আমীরুল মু’মিনীন সাইয়্যেদুনা হযরত আলী মুরতাদ্বা কাররামাল্লাহু তা‘আলা ওয়াজহাহুল কারীম
মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান>
পবিত্র নাম আলী, কুনিয়াৎ আবুল হাসান। উপাধি ‘মুরতাদ্বা’ ও ‘আসাদুল্লাহ্’। তাঁর পিতা আবূ তালিব। দাদা আবদুল মুত্তালিব। খাজা আবূ তালিব সরকার-ই দু’ আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রকৃত চাচা। ‘তাবাক্বাত-ই আবূ সা’দ’ ও ‘উসদুল গাবাহ্’য় রেওয়ায়ত রয়েছে যে, সাইয়্যেদুনা আলী মুরতাদ্বা কাররামাল্লাহু তা‘আলা ওয়াজহাহুল করীম মক্কা মু‘আয্যামায় পয়দা হন। সাইয়্যেদুনা আলী মুরতাদ্বা যখন মায়ের গর্ভে ছিলেন, তখন তাঁর মহিয়সী আম্মাজান আশ্চর্যজনক স্বপ্নাদি দেখতে থাকেন। একদা নূরানী আকৃতির কিছু সংখ্যক বুযুর্গ আসলেন এবং তাঁকে সুসংবাদ শুনাচ্ছিলেন। তাঁর আম্মাজান হযরত ফাতিমা বিনতে আসাদ নিজে বর্ণনা করলেন, ‘‘যখন আলী আমার গর্ভে ছিলেন, তখন আমি আশ্চর্যজনক খুশী ও আনন্দ অনুভব করতাম। আর যখন আমি কোন মূর্তিকে সাজদা করার ইচ্ছা করতাম, তখন আমি গর্ভে এমন অসহনীয় ব্যাথা অনুভব করতাম যে, ওই ব্যাথার কারণে আমি বোত-প্রতিমাকে সাজদাহ্ করার ইচ্ছাই ছেড়ে দিতাম।
তারপর হযরত আলী দুনিয়ায় ভূমিষ্ঠ হয়ে তিনদিন যাবৎ দুধ পান করলেন না। এ কারণে ঘরে হতাশা ছেয়ে গেলো। তখন সেটার খবর হুযূর-ই আক্রাম মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে দেওয়া হলো। তিনি তাশরীফ আনলেন এবং আলীকে রহমতপূর্ণ কোলে নিয়ে আদর করলেন; নিজের জিহ্বা মুবারক শিশু আলীর মুখের ভিতর রাখলেন। তিনি ওই জিহ্বা মুবারক চুষতে লাগলেন। এরপর থেকে দুধ পান করতে লাগলেন।’’
হযরত আলী মুরতাদ্বা কাররামাল্লাহু তা‘আলা ওয়াজহাহুল করীম শুধু পাঁচ বছর যাবৎ আপন পিতামাতার কোলে ও তত্ত্বাবধানে লালিত হয়েছেন। তারপর তাঁকে হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আপন রহমতের ছায়ায় স্থান দিলেন। আর নিজের কাছে রেখে নিজেই তাঁকে লালন-পালন করতে লাগলেন। এভাবে যখন তাঁর বয়স দশ বছর হয়ে গেলো, এদিকে নুবূয়তের ঘোষণা দেওয়ার সময় এসে গেলো, তখন হুযূর-ই আন্ওয়ার সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপর ওহী অবতীর্ণ হতে আরম্ভ হলো।
আল্লাহ্ আহকামুল হাকেমীন হুকুম দিলেন- সর্বপ্রথম নিজের খান্দানের লোকদের উপর ইসলামের দা’ওয়াত পেশ করুন এবং তাদের চরিত্র ও কর্ম সংশোধন করুন! সুতরাং আল্লাহর ইচ্ছানুসারে হুযূর-ই আন্ওয়ার সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উম্মুল মু’মিনীন খাদীজাতুল কুবরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা, নিজের প্রণোৎসর্গকারী সাথী সাইয়্যেদুনা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, নিজের প্রিয় চাচাত ভাই হযরত আলী মুরতাদ্বা কাররামাল্লাহু তা‘আলা ওয়াজহাহুল করীমের সামনে ইসলাম পেশ করলেন। সুতরাং তাঁদের সাথে হযরত আলীও ইসলাম গ্রহণ করলেন।
ইতিহাস বেত্তাগণ ও মুহাদ্দিসীন-ই কেরামের অভিমত রয়েছে যে, প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে আবূ বকর সিদ্দীক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছেন। ইমাম সুয়ূতী একথার উপর কারো কারো ইজমা’ হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। আমাদের ইমাম-ই আযম এ প্রসঙ্গে সব বর্ণনার মধ্যে এভাবে তাত্ববীক্ব দিয়েছেন যে, প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, অল্প বয়স্কদের মধ্যে সাইয়্যেদুনা হযরত আলী মুরতাদ্বা কাররামাল্লাহু তা‘আলা ওয়াজহাহুল করীম এবং নারীদের মধ্যে উম্মুল মু’মিনীন হযরত খাদীজাতুল কুবরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা সর্বপ্রথম ইসলাম কবূল করেছেন। [সূত্র. সদরুল আফাদ্বিল কৃত ‘সাওয়ানিহ্-ই কারবালা]
তাঁরা ইসলাম কবুল করার আগে ও পরে হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর খিদমত, হিফাযত, আনুগত্য ও ত্যাগের হক্ব আদায় করেছেন, দ্বীনের প্রচার-প্রসারের ক্ষেত্রেও তাঁরা প্রশস্ত মনে নিজেদের জানী ও মালী খিদমতসমূহ পেশ করেছেন। এ আউয়ালীন-ই সাবেক্বীন (প্রথম অগ্রণীগণ)-এর উপর আল্লাহ্ তা‘আলার রহমতের বারিধারা বর্ষিত হতে থাকুক!
সাইয়্যেদুনা আলী মুরতাদ্বা কাররামাল্লাহু তা‘আলা ওয়াজহাহুল করীমের পবিত্র জীবনটুকু উন্নত চরিত্র-সৌন্দর্যের সুন্দর প্রকাশস্থলই। আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁকে ‘আখলাক্ব-ই হাসানাহ্’ (সুন্দর চরিত্র)-এর পায়কর করেছিলেন। ‘উসদুল গাবাহ্’ কিতাবের বর্ণনানুসারে, তিনি এ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কখনো নিজেকে অন্য লোকদের থেকে স্বতন্ত্র ও শ্রেষ্ঠ মনে করেননি। সবসময় হাসিমুখে বিনয়ী যিন্দেগী অতিবাহিত করেছেন। আম লোকদের মত ঘরের কাজও করতেন। নিজ হাতে ছেঁড়া-পুরাতন কাপড়ে তালিও লাগাতেন। জুতোগুলোর সংস্কার করতেন। সরকার-ই দু’আলম খন্দক খননের নির্দেশ দিলে সাইয়্যেদুনা আলী মুরতাদ্বা কাররামাল্লাহু তা‘আলা ওয়াজহাহুল করীম এক মা’মূলী মযদূরের ন্যায় কাজ করেছেন। ঐতিহাসিক খন্দকের যুদ্ধের প্রাক্কালে হুযূর-ই আক্রাম খন্দক খননের এ নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ বরকতময় নির্দেশ প্রদানের পর সর্বপ্রথম সাইয়্যেদুনা আলী মুরতাদ্বা মাটি খননের কাজ আরম্ভ করেছেন। নিজে খনন করতেন এবং নিজে ওই মাটি তুলে খন্দকের বাইরে নিক্ষেপ করতেন। আর সামনে কোন বড় ধরনের পাথর আসলে নিজের খোদাপ্রদত্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করে সেগুলোকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলতেন।
পানাহারে এমন সরলতা ছিলো যে, বেশীরভাগ সময়ে যবের রুটি আহার করতেন। তাও কখনো ব্যঞ্জন দ্বারা, আবার কখনো ব্যঞ্জন ছাড়া আহার করে নিতেন। তাঁর বিছানাও একেবারে মা’মুলী ছিলো। হযরত মাওলা আলী ন্যাপরায়ণতা, তাক্বওয়া-পরহেযগারী, দয়া প্রদর্শন, বিনয়, সততা ও আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল বা ভরসার মধ্যে অতি উঁচু পর্যায়ের ছিলেন। তাঁর মুখ মুবারকে কখনো মন্দ কথা কিংবা মন্দ বাক্য উচ্চারিত হয়নি।
তিনি অত্যন্ত সুস্থ বিবেকসম্পন্ন ও পবিত্র চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। স্বভাবে কোন প্রকার অনর্থকতা ছিলোনা। হযরত আবূ যার গিফারী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেছেন, হিজরতের পূর্বে যখন মক্কার ক্বোরাঈশ বংশীয় কাফিররা, মা‘আযাল্লাহ্, হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে ক্বতল (শহীদ) করার জন্য স্কীম তৈরী করলো, তখন পরওয়ারদিগার-ই আলম হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে নির্দেশ দিলেন- আপনি হিজরত করে চলে যান। সুতরাং হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হিজরতের ইচ্ছা করে নিলেন। হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে এরশাদ করলেন, ‘‘আজ রাতে আমি মক্কা থেকে মদীনা চলে যেতে চাই। মক্কাবাসীরা আমার প্রাণ নাশের জন্য উদ্যত হয়ে আছে। সুতরাং তুমি কি এতে রাজি হবে যে, আজ রাতে আমার বিছানার উপর শয়ন করবে?’’
সাইয়্যেদুনা আলী মুরতাদ্বা কাররামাল্লাহু তা‘আলা ওয়াজহাহুল করীম অতি আদব সহকারে আরয করলেন, ‘‘হে আল্লাহর রসূল! আমার জান আপনার উপর ক্বোরবান! আমি সানন্দে এ খিদমতের জন্য প্রস্তুত আছি। যদি ক্বোরাঈশ আমাকে ক্বতলও করে ফেলে, তবুও আমার কোন পরোয়া নেই।’’ এ জবাব শুনে হুযূর-ই আক্রাম খুব খুশী হলেন এবং মদীনা তৈয়্যবার দিকে রওনা হয়ে যান। এ দিকে হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এমন বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে আপন মুনিবের বিছানায় শু’য়ে পড়লেন। এ-ই ঘটনা থেকে সাইয়্যেদুনা আলী মুরতাদ্বা কাররামাল্লাহু তা‘আলা ওয়াজাহুল করীমের বৃহত্তম ওফাদারী (বিশ্বস্ততা) ও প্রাণ উৎসর্গকরণের প্রমাণ মিলে।
বদর ও উহুদের যুদ্ধে সাইয়্যেদুনা আলী মুরতাদ্বা অতুলনীয় বীরত্ব প্রদর্শন করেছেন। হযরত আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, ‘‘বদরের যুদ্ধে কাফির বাহিনীর সত্তরজন নিহত হয়েছিলো। তাদের মধ্যে ২১ জনকে হযরত আলী মুরতাদ্বা কাররামাল্লাহু তা‘আলা ওয়াজহাহুল করীম জাহান্নামে পৌঁছিয়েছিলেন। তখন তাঁর বয়স হয়েছিলো ২৭ বছর।
উহুদের যুদ্ধে যখন মুসলমানদের পাগুলো উপড়ে গিয়েছিলো, তখন হযরত আলী মুরতাদ্বা সাহস হারাননি। পূর্ণ স্থিরতা ও প্রতিজ্ঞার সাথে মুশরিকদের মোকাবেলা করতে থাকেন এবং অব্যাহত গতিতে তরবারি চালাতে থাকেন। হযরত আলী মুরতাদ্বা কাররামাল্লাহু তা‘আলা ওয়াজহাহুল করীম নিজেই বর্ণনা করছেন, ‘‘উহুদের যুদ্ধের সময় আমার দেহের উপর ১৬টি জখম এসেছিলো; কিন্তু আল্লাহর অনুগ্রহক্রমে আমার প্রতিজ্ঞা ও ইচ্ছার মধ্যে কোন মা’মূলী দুর্বলতাও সৃষ্টি হয়নি।’’
যখন খন্দকের যুদ্ধের সূচনা হলো, তখন কাফিরবাহিনী থেকে এক বাহাদুর পলোয়ান চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করে বলেলো, ‘‘কোন্ মুসলমান আমার সাথে মুকাবেলা করবে, এসো।’’ এ চ্যালেঞ্জ শুনতেই হযরত আলী হুযূর-ই আক্রামের মহান দরবারে হাযির হয়ে আরয করলেন, ‘‘হুযূর, আমার মন চাই যে, আমিই এ নিকৃষ্টতর দুশমনের সাথে মোকাবেলা করবো।’’ রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম খুশী হয়ে নিজের আমামা শরীফ নামিয়ে সাইয়্যেদুনা আলী মুরতাদ্বা শেরে খোদার মাথায় পরিয়ে দিলেন। আর এরশাদ করলেন, ‘‘যাও সর্বশক্তিমান খোদার উপর ভরসা করে। তার মোকাবেলা করো।’’ হযরত আলী মুরতাদ্বা কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ওই প্রতিপক্ষের উপর বিজয়ী হলেন। আর দ্বীনের ওই দুশমনকে ক্বতল করে জাহান্নামে পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন।
একবার বনী ক্বোরায়যাহ্ (গোত্র) বিরাট বাহিনী সহকারে একের পর এক করে অন্য মনস্ক মুসলমানদের উপর হামলা করতে লাগলো। মুসলমানদের মধ্যে এদিক-ওদিক ছুটাছুটি শুরু হয়ে গেলো; কিন্তু খোদার সিংহ হযরত আলী মুরতাদ্বা একেবারে চিন্তাহীন রয়ে গেলেন। আর তখনই তরবারি বের করে ময়দানে বীরদর্পে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং অগণিত ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারীকে ক্বতল করে ফেললেন। শেষ পর্যন্ত ওই বিপর্যয় সৃষ্টিকারীরা হাতিয়ার ফেলে পালিয়ে গেলো।
সাইয়্যেদুনা আলী মুরতাদ্বা কাররামাল্লাহু তা‘আলা ওয়াজহাহুল করীম অন্যকে প্রাধান্যদাতা ও বড় দানশীল ছিলেন। নিজের সামর্থ্যানুসারে সবসময় গরীব-মিসকীন ও অভাবীদের সাহায্য করতেন। যদি কোন অভাবী লোক এসে যেতো, আর তাঁর নিকট কিছুই থাকতো না, তবে অন্য লোকের নিকট থেকে কর্জ নিয়ে তার চাহিদা মিটাতেন। বেশীরভাগ সময় এ ধরনের কর্জ তাঁর দায়িত্বে থাকতো। নিজের চাহিদা পূরণে কর্জ নিতে তিনি অভ্যস্থ ছিলেন না।
হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা বর্ণনা করেছেন, একদিন হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর নিকট চারটি দিরহাম ছিলো। আর কয়েকটা প্রয়োজনও তাঁর সামনে ছিলো। হঠাৎ এক ইয়ামনী এসে হযরত আলীর সামনে নিজের প্রয়োজনের কথা জানালো। খোদা তা‘আলার সিংহ তৎক্ষণাৎ ওই চার দিরহাম ওই অভাবীকে দান করে দিলেন। আর নিজের প্রয়োজনের কথা চিন্তাই করেননি। পরম করুণাময় আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট এ কাজ অত্যন্ত পছন্দ হলো। তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর প্রশংসা করে ক্বোরআন করীমের নিম্নলিখিত আয়াত নাযিল করলেন-اَلَّذِیْنَ یُنْفِقُوْنَ اَمْوَالَهُمْ بِالَّیْلِ وَ النَّهَارِ سِرًّا وَّ عَلَانِیَةً فَلَهُمْ اَجْرُهُمْ عِنْدَ رَبِّهِمْۚ-وَ لَا خَوْفٌ عَلَیْهِمْ وَ لَا هُمْ یَحْزَنُوْنَؔ(۲۷۴) তরজমা: ওইসব লোক, যারা খোদার রাহে নিজেদের মাল রাতে ও দিনে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তাদের জন্য তাদের রবের নিকট তাদের প্রতিদান (সাওয়াব) রয়েছে। আর তাদের জন্য না ভয় আছে, না অনুশোচনা আছে। [সূরা বাক্বারা: আয়াত-২৭৪, কানযুল ঈমান]
সাইয়্যেদুনা আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা বর্ণনা করেন, হিজরতের পর হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যখন আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন প্রতিষ্ঠা করছিলেন এবং প্রত্যেক আনসারীকে একজন মুহাজিরের ভাই বানিয়ে দিলেন, এমনকি সকল আনসার ও মুহাজিরের চুক্তি পরিপূর্ণ হয়ে গেলো, হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম ব্যতীত। পারস্পরিক চুক্তিগুলো পূর্ণাঙ্গ হয়ে যাবার পর হযরত আলী আরয করলেন, ‘‘হে আল্লাহর রসূল! আপনি সকল মুহাজিরের ভাই নির্বাচন করেছেন, কিন্তু আমাকে কারো ভাই বানাননি? আর কাউকে আমার সঙ্গী নির্দ্ধারণ করেননি।’’ সরকার-ই দু’ আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মায়া-মমতার সাথে হযরত আলীকে নিজের গলা মুবারকের সাথে মিলিয়ে নিলেন, আর কপালে চুমু খেয়ে এরশাদ করলেন- يَا عَلِىُّ اَنْتَ اَخِىْ فِى الدُّنْيَا وَالْاٰخِرَةِ অর্থ: হে আলী! দুনিয়া ও আখিরাতে তুমি আমার ভাই। আর আল্লাহর রসূল তোমার সাথী।
হযরত সাইয়্যেদুনা সা’দ ইবনে আবী ওয়াক্বক্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেছেন, ‘‘একদিন আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হযরত আলীকে সম্বোধন করে দয়া, বদান্যতা ও ভালবাসা ভরা এরশাদ ফরমালেন-يَا عَلِىُّ اَنْتَ مِنِّىْ بِمَنْزِلَةِ هَارُوْنَ مِنْ مَوْسٰى وَلٰكِنْ لاَ نَبِىَّ بَعْدِىْ وَاَنْتَ مِنِّىْ وَاَنَا مِنْكَ ـ (صحيح مسلم شريف) অর্থ: হে আলী! তোমার মর্যাদা আমার নিকট তেমনি, যেমন হারূন আলায়হিস্ সালাম-এর মর্যাদা হযরত মূসা আলায়হিস্ সালাম-এর নিকট ছিলো; কিন্তু স্মরণ রাখো! আমার পর কোন নবী নেই। আমি সর্বশেষ নবী! তুমি আমার, আমি তোমার।’’ [সহীহ্ মুসলিম শরীফ]
সাইয়্যেদুনা আলী মুরতাদ্বা কাররামাল্লাহু তা‘আলা ওয়াজহাহুল করীম এমনিতে তো চতুর্থ খলীফা; কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে তাঁর পূর্ববর্তী তিন খলীফার আমলে তিনি সম্মানিত ও প্রভাবশালী ছিলেন, সরকার-ই দু’ আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম লোক চক্ষুর অন্তরালে তাশরীফ নিয়ে যাবার পর যখন হুযূর-ই আক্রামের খাস বন্ধু হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু খলীফা নির্বাচিত হলেন, তখন থেকে হযরত আলী নিয়মিতভাবে খলীফাকে সমর্থন ও তাঁর ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে লাগলেন। তাঁর পরে হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু খিলাফতের মসনদে আসীন হলেন। তখন হযরত আলী তাঁরও সর্বাধিক সহযোগিতা ও সাহায্য করতে থাকেন। হযরত ওসমান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু যখন খলীফার পদ অলঙ্কৃত করলেন, তখন সাইয়্যেদুনা আলী মুরতাদ্বা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাঁকেও সুপরামর্শ দিতে ও সাহায্য-সহযোগিতা করতে থাকেন এবং খুব বেশী সঙ্গ দিলেন। হযরত ওসমান গণীর শাহাদাতের পর হযরত আলী, সর্বসম্মতিক্রমে খলীফা নির্বাচিত হলেন। তিনি খিলাফতের দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠা ও দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করেন।
হযরত আলীর খিলাফতামলে অনেক বিদ্রোহও দেখা দিয়েছিলো; কিন্তু তিনি তাঁর দায়িত্ব অব্যাহত গতিতে পালন করতে লাগলেন। তিনি প্রয়োজনের তাগিদে ইরানের সীমান্ত ছাউনিকে কূফায় স্থানান্তরিত করে কূফাকেই নিজের কেন্দ্রস্থল (রাজধানী) করে নিলেন; কিন্তু বিদ্রোহী ও ফিৎনাকারীরা এখানেও তাঁকে শান্তিতে কাজ করতে দেয়নি। শেষ পর্যন্ত তাঁর বয়স ৬৩ বছর এবং খিলাফতকাল ৪ বছর ৯ মাস পূর্ণ হওয়ার পর ২১ রমজানুল মুবারক রবিবার ইবনে মুলজিম নামক এক খারেজীর অতর্কিত হামলায় শাহাদত বরণ করেন। ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেঊন।
লেখক: আনজুমান রিসার্চ সেন্টার, ষোলশহর, চট্টগ্রাম।