Anjuman-E Rahmania Ahmadia Sunnia Trust

আল্লাহ্’র নিকট সবচাইতে প্রিয়, বান্দার তাক্বওয়া ও ক্রন্দন

আল্লাহ্’র নিকট সবচাইতে প্রিয়, বান্দার তাক্বওয়া ও ক্রন্দন

মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ জসিম উদ্দিন আবিদী>

আল্লাহ তা‘আলা মানব ও জিন জাতিকে তাঁরই ইবাদত বন্দেগীর জন্য সৃষ্টি করেছেন। ক্বোরআন মাজীদে তিনি ইরশাদ ফরমান-وما خلقت الجن والانس الا ليعبدون (الذاريت:٥٦) অর্থ:- “এবং আমি জিন ও মানব এতটুকুর জন্যই সৃষ্টি করেছি যে আমার ইবাদত করবে”। [সুরা যারিয়াত :৫৬,অনুবাদ কানযুল ঈমান]
পবিত্র আয়াতে কারীমা থেকে আমরা সুস্পষ্টভাবে বুঝতে পারলাম আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সৃষ্টি করা ও আমাদেরকে এ পৃথিবীর বুকে প্রেরণের উদ্দেশ্য হলো তাঁরই ইবাদত করা। এছাড়া আমাদের আর কোন উদ্দেশ্য থাকতে পারেনা। তবে আমরা প্রয়োজনের খাতিরে অন্যান্য যে সমস্ত কার্যাদি সম্পাদন করে থাকি, তাও যদি তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে করে থাকি তাহলে এগুলোও ইবাদতে পরিণত হবে। কার্যাদি সম্পাদনের সময় আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, কোন কাজে তিনি সন্তুষ্ট আর কোন কাজে অসন্তুষ্ট। তাঁর পছন্দনীয় কাজগুলো করে বাকীগুলো বর্জন করতে হবে। এদিকে একটু খেয়াল রাখলে আমাদের সব আমল ইবাদতে পরিণত হবে। তেমনিই আমাদের সৃষ্টি ও এ ধরণীতে আগমণের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হবে। এটির জন্য আমাদেরকে মহান সৃষ্টিকর্তার আদেশ- নিষেধ মেনে চলতে হবে। যেমন আল্লাহ তাআ’লা পবিত্র কুরআন মাজীদে তাঁর ভয়ে অধিক ক্রন্দন ও কম হাসার নির্দেশ প্রদান করেছেন।

যেমন তিনি ইরশাদ ফরমান – فليضحكوا قليلاو وليبكوا كثيرا-(التوبة:٨٢) অর্থ:- “ সুতরাং তাদের উচিত যেন অল্প হাসে এবং প্রচুর কাঁদে”। [সূরা তাওবা:৮২,কানযুল ঈমান] تبكون-(النجم ٦٠): تضحكون و অর্থঃ- “এবং হাসছো এবং কাঁদছোনা”।  [সূরা নাজ্ম: ৬০, কানযুল ঈমান]
আমাদের সৃষ্টিও এ দুনিয়াতে আসার উদ্দেশ্য পূরণের জন্য ক্বোরআন মাজীদের নির্দেশ মান্য করার পর তাঁর প্রিয় রাসূল আকরাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র হাদীস শরীফ মানতে হবে। এবার দেখা যাক এ বিষয়ে হাদীস শরীফে কী বলা হয়েছে। হুযুর আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ ফরমান- لاتكثرالضحك فإن كثر الضحك يميت القلب-(الحديث) অর্থ:- “তুমি অতিরিক্ত হাসিওনা, কেননা অতিরিক্ত হাসা অন্তরের মৃত্যু ঘটায়। [আল হাদীস]
তিনি আরো ইরশাদ ফরমান لوتعلمون ما أعلم لضحكتم قليلاوبكيتم كثيرا-(صحيح البخارى والمسلم) অর্থ:- “আমি যা জানি তোমরা যদি তা জানতে তাহলে তোমরা কম হাসতে আর বেশি কাঁদতে।” [সহীহ বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফ] তিনি আরো ফরমান -وتبسمك فى وجه أخيك صدقة-(الحديث) অর্থ: “ তোমার মৃদু হাসি তোমার ভাইয়ের চেহারায় সদক্বা স্বরূপ।” [আল হাদীস]

পবিত্র কুরআন মাজীদ ও হাদীস শরীফের আলোকে সুষ্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, অধিক ক্রন্দন ও অল্প হাসা আল্লাহ তাআলা ও তাঁর প্রিয় রাসূল কারীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র নিকট অতি উত্তম আমল। এর বিপরীত আমল অপছন্দনীয়।
এ নির্দেশ মানার পরিপূর্ণ বাস্তব নমুনা দেখা যায় আম্বিয়ায়ে কেরাম আলায়হিমুস্ সালাম, সাহাবা-ই কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ও আউলিয়ায়ে এযাম’র পবিত্র জীবনে। এ বিষয়ের উপর খুবই গুরত্বপূর্ণ অধ্যায় রচনা করেছেন আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রযা খা ফাযেলে বেরলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র সম্মানিত পিতা ইমামুল মুতাকাল্লেমীন আল্লামা নক্কী আলী খাঁ মুহাদ্দিসে বেরলভী (রাহমাতুল্লাহি আলায়হি) الكلام الاوضح فى تفسير سورة الم نشرح (আলকালামুল আত্তযাহ ফী তাফসীরে সুরাতি আলাম নাশারাহ) নামক গ্রন্থে (যেটি সূরা ইনশিরাহ’র তাফসীরের উপর লিখা হয়েছে) ১৬৭ নং পৃষ্ঠা-১৬৯ নং পৃষ্ঠায়। যাতে আম্বিয়া-ই কেরাম ও আউলিয়ায়ে এযাম আল্লাহ তা‘আলার ভয়ে কীভাবে ক্রন্দন করেছেন এর চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। যেটির গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিম্মে তুলে ধরা হলো।–
হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম’র ক্রন্দন
হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে লজ্জায় দুইশত বছর আসমানের দিকে তাকাননি। যদি সারা জাহানের অশ্রুজল একত্রিত করা হয়, হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম’র চোখের পানির সমান হবেনা। অর্থাৎ তাঁর অশ্রুজল অধিক হবে।
হযরত দাউদ আলায়হিস্ সালাম’র ক্রন্দন
হযরত দাউদ আলায়হিস্ সালাম গভীর রাত পর্যন্ত সর্বদা ইবাদত করতেন। গভীর রাতে নিদ্রার জন্য গেলে কোন কারণ বশত: আরো বিলম্ভ হয়ে যেত। আর যখন খাবার খেতে বসতেন এত অধিক পরিমাণ ক্রন্দন করতেন, অশ্রুজল খাবারের সাথে মিশে যেত। ক্রন্দন করতে করতে তাঁর চক্ষু ক্ষত হয়ে গেছে। অধিক পরিমাণ অশ্রুজল প্রবাহিত হয়ে মুখমন্ডলের দু’পাশে গর্তের সৃষ্টি হয়ে যেত । যখন তাঁর ক্রন্দনের নির্দিষ্ট সময় আসত, তখন আহ্বানকারী আহ্বান করতেন। আজ দাউদ স্বীয় অবস্থায় ক্রন্দন করতে যাচ্ছেন। যে তাঁর ক্রন্দন শুনতে চাও, তাহলে জঙ্গলে যাও। মানুষ তাদের আবাসস্থল থেকে, পাখীরা বাসা থেকে, হিংস্র প্রাণী জঙ্গল থেকে আর পাহাড়ী জন্তু পাহাড় থেকে চলে আসত। তিনি প্রথমে সৃষ্টিকর্তার প্রশংসা করতেন। অতঃপর বেহেশত ও দোযখের স্মরণ করতেন এবং স্বীয় অবস্থার উপর এমনভাবে ক্রন্দন আরম্ভ করতেন এক পর্যায়ে অনেক মানুষ মৃত্যুবরণ করতেন। দুজন খাদেম তাঁকে ধরে রাখতেন, যাতে আল্লাহ তা‘আলার ভয়ে শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ প্রক্ষিপ্ত হয়ে না যায়।
হযরত ইয়াহিয়া বিন যাকারিয়া আলায়হিস্ সালাম’র ক্রন্দন
হযরত ইয়াহিয়া বিন যাকারিয়া আলায়হিস্ সালাম জঙ্গলে গিয়ে ক্রন্দন করতেন। একদা হযরত যাকারিয়া আলায়হিস্ সালাম, হযরত ইয়াহিয়া আলায়হিস্ সালাম’র পেছনে গিয়ে দেখলেন যে, তিনি তৃষ্ণায় খুবই অস্থির। পানি হাতে নিয়ে বলতে লাগলেন, হে মাবুদ! আপনার মর্যাদার শফথ! যতক্ষণ না আপনি আমার ঠিকানা বলে না দিবেন; ততক্ষণ পানি পান করবোনা। এ বলে তিনি এভাবে ক্রন্দন করছিলেন চোখের পানির সাথে মুখের মাংস ঝরে পড়েছে।
(চলবে)

লেখক: উপাধ্যক্ষ, বেতাগী রহমানিয়া জামেউল উলুম সিনিয়র মাদ্রাসা, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম।