধ্যাত্মিক জগৎ নিয়ে আলোচনা করছিলেন।
আলোচনাকালীন সময়ে ডান দিকে নজর দিতে তিনি সাথে সাথে দাঁড়িয়ে গেলেন। তাঁকে এমনি বিব্রত অবস্থায় দেখে অন্যরা কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না। এ ব্যাপারে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন, আমার ডানপাশে পীর-মুর্শিদের রওজা-মোবারক অবস্থিত হঠাৎ এ কথা স্মরণ হতেই তিনি আমার সম্মুখে হাজির হলেন, তাঁর তাজিমের জন্য আমি দাঁড়িয়ে গোলাম।
তিনি অত্যন্ত বিনয়ী ও অতিথিপরায়ন ছিলেন। তিনি যে কোনো কাউকে দর্শন করার সাথে সাথে সালাম দিতেন। যে কোনো অতিথিকে হাসিমুখে বরণ করে নিয়ে সেবা করতেন। তিনি সবার দুঃখে আন্তরিকভাবে সমবেদনা জ্ঞাপন করতেন। পুরা আজমীমের গরিব-দুঃখী, অসহায় মানুষেরা তাঁর লঙ্গরখানার ওপর নির্ভরশীল। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ তার লঙ্গরখানায় খাবার খেতো। একদিন তাঁর লঙ্গরখানার পরিচালক ব্যয় নির্বাহের জন্য অর্থ প্রদানের অনুরোধ করলে সাথে সাথে তিনি জায়নামাজের নিচে দেখিয়ে বললেন, ‘প্রতিদিন লঙ্গরখানার ব্যয়-নির্বাহের জন্য যা অর্থের প্রয়োজন তা এখান থেকে নিও।’ তদুপরি তিনি দরবারে উপস্থিত দরবেশের ভাতা প্রদান করতেন। অসহায় কেউ আসলে তিনি তাকে নানা ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা দিতেন।
তাঁর আহার ছিলো খুবই সাদাসিধে। তিনি মনে করতেন, খাওয়ার জন্য বাঁচা নয়, আসলে বাঁচার জন্য খাওয়া। ধ্যানমগ্ন অবস্থায় একাদিক্রমে সাত দিন তিনি কোনো খাদ্যদ্রব্য খেতেন না। এরপর তিনি শুধু পাঁচ তোলা ওজনের বার্লি খেতেন। কদাচিৎ শিকারকৃত পাখির ভুনা গোস্ত খেতেন। তাঁর বেশ-ভূষায় আড়ম্বরতা ছিল না- যা ছিলো নিতান্ত সাধারণ।
তিনি আত্মপ্রচারণা মোটেই সহ্য করতেন না। যে কোনো ভ্রমণে একজন দরবেশকে সাথে নিতেন। তিনি নীরবে-নিভৃতে একাকী থেকে ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকতেন। কোনো জায়গায় অবস্থানকালে প্রচুর লোক সমাগম দেখলে ওখান থেকে সটকে যেতেন। তিনি একজন মহান সাধক ও ধর্মপ্রচারক ছিলেন। তিনি একজন খ্যাতিসম্পন্ন জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব ও বড় মাপের কবি ছিলেন। ফারসি ভাষায় তিনি কাব্য সাধনা করেন।

খাজা গরীবে নেওয়াজের উপদেশসমূহ
হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহি আলায়হি একজন সফল ধর্মপ্রচারক ছিলেন। তিনি সারা জীবন তাঁর মহান বাণী ও উপদেশের মাধ্যমে মানবসমাজকে পথের দিশা দেখিয়েছিলেন। তাঁর অসংখ্য বাণী ও উপদেশ যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়নি। এখানে সামান্য কয়েকটি উল্লেখ করা হলোঃ
হযরত খাজা গরীবে নেওয়াজ রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, সূফী-সাধকদের অনুশোচনার তিনটি স্তর আছে। প্রথমত, ক্ষুধা নিবারণের জন্য স্বল্প খাওয়া, দ্বিতীয়ত, ইবাদত-বন্দেগির জন্য স্বল্প নিদ্রা যাওয়া এবং তৃতীয়ত, সুচারুরূপে নামাজ সমাধানের জন্য কম কথা বলা। প্রথমে ভয়, পরে আশা এবং শেষে ভালোবাসা। মনের ভীতি পাপ পরিহার করতে সাহায্য করে এবং দোযখের আগুন থেকে বাঁচায়। একান্তে ইবাদতে মগ্ন রেখে বেহেশতী সুখ পাবার এবং অমরত্ন দানের আশা জাগায়। প্রেম মানুষকে আল্লাহর সান্নিধ্যে নিয়ে ঐশী সান্ত¦না দেয়।

দোযখের আগুন থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি নিয়মিত করা উচিত। নামাজের মাধ্যমেই আল্লাহকে স্মরণ করা উচিত। নামাজের চেয়ে উত্তম ইবাদত কিছু নেই। নামাজ ব্যতীত আনুষঙ্গিক অন্য ধর্মীয় কার‌্যাবলী সমাধা করা উচিত। তাছাড়া, দরিদ্র, অসহায়, এতিম-মিসকিনদের সাহায্য করা, নির্যাতিত নিপীড়িতদের সহায়তা দান করা, ক্রীতদাসদের মুক্ত করে দেয়া, সৎভাবে জীবনযাপন করা, নানা ধরনের গর্হিত কাজ থেকে মুক্ত থাকা, অন্তরকে পাপ-পঙ্কিলতার ঊর্ধ্বে রাখা- এ ধরনের বিষয়াদির প্রতি হযরত খাজা গরীবে নেওয়াজ রহমাতুল্লাহি আলায়হি খুবই গুরুত্ব দিতেন এবং সেভাবে পালন করতেন।

এ উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারে আতায়ে রসূল, গরীব নেওয়াজ হযরত খাজা মইনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহি আলায়হির অবদান অপরিসীম। প্রতিদিন ভারতের আজমীর শরীফে তাঁর মাযারে ভক্তি-শ্রদ্ধা জানাতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অগণিত মানুষ হাজির হয় তাঁর রূহানী ফয়েজ হাসিলের জন্য। এ মহান আধ্যাত্মিক সাধক ৬৩৩ হিজরির ৬ রজব দিবাগত রাতে এশার নামায পড়ে তাঁর হুজরা শরীফে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দিলেন। অসুস্থ শরীর নিয়েও তিনি সারারাত ইবাদত বন্দেগীতে মশগুল ছিলেন। ঐদিন রাতের শেষ ভাগে তাঁর কাছে রাব্বুল আলামীনের পক্ষ হতে ইনতিকালের ডাক এসে পড়লো। পরম বন্ধু আল্লাহ্ তা‘আলার পবিত্র সান্নিধ্যে লাভের আশায় তাঁর হৃদয় উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। অতঃপর এক শুভসন্ধিক্ষণে সুবহে সাদিকের পূর্বে তিনি মহান আল্লাহ্ পাকের দরবারে হাজির হলেন।
এ মহান আধ্যাত্মিক সাধকের প্রদর্শিত পথে আমাদের চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক: গবেষক, বহু গ্রন্থ প্রণেতা, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (ভারপ্রাপ্ত), প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রাম।