Anjuman-E Rahmania Ahmadia Sunnia Trust

কবিরা গুনাহ : ভয়াবহ পরিণতি-১

কবিরা গুনাহ : ভয়াবহ পরিণতি-১

মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ্ আল-মাসুম >

গুনাহ্ হলো শরিয়তের আদেশ-নিষেধ লঙ্ঘন করা, অবহেলা করা ও আদেশ অমান্য করা। গুনাহ্-পাপ বা অপরাধ ছোট হোক কিংবা বড় হোক, তা সর্বদা বর্জনীয়। মাত্রাভেদে ও পরিণতির ভিত্তিতে ক্বোরআন ও সুন্নাহর আলোকে পাপকে সগিরা ও কবিরা দুই ভাগে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। ইরশাদ হচ্ছে-
إِنْ تَجْتَنِبُوْا كَبَائِرَ مَا تُنْهَوْنَ عَنْهُ نُكَفِّرْ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَنُدْخِلْكُمْ مُدْخَلًا كَرِيمًا-
অর্থাৎ ‘তোমাদিগকে যা নিষেধ করা হয়েছে, তার মধ্যে যা গুরুতর, তা থেকে বিরত থাকলে তোমাদের লঘুতর পাপগুলো (সগিরা গুনাহসমূহ) মোচন করব এবং তোমাদিগকে সম্মানজনক স্থানে দাখিল করব।’ পরিভাষায় যাকে সগিরা গুনাহ বলা হয়, প্রকৃতপক্ষে সেগুলোও ছোট গুনাহ নয়। যে কোন অবস্থায়ই আল্লাহর নাফরমানি ও তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করা অত্যন্ত কঠিন অপরাধ। তবে কবিরা ও সগিরার যে পার্থক্য, তা শুধু তুলনামূলক। যে গুনাহর জন্য পার্থিব জীবনে হদ বা শাস্তি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে, যেমন-নিরপরাধ মানুষ হত্যা, ব্যভিচার, চুরি ইত্যাদি; কিংবা যে পাপের জন্য পরকালে জাহান্নাম বা আল্লাহর ক্রোধ কিংবা অভিসম্পাতের কারণ বলে ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে, যেমন-সুদ খাওয়া, মাতা-পিতার অবাধ্য হওয়া ইত্যাদি উভয় পাপই কবিরা গুনাহ। আর যেসব পাপের ব্যাপারে কোন শাস্তি, আল্লাহর ক্রোধ বা অভিশাপের কথা বলা হয়নি; বরং শুধুই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, সেগুলোকে বলা হয় সগিরা গুনাহ। তবে সেসব গুনাহও কবিরা গুনাহর অন্তর্ভুক্ত হবে, যার অনিষ্ট ও পরিণতি কোনো কবিরা গুনাহর অনুরূপ কিংবা তার চেয়েও অধিক। আবার যেসব ছোট গুনাহ নির্ভয়ে করা হয় কিংবা নিয়মিতভাবে করা হয়, সেগুলোও কবিরা গুনাহর অন্তর্ভুক্ত হবে। আর কোনো ছোট পাপকে হালকা মনে করাও কবিরা গুনাহ বা বড় পাপ। ইমাম গাজ্জালি রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, প্রতিটি গুনাহ তার চেয়ে বড় ও ওপরের স্তরের গুনাহর হিসেবে সগিরা বা ছোট গুনাহ। আবার কোন গুনাহ তার চেয়ে ছোট ও নিচের স্তরের গুনাহর বিবেচনায় কবিরা গুনাহ। এ নিবন্ধে হাদীস শরীফ থেকে প্রাপ্ত কবিরা গুনাহগুলো ধারাবাহিক আলোকপাত করার প্রয়াস পেলাম।

কবিরা গুনাহের পরিণতি
কবিরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে পারলে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। একটি কবিরা গুনাহই জাহান্নামে নেয়ার জন্য যথেষ্ট। পরকালে জাহান্নাম ছাড়াও কবিরা গুনাহের দুনিয়াবী অনেক ক্ষতি রয়েছে। তন্মধ্যে কয়েকটি নি¯œরূপ- ১. রিজিক কমে যায়; ২. ইলম থেকে বঞ্চিত হতে হয়; ৩. হায়াতে বরকত কমে যায়। কিছু দিন পর গুনাহের প্রতি ঘৃণা অন্তর থেকে চলে যায়; ৪. সবচেয়ে ভয়াবহ ক্ষতি হচ্ছে, ঈমানহারা হয়ে মৃত্যুর সম্ভাবনা রয়েছে, (আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন)। মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘(আখিরাতের) গুরু শাস্তির আগে (দুনিয়ায়ও) তাদের আমি লঘু শাস্তির আস্বাদন করাব, যাতে তারা ফিরে আসে।’

কবিরা গুনাহের সংখ্যা
ক্বোরআন -হাদীস পর্যালোচনা করলে ১৪১টির অধিক কবিরা গুনাহ চিহ্নিত হয়। আল্লামা ইবনে হাজর হাইসামি রহমাতুল্লাহি আলাইহি ‘আয-যাওয়াজ’ নামক গ্রন্থে কবিরা গুনাহ ৪৬৭টি বলে উল্লেখ করেছেন। এ ব্যাপারে মনে রাখা অবশ্যক যে, ছোট সংখ্যা বড় সংখ্যাকে অস্বীকার করে না। ছোট সংখ্যাটির ওপর ভর করেই বড় সংখ্যাটির পরিচিতি বিস্তৃতি লাভ করে। সুতরাং কুরআন ও হাদীসে উল্লিখিত সংখ্যা দ্বারা সংখ্যার সীমাবদ্ধতা উদ্দেশ্য নয় বরং এর দ্বারা সতর্ক করাই উদ্দেশ্য। এ বিষয়ে হযরত আবু বাকরাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলে আরবি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে সবচেয়ে বড় (কবিরা) গুনাহ সম্পর্কে সংবাদ দেবো না?’ রাসূলুল্লাহ তিনবার একথা বললেন। আমরা বললাম, ‘‘অবশ্যই, হে আল্লাহর রাসূল।’’ তিনি বললেন, ‘‘আল্লাহর সাথে শরীক করা, মাতা-পিতার নাফরমানী করা, তিনি হেলান দেয়া অবস্থায় ছিলেন, তারপর উঠে বসলেন এবং বললেন, সাবধান! মিথ্যা কথা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া।’’ এ প্রসঙ্গে আব্দুল্লাহ্ ইবনে আমর ইবনে ‘আস্ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলে আরবি৯ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
الْكَبَائِرُ: الإِشْرَاكُ بِاللهِ، وَالْيَمِيْنُ الْغُمُوْسُ، وَعُقُوْقُ الْوَالِدَيْنِ، وَقَتْلُ النَّفْسِ-
অর্থাৎ ‘কবীরা গুনাহ্গুলো হচ্ছে, আল্লাহ্ তাআলার সাথে কাউকে শরীক করা, ইচ্ছাকৃত মিথ্যা শপথ করা, মাতা-পিতার অবাধ্য হওয়া এবং অবৈধভাবে কাউকে হত্যা করা’’। উপরোক্ত পাঁচটি কবিরা গুনাহ নি¤েœ বিশদ ভাবে তুলে ধরা হল।

১. শির্ক
আল্লামা রাবেগ ইস্পাহানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর ‘মুফরাদাত’ গ্রন্থে বলেন, শিরকের অর্থ- দু’সত্বাধিকারের সংমিশ্রণ, সমকক্ষ স্থির করা ইত্যাদি। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায়- কোনো জিনিসকে আল্লাহর সত্তা, গুণ অথবা কোনো কর্মের সাথে অংশীদার সাব্যস্ত করাকে শির্ক বলা হয়। এক কথায় আল্লাহ তা‘আলা বা তাঁর গুণাবলীতে কাউকে অংশীদার মনে করা। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর ক্ষমতায় অন্য কারো অংশীদারিত্ব সাব্যস্ত করে তাকে বলা হয় মুশরিক। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ-
অর্থাৎ ‘আল্লাহ তাঁর সাথে শির্ক করার গুনাহ মাফ করবেন না। শির্ক ছাড়া অন্যান্য যে সব গুনাহ রয়েছে সেগুলো যাকে ইচ্ছা মাফ করে দিবেন।’

শিরক প্রধানত দুই প্রকার।
প্রথমত- শির্কে আকবর : আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরিক সাব্যস্ত করা। এটি চার ভাগে বিভক্ত। যথা- ক. সত্তাগত শির্ক : আল্লাহর সত্তার মত কাউকে বা কোন শক্তিকে মনে করা। খ.গুণগত শির্ক : আল্লাহ তা‘আলার গুনাবলির মতো অন্য কারো গুনাবলি আছে এ আকিদা পোষণ করা। গ. আইনগত শির্ক : আল্লাহর অধিকারে কাউকে শরিক করা। সৃষ্টি জগতের পরিচালনায় আইন প্রণয়ণের অধিকারে আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করা। ঘ.ইবাদতের মধ্যে আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করা। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামার নাফরমানী করে কোনো মাখলুকের আনুগত্য করা।
দ্বিতীয়ত- শির্কে আসগর : ইবাদতের মধ্যে কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্য শামিল রাখা। অথবা কোনো বিষয়ে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কিছুর প্রভাবের ধারণা রাখা। শির্কে আসগরকে নিম্মোক্ত প্রকারসমূহে সীমাবদ্ধ করা যায়- ১. কথাগত শির্ক : আল্লাহ ব্যতীত অন্য কিছুর নামে শপথ করা। এ প্রসঙ্গে রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- যে আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে শপথ করলো সে শিরক করলো। ২. কার্যগত শির্ক : এমন শির্ক যা কর্মের দ্বারা সংঘটিত হয়ে থাকে। যেমন-ক. রিয়া অর্থাৎ লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে কোনো ইবাদত বন্দেগী করা। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আমি তোমাদের উপর শিরকে আসগর বা ছোট শিরকের ব্যাপারে অত্যন্ত ভয় করছি। প্রশ্ন করা হলো তা কি? তিনি বললেন, তা রিয়া বা লোক দেখানোর জন্য ইবাদত করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম অন্যত্র ইরশাদ করেন- হে লোক সকল! তোমরা নিজেদেরকে গোপন শিরক থেকে রক্ষা কর। সাহাবা-ই কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! গোপন শিরক কি? নবীজি বললেন, কোন ব্যক্তি সালাত আদায় করার জন্য দাঁড়াল। অতঃপর পরিশ্রম করে সুন্দর করে নামায আদায় করলো। কেননা সে দেখছে মানুষ তার প্রতি লক্ষ্য করছে। এটাই গোপন শির্ক।
খ. বদ ফাল (শুভাশুভ /ওয়ার্ডগেম বা ভবিষ্যৎ কথন ও কুলক্ষণ-সুলক্ষণ) গ্রহণ করা। এ প্রসঙ্গে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, কোন বস্তুকে কুলক্ষণ মনে করা ‘শির্ক’, কোন বস্তুকে কুলক্ষণ ভাবা শির্ক। তবে আল্লাহর উপর ভরসার দ্বারা তা দূরীভুত হয়। উক্ত মারাত্মক অপরাধের পরিণতি বর্ণনায় ইরশাদ হচ্ছে,
إِنَّهُ مَن يُشْرِكْ بِاللهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ ۖ وَمَا لِلظَّالِمِيْنَ مِنْ أَنصَارٍ-
অর্থাৎ ‘নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থির করে, আল্লাহ তার জন্যে জান্নাত হারাম করে দেন। এবং তার বাসস্থান হয় জাহান্নাম। অত্যাচারীদের কোন সাহায্যকারী নেই।” হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক না করে মৃত্যুবরণ করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি তাঁর সাথে কাউকে শরিক করে মৃত্যুবরণ করবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’

২. পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া
মাতা-পিতার অবাধ্যতা দু’ ধরনের। যথা- ক. হারাম অবাধ্যতা যেমন: মাতা-পিতা সন্তানের উপর কোন ব্যাপারে কসম খেয়েছেন। অথচ সে তাদের উক্ত কসমটি রক্ষা করেনি। মাতা-পিতা সন্তানের নিকট প্রয়োজনীয় কিছু চেয়েছেন। অথচ সে তাদের উক্ত চাহিদা পূরণ করেনি। মাতা-পিতা সন্তানের নিকট কোন কিছু আশা করেছেন। অথচ সে তাদের উক্ত আশা ভঙ্গ করেছে। মাতা-পিতা সন্তানকে কোন কাজের আদেশ করেছেন। অথচ সে তাদের উক্ত আদেশটি মান্য করেনি। মাতা-পিতাকে প্রহার করে, গালি দিয়ে বা কারোর নিকট তাদের গীবত বা দোষ চর্চা করে তাদেরকে কষ্ট দেয়া প্রভৃতি সর্বোচ্চ নাফরমানি। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
إِنَّ مِنْ أَكْبَرِ الْكَبَائِرِ أَنْ يَلْعَنَ الرَّجُلُ وَالِدَيْهِ، قِيْلَ: يَا رَسُوْلَ اللهِ! وَكَيْفَ يَلْعَنُ الرَّجُلُ وَالِدَيْهِ؟ قَالَ: يَسُبُّ الرَّجُلُ أَبَا الرَّجُلِ فَيَسُبُّ أَبَاهُ، وَيَسُبُّ أُمَّهُ فَيَسُبُّ أُمَّهُ-
অর্থাৎ ‘‘সর্ববৃহৎ অপরাধ হচ্ছে নিজ মাতা-পিতাকে লা’নত করা। জিজ্ঞাসা করা হলো, হে আল্লাহ্র রাসূল! মানুষ কিভাবে নিজ মাতা-পিতাকে লা’নত করতে পারে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন: তা এভাবেই সম্ভব যে, সে কারো মাতা-পিতাকে গালি দিলো। অতঃপর সে ব্যক্তি এর মাতা-পিতাকে গালি দিলো’’।
খ. মাকরূহ্ অবাধ্যতা যেমন: কারো পিতা খাবার শেষ করেছেন। এখন তিনি হাত ধোয়ার মনস্থ করেছেন এবং তিনি স্বয়ং উঠে গিয়ে হাতও ধুয়েছেন। আর ঐ সন্তান শুধু তা দেখেই আছে। কিছুই করেনি। এতে সে তার পিতার অবাধ্য হয়নি। তবে কাজটি আরো ভালো হতো যদি সে স্বয়ং উঠে গিয়ে হাত ধোয়ার পানিটুকু স্বীয় পিতাকে এগিয়ে দিত। তবে কারো পিতা যদি দাঁড়াতে না পারেন অথবা দাঁড়াতে কষ্ট হয় অথবা পিতা স্বয়ং আপন সন্তানকেই পানি উপস্থিত করতে আদেশ করেন এবং সন্তান আদেশটি পালন না করে তখন কিন্তু সন্তান নিজ পিতার অবাধ্য বলে বিবেচিত হবে। মাতা-পিতার পারস্পরিক ঝগড়া দেখে সন্তান যদি তাদের যে কারোর পক্ষ নিয়ে অন্যজনকে কোন অপবাদ, কটু কথা বা বিরক্তি সূচক শব্দ বলে তখনও তাদের অবাধ্য বলে বিবেচিত হবে। এক্ষেত্রে সন্তানের কাজ হবে, সূক্ষ¥ভাবে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেয়া। তবে খেয়াল রাখতে হবে, মীমাংসা করতে গিয়ে আপন পিতা-মাতাকে কোন বিশ্রী শব্দ বলা যাবে না। যাতে তারা তাকে অপরের পক্ষপাতী বলে মনে না করে। বরং উভয়ের প্রতি ভালোবাসা দেখাবে এবং তাদের মধ্যে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করবে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
ثَلَاثَةٌ قَدْ حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِمُ الْـجَنَّةَ: الْعَاقُّ لِوَالِدَيْهِ-
অর্থাৎ ‘‘তিন ব্যক্তির উপর আল্লাহ্ তা‘আলা জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন। তম্মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মাতা-পিতার অবাধ্য ব্যক্তি’’।
মুমিন মাত্রই সর্বদা স্বীয় মাতা-পিতার সঙ্গে ন¤্রতা দেখাতে একান্তভাবে বাধ্য। মহান আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
وَقَضَى رَبُّكَ أَلاَّ تَعْبُدُوْا إِلاَّ إِيَّاهُ، وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا، إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُلْ لَـهُمَا أُفٍّ، وَلَا تَنْهَرْهُمَا، وَقُلْ لَـهُمَا قَوْلًا كَرِيْمًا، وَاخْفِضْ لَـهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ، وَقُلْ رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِيْ صَغِيْرًا–
অর্থাৎ ‘‘আপনার প্রভু এ বলে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা তিনি ছাড়া অন্য কারোর ইবাদাত করবেনা এবং মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার করবে। তাদের একজন বা উভয়জন তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তুমি তাদেরকে বির+ক্তি সূচক কোন শব্দ বলবেনা এবং তাদেরকে ভৎর্সনাও করবেনা। বরং তাদের সাথে সম্মান সূচক ন¤্র কথা বলবে। দয়াপরবশ হয়ে তাদের প্রতি সর্বদা বিনয়ী থাকবে এবং সর্বদা তাদের জন্য এ দো‘আ করবে যে, হে আমার প্রতিপালক! আপনি তাদের প্রতি দয়া করুন যেমনিভাবে শৈশবে তারা আমার প্রতি অশেষ দয়া করে আমাকে লালন-পালন করেছেন’’। তবে তারা কোন গুনাহ্’র আদেশ করলে তা মান্য করা যাবে না,আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
وَإِنْ جَاهَدَاكَ عَلَى أَنْ تُشْرِكَ بِيْ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا، وَصَاحِبْهُمَا فِيْ الدُّنْيَا مَعْرُوْفًا-
অর্থাৎ ‘‘তোমার মাতা-পিতা যদি তোমাকে আমার সাথে এমন বস্তু বা ব্যক্তিকে শরীক করতে পীড়াপীড়ি করে যে ব্যাপারে তোমার কোন জ্ঞান নেই তথা (ক্বোর‘আন ও হাদীসের কোন সাপোর্ট নেই) তাহলে তুমি এ ব্যাপারে তাদের কোন আনুগত্য করবেনা। তবে তুমি এতদ্সত্ত্বেও দুনিয়াতে তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে। আর তাদেরকে ক্বোর‘আন ও হাদীসের বাণী শুনিয়ে ঐ পাপাচারের আদেশ থেকে বিরত থাকতে হবে।
৩. মিথ্যা কথা বলা: মিথ্যা কখনো কখনো মিথ্যাবাদীকে জাহান্নাম পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেয় এবং মিথ্যা বলতে বলতে পরিশেষে সে আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট মিথ্যুক হিসেবেই পরিগণিত হয়। এ প্রসঙ্গে রাসূলে আরবি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
عَلَيْكُمْ بِالصِّدْقِ فَإِنَّ الصِّدْقَ يَهْدِيْ إِلَى الْبِرِّ، وَإِنَّ الْبِرَّ يَهْدِيْ إِلَى الْـجَنَّةِ، وَمَا يَزَالُ الرَّجُلُ يَصْدُقُ وَيَتَحَرَّى الصِّدْقَ حَتَّى يُكْتَبَ عِنْدَ اللهِ صِدِّيْقًا، وَإِيَّاكُمْ وَالْكَذِبَ فَإِنَّ الْكَذِبَ يَهْدِيْ إِلَى الْفُجُوْرِ، وَإِنَّ الْفُجُوْرَ يَهْدِيْ إِلَى النَّارِ، وَمَا يَزَالُ الرَّجُلُ يَكْذِبُ وَيَتَحَرَّى الْكَذِبَ حَتَّى يُكْتَبَ عِنْدَ اللهِ كَذَّابًا-
অর্থাৎ ‘‘তোমরা সত্যকে আঁকড়ে ধরো। কারণ, সত্য পুণ্যের পথ দেখায় আর পুণ্য জান্নাতের পথ। কোন ব্যক্তি সর্বদা সত্য কথা বললে এবং সর্বদা সত্যের অনুসন্ধানী হলে সে শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট সত্যবাদী হিসেবেই লিখিত হয়। আর তোমরা মিথ্যা থেকে সম্পূর্ণরূপে দূরে থাকো। কারণ, মিথ্যা পাপাচারের রাস্তা দেখায় আর পাপাচার জাহান্নামের রাস্তা। কোন ব্যক্তি সর্বদা মিথ্যা কথা বললে এবং সর্বদা মিথ্যার অনুসন্ধানী হলে সে শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট মিথ্যাবাদী রূপেই লিখিত হয়’’। সামুরাহ্ বিন্ জুন্দুব থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: ’’একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদেরকে নিজ স্বপ্ন বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন: গত রাত আমার নিকট দু’ জন ব্যক্তি এসেছে। তারা আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বললো: চলুন, তখন আমি তাদের সাথেই রওয়ানা করলাম। যেতে যেতে আমরা এমন এক ব্যক্তির নিকট পৌঁছলাম যে চিত হয়ে শায়িত। অন্য আরেক জন তার পাশেই দাঁড়িয়ে একটি মাথা বাঁকানো লোহা হাতে। লোকটি বাঁকানো লোহা দিয়ে শায়িত ব্যক্তির একটি গাল, নাকের ছিদ্র এবং চোখ ঘাড় পর্যন্ত ছিঁড়ে ফেলছে। এরপর সে উক্ত ব্যক্তির অন্য গাল, নাকের ছিদ্র এবং চোখটিকেও এমনিভাবে ছিঁড়ে ফেলছে। লোকটি শায়িত ব্যক্তির এক পার্শ্ব ছিঁড়তে না ছিঁড়তেই তার অন্য পার্শ্ব পূর্বাবস্থায় ফিরে যাচ্ছে এবং লোকটি শায়িত ব্যক্তিটির সাথে সে ব্যবহারই করছে যা পূর্বে করেছে। ফিরিশ্তাদ্বয় উক্ত ঘটনার ব্যাখ্যায় বলেন: উক্ত ব্যক্তির দোষ এই যে, সে ভোর বেলায় ঘর থেকে বের হয়েই মিথ্যা কথা বলে বেড়ায় যা দুনিয়ার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ে’’।
অনেক রসিক ব্যক্তি শুধুমাত্র মানুষকে হাসানোর উদ্দেশ্যে মিথ্যা কথা বলে থাকে। বস্তুত তার ইহলৌকিক অন্য কোন ফায়েদা নেই। শুধুমাত্র অন্যকে আনন্দ দেয়ার জন্যই এমন জঘন্য কাজ করে থাকে। এ প্রসঙ্গে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
وَيْلٌ لِلَّذِيْ يُحَدِّثُ بِالْـحَدِيْثِ، لِيُضْحِكَ بِهِ الْقَوْمَ فَيَكْذِبُ، وَيْلٌ لَهُ، وَيْلٌ لَهُ-
অর্থাৎ ‘‘অকল্যাণ হোক সে ব্যক্তির যে মানুষকে হাসানোর জন্যই মিথ্যা কথা বলে। অকল্যাণ হোক সে ব্যক্তির; অকল্যাণ হোক সে ব্যক্তির’’।
৪. মিথ্যা শপথ করা: মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া একটি মারাত্মক অপরাধ। ইমাম কুরতুবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি মিথ্যা সাক্ষ্যের পরিচয়ে বলেন,
شهادة الزور هي الشهادة بالكذب ليتوصل بها إلى الباطل من إتلاف نفس أو أخذ مال أو تحليل حرام أو تحريم حلال،
অর্থাৎ ‘মিথ্যা সাক্ষ্য এমন সাক্ষ্য, যা মানুষকে বাতিলের দিকে ধাবিত করে, চাই সেটা কোন মানুষের ধ্বংসসাধন অথবা সম্পদ কেড়ে নেওয়া অথবা হারামকে হালাল করা অথবা হালালকে হারাম করার ক্ষেত্রে হৌক’। অনুরূপভাবে সাক্ষ্য গোপন করাও মিথ্যা সাক্ষীর মত। ইরশাদ হচ্ছে-
وَلَا تَكْتُمُوا الشَّهَادَةَ وَمَنْ يَّكْتُمْهَا فَإِنَّهُ آثِمٌ قَلْبُهُ وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ عَلِيْمٌ-
অর্থাৎ ‘আর তোমরা সাক্ষ্য গোপন করো না। যে ব্যক্তি তা গোপন করে, তার হৃদয় পাপিষ্ঠ। বস্তুত তোমরা যা কিছু কর, সে বিষয়ে আল্লাহ সম্যক অবগত।’ এ প্রসঙ্গে আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
شَهَادَةُ الزُّوْرِ مِنْ أَكْبَرِ الْكَبَائِرِ، وَكِتْمَانُهَا كَذَلِكَ،
অর্থাৎ ‘মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া ও সাক্ষ্য গোপন করা সবচেয়ে বড় গুনাহ’। অনুরূপভাবে সাক্ষীর জন্যও ওয়াজিব হল সত্য সাক্ষ্য দেওয়া ও মিথ্যা সাক্ষ্য থেকে বেঁচে থাকা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাক আল্লাহর জন্য সাক্ষ্যদাতা হিসাবে, যদিও সেটি তোমাদের নিজেদের কিংবা তোমাদের পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধে যায়। (বাদী-বিবাদী) ধনী হোক বা গরীব হোক (সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করো না)। কেননা তোমাদের চাইতে আল্লাহ তাদের অধিক শুভাকাক্সক্ষী। অতএব ন্যায়বিচারে প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। আর যদি তোমরা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বল অথবা পাশ কাটিয়ে যাও, তবে জেনে রেখ আল্লাহ তোমাদের সকল কর্ম সম্পর্কে অবহিত।’ কারণ,বিচার ফায়সালা নির্ণিত হয় বাদীর পক্ষের সাক্ষী অথবা বিবাদীর কসমের উপর। অতএব বাদীর পক্ষের সাক্ষী ভুল হলে এবং বিচার সে সাক্ষীর ভিত্তিতেই হলে ফায়সালা নিশ্চয়ই ভুল হতে বাধ্য। আর তখন এর একমাত্র দায়-দায়িত্ব সাক্ষীকেই বহন করতে হবে এবং এ জন্য সেই গুনাহ্গার হবে।
মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ার মাধ্যমে বিবাদীর উপর বিশেষভাবে যুলুম করা হয়। কারণ, এরই মাধ্যমে তার বৈধ অধিকার অবৈধভাবে অন্যের হাতে তুলে দেয়া হয়। তখন সে মাযলুম। আর মাযলুমের ফরিয়াদ আল্লাহ্ তা‘আলা কখনো বৃথা যেতে দেন না। মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদানের মাধ্যমে বাদীর উপরও যুলুম করা হয়। কারণ, এরই মাধ্যমে তার হাতে আগুনের একটি টুকরা উঠিয়ে দেয়া হয়। যা ভবিষ্যতে তার সমূহ অকল্যাণই ডেকে নিয়ে আসে। মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদানের মাধ্যমে দোষীকে আরো হঠকারী বানিয়ে দেয়া হয়। কারণ, সে এরই মাধ্যমে কঠিন শাস্তি থেকে রেহাই পায়। অতএব সে মিথ্যা সাক্ষ্য পাওয়ার আশায় আরো অপরাধ কর্ম ঘটিয়ে যেতে কোন দ্বিধা করে না। মিথ্যা সাক্ষ্য এর ভিত্তিতে অনেক হারাম বস্তুকে হালাল করে দেয়া হয়। অনেক মানুষের জীবন বিসর্জন দিতে হয়। অনেক সম্পদ অবৈধভাবে ভক্ষণ করা হয়। এ সবের জন্য বাদী-বিবাদী ও বিচারক কিয়ামতের দিন মিথ্যা সাক্ষীর বিপক্ষে আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট বিচার দায়ের করবে। (চলবে)

টিকা:
– সূরা নিসা, আয়াত: ৩১
– ফাতহুল বারি, ১২/১৯১
– সূরা সাজদা, আয়াত: ২১
– সহিহ বুখারী;সহিহ মুসলিম
– সহিহ বুখারী,হাদীস: ৬৮৭০
– সূরা নিসা,আয়াত-৪৮
– মুসনাদে আহমদ;জামে তিরমিযি;মুসনাদে হাকেম
– সহীহ আত তারগীব ওয়াত তারহিব, হাদীস: ৩২
– সহিহ ইবনে খুজাইমা, ২/ ৬৭, হাদীস: ৯৩৭
– সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৩৯১০
– সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৩৫৩৮
– সূরা মায়িদাহ,আয়াত: ৭২
– সহিহ মুসলিম
– সহিহ বুখারী,হাদীস: ৫৯৭৩; সহিহ মুসলিম,হাদীস: ৯০
– জা’মিউস্ সগীর, ৩/৬৯
– সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত: ২৩-২৪
– সূরা লুক্বমান, আয়াত : ১৫
– সহিহ মুসলিম, হাদীস: ২৬০৭
– সহিহ বুখারী,হাদীস: ৭০৪৭; সহিহ মুসলিম,হাদীস: ২২৭৫
– জামে তিরমিযী,হাদীস: ২৩১৫
– হাশিয়া তাহতাবী আলা দুররিল মুখতার (বৈরূত: দারুল মা‘আরিফ), ৩/২৬০
– সূরা বাক্বারা,আয়াত:২৮৩
– তাফসীর ইবনে কাছীর, সূরা বাক্বারা, আয়াত:২৮৩
– সূরা নিসা,আয়াত: ১৩৫
– সহিহ বুখারী,হাদীস:২৪৫৮, ২৬৮০- ৭১৮৫; সহিহ মুসলিম,হাদীস:১৭১৩