সব ঈদ মানাও হুযুর আগায়ে হ্যায়
না’ত জগতের অনন্য কিংবদন্তী মুহাম্মদ আলী জহুরী (রহ.) রচিত না’ত
সব ঈদ মানাও হুযুর আগায়ে হ্যায়>
মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল নোমান>
প্রিয়নবী হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র প্রসংশাস্তুতি হযরত আদম(আলাইহসি সালাম) থেকে শুরু করে হযরত ঈসা (আলাইহসি সালাম) পর্যন্ত আবহমান কাল ধরে চলে আসা গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। প্রত্যেক নবী-রাসূল স্ব স্ব নবুয়ত-রিসালতের সময়কালে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র গুণকীর্তন করেছেন এবং আল্লাহর পেয়ারা মাহবুবের এ ধরাধামে তাশরীফ আনয়নের শুভ সংবাদ দিয়ে গেছেন। আর যখন প্রত্যাশিত রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র শুভাগামন ঘটল তখন থেকে শুরু করে মানবজাতি তাঁর জীবনাচরণ, সুন্দর চরিত্র, সৌন্দর্য্য, অনবদ্য মর্যাদা, সৃষ্টির সেরা ও অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব ইত্যাদি বিষয়ে নানাভাবে তার প্রশংসাস্তুতি (নাত-ই রসূল) করে আসছেন। অধ্যাবধি না’ত চর্চা লিখন-পঠন প্রত্যেক ঈমানদার মুসলমানের অন্যতম নিদর্শন হিসেবে বিদ্যমান রয়েছে। কেবল অধ্যাবধি নয়; বরং মহাপ্রলয়াবধি এমনকি কিয়ামত দিবসেও প্রিয়নবীর শান-মান চলতে থাকবে মহান রবের ইচ্ছায়। তাইতো মহান আল্লাহ এরশাদ করেন- عسي ان يبعثك ربك مقاما محمودا অর্থাৎ আপনাকে আপনার প্রতিপালক এমন স্থানে দন্ডায়মান করবেন যেখানে সবাই আপনার প্রশংসা করবে।
[সূরা বনি ইসরাঈল- ৭৯ নং আয়াত। কানযুল ঈমান (বঙ্গানুবাদ)- ৫২৭ পৃষ্টা]
প্রিয়নবীর প্রসংশাস্তুতির মতো এমন মহৎ ও সৌভাগ্যময়ী আমল করে যারা পরপারে পাড়ি দিয়েছেন। নবীপ্রেমিকের নিকট তারা মরেও চির অমর হয়ে আছেন। নবী প্রশংসাস্তুতির কারণে তারা চিরস্মরনীয় হয়ে থাকবেন অনন্তকাল পর্যন্ত। এমন একজন মহান শায়ের ও না’ত জগতের অনন্য কিংবদন্তী পাকিস্তান লাহোরের আলহাজ্ব মুহাম্মদ আলী জহুরী (রহ.)।
আলহাজ্ব মুহাম্মদ আলী জহুরী (রহ.) লিখন-পঠন উভয় ক্ষেত্রে সমান পারঙ্গম ছিলেন। যেমনি তাঁর রচনাশৈলী, তেমনি তাঁর হৃদয়গ্রাহী পরিবেশনা। না’ত লিখনির ক্ষেত্রে তিনি সাবলিল ভাষা ব্যবহার করে উচ্চাঙ্গের না’ত রচনা করতেন। তাঁর বিরচিত না’তিয়া কালামগুলোর অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো, এগুলো সহজবোধ্য, সুপাঠ্য এবং এগুলোর মর্মার্থও সুগভীর। তাছাড়া তাঁর কাব্যের মৌলিকত্ব হলো, এগুলো রাসূল প্রশস্তিকে কেন্দ্র করে রচিত। নবীপ্রেমানলের টানে তাঁর হৃদয় সর্বদা জাগরিত থাকত। আপাদমস্তক নবীপ্রেমে নিবেদিত আলহাজ্ব মুহাম্মদ আলী জহুরী (রহ.)’র কথায়, কাজে, লিখনি, চিন্তা-চেতনা, ভাব দ্যোতনা, রচনাশৈলী সবকিছুতে তা প্রস্ফুটিত। তাঁর কাব্য ও না’তিয়া কালামে কাব্যিক শর্তাবলিও পরিপূর্ণভাবে বিদ্যমান ছিল।এ ব্যাপারে ড.শাহজাদ আহমদ তাঁর বিরচিত বিখ্যাত গ্রন্থ “একশো এক পাকিস্তানি না’ত গু শুয়ারা” গ্রন্থে লিখেন-“আলহাজ্ব মুহাম্মদ আলী জহুরী (রহ.) বিরচিত না’তে নবীজির জীবনাদর্শ, সৌন্দর্য্য, নবীপ্রেমের রস বিদ্যমান। জহুরী সাহেবের না’তগুলোতে পরিপূর্ণ সাবলিলতা ও বাগ্মিতা পাওয়া যায়। তাঁর না’তগুলোতে হুযুরে আকরাম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর প্রতি নিসবত বা সম্পর্কের কথা তুলে ধরা হয়েছে। আর নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) -এর সৌন্দর্য্য ও নান্দনিকতার দিকটি পরিপূর্ণ ও ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।”
আবার না’ত শরীফ পাঠের ক্ষেত্রেও তিনি অতুলনীয় ছিলেন। যখন তিনি না’ত শরীফ পাঠ করতেন, তখন পরিপূর্ণ প্রেম, ভালবাসা, ইশক ও জযবার সাথে নবীপ্রেমের সিন্ধুতে ডুব দিয়ে পরিবেশন করতেন। তাঁর হৃদয়গ্রাহী ও মর্মস্পর্শী পরিবেশনায় আশেকের অন্তরাত্মায় নবীপ্রেমের হিল্লোল বয়ে যেতো। প্রিয়নবীর ভালবাসায় আবেগাপ্লুত ও অশ্রুসিক্ত হতেন আশেক শ্রোতাকূল।
না’ত জগতের এই মহান কিংবদন্তী, আলহাজ্ব মুহাম্মদ আলী জহুরী কচুরী (রহ.) ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১১ আগস্ট, রোজ: বুধবার, সকাল ১০ টায় রাইওয়ান্ডের একটি মেডিকেলে মাওলায়ে হাকিকীর সান্নিধ্যে গমন করেন। তাঁকে তাঁর পিতৃস্থল “আরাঈয়াঁ”তে দাফন করা হয়।
বলাবাহুল্য যে, তিনি এমন সৌভাগ্যবান ব্যক্তি যে, তাঁর অসিয়ত মোতাবেক দাফনকালীন সময়ে তাঁরই প্রিয় শিষ্য সরওয়ার হোসাইন নকশবন্দী পুরো সময়জুড়ে তাঁর বিরচিত না’ত সংকলন “তাওসীফ” এর শেষ না’ত শরীফটি পড়তে থাকেন। আর এভাবেই দাফন কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। বিখ্যাত এই না’ত শরীফটি হলো,
یہ آرزو نہیں کہ دعائیں ہزار دو
پڑھ کر نبی کی نعت لحد میں اتار دو
یہ جان بھی ظہوری نبی کے طفیل ہے
اس جان کو حضور کا صدقہ اتاردو
উচ্চারণঃ ইয়ে আরজু নেহী কে দোয়ায়ে হাজার দো,
পড় কর নবী কি না’ত লাহাদ মে উতার দো।
ইয়ে জান ভী জহুরী নবী কে ত্বোফায়ল হে,
ইস জান কো হুযুর কা সদকাহ উতার দো।
[মর্মার্থঃ আমার জন্য হাজার হাজার দোয়া করবে এমন প্রত্যাশা আমার নেই। নবীজির না’ত শরীফ পড়তে পড়তে আমাকে কবরে দাফন করো। প্রিয়নবীর অপার কৃপায় তো জহুরীর এ প্রাণ! তাই এটাকে পেয়ারা নবীর উসিলায় ছেড়ে দাও। [তাওসীফ (না’ত সংকলন),পৃষ্ঠা-৯৫]
তাঁর রচিত একটি না’ত সব ঈদে মানাও… এর উচ্চারণ ও অনুবাদ প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র ধরা বুকে শুভাগমন মাস উপলক্ষে মাসিক তরজুমানের পাঠক সমীপে উপস্থাপন করছিঃ
সব ঈদে মানাও হুযুর আগ্যায়ে হে না’ত শরীফ
তাঁর বিখ্যাত না’ত সংকলন “নাওয়ায়ে জহুরী”র ২৩ পৃষ্ঠায় এই না’ত শরীফটি বিদ্যমান। লাখো লাখো আশেকে রাসূলের হৃদয় ছুঁয়েছে এই না’ত শরীফটি। এই পবিত্র রবিউল আউয়াল মাসে আয়োজিত মিলাদুন্নবীর মাহফিলসহ সারা বছর জুড়ে অনুষ্ঠিত প্রায় প্রত্যেকটি মাহফিলে এটির আশেকে রাসূলদের বিমোহিত করে নিঃসন্দেহে। তাই মাসিক তরজুমান ১৪৪৫ হিজরির মিলাদুন্নবী সংখ্যায় এটি উচ্চারণ, অনুবাদ ও কাব্যানুবাদ উপস্থাপনের প্রয়াস পেলাম। যথা-
চরন-১
উচ্চারণঃ ফলক কে নাযারো, যমীঁ কি বাহারো,
সব ঈদে মানাও, হুযুর আগ্যায়ে হে
উঠো গম কে মারো, চলো বে সাহারো,
খবর ইয়ে সুনাও, হুযুর আগ্যায়ে হে।
[ মর্মার্থঃ ওহে আসমানবাসী! যমীনের পুষ্পরাশি! সকলেই ঈদ তথা খুশি উদযাপন করো। কারণ, হুযুর নবীয়ে আকরম এ ধরাধামে তাশরীফ এনেছেন। ওহে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ! উদ্বিগ্নতা পরিহার করো। ওহে আশ্রয়হীন! যাও এই খবর চারিদিকে ছড়িয়ে দাও, অসহায়ের সহায়, উম্মতের কান্ডারী, মহা দয়ালু নবী, হুযুর নবী রাহমাতুল্লিল আলামীন শুভাগমন করেছেন।]
কাব্যানুবাদঃ
ওহে আসমানবাসী, জমিনের পুষ্পরাশি,
আসো আসো, খুশির বানে তে ভাসো,
হুযুর যে এসে গেছেন।
অনাথেরা উঠো, পেরেশানি ছাড়ো,
এ খুশির খবর, ছড়াও মাঠ-প্রান্তর,
হুযুর যে এসেছেন।
চরণ-২
উচ্চারণঃ আনোখা নিরালা উঅহ্ যী শান আয়া,
উঅহ সারে রসুলোঁ কা সুলত্বান আয়া।
আরে কাজ কুলা হো,আরে বাদশা হো,
নিগাহে জুকাও, হুযুর আগ্যায়ে হে।
[মর্মার্থঃ অনন্য, অতুলনীয় সৃষ্টির সর্বোচ্চ মর্যাদাবান রাসূল এসেছেন। ওই যে, সকল নবী-রাসূলকূল সরদার তাশরীফ এনেছেন। তাই, ওহে বাদশাগণ! ওহে ভিক্ষুকগণ! বিনয়াবনত হয়ে তোমার দৃষ্টিকে সেদিকে নিবেদন করো যে, হুযুর তাশরিফ এনেছেন।
কাব্যানুবাদঃ
অনন্য উপমাহীন, মহাসম্মানিত এসে গেছেন।
রাসূলদের সুলতান এই তো এসে গেছেন।
আরে তুচ্ছ গোলেমেরা, আরে বাদশাগণ,
ঝুঁকাও দৃষ্টি সবে, বিনয় ও আদবে,
হুযুর যে এসেছেন।
চরণ-৩
উচ্চারণঃ হুয়া চার সু রহমাতোঁ কা বসে-রা
উজালা উজালা সাভে-রা সাভে-রা
হালিমা কো পূঁহছি, খবর আমেনা কি
মেরে ঘর মে আ-ও, হুযুর আগ্যায়ে হে।
[মর্মার্থঃ দয়াল নবীর তাশরিফ আনয়নে চারদিক রহমতে ছেয়ে গেছে। আলোকোজ্জ্বল, আলোকিত প্রভাতের বিকাশ ঘটেছে। মা হালিমাতুস সাদিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহা)’র নিকট মা আমেনা (রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহা)’র এই সংবাদ পৌঁছে গেলো যে, আমার গৃহে চলে আসো। কারণ, আমার ঘরে নবীকূল সরদার তাশরিফ এনেছেন।]
কাব্যানুবাদঃ
রহমতে ছেয়ে গেছে চারিপাশ,
আলোর জলসা, প্রভাত বিকাশ।
হালিমা পেয়ে গেছে আমেনার খবর,
এসো মোর ঘর, এসো মোর ঘর,
হুযুর যে এসেছেন।
চরণ-৪
উচ্চারণ: হাওয়াওঁ মে জযবাত হ্যায়ঁ মারহাবা কে
ফাযাওঁ মে নগমাত সল্লে আলা কে
দুরূদোঁ কে গাজরে, সালামো কে তুহফে,
গোলামোঁ সাজাও হুযুর আগ্যায়ে হে।
[মর্মার্থঃ প্রিয়নবীর শুভাগমনকে বাতাস স্বাগতম জানায় মহা উল্লাসে,আর সৌন্দর্য্যমন্ডিত সৃষ্টিরাজি প্রিয়নবীর দুরূদ সাল্লে আলা পাঠে মুখরিত হয়ে উঠল। ওহে কামলিওয়ালা নবীর গোলামেরা! দুরূদের মজলিস ও সালামের তোহফায় তোমরাও মিলাদুন্নবীর মাহফিল সাজাও মহা আনন্দে। কারণ, হুযুর আগমন করেছেন।]
কাব্যানুবাদঃ
বাতাস স্বাগত জানায় মহা উল্লাসে,
চারিদিক ভরে গেছে দুরূদের সুবাসে।
দুরূদের মালায়, সালামের হাদিয়ায়,
ও খাদেম! নাও সব সাজায়,
হুযুর যে এসেছেন।
চরণ-৫
উচ্চারণ: সামাঁ হে ছানায়ে হাবীবে খোদা কা
ইয়ে মিলাদ হে সারওয়ারে আম্বিয়া কা
নবী কে গদাও! সব ইক দোসরে কো
গলে সে লাগাও হুযুর আগ্যায়ে হে।
[মর্মার্থঃ প্রিয় হাবীব (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) -এর প্রশংসার মাহফিল চলছে সর্বত্র। কারণ, এটা তো নবীকূল সরদারের এ ধরাধামে শুভাগমনের মতো মহান উপলক্ষ। ওহে দরবারে রিসালাতের ভিখারীগণ! একে অপরকে বুকে টেনে নাও, আলিঙ্গন করে আনন্দ প্রকাশ করো যে, হুযুর মর্ত্যলোকে আগমন করেছেন।
কাব্যানুবাদঃ
প্রশংসা চারিধার, হাবীবে খোদার,
এ যে আগমন নবীদের সরদার।
ওহে নবীর ভিখারে, একে অপরে,
বুকে টেনে নাও রে,
হুযুর যে এসেছেন।
চরণ-৬ (মাকতা )
উচ্চারণ: কাহাঁ ম্যায় জহুরী, কাহাঁ উন কি বাতেঁ
করম হি করম হ্যায়,ইয়ে দিন আওর রাতেঁ
জাহাঁ পর ভী জাও! দিলো কো জাগাও
ইয়েহি কেহতে জাও! হুযুর আগ্যায়ে হে।
[মর্মার্থঃ কোথায় আমার মতো নগণ্য মুহাম্মদ আলী জহুরী! আর কোথায় সেই উচ্চাসিত প্রিয়নবীর অতুলনীয় মান-মর্যাদা! আমাদের উপর দিবারাত্রি সর্বদা তো সেই পেয়ারা নবীর অপার দয়া ও অনুগ্রহের পর অনুগ্রহ। তাই (হে জহুরী!) যখন যেথায় যাবে অন্তরাত্মাকে নবীপ্রেমে উদ্ভাসিত ও জাগিয়ে তুলে এটাই ঘোষণা করো যে, মহান মর্যাদার অধিকারী, উম্মতের কাণ্ডারী, নবী রাহমাতুল্লিল আলামীন শুভাগমন করেছেন।]
ক্যাব্যানুবাদঃ
কোথায় এ জহুরী নাদান, কোথায় উনার শান ও মান,
দয়ার পরে দয়া দান, দিবস ও নিশিতে সমান।
যখনই যেখানে যাও, হৃদয়কে জাগিয়ে দাও,
এ কথা বলে যাও, হুযুর যে এসেছেন।
[আলোচ্য না’তটির কাব্যানুবাদ করেছেন- তরুণ কবি, মুহাম্মদ আবু রাশেদ]
পরিশেষে বলা যায়, না’ত সাহিত্যের মহান কিংবদন্তী আলহাজ্ব মুহাম্মদ আলী জহুরী কচুরী (রহ.) কাব্য ও না’ত সাহিত্যে যে অতুলনীয় অবদান রেখেছেন, ইতিহাসে তা চির অম্লান হয়ে থাকবে।
লেখক : প্রচার সম্পাদক, আ’লা হযরত ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ও বিশিষ্ট না’ত খাঁ।