ব্যাংকে জমাকৃত টাকার সুদ ও মুনাফার ইসলামি বিধান
মাওলানা মুহাম্মদ সরওয়ার উদ্দিন ক্বাদেরী>
নগদ টাকা-পয়সা ও মূল্যবান জিনিসপত্র নিজের কাছে সংরক্ষিত রাখা মোটেও নিরাপদ নয়। হেফাজতে রাখার জন্য ব্যাংকই একমাত্র নিরাপদ ও আস্থার ঠিকানা। বর্তমান বিশ্বব্যাপী প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সুদ প্রথা অতি সাধারণ ও সচরাচর বিষয়। একইভাবে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধীনে পরিচালিত সরকারী ও বেসরকারী অনেক ব্যাংকে সুদের বিষয়টি সুস্পষ্ট। ইসলামী শরীয়তে সুদ প্রথা সম্পূর্ণরূপে হারাম। আবার “শরীয়া ভিত্তিক পরিচালিত” শ্লোগানে পরিচালিত কতিপয় ব্যাংক সুদের পরিবর্তে “মুনাফা” শব্দ ব্যবহার করে গ্রাহকের দৃষ্টি আকর্ষণের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এমতাবস্থায় আমাদের দেশের সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন ব্যাংকের সেভিংস ও মেয়াদী একাউন্টে গ্রাহকের জমাকৃত টাকার উপর প্রদেয় সুদ ও মুনাফার ইসলামি বিধান সম্পর্কে কুরআন-সুন্নাহর দালিলিক সমাধান উপস্থাপনের প্রয়াস পাব আলোচ্য নিবন্ধে।
رِبَا (সুদ) এর আভিধানিক ও পারিভাষিক পরিচিতি
اَلرِّبَا فِىْ اللُّغَةِ اَلزِّيَادَةُ অর্থাৎ رِبَا (রেবা) এর শাব্দিক অর্থ হলো- অতিরিক্ত নেয়া।
আল্লামা যাস্সাস ‘আহকামুল কুরআন’ গ্রন্থে বলেন,مُطْلَقًا اَلرِّبَا فِىْ اللُّغَةِ اَلزِّيَادَةُ অর্থাৎ অভিধানেرِبَا (রেবা) অর্থ- সচরাচর বাড়তি নেয়া।
১. ইসলামি শরীয়তের পরিভাষায়-
وَ فِىْ الشَّرْعِ عِبَارَةٌ عَنْ فَضْلِ مَالٍ لَا يُقَابِلُهُ عِوَضٌ فِيْ مُعَاوَضَةِ مَالٍ بِمَالٍ
অর্থাৎ ‘শরীয়তের পরিভাষায় সুদ এমন অতিরিক্ত মালকে বুঝায়, যা মালের বিনিময়ে মাল নেয়ার সময় বিনিময় বিহীন গ্রহণ করা হয়।
২. আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী (রহ.) বলেন,
هُوَ فَضْلُ مَالٍ عَنْ عِوَضٍ فِىْ مُعَاوَضِ مَالٍ بِمَالٍ .
অর্থাৎ সুদ হচ্ছে মালের বিনিময়ে মাল নেয়ার সময় অতিরিক্ত গ্রহণ করা।
৩. ইবনুল আছীরের মতে-
هُوَ الزِّيَادَةُ عَلى أَصْلِ الْمَالِ مِنْ غَيْرِ عَقْدِ تَبَايُعٍ.
অর্থাৎ ব্যবসায়িক চুক্তি/লেনদেন ব্যতীত মূলধনের উপর অতিরিক্ত গ্রহণ করাকে সুদ বলে।
৪. ‘আহকামুল কুরআন’ নামক গ্রন্থে রয়েছে-
وَ فِىْ الشَّرْعِ زِيَادَةٌ يَأْخُذُهَا الْمُقْرِضُ مِنَ الْمُسْتَقْرَضِ مُقَابِلَ الْأَجْلِ
অর্থাৎ “ ইসলামি শরীয়তের পরিভাষায়- ঋণদাতা ঋণ গ্রহীতা হতে সময়ের বিনিময়ে অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করাকে সুদ বলে।” উপরোল্লিখিত আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থ হতে স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, কোন জিনিস ঋণ হিসাবে অন্যকে প্রদান করে অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করা সুদের অন্তর্ভূক্ত।
مُنَافِعٌ (মুনাফা) এর আভিধানিক ও পারিভাষিক পরিচিতি
اَلْمُنَافِعُ فِىْ اللَّغَةِ اَلْفَائِدَةُ অর্থাৎ অভিধানে ‘মুনাফা’ শব্দের অর্থ হলো- লাভ, কল্যাণ, উপকারিতা, সুবিধা ইত্যাদি। পরিভাষায় ‘মুনাফা’ বলা হয়-
هُوَ الزِّيَادَةُ الَّتِىْ تُحْصَلُ فِىْ الْبَيْعِ وَالشِّرَاءِ عَلى الْمُبِيْعِ أَوِ الزِّيَادَةُ عَلى أَصْلِ الْمَالِ بِطَرِيْقِ التِّجَارَةِ عَلى سَبِيْلِ التَّرَاضِىْ
অর্থাৎ পারষ্পরিক সন্তুষ্টি সাপেক্ষে ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে বিক্রিত বস্তু বা মূলধনের উপর অর্জিত অতিরিক্ত অর্থকে মুনাফা বলে।
অথবা, أَوِ الزِّيَادَةُ مَا يَحْصُلُ الْاِنْسَانُ بِتَصَرُّفِ الْوَقْتِ
وَالْمِهْنَةِ وَالْعَقْلِ فِىْ التِّجَارَةِ بِإِخْتِلَافِ الْاَجْنَاسِ
ভিন্ন প্রকৃতির বস্তু ক্রয়-বিক্রয়ে কায়িক পরিশ্রম, সময় ব্যয় ও মেধা খরচের বিনিময়ে মানুষ যে অতিরিক্ত লাভ অর্জন করে, তাকে মুনাফা বলে।
সুদ ও মুনাফা (رِبَا وَ مُنَافِعٌ ) এর পার্থক্য
আল্লাহ পাক বেচা-কেনাকে হালাল করেছেন আর সুদকে হারাম করেছেন। মহান আল্লাহর এই ঘোষণা দ্বারা رِبَا وَ مُنَافِعٌ (সুদ ও মুনাফা) এর মধ্যে পার্থক্য সুষ্পষ্ট হয়ে গেল। কারণ, কায়িক পরিশ্রম, সময় ব্যয় ও মেধা খরচ করে যে অতিরিক্ত লাভ অর্জিত হয়, তাকে মুনাফা বলে। পক্ষান্তরে মাল এর বিনিময়ে অতিরিক্ত মাল গ্রহণ করাকে সুদ বলে।
সুদ হারাম হওয়ার বিষয়ে পবিত্র কুরআনের দলীল
আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন,
الَّذِينَ يَأْكُلُونَ الرِّبَا لَا يَقُومُونَ إِلَّا كَمَا يَقُومُ الَّذِي يَتَخَبَّطُهُ الشَّيْطَانُ مِنَ الْمَسِّ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا إِنَّمَا الْبَيْعُ مِثْلُ الرِّبَا وَأَحَلَّ اللهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا فَمَنْ جَاءَهُ مَوْعِظَةٌ مِنْ رَبِّهِ فَانْتَهَى فَلَهُ مَا سَلَفَ وَأَمْرُهُ إِلَى اللهِ وَمَنْ عَادَ فَأُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
অর্থাৎ যারা সুদ খায় তারা তাদের কবর থেকে এমনভাবে উঠবে, যেভাবে শয়তানের আছর (প্রভাব) দ্বারা মাতাল হয়ে উঠে। এটা এ জন্য যে, তারা বলে বেচা-কেনা সুদের মত, অথচ আল্লাহ তাআলা বেচা-কেনা হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন। অত:পর যার নিকট তার পালনকর্তার কাছ থেকে উপদেশ এসেছে এবং সে বিরত হয়েছে, পূর্বে যা হয়ে গেছে, তা তার। (তার ব্যাপারটি আল্ল¬াহর উপর নির্ভরশীল)। আর যারা পুনরায় সুদ নেয় তারা জাহান্নামী। তারা সেখানে চিরকাল অবস্থান করবে।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَذَرُوا مَا بَقِيَ مِنَ الرِّبَا إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ فَإِنْ لَمْ تَفْعَلُوا فَأْذَنُوا بِحَرْبٍ مِنَ اللهِ وَرَسُولِهِ وَإِنْ تُبْتُمْ فَلَكُمْ رُءُوسُ أَمْوَالِكُمْ لَا تَظْلِمُونَ وَلَا تُظْلَمُونَ .
অর্থাৎ হে ঈমানদার! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আর যত সুদ তোমাদের বাকী রয়ে গেল তা বাদ দাও। যদি তোমরা মু’মিন হও। অত:পর যদি তোমরা এটা না কর তোমাদের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ হতে যুদ্ধের ঘোষণা রইল। আর যদি তাওবা করে নাও তবে তোমাদের মূলধন পাবে। যাতে অন্যের উপর তোমরা জুলুম না কর আর অন্যরাও তোমাদের উপর যুলুম না করে। আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে অন্যত্র এরশাদ করেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَأْكُلُوا الرِّبَا أَضْعَافًا مُضَاعَفَةً وَاتَّقُوا اللهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ .
অর্থাৎ হে ঈমানদার! তোমরা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খেয়ো না। আর আল্লাহকে ভয় কর। যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে আরো এরশাদ করেন,
وَمَا آتَيْتُمْ مِنْ رِبًا لِيَرْبُوَ فِي أَمْوَالِ النَّاسِ فَلَا يَرْبُو عِنْدَ اللَّهِ وَمَا آتَيْتُمْ مِنْ زَكَاةٍ تُرِيدُونَ وَجْهَ اللهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُضْعِفُونَ .
অর্থাৎ সুদ হিসাবে তোমরা যা কিছু দিয়েছ মানুষের ধন-সম্পদ বর্ধিত হওয়ার জন্য, তা আল্লাহর দরবারে বর্ধিত হয় না। আর তোমরা যা যাকাত দিয়েছ তাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি চেয়েছো, তা তাদের ধন সম্পদকে দ্বিগুণকারী।
সুদ হারাম হওয়ার বিষয়ে হাদীস শরীফের দলীল
হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে,
১. عَنْ جَابِرٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ لَعَنَ رَسُوْلُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ آكِلَ الرِّبوا أَوْ مَوْكِلَهُ وَكَاتِبَهُ وَ شَاهِدَيْهِ وَقَالَ هُمْ سَوَاءٌ.
অর্থাৎ খাদেমে রাসূল হযরত জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুদ দাতা, গ্রহীতা, সুদ সংক্রান্ত লেখক ও তার দুই সাক্ষীর উপর লা‘নত (অভিসম্পাত) করেছেন। তিনি আরো বলেন, অপরাধী হিসাবে তারা সবাই সমান।
২. عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَيَأْتِيَنَّ عَلَى النَّاسِ زَمَانٌ لَا يَبْقى أَحَدٌ إِلَّا أَكَلَ الرِّبوا فَإِنْ لَّمْ يَأْكُلْهُ أَصَابَهُ مِنْ بُخَارِه قَالَ إِبْنُ عِيْسى : أَصَابَه مِنْ غُبَارِهِ .
অর্থাৎ প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, হুজুর আকরম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, হে লোক সকল! তোমরা মানবজাতির সম্মুখে এমন এক সময় আসবে, সুদ খাওয়া ব্যতিরেকে কেউ বাকী থাকবে না। আর সে যদি না ও খায় তার নিকট সুদের ধোঁয়া হলেও লাগবে। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, সুদের ধুলাবালি হলেও লাগবে। অর্থাৎ হয়ত সুদ দেবে অথবা সাক্ষী হবে নতুবা লিখক হবে নতুবা এ ব্যাপারে সাহায্য করবে নতুবা সুদীর বাড়ীতে দাওয়াত খাবে, অথবা সুদীর হাদিয়া গ্রহণ করবে।
৩. عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ حَنْظَلَةَ غَسِيْلِ الْمَلَائِكَةِ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ دِرْهَمٌ رِبوا يَأْكُلُهُ الرَّجُلُ وَهُوَ يَعْلَمُ أَشَدُّ مِنْ سِتَّةِ وَّثَلَاثِيْنَ زِنْيَةٍ.
প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ বিন হানযালা (যাকে ফেরেস্তা কর্তৃক গোসল দেয়া হয়েছিল) রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলে আকরম সাল্ল¬াল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, কেউ যদি জেনে-শুনে এক দিরহাম সুদ গ্রহণ করে তা ছত্রিশবার ব্যভিচারের চেয়েও মারাত্মক গুনাহ।
৪. عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اَلرِّبوا سَبْعُوْنَ جُزْءًا أَيْسَرُهّا أَنْ يَنْكَحَ الرَّجُلُ أُمَّهُ.
হযরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, সুদের মধ্যে সত্তরটি গুনাহ রয়েছে। তম্মধ্যে সহজতম গুনাহ হলো তার মায়ের সাথে ব্যভিচার করা।
৫. عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ آتَيْتُ لَيْلَةً أُسْرِىَ بِيْ عَلي قَوْمِ بُطُوْنِهِمْ كَالْبُيْوْتِ فِيْهَا حَيَّاتٌ تُرى مِنْ خَارِجِ بُطُوْنِهِمْ ، فَقُلْتُ مَنْ هَؤُلآءِ يَاجِبْرَائِيْلُ! قَالَ هَؤُلآءِ أُكْلَةُ الرِّبوا .
সাইয়্যেদুনা আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, সরকারে দো আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, আমি মে’রাজ রজনীতে এমন এক গোত্রের পাশ দিয়ে গেলাম, যাদের পেট ঘরের মত বড় বড়, যাতে সাপ রয়েছে, যা পেটের বাহির হতে দেখা যাচ্ছে। অত:পর আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে জিবরাইল! এরা কারা? উত্তরে তিনি বললেন, এরা হলো সুদখোর।
হযরত উমর বিন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, সুদের সম্পর্ক ছেড়ে দাও। এমনকি সুদের সন্দেহ যেখানে হয় তাও পরিত্যাগ কর। উপরোল্লি¬খিত আয়াতে ও হাদীসের আলোকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সুদ হারাম প্রমাণিত হয়।
ইসলামে হালাল উপার্জনের বৈধ পন্থাসমূহ
ইবাদত কবুলের পূর্বশর্ত হচ্ছে হালাল উপার্জন। হালাল উপার্জনের উপর নির্ভর করা এবং হারাম উপার্জন বর্জন করা সকল ঈমানদারের উপর ফরযে আইন। হালাল উপার্জনের পন্থাসমূহ হচ্ছে- ১.শারীরিক শ্রম ২.কৃষিকাজ ৩.ব্যবসা-বাণিজ্য ৪.চাকরি ইত্যাদি। তাছাড়া হালাল উপার্জনের অন্যান্য অবলম্বন হচ্ছে গবাদি পশুপালন, হাঁস, মুরগী ও গরুর খামার, মৎস্য চাষ, বৃক্ষ রোপন, ছোট, বড় ও মাঝারি সাইজের নার্সারি, কুটির শিল্প, ফলের বাগান ইত্যাদির মাধ্যমে আত্ম কর্মসংস্থান। এতে যেমন আত্ম কর্মসংস্থান ও হালাল উপার্জনের ব্যবস্থা হয়, তেমনি দেশেরও উন্নতি হয়। আর হালাল উপার্জনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হ’ল বৈধ পন্থায় ব্যবসা-বাণিজ্য করা। কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তা‘আলা ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসঙ্গে তিজারাহ (تِجَارَةٌ), বায়উন (بَيْعٌ), শিরা (شِرَاءٌ) এ তিনটি শব্দ ব্যবহার করেছেন। উল্লেখ্য যে, পাঁচটি পদ্ধতিতে ব্যবসা-বাণিজ্য করলে তা হালাল হিসাবে ইসলামী শরী‘আত কর্তৃক অনুমোদিত হয়। যেমন: ১.বায়‘উল মুরাবাহাহ্ ২.বায়‘উল মুয়াজ্জাল ৩.বায়‘উস সালাম ৪.বায়‘উল মুদ্বারাবা ৫.বায়‘উল মুশারাকা।
শরীয়ত সম্মত পাঁচ প্রকার হালাল ব্যবসার সংক্ষিপ্ত বিবরণ
১.বায়‘উল মুরাবাহাহ্: লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে নগদ মূল্যে ক্রয়-বিক্রয়ের একক ব্যবসা।
২.বায়‘উল মুয়াজ্জাল: ভবিষ্যতে নির্ধারিত কোন সময়ে একসাথে অথবা কিস্তিতে উভয় পক্ষের সম্মতিতে মূল্য পরিশোধের শর্তে ক্রয়-বিক্রয়।
৩.বায়‘উস সালাম: ভবিষ্যতে নির্ধারিত কোন সময়ে সরবরাহের শর্তে এবং তাৎক্ষণিক উপযুক্ত মূল্য পরিশোধ সাপেক্ষে নির্দিষ্ট পরিমাণ শরী‘আত অনুমোদিত পণ্য সামগ্রীর অগ্রিম ক্রয়-বিক্রয়।
৪.বায়‘উল মুদ্বারাবা: এক পক্ষের মূলধন এবং অপরপক্ষের দৈহিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রমের সমন্বয়ে যৌথ ব্যবসা। এ পদ্ধতিতে লভ্যাংশ তাদের মাঝে চুক্তিহারে বণ্টিত হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খাদীজা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার মূলধন দ্বারা এরূপ যৌথ ব্যবসা করেছিলেন। ছাহাবায়ে কেরাম অনেকেই এ পদ্ধতিতে ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন। মুদ্বারাবায় যে ব্যক্তি পুঁজির যোগান দেয় তাকে ছাহিবুল মাল (صَاحِبُ الْمَالِ) বা রাববুল মাল (رَبُّ الْمَالِ) এবং শ্রমদানকারী তথা ব্যবসা পরিচালককে মুদ্বারিব (مُضَارِبٌ) বা উদ্যোক্তা বলা হয়। এখানে ছাহিবুল মাল-এর পুঁজি হচ্ছে ব্যবসায় প্রদত্ত অর্থ-সম্পদ আর মুদ্বারিবের পুঁজি হচ্ছে দৈহিক ও বুদ্ধিভিত্তিক শ্রম। মুদ্বারাবা কারবারে লাভ হ’লে ব্যবসায় শুরুতে কৃত চুক্তির শর্তানুসারে ছাহিবুল মাল এবং মুদ্বারিব উভয়েই উক্ত লাভ ভাগ করে নেয়। পক্ষান্তরে ব্যবসায় লোকসান হ’লে সম্পূর্ণ লোকসান কেবল ছাহিবুল মাল তথা পুঁজি বিনিয়োগকারীকেই বহন করতে হয়। আর এ ক্ষেত্রে মুদ্বারিবের ব্যয়িত শ্রম, বুদ্ধি ও সময় বৃথা যায়। মুদ্বারিব কোন লাভ পায় না এটাই তার লোকসান। তবে ব্যবসা পরিচালনায় মুদ্বারিবের অবহেলা কিংবা চুক্তির শর্ত ভঙ্গের কারণে লোকসান হ’লে সে ক্ষেত্রে লোকসানের দায়ভার মুদ্বারিবকেই বহন করতে হবে। কেননা, এ ক্ষেত্রে পুঁজির মালিকের কোন ভূমিকা থাকে না।
৫.বায়‘উল মুশারাকা : মূলধন ও লভ্যাংশের ব্যাপারে দুই বা ততোধিক অংশীদারের মধ্যকার চুক্তি অনুসারে ব্যবসা। মুশারাকা পদ্ধতিতে ব্যবসায় লাভ হ’লে অংশীদারগণ পূর্ব নির্ধারিত অনুপাতে তা ভাগ করে নেয়। আর লোকসান হ’লে অংশীদারগণ নিজ নিজ পুঁজির আনুপাতিক হারে তা বহন করে। জীবন রক্ষার জন্য আমাদের রিযিকের প্রয়োজন। আর রিযিক অর্জন করতে হয় অনুসন্ধানের মাধ্যমে। তাই প্রতিটি মানুষ নিজ নিজ যোগ্যতা অনুযায়ী পরিশ্রম ও বিভিন্ন তদবীরের মাধ্যমেই রিযিক অনুসন্ধান করে থাকে। রিযিক অনুসন্ধান করার জন্য আল্লাহ পাকের নির্দেশিত পন্থা রয়েছে। ইসলামে বৈধ পন্থায় সম্পদ অর্জন জায়েজ ও হালাল এবং অবৈধ পন্থায় সম্পদ অর্জন নাজায়েজ ও হারাম। ইসলামী জীবন পরিচালনার লক্ষ্যে প্রতিটি ঈমানদার-মুসলমানের জন্য আল্লাহ পাকের নির্দেশিত বৈধ পন্থায় হালাল সম্পদ উপার্জনের কোন বিকল্প নেই। [আগামী সংখ্যা সমাপ্য]
টীকা:
হাশিয়ায়ে কুদূরী
আইনী, কেফায়া
আল্লামা যাস্সাস ‘আহকামুল কুরআন’
আধুনিক আরবি-বাংলা অভিধান কৃত: ড. ফজলুর রহমান
সূরা আল বাকারা : ২৭৫
সূরা আল বাকারা : ২৭৮-২৭৯
সূরা আলে ইমরান : ১৩০
সূরা রূম : ৩৯
মুসলিম শরীফ ও মিশকাত শরীফ, পৃ: ২৪৪
আবু দাউদ, হাদিস নং ৩৩৩১
আহমদ, দারা কুতনী, মিশকাত শরীফ, পৃ: ২৪৬
ইবনে মাজাহ, বায়হাকী ও মেশকাত, পৃ: ২৪৬
আহমদ, ইবনে মাজাহ, মিশকাত, পৃ: ২৪৬
ইবনে মাজাহ ও দারেমী
মুসলিম, মিশকাত হা/২৭৬০
আব্দুর রহমান আল-জাযায়রী, কিতাবুল ফিকহ আলাল মাযাহিবিল আরবা‘আহ (বৈরুত : দারুল ইলামিয়্যাহ, তা.বি), ৩/৩৪; শাহ ওয়ালী উল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা (বৈরুত : দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, তা.বি.) ২/১১৬
মুওয়াত্তা হা/২৫৩৫, দারাকুৎনী হা/৩০৭৭, ইরওয়াউল গালীল হা/১৪৭২, ৫/২৯২ পৃঃ; বুলূগুল মারাম হা/৮৯৫
ইমাম শামসুদ্দীন আস-স,রাখসী, আল-মাবসূত (বৈরুত : দারুল মা‘রিফাহ, ১৪১৪ হিঃ/১৯৯৩ ইং), ২২/১৮ পৃঃ
আলী আল-খাফীফ, আশ-শিরকাতু ফী ফিকহিল ইসলামী (কায়রো : দারুন নশর, ১৯৬২ ইং), ৭৪ পৃঃ
সা‘দী আবু হাবীব, আল-কামূসুল ফিকহ (পকিস্থান : ইদারাতুল কুরআন ওয়াল উলূমিল ইসলামিয়্যাহ, তাবি), ১৯৫ পৃঃ; মুফতী মুহাম্মাদ তাক্বী উছমানী, অনুঃ মুফতী মুহাম্মাদ জাবের হোসাইন, ইসলামী ব্যাংকিং ও অর্থায়ন পদ্ধতি : সমস্যা ও সমাধান, (ঢাকা : মাকতাবাতুল আশরাফ, ২০০৫ ইং), ২৭ পৃঃ।
আবুদাঊদ হা/৪৮৩৬, সনদ ছহীহ, বুলূগুল মারাম হা/৮৭০, নায়লুল আওত্বার হা/২৩৩৪-৩৫
লেখক: মুহাদ্দিস, গহিরা এফ. কে. জামেউল উলূম বহুমুখী কামিল মাদরাসা, রাউজান, চট্টগ্রাম।