শিক্ষার্থীদের আত্মহনন এবং আমাদের দায়ভার
মুহাম্মদ আনোয়ার শাহাদাত>
পৌনে পাঁচ কোটি তরুণের দেশ প্রিয় বাংলাদেশ। এই তরুণদের হাত ধরেই রচিত হবে আগামীর বাংলাদেশের সাফল্যের ইতিহাস। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সাথে তাল মিলিয়ে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রাকে আরো এগিয়ে নিতে হলে আজকের তরুণ ও যুবকদের হতে হবে জ্ঞান-বিজ্ঞানে অত্যন্ত দক্ষ ও কর্মঠ। অথচ অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের তরুণদের একটি অংশ বিশেষ করে তরুণ শিক্ষার্থীদের একটি অংশ চরম হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে অমূল্য জীবনের মর্মার্থ ভুলে গিয়ে আত্মহননের পথ বেঁচে নিচ্ছে। যা অত্যন্ত ভয়াবহ ও মারাত্মক সামাজিক বিপর্যয়ের রূপ নিচ্ছে! বিগত এক দশক আগেও পরিস্থিতি এমন ভয়াবহ ছিল না। বর্তমানে শিক্ষার্থীদের আত্মহনন অতীতের সকল পরিসংখ্যানকে টপকে গেছে। আত্মহনন বা আত্মহত্যা এমন একটি আত্মবিধংসী কাজ যা ঘটে গেলে শোধরানোর কোন রাস্তা বা উপায় আর বাকি থাকে না। মানুষের মৃত্যুর প্রথম দশটি কারনের মধ্যে আত্মহত্যাও একটি অন্যতম কারন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৮ লাখ লোক আত্মহত্যা করে! বিশেষ করে ১৯ থেকে ২৫ বছরের তরুণ-যুবকদের মধ্যে এই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি যা মানবতার জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি ও ভয়াবহ ইঙ্গিত।
দেশের তরুণ শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহননের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় বর্তমানে পৃথিবীর উচ্চ আত্মহত্যা প্রবণতা দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশও চলে এসেছে যা সত্যিই ভয়াবহ ইঙ্গিত বহন করে। শিক্ষার্থীদের এই আত্মহনন রুখতে হবে নতুবা মানবিক সমাজ বিনির্মাণ যেমন কঠিন হবে তেমনি সভ্যজাতি হিসেবে বিশ্বদরবারে গৌরবময় অবস্থানে পৌঁছুতে আমরা ব্যর্থ হব। শিক্ষার্থীদের আত্মহননের প্রবণতা কেন বেড়ে চলেছে তা অনুসন্ধান করে উপযুক্ত ও কার্যকরী পদক্ষেপের মাধ্যমে সমাধানের পথে এগিয়ে আসতে হবে সকলকে সম্মিলিত ভাবে। কারো একক প্রচেষ্টা বা উদ্যোগে এই ভয়াবহ মানববিধংসী প্রবণতা রোধ করা সহজ হবে না। তাই ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র একত্রে সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। যে কোন সমস্যা সমাধানের পূর্বে সমস্যা কি এবং এর মূল কারনগুলো যথাযথ খুঁেজ বের করা জরুরি। বিখ্যাত ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইমের মতে, আত্মহত্যা একটি সামাজিক ঘটনা। তাঁর বিখ্যাত ’দ্যা সুইসাইড’ গ্রন্থে আত্মহত্যা নিয়ে ব্যাপক আলোচনার পর তিনি জোর দিয়ে বলেছেন- ’আত্মহত্যা করার শক্তি যতটুকু না মানসিক তার চাইতে বেশি সামাজিক। তিনি উপসংহারে এসেছিলেন যে, সামাজিক অশান্তি বা সামাজিক সংহতির অভাব থেকে আত্মহত্যার ফলাফল।’
আত্মহত্যার কারণ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষক, অপরাধ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড.জিয়া রহমান বলেন, ’সমাজে যখন প্রতিযোগীতা বেড়ে যায়, মানুষের মনে চাপ বাড়ে, জীবন ধারণের চাপ বাড়ে তখন আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যা এক ধরনের অপরাধ। একটা জীবনকে শেষ করে দেয়া আমাদের দেশের সমাজ ও আইন সেটাকে বৈধতা দেয়নি।’ সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, মানসিক চাপে মানুষ আত্মহত্যা করে থাকে। দেশে কম বয়সি শিক্ষার্থী ও তরুণদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। শিক্ষাব্যবস্থায় অত্যধিক বৈষম্য, শিক্ষায় অতিরিক্ত প্রতিযোগীতা, পরীক্ষার পাশের চাপ, শিক্ষাজীবন শেষ করে চাকরি না পাওয়া, জীবনের মূল্য সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাব, জীবনের প্রতি হতাশা, প্রেমে ব্যর্থতা, মাদকাসক্তি, পারিবারিক ও সামাজিক শাসন ও বন্ধনের অভাব,অভিভাবক বা পিতামাতার অতিশাসন, চাহিদার অপূর্ণতা থেকে সৃষ্ট মানসিক যন্ত্রণা, বয়োঃসন্ধিকালের মনোদৈহিক পরিবর্তনের সাথে নিজেকে দ্রুত খাপ খায়য়ে নিতে না পারা, আত্মহত্যার সরঞ্জামের সহজলভ্যতা, এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আত্মহত্যার বিভিন্ন ভিডিও তরুণদের আত্মহত্যায় প্ররোচনা যোগায়। মাধ্যমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া শিক্ষার্থীরা পর্যন্ত আত্মহত্যার মতো ভয়াবহ পথ বেছে নিচ্ছে। আচঁল ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, ২০২০ সালে ৭৯ জন শিক্ষার্থী, ২০২১ সালে ১০১ জন শিক্ষার্থী, ২০২২ সালে ৪৪৬ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করছে। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২২ সালে আত্মহত্যার এই হার ৫ দশমিক ৫ গুণ বেড়েছে যা সত্যিই ভয়ানক!
শিক্ষার্থীদের আত্মহননের এই মিছিল আর দীর্ঘ হতে দেয়া যায় না। অন্য অনেক সমস্যার মতো এই সমস্যারও সমাধান আছে। এটি শুরু করতে হবে আপন ঘর থেকেই। আমরা যদি প্রত্যেকে নিজের সন্তানদেরকে এই জঘন্যতম ও মহাপাপের পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে চাই তাহলে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। এই জন্য আমাদের প্রথম দরকার আমাদের সন্তানের উপযুক্ত নৈতিক শিক্ষা দান করা। তাদেরকে বুঝানো যে তারা ¯্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। মানুষ হিসেবে তাদের আত্মপরিচয় সর্ম্পকে সচেতন করে তুলতে হবে। তাদের মন-মগজে এটি গেঁথে দিতে হবে যে, জীবন সংহারের বা আত্মহননের অধিকার তার নেই। জীবন হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা বা আল্লাহ প্রদত্ত মহান আমানত এবং মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে তার মূল্য অনেক। একজন মানবসন্তান শিশুকাল পেরিয়ে কিশোর এবং যৌবনে যেতে যেতে যদি তার কাছে জীবনের মূল্য, এই জীবনের প্রকৃত মালিক কে, মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে তাকে কে পাঠিয়েছেন, কেন পাঠিয়েছেন, এই সুন্দর পৃথিবীতে তার বেচেঁ থাকার প্রয়োজনীয়তা কত মূল্যবান ও অর্থবহ, তার চুড়ান্ত গন্তব্য কোথায় এবং শেষ পর্যন্ত তাকে যে পৃথিবীর প্রতিটি কর্মকান্ডের পইপই হিসেব দিতে হবে এবং কর্মানুযায়ী তাকে প্রতিফল ভোগ করতে হবে এসব বিষয় সম্পর্কে খুবই স্বচ্ছ ধারণা যদি আমরা দিয়ে দিতে পারি তাহলে সেই সন্তান সহজে কখনো কোন অনৈতিকতার পথ কিংবা জীবন সংহারি পথ বেছে নিবে না। কিশোর-তরুণ বয়স থেকেই তাদের বুঝাতে হবে যে, তাদের জীবন শুধু তাদের কাছে নয় বরং তার মা-বাবা, পরিবারর-পরিজন, সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জীবনে প্রতিযোগীতা, ঘাত-প্রতিঘাত, অকৃতকার্যতা, ব্যর্থতা এবং চরম দূর্দিন বা সংকট আসতে পারে এবং এগুলো জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানুষকে প্রকৃত মানুষ হতে হলে এসব ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। এসব ব্যাপারগুলো সম্পর্কে সন্তানদের পরিস্কার ধারণা দিতে হবে এবং চলমান বাস্তবতার মধ্যে কীভাবে নিজেকে একজন প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে হবে তার শিক্ষা ও প্রেরণা দিতে হবে পরিবার থেকেই। সন্তানের ভুল বা অন্যায় কাজের জন্য তাদেরকে মাত্রাতিরিক্ত বকাঝকা করা, পরীক্ষায় অকৃতকার্য বা সম্মানজনক ভাবে উত্তীর্ণ হতে না পারা, পড়ালেখা বা ক্যারিয়ারের ব্যাপারে অন্য কারো সাথে তুলনা দিয়ে সবসময় মানসিক চাপে রাখা ইত্যাদি বিষয় থেকে মা-বাবা তথা অভিভাবকদের সতর্ক থাকা খুবই প্রয়োজন। মানুষ মাত্রই ভুল। আর তরুণ বয়সে তো তাদের মনোবৈচিত্রের কারনে বিভিন্ন ভুল পথে বা বিভিন্ন অনৈতিক কাজে জড়াতে পারে সেটি স্বাভাবিক। তখন পরিবারকে তার প্রতিপক্ষ নয় বরং বন্ধু হয়ে পাশে দাঁড়াতে হবে, তার সাথে আন্তরিকতার সাথে কথা বলে জানার চেষ্টা করতে হবে সমস্যা কোথায় এবং কেন সে এই কাজ করছে বা এই পথে পা দিয়েছে। সমস্যা চিহ্নিত করে কৌশলে তার সহযোগী হয়ে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে, প্রয়োজনে মনোচিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া যেতে পারে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সাথে রূঢ় আচরণ করা থেকে শিক্ষকদের বিরত থাকা উচিত এবং ক্লাসে কাউকে অতিরিক্ত হেনস্থা করা বা লজ্জা দেয়া উচিত না। শিক্ষার পরিবেশ এবং শিক্ষকদের আচরণ আরো বন্ধুত্বসুলভ এবং সাপোর্টিভ হওয়া দরকার। স্কুলে নিয়মিত পড়ালেখার পাশাপাশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড বাড়ানো প্রয়োজন, বিভিন্ন মনীষীদের সংগ্রামী জীবনী পড়তে দেয়া এবং পৃথিবীখ্যাত মনীষীদের সংগ্রামী জীবন নিয়ে শ্রেণিকক্ষে আলোচনা করা প্রয়োজন। যাতে করে শিক্ষার্থীরা অনুধাবন করতে পারে যে, জীবনে সফলতার জন্য অনেক চড়াই-উৎরাই পাড়ি দিতে হয়। ব্যর্থতা না আসলে জীবনে সফল হওয়া যায় না। পরীক্ষায় ভালো ফলাফল না করলেই জীবন ব্যর্থ এমন চিন্তার বলয় থেকে শিক্ষার্থীদের বের করতে আনতে হবে। সময় এসেছে মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে কাউন্সিলর ও ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিষ্ট নিয়োগ দেয়া। তাতে করে শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সঠিক সময়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণে সুবিদা হবে এবং মানসিক বিপর্যয়ের হাত থেকে শিক্ষার্থীদের রক্ষা করা যাবে। পড়ালেখার জন্য অতিরিক্ত বকাঝকা না করে তাদের দূর্বলতার জায়গাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা করা এবং প্রয়োজনে তাদের অভিভাবকদের অভিহিত করা উচিত। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সেশনজট কমিয়ে আনা দরকার এবং রাষ্ট্রের উচিত বেকার সমস্যা সমাধানের ব্যাপক ও কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করা তাহলে যারা বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে পড়ালেখা শেষ করার পর্যায়ে রয়েছে তাদের মনে বেকারত্বের আশঙ্কা কমে যাবে এবং মানসিক চাপ থেকে তারা রেহাই পাবে। প্রত্যেক অভিভাবকদের উচিত তার সন্তান কাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করছে এবং কোথায় কোথায় সময় কাটাচ্ছে তার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা এবং শুরুতেই এসব ব্যাপারে সন্তানকে উপযুক্ত দিক-নির্দেশনা দেয়া। কারন বন্ধুত্বের সাহচর্যে মানুষ প্রথমে খারাপ পথে পা বাড়ায় তারপর আস্তে আস্তে এতে অভ্যস্থ হয়ে পড়ে। মাদকাসক্তি, মোবাইল কিংবা প্রযুক্তির নেশায় বুদবুদ হয়ে থাকা, পরিবারের তোয়াক্কা না করে বাউণ্ডুলে জীবনে অভ্যস্থ হয়ে পড়া এবং আধুনিকতার নামে অপসংস্কৃতিতে নিজেকে বিলিয়ে দেয়া ইত্যাদি থেকে প্রজন্ম রক্ষা করার দায়িত্ব কিন্তু আমার, আপনার সকলের। মা-বাবারা শুধু সন্তানদের পরীক্ষার ফলকে সামাজিক মর্যাদা রক্ষার হাতিয়ার বলে মনে করেন। প্রত্যাশিত ফলাফল অর্জনে ব্যর্থ হলে সন্তানকে তিরস্কার, গালাগাল এমনকি শারীরিক নির্যাতন করার মতো ঘটনাও ঘটে যা সন্তানের আত্মসম্মানে ব্যাপক প্রভাব ফেলে এবং সে নিজেকে ব্যর্থ, অথর্ব ভাবতে থাকে ফলশ্রুতিতে জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা চলে আসে এবং আত্মহননের পথে পা বাড়ায়। প্রত্যেক মা-বাবা তার সন্তানকে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চায়। ভালো পড়া-লেখা করে ভালো চাকরি করবে, পরিবারে আর্থিক সচ্চলতা বাড়াবে, সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করবে এসব নিয়ে ভাবেন সর্বক্ষণ কিন্ত ক’জন মা-বাবা এমন আছেন যারা চায় তার সন্তান একজন প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠুক, নৈতিক শিক্ষায় মানবিকবোধ সম্পন্ন একজন সাদামনের মানুষ হয়ে উঠুক। আমাদের চিন্তার জগতে পরিবর্তন আনতে হবে তাহলেই আমরা আমাদের প্রজন্মকে উপযুক্ত শিক্ষা েিদত পারব এবং আত্মহননের মতো মারাত্মক অপরাধ প্রবণতা থেকে বাঁচাতে পারব। অনেক সময় দেখা যায় কর্মজীবী স্বামী-স্ত্রী উভয়ে বেশিরভাগ সময় বাইরে কাটান তাই তাদের সন্তানরা মা-বাবাকে কাছে পায় না। অর্থ, যশ-খ্যাতি, সম্মান অর্জনের তীব্র প্রতিযোগীতায় নিরন্তর ছুটে চলা এসব অভিভাবকদের এতটুকু ফুরসত হয় না নিজের সন্তানদের সাথে দুদণ্ড বসে কথা বলার কিংবা গল্প করার। সন্তানদের পড়ালেখা, আচার-আচরণ, স্বাস্থ্য, তাদের আবেগ-অনুভুতি বা ভালোলাগা, মন্দলাগার বিষয়ে খোঁজ-খবর নেবার সময়টুকু অনেক মা-বাবাই পান না। আবার অনেক ক্যারিয়ার সফল মানুষ আছেন যারা জাগতিক মোহে নানান কারনে সংসারের প্রতি অনীহা দেখিয়ে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাচ্ছেন। ফলশ্রুতিতে এসব ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তানদের মনের উপর ব্যাপক বিরূপ প্রভাব পড়ে। বাবা-মায়ের এমন দ্বন্দ্বের কারনে সন্তানদের মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয় এবং তা পরবর্তীতে হতাশায় রূপান্তরিত হয়। এমন মানসিক অবস্থা সে না পারে সইতে না পারে প্রকাশ করতে। এই মানসিক সংকটের অনিবার্য ফল হিসেবে একসময় সে জড়িয়ে পড়ে মাদক সহ নানাবিধ অনৈতিক কর্মকান্ডে এবং হয়ে উঠে সংসার বিদ্বেষী যার শেষ পর্যায়ে অপেক্ষা করে নিজেকে ধ্বংস করে দেয়ার মতো মনোবৈকল্য কিংবা আত্মহত্যা।
আমরা মুসলিম হিসেবে আমাদের পুরো জীবন পরিচালিত করতে হবে ইসলামের কালজয়ী দিকনির্দেশনা অনুযাযী। ইসলামে আত্মহননের কোন সুযোগ নেই। আমাদের ধর্মে আত্মহত্যা মহাপাপ, দেশের প্রচলিত আইনেও এটি অপরাধ হিসেবে বিবেচ্য। যে বা যারা আত্মহত্যার পথ বেছে নেবে তাদের অমূল্য জীবন তো শেষ হয়ে যাবে পৃথিবী থেকে কিন্তু চুড়ান্ত বিচারের দিন এর ভয়াবহ ও মর্মন্তুদ শাস্তি পেতে হবে। জীবন থেকে পালিয়ে বাঁচা যায় না, জীবনকে মোকাবিলা করতে হয়। সকল বিপদাপদ এবং প্রতিকূলতাকে দূরে ঠেলে সফলতার পথে এগিয়ে যাওয়ার নামই হচ্ছে জীবন। কোন কাজে ব্যর্থ হওয়া মাত্র অধৈর্য হয়ে হতাশার অন্ধকারে ডুবে যাওয়া কোন মুসলমানের কাজ নয়, এই সমস্ত বিষয়গুলো সন্তানদের হৃদয়ে গেঁথে দিতে হবে।
মহান রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনুল করীমে ঘোষণা দেন, ’হে ঈমানদারগণ! তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর; নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্য্যশীলদের সাথে রয়েছেন।’ [সূরা বাকারা-১৫৩]
আর আত্মহত্যার ব্যাপারে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, ’তোমরা নিজেদের হত্যা করো না; নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি ক্ষমাশীল।’ [সূরা নিসা-২৯]
আত্মহত্যার মারাত্মক পরিণতি সম্পর্কে সন্তানদেরকে জানাতে হবে। এই ব্যাপারে কোরান হাদীসের যে ব্যাপক শিক্ষা রয়েছে তা তুলে ধরে মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া, বিভিন্ন সভা-সমাবেশে আলোচনা করতে হবে। আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের একাধিক হাদিস শরীফ রয়েছে যেখানে আত্মহত্যার ভয়াবহ পরিণতির কথা উল্লেখ রয়েছে। যেমন হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন, ’যে ব্যক্তি ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামে (অনুরূপভাবে) নিজেকে ফাঁস লাগাতে থাকবে আর যে ব্যক্তি বর্শার আঘাতে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামে (অনুরূপভাবে) বর্শা বিদ্ধ হতে থাকবে।’ [বুখারী শরীফ]
হাদীসের মর্মকথা হলো, পৃথিবীতে যে যেভাবে নিজেকে হত্যা করবে ঠিক সে সেইভাবে জাহান্নামে নিজের উপর শাস্তি ভোগ করবে। কেউ যদি পাহাড় থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করা সে চিরকাল জাহান্নামের আগুনে লাফিয়ে পড়তে থাকবে। যে বিষপানে আত্মহত্যা করবে সে চিরকাল জাহান্নামের আগুনের মধ্যে দগ্ধ হতে হতে বিষ পান করতে থাকবে। কতই না মর্মান্তিক ও ভয়ানক শাস্তি! এমনকি বিষপানে আত্মহত্যাকারীর জানাজাও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি আদায় করেননি।
এত অপমানজনক ও লাঞ্চনার মৃত্যু কেন বেছে নেবে আমাদের প্রজন্ম! কোন মা-বাবা তার সন্তানের আত্মহনন মেনে নিতে পারে না। একজন সন্তানের অকাল ও অনৈতিক এই মরণ কত যে দুঃসহ যন্ত্রণার তা কেবল ভুক্তভোগী মা-বাবারাই বুঝতে পারেন। তাই আসুন পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে উঠার আগে আমাদের মানবিক সম্পর্কগুলো জোরদারে সচেষ্ট হই। সন্তানের সাথে মা-বাবা কিংবা অভিভাবকদের সম্পর্কগুলোর যত্ন ও সুরক্ষায় নিজের দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিই। সন্তানদের যে কোন সমস্যা সমাধানে মানবিক সহযোগীতার হাত সবসময় উন্মুক্ত রাখি। তবেই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আত্মহননের মত মারাত্নক ও ভয়াবহ ব্যাধি থেকে রক্ষা করতে পারব।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সৌদি আরব প্রবাসী।