কেয়ামত দিবসে এক ব্যক্তির শাস্তির বোঝা অন্য কেউ বহন করবে না
অধ্যক্ষ হাফেয কাজী আবদুল আলীম রিজভী
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ
اَعِنْدَهٗ عِلْمُ الْغَیْبِ فَهُوَ یَرٰى(35(اَمْ لَمْ یُنَبَّاْ بِمَا فِیْ صُحُفِ مُوْسٰى(36(وَ اِبْرٰهِیْمَ الَّذِیْ وَفّٰۤى(37(اَلَّا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِّزْرَ اُخْرٰى(38(وَ اَنْ لَّیْسَ لِلْاِنْسَانِ اِلَّا مَا سَعٰى(39(وَ اَنَّ سَعْیَهٗ سَوْفَ یُرٰى(40(ثُمَّ یُجْزٰىهُ الْجَزَآءَ الْاَوْفٰى(41(وَ اَنَّ اِلٰى رَبِّكَ الْمُنْتَهٰى(42(وَ اَنَّهٗ هُوَ اَضْحَكَ وَ اَبْكٰى(43(وَ اَنَّهٗ هُوَ اَمَاتَ وَ اَحْیَا(44(وَ اَنَّهٗ خَلَقَ الزَّوْجَیْنِ الذَّكَرَ وَ الْاُنْثٰى(45(مِنْ نُّطْفَةٍ اِذَا تُمْنٰى(46(وَ اَنَّ عَلَیْهِ النَّشْاَةَ الْاُخْرٰى(47(وَ اَنَّهٗ هُوَ اَغْنٰى وَ اَقْنٰى(48(
তরজমা: তার নিকট কি অদৃশ্যের জ্ঞান আছে? সুতরাং সে কি দেখছে? তার নিকট কি খবর আসেনি সে সম্পর্কে, যা হযরত মূসা আলায়হিস্ সালাম-এর সহীফা সমূহে (আল্লাহ প্রদত্ত কিতাবে) রয়েছে। এবং ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম-এর (সহীফা সমূহে) যিনি (আল্লাহর) বিধানাবলী যথাযথভাবে পালন করেছেন। (কিতাবে আরো রয়েছে) যে, কোন বোঝা বহনকারী ব্যক্তি অন্য কোন ব্যক্তির (গুনাহর) বোঝা বহন করবে না। এবং এ যে, মানুষ পাবে না, কিন্তু আপন প্রচেষ্টা (এর ফলাফল) এবং এ যে, তার প্রচেষ্টা শীঘ্রই দেখা যাবে। অত:পর তাকে পূর্ণমাত্রায় প্রতিদান দেয়া হবে। এবং এ যে, নিশ্চয়ই আপনারই প্রতিপালকের নিকট সমাপ্তি, এবং এ যে, তিনিই হন (সেই সত্ত্বা) যিনি (যাকে ইচ্ছা) হাসিয়েছেন এবং (যাকে ইচ্ছা) কাঁদিয়েছেন। এবং এ যে, তিনিই হন (সেই সত্ত্বা) তিনি যাকে ইচ্ছা মৃত্যু ঘটান এবং যাকে ইচ্ছা জীবিত করে। এবং এ যে, তিনিই দু’জোড়া তৈরী করেন- নর ও নারী। বীর্য থেকে যখন স্খলিত হয়। এবং এ যে, তাঁরই দায়িত্বে শেষ উত্থান। এবং এ যে, তিনিই অভাবমুক্তি দান করেছেন এবং স্বল্পে তুষ্টি দান করেছেন। [৩৫-৪৮ নং আয়াত সূরা আন নাজম]
আনুষঙ্গিক আলোচনা
ام لم ينبابما فى صحف موسى- وابرهيم الذي وفى
উপরোক্ত আয়াতদ্বয়ের ব্যাখ্যায় মুফাসসেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছন যে, এতে সাইয়্যেদুনা ইব্রাহীম খলীলুল্লাহ আলায়হিস সালামের বিশেষ গুণ অঙ্গিকার পূরনের প্রসঙ্গে আলোকপাত করা হয়েছে। অর্থাৎ তাঁকে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে যেসব নির্দেশাবলী প্রদান করা হয়েছিল তা তিনি পরিপূর্ণরূপে পালন করেছিলেন, এতে প্রিয়তম পুত্র সাইয়্যেদুনা ইসমাঈল যবীহুল্লাহ আলায়হিস্ সালাম-এর আল্লাহর নামে যবাই হওয়ার বিষয় এবং নিজে অভিশপ্ত নমরূদের আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত। তাছাড়া অন্যান্য নির্দেশিত কার্যাবলীও। অত:পর মহান আল্লাহ ঐ বিষয় বস্তুর উল্লেখ করেছেন যা হযরত মূসা আলায়হিস্ সালাম এর কিতাব ‘তাওরাত শরীফ’ এবং হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালামকে প্রদত্ত সহীফা সমূহে উল্লেখ করা হয়েছে। [খাযায়েনুল ইরফান শরীফ]
وفى মানে ওয়াদা-অঙ্গিকার পরিপূর্ণরূপে পালন করা। অর্থাৎ সাইয়্যেদুনা ইব্রাহীম খলীলুল্লাহ আলায়হিস সালাম আল্লাহর কাছে অঙ্গিকার করেছিলেন যে, তিনি আল্লাহর আনুগত্য করবেন এবং মানুষের নিকট তাঁর পয়গাম পৌঁছিয়ে দেবেন, তাঁকে অনেক অগ্নিপরীক্ষায়ও অবতীর্ণ হতে হয়েছে।
[তাফসীর ইবনে কাসীর ও ইবনে জরীর তাবারী]
কোন কোন হাদীস শরীফে সাইয়্যেদুনা ইব্রাহীম খলীলুল্লাহ আলায়হিস্ সালাম-এর বিশেষ বিশেষ কর্মকান্ড বোঝানোর জন্য وفى শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এটা উপরোক্ত তাফসীরের পরিপন্থী নয়। কেননা, অঙ্গিকার পালন শব্দটি মূলত: ব্যাপক, এতে নিজস্ব কর্মকান্ড সহ খোদায়ী বিধানাবলী পালন এবং আল্লাহর আনুগত্য ও দাখিল আছে। এ ছাড়া রেসালতের কর্তব্য পালনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের সংশোধন ও এর পর্যায়ভূক্ত। হাদীসে বর্ণিত কর্মকান্ড ও এগুলোর অন্তর্ভূক্ত।
উদাহরণ: হযরত আবূ ওসামা রদিয়াল্লাহ আনহু কর্তৃক বর্ণিত রেওয়ায়েতে আছে যে, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম- وابرهيم الذي وفى তেলাওয়াত করে তাকে বললেন- তুমি জান এর মতলব কি? হযরত আবূ ওসামা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু আরজ করলেন- আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন অর্থ এইوفى عمل يومه باربع ركعات فى اول النهار অর্থাৎ তিনি দিনের কাজ এভাবে পূর্ণ করে দেন, দিনের শুরুতে চার রাকআত (ইশরাকের) নামায পড়ে নেন, (তাফসীরে ইবনে কাসীর)
জামে তিরমীজি শরীফে সাহাবীয়ে রাসূল সাইয়্যেদুনা হযরত আবূ যর গিফারী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু কর্তৃক বর্ণিত এক হাদীস দ্বারাও এর সমর্থন পাওয়া যায়। রাসূলে আকরম নূরে মুজাসসাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন -ابن ادم اركع لى اربع ركعات فى اول النهار اكفك اخرة অর্থাৎ মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন : হে বনী আদম! দিনের শুরুতে আমার জন্য চার রাকআত নামাজ আদায় করো, আমি দিনের শেষ পর্যন্ত তোমার সকল কাজের জন্য যথেষ্ট হয়ে যাব।
সাহাবীয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম সাইয়্যেদুনা হযরত মুয়ায ইবনে আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর রেওয়ায়তে রাসূলে আকরম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন আমি তোমাদেরকে বলছি মহান আল্লাহ সাইয়্যেদুনা হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস সালামকে الذي وفى খেতাবে কেন ভূষিত করলেন। কারণ এই যে, তিনি প্রত্যহ সকাল-বিকাল নি¤েœাক্ত এই আয়াত তেলাওয়াত করতেন فسبحن الله حين تمسون وحين تصبحون وله الحمد فى السموات والارض و عشيا و حين تظهرون- [তাফসীরে ইবনে কাসীর]
اعنده علم الغيب فهو يرى
উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীর শাস্ত্রবিশারদগণ উল্লেখ করেছেন- পূর্বোক্ত আয়াতে কুরআন : تولى واعطى قليلا এর শানে নুযুল বর্ণনায় উল্লেখিত ঘটনার আলোকে আলোচ্য আয়াতের উদ্দেশ্য এই যে, যে ব্যক্তি তার কোন এক বন্ধুর এই কথায় ইসলাম ত্যাগ করলো যে, তোমার পরকালীন আযাব আমি মাথা পেতে নেব, সেই নির্বোধ লোকটা বন্ধুর এই কথায় কিরূপে বিশ্বাস স্থাপন করলো? তার কাছে কি অদৃশ্যের জ্ঞান আছে? যদ্ধারা সে দেখতে পাচ্ছে যে, এই বন্ধু তার শাস্তি মাথা পেতে নেবে এবং তাঁকে বাঁচিয়ে দেবে? বলা বাহুল্য, এটা নিরেট প্রতারণা। মূলত : তার কাছে কোন অদৃশ্যের জ্ঞান নেই। এবং অন্য কেউ তার পরকালীন শাস্তি নিজে ভোগ করে তাকে বাঁচাতে পারে না। পক্ষান্তরে যদি শানে নুযুলের ঘটনা থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়া হয়, তবে আয়াতের অর্থ এই হবে যে, দান কার্য শুরু করে তা বন্ধ করে দেয়ার কারণ এই ধারনা হতে পারে যে, উপস্থিত সম্পদ ব্যয় করে দিলে আবার কোথা থেকে আসবে যে? এই ধারনা খন্ডন করার জন্য বলা হয়েছে , তার কাছে কি অদৃশ্যের জ্ঞান আছে, যদ্ধারা সে দেখতে পাচ্ছে, যে, এই সম্পদ খতম হয়ে যাবে এবং তদস্থলে অন্য সম্পদ সে লাভ করতে পারবে না ? এটা ভূল তার কাছে অদৃশ্যের জ্ঞান নেই, এবং তার এই ধারণাও সঠিক নয়।
صحف موسى وابرهيم
এর বিশেষভাবে উল্লেখ করার তৎপর্য : সাইয়্যেদুনা হযরত মূছা কলীমুল্লাহ ও সাইয়্যেদুনা হযরত ইব্রাহীম খলীলুল্লাহ আলায়হিমুস সালাম এর ছহীফা সমূহের বিশেষ নির্দেশ ও শিক্ষা বর্ণনায় তাৎপর্য ব্যাখ্যায় মুফাসসেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন- পবিত্র কুরআনে করীম পূর্ববর্তী কোন পয়গম্বরের উক্তি অথবা শিক্ষা উদ্ধৃত করার মানে এই যে, এই উম্মতের জন্য ও সেটা অবশ্য পালনীয়। তবে এর বিপক্ষে কোন আয়াত অথবা হাদীস থাকলে সেটা ভিন্ন কথা। পরবর্তী আঠার আয়াতে সেই সব বিশেষ শিক্ষা উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলো মূছা ও ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম-এর ছহীফায় উল্লেখ ছিল, তন্মধ্যে পূর্ববর্তী আয়াত সমূহের সাথে সম্পর্কযুক্ত কর্মগত বিধান মাত্র দুটি। অবশিষ্ট শিক্ষা উপদেশ ও আল্লাহর কুদরতের নিদর্শনাবলীর সাথে সংম্পৃক্ত, কর্মগত বিধানদ্বয় এই যে : الا تزروازرة وزر اخرى এবং وان ليس للانسان الا ما سعى প্রথম আয়াতের অর্থ হলো এই যে, কোন বোঝা বহনকারী নিজের ছাড়া অপরের বোঝা বহন করবে না। এ আয়াতে বোঝা মানে পাপ তার শাস্তির বোঝা, উল্লেখ্য এই যে, কেয়ামতের দিন এক ব্যক্তির শাস্তি অপরের ঘাড়ে চাপানো যাবে না, এবং অপরের শাস্তি নিজে বহন করার ক্ষমতা ও কারও হবে না। দ্বিতীয় বিধান হচ্ছে وان ليس للانسان الا ما سعى অর্থাৎ এ আয়াতের সারমর্ম এই যে, অপরের আযাব যেমন কেউ নিজে গ্রহন করতে পারে না, তেমনি অপরের কাজ নিজে করার অধিকারও কারও নেই। এতে করে সে অপরকে কাজের দায়িত্ব থেকে মুক্ত করতে পারে না, উদাহরণত: এক ব্যক্তি অপরের পক্ষ থেকে ফরয নামাজ আদায় করতে পারে না এবং ফরজ রোজা রাখতে পারে না। এভাবে যে, অপর ব্যক্তি এই ফরজ নামাজ ও রোজা থেকে মুক্ত করতে পারে না। যার ফলে অপরকে মুমিন সাব্যস্ত করা যায়।
লেখক: অধ্যক্ষ-জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদরাসা, চট্টগ্রাম।