আল্লামা ইকবালের কাব্যে ইশকে রাসূল
শাহ্জাহান মুহাম্মদ ইসমাইল>
আল্লামা ইকবাল ছিলেন বিংশ শতকের অন্যতম প্রখ্যাত চিন্তাবিদ ও ইসলামী চিন্তা ধারার সার্থক ভাষ্যকার। তিনি একাধারে ছিলেন কবি, দার্শনিক, চিন্তানায়ক ও ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানে সুপন্ডিত ব্যক্তিত্ব।
আল্লামা ইকবালের রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র ইশকে রাসূল যেন স্বচ্ছ সলিলা সরোবর। তাঁর রচিত কবিতায় ইসলামি ভাবধারা ইসলামের জয়গান বিশেষত নবীপ্রেম ছিলো মূল প্রতিপাদ্য। আল্লামা ইকবাল ছিলেন একজন প্রকৃত আশেকে রসূল, নির্ভেজাল নবীপ্রেমিক।
ইশকে রাসূলের অমূল্য মনি মুক্তার তালাশে আল্লামা ইকবাল সে সরোবরে সানন্দে ঘুরে বেড়িয়েছন আজীবন। আর গেঁথেছেন নবীপ্রেমের হীরা-জহরতে ভরা অমূল্য না’তের মনিহার।
আওলাদে রসূল গাউসে জামান আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি (১৯১৬ খ্রি.-১৯৯৩ খ্রি.) ছিলেন আল্লামা ইকবাল’র কবিতার একনিষ্ঠ সমঝদার পাঠক ও ভক্ত। তাঁর প্রাত্যহিক প্রাতকালীন তাকরীর এবং পীরভাইদের কাছে লিখিত চিঠিপত্রে প্রায়শই ইকবালের কবিতার উদ্ধৃতি শোভা পেত। ইকবালের একটা শে’র তিনি সব সময় উচ্চারণ করতেন,
“কী মুহাম্মদ সে ওয়াফা তুনে, তো হাম তেরে হ্যায়,
ইয়ে জাহাঁ চিজ হ্যায় কেয়া লওহ কলম তেরে হ্যায়”।
[জওয়াবে শেকওয়া’র শেষ চরণ]
আমাদের জাতীয় কবি, কাজী নজরুল ইসলাম, আল্লামা ইকবালের এ অমর পংক্তিটির কী সুন্দর কাব্যানুবাদ করেছেন –
“আল্লাহ্ কে যে পাইতে চায়, হযরতকে ভালবেসে,
আরশ-কুরসী, লওহ-কলম না চাহিতে পেয়েছে সে।”
কবি ইকবাল ছিলেন প্রকৃত নবী প্রেমিক। নবী প্রেমে মাতোয়ারা কবির কন্ঠে তাই উচ্চারিত হতে দেখি,
“মগজে কুরআ, রুহে ঈমান, জানে দ্বীন,
হাসত হুব্বে রাহমাতুল্লিল আলামীন।”
অর্থাৎ- “কুরআনের মগজ, ঈমানের আত্মা, ধর্মের প্রাণ শক্তি হলো, সৃষ্টির তরে অপার করুনার (নূর নবীজী) প্রতি, অকুণ্ঠ ভালবাসা।”
এ শেরটিও আমরা হুযুর কিবলা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হির কাছ থেকে বহুবার শুনেছি। কারণ এ দেশের বুকে ইশকে রাসূলের জোয়ার বইয়ে দিয়েছেন তিনি। যার প্রমান জশনে জুলসের সুবিশাল মিছিলের প্রবর্তন (১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি সবসময় বলতেন, “নবী প্রেম হল ইমানের পূর্বশর্ত”। ইকবালের উপরোক্ত শেরটাও একই কথার প্রতিধ্বনি।
ইশকে রাসূলের রঙ্গে রংগীন হতে পারলেই আমাদের মুক্তি সুনিশ্চিত। তাই আল্লামা ইকবাল বলেন,
“হার কে ইশকে মুস্তাফা সামানে উস্ত,
বাহরও বর দর গোশায়ে দামানে উস্ত”।
“ইশকে মুস্তাফার ধনে পারলে হতে ধনী,
জল ও স্থলের সব কিছু ধরা দেবে এমনি”॥
নূর নবীজীর প্রতি পরিপূর্ণ আনুগত্য প্রদর্শনের দাবী করে আল্লামা ইকবাল ঘোষণা করেন,
“ব-মুস্তাফা ব-রসা খেশ রা কে দ্বীন হামা উস্ত,
আগর বা-উ না রসিদী তামামী বু-লাহাভী আস্ত’’॥
“নবী মুস্তাফার চরণে তুমি সঁপে দাও নিজেকে,
তা না হলে তুমিও পরিণত হবে আবু লাহাবে”॥
সব সময় অযু অবস্থায় জিকিরে লিপ্ত থাকার উপদেশ দিতে গিয়েও হুযুর কিবলা (রাহমাতুল্লাহি আলায়হি) কবি ইকবালের একখানা শের উদ্ধৃত করেছেন, -“হাত কার ওয়াল, দীল ইয়ার ওয়াল” অর্থাৎ- ‘হাত দিয়ে কাজ কর, মন দিয়ে আল্লাহ্ কে স্মরণ কর’।
ফানাফিল্লাহ’র মকাম হাসিলের জন্য আমাদেরকে উৎসাহ দিতে গিয়েও তিনি আল্লামা ইকবালের একটা শের উল্লেখ করেছেন,
“মিটাদো আপনি হাস্তি কো আগর কুছ মরতবা চাহো,
কে দানা খাকপে মিল কর গুলে গুলজার বনতি হ্যায়”।
কাব্যানুবাদ-
‘হও যদি তুমি প্রত্যাশী ভবে মর্যাদার,
মিটিয়ে দাও তবে নিজের অস্তিত্বের পাহাড়,
বীজের চরম আত্ম বলিদান,
গড়ে তোলে সুশোভিত ফুল বাগান’॥
রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম’র সম্মানের প্রতি এমনি ছিল কবির চিন্তাধারা।
কবির রাসূল প্রেমের একটা উদাহরণ দিচ্ছি ইকবালের ‘জওয়াবে শেকওয়া’র শেষ অধ্যায় থেকে। ‘জওয়াবে শেকওয়া’য় মোট ৩৬ টি স্তবক রয়েছে। এর ৩৩ সংখ্যক স্তবকখানা দেখুন,
“সে নামেরি কুসুম ছাড়া বুলবুলিদের বিলাপ বৃথা,
ফুল বাগানের শোভা বৃথা, মুকুলরাজির হাসি বৃথা,
ঐ নামেরি সাকী ছাড়া পাত্র বৃথা, শরাব বৃথা,
তৌহিদ সভার শোভা বৃথা, তোমাদেরও হাস্তি বৃথা,
ঐ নামেরি কল্যাণে আজ আকাশ আছে শূণ্য পরে,
ভবের নাড়ী সবল আছে, পবিত্র সে নামের জোরে।”
আল্লামা ইকবালে’র নাত- মিলাদ মানাতে হেঁ,
১.
দুই ভূবনের কান্ডারীর আজ, করছি পালন জন্মদিন;
জীবন্ত এক সত্যকে মন! আজ অনূভব করার দিন।
মেরাজ রজনীতে ছিলেন, নবীজী বিশেষ মেহমান,
আরশে খোদায় চেয়ে দেখ!সে নবীজীর কত সম্মান?
২.
নবীজীর অসম্মান করে ওরা, শয়তানেরী ইন্ধনে,
বিদ’আতের তুফান জাগানো ধূয়া তোলে দ্যাখ শয়তান
মুখে সবাই বলছে কত, “আমার মত মানুষ নবী”
চেয়ে দেখ! সে নবীর দ্বারে, শির ঝুঁকাচ্ছে মানুষ সবি॥
৩.
আমরা কভূ ভুলতে নারি, নবী বংশের মহান কুরবানী?
জালিম ইয়াজিদের দরবারে তাঁরা, নির্ভয়ে শোনান সত্যের বাণী॥
জ্ঞান ও বিবেক খোলা তাদের, তবুও সত্য লুকিয়ে ফিরে!
রাখুক তারা লুকিয়ে যতই, জানাবো আমি স্পষ্ট করে॥
৪.
দুনিয়ার যত কল্যাণ আছে, পেয়েছি সবই আহমদের উসিলাতে,
তাঁর দয়াতেই নিচ্ছি যে শ্বাস, তাঁর গুনগান করছি যে তাই॥
ইকবাল! মুহাম্মদের (দ.) তরে রয়েছে, সবকিছু এ খোদায়ীর,
সে পূতঃ নামের গুনেই আমি, বানাই বিগড়ানো তাকদীর॥
নবীজির দরবারে নিবেদন – আল্লামা ইকবাল
(‘বাংগে দারা’ থেকে) কুল্লিয়াতে ইকবাল পৃষ্ঠা নং ঃ ২৭৭-২৭৮।
১.
ওগো প্রভাতের শীতল বায়ু প্রবাহ!
কামলিওয়ালার কাছে, মোর সংবাদ পৌঁছে দিও॥
বলো তাঁরে, “ত্বরাও তব উম্মতেরে!
অসহায় উম্মতের দ্বীন-দুনিয়া সবই গেছে”॥
২.
বিরূপ গ্রোতের ভয়াল থাবায়, বাঁচার আশায় আকুতি জানায়,
“রক্ষাকারী কেউ আছো কী?বিপদ থেকে বাঁচাবে আমায়?
কূলের দিশা বহুদুরে, বাঁচার উপায় কী আছেরে?
মাঝ দরিয়ায় তুফান ভারী, গিয়েছি ভীষন ঘাবড়ে”॥
৩.
ইজ্জত’ই এলো মুহব্বতের কাজে, তমসার যবনিকা ছিড়ে!
আঁধার কাটতেই ইজ্জত গেলো, শ্লাঘাও গেলো, প্রেয়সী রইলো দূরে।
হঠাৎ! দু’ফোটা কৃপার বারি, ফিরিয়ে আনলো আব্রু নতুন,
যাযাবরের স্বভাব গেলো, অনিশ্চয়তার সাগর মাঝে স্বস্তি এলো॥
ইকবালের কন্ঠ থেকে ধ্বণিত হলো,“কে জানে, কার শুনি? ঐ আহবান,
শান্তিবাণী পৌঁছে গেলো, শুনে মাহফিলের কাঁপলো পরাণ।”
ইকবালের কবিতার কয়েকটা পংক্তি
১.
না ওটা ফুল নয়, বলি আমি নিশ্চয়ই,
মুহাম্মদের খুশবু যে ফুলে নাহি রয়।
নয় ওটা অন্তর, শুধুই নিরেট পাথর,
মুহাম্মদের ভালবাসায় সিক্ত নয় যে অন্তর॥
২.
ওটা কোন ইবাদাতই না,
যেথায় নবীজীর প্রেম থাকেনা॥
সুগন্ধ ছাড়া কোন ফুল হয় না,
কাগজের ফুলে সবাস থাকেনা॥
৩.
ওগো নবীজী!আপনার ভালবাসা যদি,
নামাজে আমার না দেয় দিশা,
ব্যর্থ আমার রুকু-সিজদা,
নামাজে দাঁড়ানো সবই বৃথা॥
মৃত্যুর মাত্র ১০ মিনিট পূর্বে আল্লামা ইকবালের রচিত পংক্তি
জানিনা অতীত সুর আবার বাজিবে কিনা?
হেজাজী সমীর পুনঃ এদিকে বহিবে কিনা?
এই দীন ফকীরের নিঃশেষ হইল আয়ু;
অপার রহস্যভেদী জানিনা জন্মিবে॥
আল্লামা ইকবালের সর্বশেষ উক্তি যা তিনি মৃত্যুর মাত্র ৩০ মিনিট পূর্বে বলেছিলেন-
নিশানে মরদে মুমেন বাতু গুয়ম।
চু মর গায়দ তাবাসসুম বর লবে উশত।
ঈমানদারের নিশানাটি বলছিরে ভাই তোদের তরে,
মৃত্যুকালে মৃদু হেসে মৃত্যুকে যে বরণ করে॥
লেখক: প্রাবন্ধিক, অনুবাদক