দিল্লির ইন্দো বাংলা কনফারেন্স বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কের নবদিগন্তের হাতছানি
ইমরান হুসাইন তুষার>
বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশ ভারতের নানাবিধ সংযোগ রয়েছে। ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা, ঐতিহ্য এবং শিল্পকলাসংক্রান্ত বিষয়গুলোতে যেমন মিল রয়েছে তেমনি এই বিষয়গুলোর প্রতি দুই দেশের মানুষের আবেগও প্রায় সমরূপ। এই দুই দেশের মতো নিবিড় ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্ক পৃথিবীতে বিরল। বাংলাদেশ ও ভারত শুধু ভৌগোলিক সীমান্ত সম্পর্কেই আবদ্ধ নয়, বরং দুই দেশ অর্থনীতি, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ নানা ক্ষেত্রে পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। বিশ্বায়নের যুগে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সম্পর্ক তৈরিতে যোগাযোগ ব্যবস্থার বিকল্প নেই। তারই অংশ হিসেবে আমাদের এবারের ভারত সফরটি ছিল বেশ গুরুত্ববহ। ইতপূর্বে আরো বেশ কয়েকবার আমার ভারত সফর হলেও এবারের সফরটা ছিল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম।
গত ২০ অক্টোবর দিল্লির ইন্দো-ইসলামিক হেরিটেজ সেন্টার (ওওঐঈ)-উদ্যোগে নয়াদিল্লির লোদি রোডে দিল্লি ইসলামিক সেন্টারে ইন্দো বাংলা কনফারেন্সে অংশগ্রহণের জন্য আমাদের ভারতীয় বন্ধু ড.সুজাত আলী কাদেরীর আমন্ত্রণে বাংলাদেশের আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের প্রতিনিধিত্ব করতে শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিক অধ্যক্ষ আবু তালেব বেলাল, বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক আব্দুর রহিম ভাইসহ ভারত-বাংলাদেশের যৌথ জার্নাল সুফির নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে আমি ৬ দিনের সফরে ১৯ অক্টোবর বাংলাদেশ ত্যাগ করি। ১৯ অক্টোবর রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ অধ্যক্ষ আবু তালেব বেলাল ভাই আর আমি দিল্লি ইন্দিরাগান্ধী ইন্টারন্যাশনাল বিমানবন্দরে পৌঁছি। দিল্লি নিযামউদ্দিনে দরগাহ্ মারকাজ গেস্ট হাউজে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। আব্দুর রহিম ভাই অবশ্য দুপুরেই পৌঁছে গিয়েছিলেন।
২০ অক্টোবর শুক্রবার সকালের নাস্তা সেরে জিয়ারতের উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়ি। আমাদের সাথে সেখান থেকে যুক্ত হয় ভারতের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অধ্যক্ষ বেলাল ভাইয়ের ছেলে ইয়াছির, পীর ভাই জয়নাল ও রিফাত। প্রথমেই নিযামউদ্দিন হতে মেরাউলিতে সুলতানুল হিন্দের খলিফা হযরত খাজা কতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী (রহ.)’র মাযার শরীফে। দিল্লিতে যার নামে ‘কুতুব মিনার’ দাঁড়িয়ে আছে তিনি হলেন খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী। তিনি বাবা শেখ ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকর (রহ.)’র পীর এবং হযরত নিযামুদ্দীন আউলিয়ার (রহ.)’র দাদাপীর। মেহরাউলের জাফর মহলের পাশেই অবস্থিত এই ঐতিহাসিক দরগাহ। ভারতের অনেক বিখ্যাত শাসক তাঁর দরগাহর নানাবিধ সংস্কার ও উন্নয়ন করেন। সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেক ও ইলতুতমিশ দরগাহর জন্য ঘান্দাক কি বাউলি কূপ স্থাপন করেন। শের শাহ সুরি একটি বড় গেইট তৈরী করেন। শেষ মুঘল স¤্রাট বাহাদুর শাহ দরগাহের ধবধবে সাদা মতি মসজিদটি নির্মাণ করেন। এছাড়াও দরগাহে প্রবেশ মুখে যে লাল পোড়ামাটি আর মহামূল্যবান কালো কষ্টিপাথরের একটি মসজিদ আপনার নজরে আসবে সেটা ফারুকশিয়ার নির্মাণ করেন।
সময় সল্পতার কারণে ভারতীয়-মুসলিম স্থাপত্যকীর্তির গুরুত্বপূর্ণ এবং অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন কুতুব মিনারের গাঁ ঘেষে চেরাগ দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা হই। এই মিনার’টি ভারতের প্রথম মুসলমান শাসক কুতুবুদ্দিন আইবেকের আদেশে ১১৯৩ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হয় আর ১৩৮৬ খ্রিষ্টাব্দে কাজ সম্পূর্ণ করেন ফিরোজ শাহ তুঘলক। মাযার মসজিদ ও মাদরাসা নিয়ে গঠিত ছিল এই কমপ্লেক্স। তবে বর্তমানে মিনারটি এবং ইলতুতমিশের মাযার শরীফটিই অক্ষত আছে। ভাঙ্গা মসজিদটি কাছেই আছে আলা উদ্দিন খিলজির মাযার। ইলতুতমিশের কন্যা রাজিয়া সুলতানা দিল্লির প্রথম মহিলা শাসক। সুলতান ইলতুতমিশ ব্যক্তি জীবনে ছিলেন একজন আবেদ। খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী (রহ.) ইন্তেকালের আগে তাঁর সকলকে ওসিয়ত করেন, জানাযা যে ব্যক্তি পড়াবে; তার মধ্যে ৪টি গুণ থাকতে হবে। যদি এ ৪টি গুণ কোনো ব্যক্তির জীবনে পাওয়া না যায়; তবে বিনা জানাযায় আমার লাশ দাফন করবে। শর্তগুলো হলো-১.যে ব্যক্তি জীবনে কোনো দিন তাকবিরে উলা ব্যতিত নামাজ পড়েনি; এমন ব্যক্তি। ২.যার জীবনে একদিনও তাহাজ্জুদ কাজা হয়নি; এমন ব্যক্তি। ৩. যে ব্যক্তি তার চোখের দ্বারা পরনারী দেখে কখনো গোনাহের কল্পনা করেনি; এবং ৪.যে ব্যক্তি জীবনে কোনো দিন আছরের সুন্নাতও কাজা করেনি। জানাযায় হাজার হাজার ভক্ত, খলিফাদের মধ্যে একমাত্র ইলতুতমিশকেই পাওয়া গেল এই চারগুণের অধিকারী।
মিনিট বিশে প্রায় ছয় কিলোমিটার পথপাড়ি দিয়ে চলে গেলাম চেরাগ দেহলিতে হযরত নিযামউদ্দিন আউলিয়ার খলিফা হযরত নাছির উদ্দিন মাহমুদ চেরাগ দেহলি (রহ.)’র মাযার শরীফে। মূল সড়ক হতে অনেকটা ভিতরে তাঁর মাযার কমপ্লেক্স। আকাঁবাঁকা সরু গলি পেরিয়ে যেতে হয় তাঁর মাযারে। জুমার নামাজ অতি সন্নিকটে তাই সংক্ষিপ্ত জিয়ারত শেষে আবারও ছুটলাম নিযামউদ্দিনে হুমায়ূন সৌধের পিছনে হযরত পাতাশাহ (রহ.)’র দরগাহ মসজিদের উদ্দেশ্যে। ইশক ও আদবে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর এসডিআই রাজেস্থানের প্রধান সাইয়্যেদ মোহাম্মদ কাদেরি সাহেবের সংক্ষিপ্ত চমৎকার আলোচনা এবং তাঁর ইমামতিতে জুমার নামাজ আদায় এবং ড.সুজাত আলী কাদেরী সাহেবের অফিসে সুস্বাদু লাঞ্চ শেষে গেলাম দিনের প্রথম কর্মসূচিটিতে। মাতা সুন্দরী রোডস্থ আইওয়ান-ই গালিবের অডিটোরিয়ামে মুসলিম কনভেনশন ও গাউছুল আযম কনফারেন্স সর্বভারতীয় তানজিম উলামা-ই ইসলামের চেয়ারম্যান মুফতি আশফাক হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। এই কনফারেন্সে ভারতের কাশ্মীরসহ বিভিন্ন প্রদেশের কয়েকশত উলামা মাশায়েখ অংশগ্রহণ করেন। এতে হুযুর গাউছে পাকের বরকতময় জীবন ও কর্মের নানাদিক নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি ভারত-বাংলাদেশের সু-সম্পর্কের বিষয়ে বিশেষ আলোকপাত করেন উলামায়ে কেরাম। বিশেষ করে গভমেন্ট ইউনিভার্সিটি অব জার্নালিজম এন্ড মাস কমিউনিকেশন যোদপুর রাজস্থানের অধ্যাপক ড.আখলাক উসমানি এবং খসরু ফাউন্ডেশনের দায়িত্বশীল প্রফেসর ড.হাফিজুর রহমান মিছবাহি বাংলাদেশের নানাবিধ উন্নয়ন মূলক পদক্ষেপ, সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ নির্মূলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ট নেতৃত্বের প্রশংসা করে তথ্যবহুল আলোচনা করেন। অধ্যাপক ড.আখলাক উসমানি আরো বলেন, নরেন্দ্র মোদি সরকারের নেতৃত্বে এক বছরের মধ্যে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ব্যবসা দ্বিগুণ হয়েছে। এই বৃদ্ধি দুই দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বিশ্বাসের প্রমাণ হিসেবে কাজ করে। সম্মেলনে উভয় দেশের বিশিষ্ট প্রতিনিধিরা একত্রিত হন, জঙ্গীবাদ মোকাবেলা, সুফিধারার শিক্ষার প্রচার এবং উভয় দেশের জনসংযোগ বাড়ানোর গুরুত্বের উপর জোর দেন। কনফারেন্স শেষ করেই আমরা এমএসও’র সভাপতি পিএইচডি গবেষক মোদাসসির আশরাফী ভাইয়ের সাথে দিনের দ্বিতীয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের জন্য রওনা হই।
দিনের দ্বিতীয় কর্মসূচিটি ছিল ভারতের বিশেষজ্ঞ, নীতিনির্ধারক, শিক্ষাবিদ, ধর্মীয় নেতা এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের সাথে এক গোল টেবিল বৈঠক। দিল্লি ইসলামিক সেন্টারের হল রুমে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন, ভারতের সর্বোচ্চ সম্মানার পদ্ম পুরস্কারপ্রাপ্ত, জাতীয় শিক্ষাবিদ, যোধপুরের মৌলানা আজাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুল ওয়াসির। আইআইএইচসি-এর পরিচালক ড. সুজাত আলী কাদেরী সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন-ভারতীয়দের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, জামিয়া মিল্লিয়া ইসলামিয়া ইউনিভার্সিটি নিউ দিল্লীর সহকারী অধ্যাপক ড.আব্দুল ওয়াহিদ নাজির, গভমেন্ট ইউনিভার্সিটি অব জার্নালিজম এন্ড মাস কমিউনিকেশন যোদপুর রাজস্থানের অধ্যাপক ড.আখলাক উসমানি, খসরু ফাউন্ডেশনের দায়িত্বশীল প্রফেসর ড.হাফিজুর রহমান মিছবাহি, মাসিক ম্যাগাজিন “কানজুল ঈমান” এর সম্পাদক ড.মোহাম্মদ জাফর উদ্দিন বারকাতি, এসডিআই রাজেস্থানের প্রধান সাইয়্যেদ মোহাম্মদ কাদেরী, এমএসও সেন্ট্রাল প্রেসিডেন্ট পিএইচডি গবেষক মোদাসসির আশরাফী। বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে বক্তব্য রাখেন, দৈনিক পূর্বদেশের সহকারী সম্পাদক, অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আবু তালেব বেলাল, বিশিষ্ট লেখক-গবেষক আবদুর রহিম ভাই এবং আমি। মাসিক ম্যাগাজিন “কানজুল ঈমান” এর সম্পাদক ড.মোহাম্মদ জাফর উদ্দিন বারকাতি’র সঞ্চালনায় বৈঠকে স্বাগত বক্তব্যে আইআইএইচসি-এর পরিচালক ড. সুজাত আলী কাদেরী আকায়েদে আহলে সুন্নাতের অনুসারী ও সুফিধারায় বিশ্বাস দুইদেশের মধ্যে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সাংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধি, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ মোকাবেলার পাশাপাশি দুইদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কিভাবে ভূমিকা রাখা যায় সে সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
বৈঠকে অংশগ্রহণকারী ভারতীয়দের নানা প্রস্তাবনা এবং জিজ্ঞাসার বিপরিতে পাঁচটি বিষয়ে বাংলাদেশের সুফিবাদি মুসলমানদের অবস্থান তুলে ধরা হয়। এগুলো হল: ১. উপমহাদেশে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে সুলতানুল হিন্দ হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহ.)’র অবদানকে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা অত্যান্ত কৃতজ্ঞচিত্তেই স্মরণ করেন। বাংলাদেশের আনাচে কানাচে মসলকে আ’লা হযরতের মতাদর্শে অগণিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেছে। এ প্রয়াসের সূচনা হয় সৈয়দ আহমাদ শাহ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি’র হাত ধরে। ১৯৫৪ সালে জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে। এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা মাসলাকে আ’লা হযরতের বহুমুখি চর্চা করছে। সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ মত ধর্মীয় উগ্রবাদ মোকাবেলায় বাংলাদেশের ওলামায়ে আহলে সুন্নাতের নানামূখি উদ্যোগের সর্বমহলে স্বীকৃত এবং প্রশংসিত। তাছাড়া আনজুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট কর্তৃক প্রকাশিত মাসিক তরজুমান বিগত চার দশক ইসলামের মুলধারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আর্দশ, সুফিবাদের উদারনীতি এবং ধর্মের ছদ্মাবরণে উগ্রবাদ মোকাবেলায় জ্ঞানভিত্তিক আন্দোলনমূলক একটি প্রয়াস। শান্তিরবার্তা মানুষের জন্য। তাই সুফিগণ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানবতার সেবায় কাজ করে। বাংলাদেশের করোনাকালীন সময়ে গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ সেই আদর্শকে বুকে ধারণ করে মানবতার সেবার অনন্য নজির স্থাপন করেছে।
২. ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশেও রয়েছে অনেক প্রাচীন ইসলামিক স্থাপত্য। যার অধিকাংশই সুফিদের হাতে তৈরি। এসব স্থাপত্য নিদর্শনগুলোই ভারতের অনেকেই চিনেন না। আগামী জুলাইতে হিজরি নববর্ষ উপলক্ষে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিবত্য ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক হেরিটেজ এক্সপো মধ্য দিয়ে এসব স্থাপত্যের সাথে বিশ্ববাসী পরিচিত করানো মাধ্যমে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের বিকাশ ঘটবে। বাংলাদেশ থেকে আসা রোগীদের জন্য ভারতীয় হাসপাতালগুলোতে বাংলা ভাষায় তথ্য বোর্ড ও ওয়েবসাইটের বিবরণ প্রদান এবং হাসপাতালের কর্মীদের জন্য বাংলা ভাষা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
অপরদিকে ভারতীয়দের পক্ষ থেকে দুইদেশের সম্পর্ক উন্নয়নে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আন্তরিকতার কথা তুলে ধরেন। এছাড়াও সংগঠনের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকটি প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়। তার মধ্যে, যৌথভাবে দরসে নেজামী মাদরাসা শিক্ষা কারিকুলাম তৈরি; শিক্ষার্থী বিনিময়ের উদ্যোগ গ্রহণ এবং পাঠ্যক্রম ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে পরিচিত করার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজগুলোতে ভারতীয় শিক্ষার্থীদের আবাসন উন্নয়ন এবং এডুকেশন ট্যুরিজম সম্প্রসারণ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য।
বৈঠক শেষে সোজা মাহবুবে এলাহী হযরত নিযামউদ্দিন আউলিয়া (রহ.)’র দরগাহে। মাহবুবে এলাহীর এবং তোতায়ে হিন্দুস্তান আমির খসরু (রহ.)’র জিয়ারত শেষে দরগাহ মারকাজে ফিরে আসি। হযরত নিযামউদ্দিন আউলিয়া (রহ.)’র খলিফা এবং দিল্লির রাজকবি ছিলেন। দরগাহ কমপ্লেক্সে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় আটশত বছরের নান্দনিক শৈলীর একটি মসজিদ।
২১ অক্টোবর সকালে নাস্তা সেরে মোদাসসির আশরাফীর সাথে বেরিয়ে পড়ি ড.সুজাত আলী কাদেরী ভাইয়ের সাথে বৈঠকের জন্য। এ বৈঠকে বাংলাদেশে সুন্নিদের সাংগঠনিক কর্মকান্ড এবং ভারত-বাংলাদেশের সুন্নি কমিউনিটির মধ্যকার সাংগঠনিক অভিজ্ঞতা বিনিময়ে নানা উদ্যোগ সম্পর্কে বিশদ আলোচনাও হয়। পাশাপাশি উভয় দেশের পর্যটনশিল্পের বিকাশে ভূমিকা রাখতে পারস্পারিক সহযোগিতায় প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন উভয় দেশের প্রতিনিধি। তারপর স্মারক শুভেচ্ছা বিনিময় এবং লাঞ্চ গ্রহণের মধ্যে দিয়ে তিন ঘন্টা ব্যাপী বৈঠকের যবনিকাপাত হয়। বইসই প্রকাশিত আবদুর রহিম সাহেব লিখিত “টোকিও হতে ইস্তানবুল” বইটি ভারতীয় বন্ধুদের উপহার প্রদান করা হয়।
বিকেলে দিল্লি ক্যান্ট স্টেশন হতে বন্দে ভারত ট্রেনে আজমির শরীফের উদ্দেশ্যে সৈয়দ মুহাম্মদ কাদেরী ভাইয়ের নেতৃত্বে জিশান আশরাফী ভাইসহ রওনা হই। ফাস্ট ক্লাস ট্রেন ভ্রমণ। উঠামাত্রই ট্রে ভর্তি চা-নাস্তা। তারপর ঘন্টা দুই পরেই ডিনার। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটায় আজমীর শরীফে পৌঁছে যাই আজমীর শরীফে। ২২ অক্টোবর ছিল আরবি মাসের ৬ তারিখ। তাই দরগাহে তিলধারণের ঠাঁই ছিল না। প্রফেসর ড. লিয়াকত মঈনী সাহেবে ভাতিজা মুশায়িদ ভাই আমাদের থাকার জন্য দুইটি রুমের ব্যবস্থা করে দেন দরগাহর ৪নং গেইটের কাছে। আবদুর রহিম ভাই ও আবু তালেব বেলাল ভাই সরাসরি জিয়ারতে চলে যায়। কিন্তু আমি জিশান, রিফাত এবং জয়নাল ভাই তাহাজ্জুদ নামাজের সময় সুলতানুল হিন্দের জিয়ারতে যাই। নামাজ, জিয়ারত, দীর্ঘ মিলাদ-কিয়াম শেষে কিছুক্ষণ বিশ্রাম এবং সকালের নাস্তা সেরে আনা সাগর পরিদর্শন করতে বের হই। খাজা বাবার চিল্লা জিয়ারত ও জোহরের নামাজ পড়ে সেখান থেকে ফিরে আসি দরগাহে। আবার দরগাহে আছর ও মাগরিবের নামাজ আদায় এবং জিয়ারত শেষে গেস্ট হাউজে ফিরি। রাতের খাবার খেয়ে রিফাত, জয়নাল এবং জব্বর ভাই দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা করেন। তাদের বিদায় দিয়ে এশার নামাজ পড়ে কয়েক ঘন্টা বিশ্রাম করে আবার তাহাজ্জুদ নামাজের সময় সুলতানুল হিন্দের জিয়ারতে যাই। ফজর নামাজ পড়ে আমি আবদুর রহিম ভাই, বেলাল ভাই এবং জিশান ভাই আমরা চারজন খাজা বাবার বড় ছেলে খাজা ফখরুদ্দিন চিশতী (রহ.) এবং মামুজানের জিয়ারতে উদ্দেশ্যে। প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরে সারওয়ার শরীফে তাঁদের মাযার শরীফ। খাজা বাবার মাযার শরীফের আদলেই কমপ্লেক্সটি যে কোন জিয়ারতকারীকেই বিমোহিত করবে। বিশেষ করে মাযারের গা ঘেষে থাকা দীঘিটির অথৈই জলরাশি। খাজা ফখরুদ্দিন চিশতী (রহ.) মাযার হতে কয়েক মিনিট দূরত্বের তাঁর মামা এবং দুইজন শিষ্যের মাযার। চমৎকার প্রাকৃতিক পরিবেশ সেখানকার।
২৩ অক্টোবর বিকেল সাড়ে ৩টায় দিল্লির ফিরতি ট্রেন। তাই খাজা বাবার দরগাহে বিদায়ী সালামি জানিয়ে শতাব্দী এক্সপ্রেসে ফিরি দিল্লিতে। রাতের ডিনার ট্রেনেই সেরে ফেললাম হোটেল রুমে গিয়ে লম্বা একটা রেস্ট। পরদিন সকালে আরেকটি বৈঠক ছিল। সেটাতে আমি আবদুর রহিম ভাই অংশগ্রহণ করি। সেই ফাঁকে আবু তালেব বেলাল স¤্রাট হুমায়ুনের সৌধে ডু মেরে নেয়। বৈঠক শেষে হযরত নিযামউদ্দিন (রহ.) জিয়ারত করে ড. সুজাত আলী ভাই’র বাসায় যাই এএনআইতে সাক্ষাৎকার দিতে। এটি ভারতের সর্ববৃহৎ ও জনপ্রিয় নিউজ এজেন্সি। সাক্ষাৎকার শেষে বন্ধুবর ফারহান নবি সিদ্দিকীর ছোটভাই ফায়জান সিদ্দিকী আমাদের অনারে দিল্লি হাকিকত কিতাভেবী সেন্টারে লাঞ্চের আয়োজন করেন। চারতলা সেন্টারের নিচতলায় প্রেস, দোতলায় অফিস এবং তিনতলায় গেস্ট হাউজ। লাঞ্চ ও ভিজিট শেষে দিল্লির গুলিস্তান করালবাগ হতে যৎসামান্য কেনাকাটা করে হোটেলে ফিরি। আমার আর বেলাল ভাইয়ের ফ্লাইট ভোর ছয়টায় তাই কিছুক্ষণ বিশ্রাম করেই রওনা হই বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে। আবদুর রহিম ভাই ২৬ অক্টোবর দুপুরে আসবেন। সেজন্য তিনি থেকে যান হোটেলে।
সময় সল্পতার জন্য দিল্লি শহরের অনেক স্থাপত্য নিদর্শন দেখা সম্ভব হয় নি। এর মধ্যে রয়েছে অনেক বরকতময় স্থানও। যেমন, মেরাউলিতেই আছে উপমহাদেশের প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ আব্দুল হক মুহাদ্দেস দেহলভী (রহ.)’র মাযার। ইন্ডিয়া গেইটের কাছেই হযরত রহিমউদ্দিন তুশী মটকাশাহ (রহ.)’র মাযার। দিল্লি জামে মসজিদ ও লাল কেল্লা একেবারেই পাশাপাশি। এই লাল কেল্লা হতে বাহাদুর শাহ জাফরকে রেঙ্গুনে নির্বাসনে প্রেরণ করা হয়। আর দিল্লি জামে মসজিদে রয়েছে অমূল্য কিছু তাবারুক। যার মধ্যে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাঁড়ি মোবারক, নালাঈন শরীফ, কদম মোবারকের ছাপ, মাওলা আলী ও ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র হাতে লিখা কুরআন শরীফ। এই সফরে সম্ভব না হলেও আমি আগের প্রত্যেকটা সফরেই জিয়ারত মিস করি নি। জুমাবার খাদেম সাহেব জিয়ারতের উদ্দেশ্যে বের করেন।
আমি দৃঢ়ভাবে আশাবাদি আমাদের এবারের সফর বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কের নবদিগন্তের সূচনা করবে। আগামী জুলাইতে ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক হেরিটেজ এক্সপোর মাধ্যমে আমরা এ কনফারেন্সের প্রাথমিক সুফল পেতে সক্ষম হবো। পাশাপাশি উভয়ে দেশের উলামায়ে আহলে সুন্নাতের মধ্যে সুসম্পর্ক আরো বৃদ্ধি পাবে। ইনশাআল্লাহ।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা প্রধান, বইসই।