নবী-ই রহমত’র দ্বীন প্রচার পদ্ধতি
মাওলানা মুহাম্মদ আবুল হাশেম >
আরবী অভিধানের প্রসিদ্ধগ্রন্থ ‘লিসানুল আরব’ অনুযায়ী ‘তাবলীগ’ (تبلیغ) শব্দের অভিধানিক অর্থ- পৌঁছানো। পরিভাষায়- কোন ভাল এবং সুন্দর বিষয় বিশেষ করে দ্বীনী বিষয়াদি (ইসলাম) কে অপর ব্যক্তিবর্গ ও সম্প্রদায়ের নিকট পৌঁছানো হবে এবং গ্রহণ করার দা’ওয়াত দেয়া হবে। ‘তাবলীগ’ (تبلیغ) শব্দের সীগাহ বাবে تفعیل থেকে, যার একটি বৈশিষ্ট্য مبالغہ ও রয়েছে। সুতরাং সেটার মর্মার্থে এটাও অন্তর্ভূক্ত রয়েছে যে, সম্বোধিত ব্যক্তি পর্যন্ত দ্বীনের কথা অত্যন্ত উন্নত ও হৃদয়গ্রাহী পন্থায় পৌঁছানো, যাতে তার মন-মগজে সেটার প্রভাব বিস্তার করে।
এ তাবলীগ কিংবা দ্বীন-ই ইসলামের দা’ওয়াত রসূল-ই আকরম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র পদ-মর্যাদার ফরয ছিল। যেমন: ক্বোরআন মাজীদে আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেন:
یٰۤاَیُّهَا الرَّسُوْلُ بَلِّغْ مَاۤ اُنْزِلَ اِلَیْكَ مِنْ رَّبِّكَؕ-وَ اِنْ لَّمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهٗؕ -وَ اللّٰهُ یَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِؕ
“হে রসূল! পৌঁছিয়ে দিন যা কিছু অবতীর্ণ করা হয়েছে আপনার প্রতি আপনার প্রতিপালকের নিকট থেকে; এবং যদি এমন না হয় তবে আপনি তাঁর কোন সংবাদই পৌঁছালেন না। আর আল্লাহ্ আপনাকে রক্ষা করবেন মানুষ থেকে।”
রসূল-ই মক্ববূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম স্বীয় পদ-মর্যাদার ফরয তথা তাবলীগ ও রিসালতের কর্তব্যকে ২৩ বছর ব্যাপী যে দৃষ্টান্তহীন দৃঢ়তা, উন্নত সাহস, ধারাবাহিক এবং দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম, দরদ, ধৈর্য্য, সহনশীলতা এবং স্বাধীনভাবে আদায় করেছেন, সেটার উদাহরণ দ্বীনী ইতিহাসে পাওয়া যায় না। নুবূয়ত ঘোষণার পূর্ব দিন থেকে বিসাল শরীফ পর্যন্ত তাঁর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি অনুভবে ছিল, যে বিষয়টি তাঁকে দিন-রাত অস্থির করে রেখেছিল, যে চিন্তা তাঁকে সদাসর্বদা পেরেশান রেখেছে, সেটা হচ্ছে দা’ওয়াত ও রিসালতের তাবলীগ-এর কর্তব্য। হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এ রব্বানী হিদায়ত এবং আসমানী আইন অনুযায়ী উম্মতকে প্রতিটি ছোট-বড় বিষয়ের তাবলীগ করেছেন। সরকার ও প্রশাসন পরিচালনা থেকে সাধারণ শারীরিক গোসল ও পবিত্রতা পর্যন্ত সবকিছুর আদাব তথা শিষ্টাচারসমূহ স্বীয় উম্মতকে শিক্ষা দিয়েছেন।
যথা: হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু নবী-ই রহমত-ই আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম থেকে রেওয়ায়ত করেন, তিনি ইরশাদ করেন:
إنما أنا لكم مثلُ الوالدِ أعلِّمُكم ، إذا ذَهَبَ أحدُكم إلى الخلاءِ ، فلا يَسْتَقْبِلْ القبلةَ ، ولا يَسْتَدْبِرْها ، ولا يَسْتَنْجِ بيمينِه . وكان يَأْمِرُ بثلاثةِ أحجارٍ ، ونهى عن الرَّوْثِ والرِّمَّةِ.
“নিশ্চয় আমি তোমাদের জন্য পিতার ন্যায়, তোমাদেরকে শিক্ষা দেই। যখন তোমাদের মধ্য থেকে কেউ শৌচাগারে গমণ করবে, তখন সে যেন ক্বিবলার প্রতি মুখ না করে এবং না সেটার প্রতি পীঠ দেয়, না স্বীয় ডান হাত দ্বারা ইস্তিন্জা (শৌচকর্ম) করবে। তিনি (হুযূর) ইস্তিন্জা (শৌচকর্ম)’র জন্য তিনটি পাথর/ঢিলা ব্যবহার করার নির্দেশ দিতেন এবং ইস্তিন্জা (শৌচকর্ম)’র ক্ষেত্রে গোবর এবং জীর্ণ হাড় ব্যবহার করাকে নিষেধ করতেন।”
অনুরূপ হযরত সালমান ফারসী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, এক মুশরিক ব্যক্তি তাঁকে উপহাস করে বলল: আমি দেখলাম যে তোমাদের সাহিব (নবী) তোমাদেরকে প্রত্যেক বিষয়ের শিক্ষা দেন এমন কি প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণের ব্যাপারেও। তখন আমি (বড় গর্ব করে) জবাব দিলাম, হ্যাঁ, তিনি সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, আমরা প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণের সময় যেন ক্বিবলার প্রতি মুখ না করি এবং স্বীয় ডান হাত দ্বারা ইস্তিন্জা (শৌচকর্ম) না করি। আর ইস্তিন্জার জন্য তিনটি পাথর কিংবা ঢিলা দ্বারা যথেষ্ট করি, যাতে গোবর ও হাড্ডি হবে না।”
মোটকথা, মানবকুলের সর্বসাধারণ ও বিশেষ ব্যক্তিবর্গের মধ্যে যে কথা যে স্তরের উপযুক্ত এবং যার সামর্থ অনুযায়ী ছিল, হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম কোন কাটসাট না করে নির্ভয়ে পৌঁছিয়ে দিয়ে আল্লাহ্র প্রমাণ তাঁর বান্দাদের প্রতি পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন।
সহীহ মুসলিম-এর এক রেওয়ায়ত মতে, ওফাত শরীফের আড়াই মাস পূর্বে বিদায় হজ্জের সময় আরাফার ময়দানে প্রায় এক লক্ষ চব্বিশ হাজার সাহাবায়ে কিরাম রিদ্বওয়ানুল্লাহি আলায়হিম আজমাঈন-এর বিরাট জমায়েতে স্বীয় ঐতিহাসিক এবং স্মরণীয় খোতবায় তাবলীগ-ই রিসালতের হক্ব আদায় করার চাক্ষুশ সাক্ষী এবং স্বীকৃতি গ্রহণ করে তিনি সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আসমানের প্রতি আঙ্গুল মুবারক উত্তোলন করলেন এবং মহান রবের দরবারে তিন বার আরয করলেন: اللهم اشهد
“হে আল্লাহ্! তুমি সাক্ষী থাকো, আমি তোমার পয়গাম তোমার বান্দাদের নিকট পৌঁছে দেয়ার হক্ব আদায় করেছি।”
হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র তাবলীগ তথা দ্বীন প্রচার পদ্ধতি
তিনি সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নুবূয়তের কর্তব্য পালনের সময়ে কী রূপরেখা এবং পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন, নিচে এ বিষয়ে কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলো:
১. হিকমত, সদুপদেশ এবং উত্তম পদ্ধতিতে আলোচনা
হুযূর নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র দ্বীন প্রচার পদ্ধতি কীরূপ হবে স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁকে এ বিষয়ে মৌলিক এবং বুনিয়াদী হিদায়ত দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে,
اُدْعُ اِلٰی سَبِیْلِ رَبِّکَ بِالْحِکْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِیْ هِیَ اَحْسَنُ.
“(আপনি) আপন প্রতিপালকের পথের দিকে আহ্বান করুন পরিপক্ক কলা-কৌশল ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে ওই পন্থায় তর্ক করুন, যা সর্বাধিক উত্তম হয়।”
এ আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলা আপন মাহবূব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে দা’ওয়াতের তিনটি পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছেন। যথা:
১. হিকমত,
২. সদুপদেশ এবং
৩. উত্তম পদ্ধতিতে আলোচনা/তর্ক করা
হিকমত দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, সুদৃঢ় এবং অবিচল বিষয়াদি, মজবুত দলীলসমূহ ও অকাট্য প্রমাণাদির আলোকে এমন কৌশলগত পদ্ধতিতে উপস্থাপন করা হবে, সেগুলো শুনে বুঝ ও বোধসম্পন্ন এবং জ্ঞান পিপাসু, বাস্তবতা পছন্দ এবং ন্যায়সঙ্গত স্বভাবের স্তর, যদি সে স্বীয় কানে জেদ ও হটকারিতার রুই প্রবেশ না করায়, তাহলে সেটাকে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়ে পড়বে। দুনিয়ার সকল কল্পনা এবং দর্শন ওই দলীলাদির সামনে ম্লান হয়ে যাবে এবং কোন প্রকার জ্ঞানগত ও বিবেকগত উন্নতি যেন আল্লাহ্র পয়গম্বরের বর্ণনাকৃত হাক্বীক্বতসমূহ কোনরূপ পরিবর্তন করতে না পারে।
(موعظہ حسنہ) সদুপদেশ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, কার্যকর, প্রভাববিস্তারকারী এবং সহানুভূতিপূর্ণ উপদেশ, যাতে ন¤্রতা এবং চিত্তাকর্ষণের প্রাণচাঞ্চল্য বিদ্যমান থাকবে। সাধারণভাবে লক্ষণীয় যে, ইখলাস, আন্তরিকতা, ¯েœহ এবং উন্নত চরিত্র মাধুর্য দ্বারা সুন্দর, ন্যায়সঙ্গত এবং হৃদয়গ্রাহী পন্থায় যে নসীহত করা হয়ে থাকে, তা দ্বারা পাথর হৃদয়ও মোম হয়ে যায়। মৃত অন্তরে প্রাণ সঞ্চার হয়, লোকেরা মুবাল্লিগের মুখে সুন্দর সুন্দর কথা শুনে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যের প্রতি দৌঁড়াতে থাকে। বিশেষ করে যারা বেশি পড়াশোনাসম্পন্ন নয়, উন্নত বিবেক, বুঝসম্পন্ন নয়, কিন্তু সত্যের খোঁজে স্পৃহা অন্তরে লালন করে, তাদের মধ্যে প্রভাববিস্তারকারী ওয়ায-নসীহত দ্বারা আমলের এমন স্টীম ভর্তি করা যাবে, যা বড় বড় গবেষণাকর্ম দ্বারাও সম্ভব হবে না।
অবশ্যই দুনিয়াতে সর্বদা এমন কিছু সংখ্যক লোকও রয়েছে, যাদের কাজ হচ্ছে আল্লাহ্র পথে প্রতিটি বিষয়ে জটিলতা সৃষ্টি করা, কথায় কথায় দলীল বের করা এবং কুতর্ক করা। এসব লোক না হিকমতের কথা গ্রহণ করে, আর না ওয়ায-নসীহত শ্রবণ করে, বরং সর্বদা চায় যে, প্রতিটি মাসআলায় তর্ক-বিতর্ক, মুনাযারার বাজার সগরম রাখবে। এ জন্য দা’ওয়াত ও তাবলীগ-এর ক্ষেত্রে তৃতীয় নির্দেশনা- وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِیْ هِیَ اَحْسَنُ এর শব্দমালা দ্বারা ইরশাদ করা হয়েছে। অর্থাৎ যদি তর্ক-আলোচনার পরিবেশ তৈরী হয়, তাহলে উত্তম পদ্ধতিতে তাহযীব, শিষ্টাচার, ভদ্রতা, সত্য প্রতিষ্ঠা এবং ইনসাফ সহকারে তর্ক করুন। অযথা অন্তরে আঘাত লাগে কিংবা কলিজা জখম হয় এমন কথাবার্তা বলিও না, যার দ্বারা বিষয়টি দীর্ঘ হয়ে পড়ে। উদ্দেশ্য শুধু বুঝানো, সত্য স্পষ্ট করা, কঠোর কথা, অসদাচরণ এবং হটকারিতা দ্বারা কোন ভালো ফল আসে না।
২. সম্বোধিত ব্যক্তির মেধাগত যোগ্যতার প্রতি লক্ষ্য রাখা
তাবলীগ ও দ্বীনী দা’ওয়াতের ধারাবহিকতায় এ মৌলিক রব্বানী হিদায়তের আলোকে হুযূর আকরম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যে দ্বীন প্রচার পদ্ধতি পছন্দ করেছেন, সেটার রূপরেখা এমন ছিল যে, তিনি দা’ওয়াতের সময় শ্রোতা কিংবা শ্রোতাদের মেধাগত ও বিবেকগত যোগ্যতা, তাদের স্বভাবগত যোগ্যতার প্রতিও লক্ষ্য রাখতেন। তিনি সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম প্রত্যক্ষ দর্শনের জন্য কোন বস্তুর বাহ্যিক অবস্থার প্রতি ইশারা করতেন কিংবা সেটার মৌলিকত্ব ও বাস্তবতার পর্দা উন্মুক্ত করার জন্য সেটার পাশে দ-ায়মান হয়ে যেতেন এবং সেটা থেকে স্বীয় কথা এমনভাবে বর্ণনা করতেন যে, নির্বোধ থেকে নির্বোধ লোকের মস্তিস্কে বসে যেত। যেমন: এক সফরে পথিমধ্যে একটি বকরীর মৃত বাচ্চা দেখলেন, সেটার কান ধরে লোকদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, এমন কেউ আছো কি যে, এটাকে শুধু এক দিরহামের বিণিময়ে ক্রয় করতে রাজি হবে? যখন সকলে অস্বীকৃতি জানালো, তখন সেটা দ্বারা দুনিয়ার হাক্বীক্বত প্রকাশ করার জন্য তিনি সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: আল্লাহ্র শপথ! এ মৃত বাচ্চা তোমাদের দৃষ্টিতে যতটুকু মূল্যহীন, দুনিয়া আল্লাহ্ তা‘আলার দৃষ্টিতে তদপেক্ষা বেশি মূল্যহীন।”
অনুরূপ সীরাত ও হাদীসের গ্রন্থাবলিতে আমরা এটাও দেখি যে, প্রশ্নকারীর মেধাগত অবস্থা, আত্মিক ও চিন্তা-চেতনাগত ব্যাধি, আগ্রহ, অবস্থাদি কিংবা চাহিদাদির প্রতি লক্ষ্য রেখে অভিজ্ঞ ডাক্তারের পক্ষ থেকে একই প্রশ্নের জবাব প্রত্যেক ব্যক্তিকে পৃথক পৃথক দিয়েছেন। যেমন: বহু সংখ্যক লোক জিজ্ঞাসা করেছে, یارسول اللہ ﷺ ! ای الاعمال افضل؟ “হে আল্লাহ্র রসূল! সর্বোত্তম আমল কোনটি? তখন তিনি এক ব্যক্তিকে বললেন, জিহাদ সর্বোত্তম আমল। দ্বিতীয় লোককে বললেন, মায়ের খিদমত সর্বোত্তম আমল, তৃতীয় ব্যক্তিকে বললেন, নামায সর্বোত্তম আমল এবং চতুর্থ ব্যক্তিকে বললেন, লোকদেরকে কাবার খাওয়ানো এবং সাক্ষাতকারী প্রত্যেককে সালাম দেয়া সর্বোত্তম আমল।”
৩. কথাকে পুনরাবৃত্তি করা
এছাড়াও আমরা এও দেখি যে, আল্লাহ্ কারীম যদিওবা তাঁকে সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম পূর্ববর্তী ও পরবর্তী জ্ঞান দ্বারা সম্মানিত করেছেন এবং ইমাম কুসায়রীর কথা অনুযায়ী লওহ ও কলমের জ্ঞান হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র খোদাপ্রদত্ত জ্ঞানরাজির অতি সামান্য অংশ ছিল।
فان من جودک الدنیا وضرتھا
ومن علومک علم اللوح والقلم
এতদসত্ত্বেও বুঝানো এবং কথাকে মস্তিষ্কে পৌঁছানোর জন্য স্বীয় কথাকে অতি সহজরূপে তিন তিন বার পুনরাবৃত্তি করতেন এবং কখনো কখনো নানা উপমা বা উদাহরণও পেশ করতেন, যাতে কথা ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম হয়ে যায়।
সাধারণ দুনিয়াদার এবং পেশাদার ওয়ায়েয, খতীবগণ, তাকরীরকারীদের ন্যায় তেজদীপ্ত বয়ান এবং সুমধুর বয়ান, বক্তৃতার কলা-কৌশল, জোশপূর্ণ বয়ান, অগ্নিঝরা বয়ানের উপকরণ প্রদর্শন কিংবা নিজ জ্ঞানের প্রভাব বিস্তার করা হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র নুবূয়তের শান, মর্যাদা ও স্তরের বিপরীত ছিল। অন্যথায় দুনিয়াতে তাঁর চেয়ে বড় খতীব বা বক্তা আর কে হতে পারে? এজন্য কোন মাসআলা বুঝানো, কোন কথার উপর জোর দেয়ার জন্য কিংবা সেটার অধিকতর গুরুত্ব প্রকাশ করার জন্য কথাকে তিন বার পুনরাবৃত্তি করা তাঁর আমল এবং পবিত্র স্বভাব ছিল। যেমনিভাবে হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাঁর এ আমলের ব্যাপারে বুঝাতে গিয়ে বলেন: নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যখন কোন কথা ইরশাদ করতেন, তখন সেটাকে তিনবার পুনরাবৃত্তি করতেন, এমনকি সে কথা তাঁর নিকট থেকে বুঝে নেয়া হত এবং (অনুরূপ) যখন তিনি কোন সম্প্রদায়ের নিকট তাশরীফ নিয়ে যেতেন, তাহলে তাদেরকে সালাম পেশ করতেন এবং (অনুমতির জন্য) তাদেরকে তিনবার সালাম বলতেন।”
শ্রোতার মান লক্ষ্য রেখে তিনি গ্রাম্য, শহুরে, শিক্ষিত ও অশিক্ষিত তথা বিবেক ও বুদ্ধির শ্রেণিবিন্যাস খেয়াল করে নানা পদ্ধতিতে দা’ওয়াত দিতেন।
৪. সম্বোধিত ব্যক্তির মানসিকতা ও স্বভাবের প্রতি লক্ষ্য রাখা
হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র দ্বীন প্রচারের মধ্যে এ বিষয়টিও নজরে আসে যে, তিনি স্বীয় সম্বোধিত ব্যক্তিবর্গের স্বভাব ও মন-মানসিকতার প্রতি লক্ষ্য রাখতেন, এবং তাদের জযবা ও অনুভূতিগুলোরও পুরো খেয়াল রাখতেন। যদি জযবার মধ্যে শীতলতা দেখা যেত, তখন তিনি সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হিকমতের সাথে তাদের মধ্যে উষ্ণতা ও তেজ তৈরী করতেন। আর যদি সম্বোধিত ব্যক্তিবর্গের জযবার মধ্যে জ্বলন, উত্তেজনা অনুভব করতেন, তখন এমন কোন কথা মুখ মুবারক থেকে বের করতেন না এবং না কার্যত এমন কোন অবস্থা গ্রহণ করতেন, যার দ্বারা জযবা অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়বে।
মানবিক মানসিকতা হচ্ছে, মানুষ স্বভাবগতভাবে কঠিন বিষয়াদি গ্রহণ করতে তাৎক্ষনিক প্রস্তুত হয় না। হুযূর নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এ মানবিক মন-মানসিকতাকে নজরে রেখে কখনো নও মুসলিমদের উপর কঠিন এবং বাহ্যিকভাবে আত্মার উপর ভারী হয় এমন বিধানাবলি দা’ওয়াত ও তাবলীগের জন্য শীথিল করেছেন। যেমন: হযরত মু‘আয ইবনে জাবল এবং হযরত আবূ মূসা আশয়ারী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমাকে ইয়ামেনে প্রেরণকালে নির্দেশনামূলক ইরশাদ করেন:
یَسِّرَا وَلَا تُعَسِّرَا وَبَشِّرَا وَلَا تُنَفِّرَا.
“তোমরা দু’জন লোকদের জন্য সহজতা তৈরী করবে, কঠোরতা করবে না, লোকেদেরকে সুখবর দিবে, দ্বীনের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করবে না।”
৫. সম্বোধিত ব্যক্তিবর্গের আত্মমর্যাদা সুরক্ষা
বিশ্বকুল সরদার নবী-ই রহমত সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম স্বীয় দা’ওয়াত, তাবলীগ, তা’লীম, তারবিয়ত, দ্বীনী সংশোধনেলোকের আত্মমর্যাদার প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতেন। যদি কোন ব্যক্তি থেকে শরী‘আত বিরোধী আচরণ কিংবা ভুল-ত্রুটি সংঘটিত হত, তখন নাম উল্লেখ করে লোকদের সামনে তাকে লজ্জিত করতেন না, বরং ইরশাদ করতেন: লোকদের কী হলো যে, তারা এরূপ আচরণ করছে। এ পদ্ধতিতে ওই ব্যক্তির আত্মমর্যাদা আঘাতপ্রাপ্ত হয় না এবং তার সংশোধনও হয়ে যায়। যথা: উম্মুল মু’মিনীন সায়্যিদাহ আয়েশা সিদ্দীক্বাহ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা বর্ণনা করেন:
كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا بَلَغَهُ عَنِ الرَّجُلِ الشَّيْءَ لَمْ يَقُلْ: مَا بَالُ فُلَانٍ يَقُوْلُ؟ وَلٰكِنْ يَقُوْلُ: مَا بَالُ أَقْوَامٍ يَقُوْلُوْنَ كَذَا وَكَذَا؟
“নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট যখন কোন ব্যক্তি সম্পর্কে কোন কিছু (মন্দ কথা) পৌঁছত, তখন তিনি এভাবে বলতেন না যে, অমুক (নাম ধরে)’র কী হয়েছে যে, সে এরূপ বলছে; বরং ইরশাদ করতেন: লোকদের কী হয়েছে যে, তারা এরূপ কথাবার্তা বলছে ।” [সুনানে আবূ দাঊদ, হা/৪৭৮৮]
অনুরূপ এক ব্যক্তিকে নামাযের মধ্যে আসমানের দিকে দৃষ্টি উঠাতে দেখে ইরশাদ করেন:
ما بَالُ أَقْوَامٍ يَرْفَعُوْنَ أَبْصَارَهُمْ إِلَى السَّمَاءِ في صَلَاتِهِمْ، فَاشْتَدَّ قَوْلُهُ في ذٰلِكَ، حتَّى قالَ: لَيَنْتَهُنَّ عَنْ ذٰلِكَ أَوْ لَتُخْطَفَنَّ أَبْصَارُهُمْ.
“লোকদের কী হলো যে, তারা নামাযে আসমানের দিকে চোখ তুলে তাকায়? এ ব্যাপারে তিনি কঠোর বক্তব্য রাখলেন; এমনকি তিনি বললেন: যেন তারা অবশ্যই এমন করা হতে বিরত থাকে, অন্যথায় অবশ্যই তাদের দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নেয়া হবে।”
[সহীহ বোখারী, হা/৩০৩৮]
৬. সম্বোধিত ব্যক্তিবর্গের কল্যাণ কামনা এবং সহানুভূতি প্রকাশ
হুযূর নবী-ই আকরম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর দ্বীন প্রচারে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, অতুলনীয়, অনুপম বিষয়, যা বড় বড় বিরুদ্ধবাদী এবং দুশমনদেরকে নবভী দরবারে ঝুঁকে পড়তে বাধ্য করে দিয়েছিল, সেটা হচ্ছে- সম্বোধিত ব্যক্তিবর্গ, শ্রোতাম-লী এবং সকল মানুষের জন্য সত্যিকার কল্যাণ কামনা, সহানুভূতি প্রকাশ এবং পরোপকারের আগ্রহ। এ কল্যাণ কামনার জযবা তাঁকে মক্কা মুকাররমার এক এক ব্যক্তির নিকটে নিয়ে গেছে, এ মানবিক সহানুভূতি তাঁকে মক্কার বাজারগুলো, মেলাগুলো এবং হজ্জের মওসুমে আরবের প্রতিটি গোত্রের নিকট যেতে বাধ্য করেছে; এ কল্যাণ কামনার জযবা তাঁকে তায়েফের ময়দানে রক্তাক্ত করিয়েছে, তদুপরি বিজ্ঞজনেরা জানেন যে, কোন সে মানসিক কষ্ট এবং শারীরিক নির্যাতন, যা এ নিষ্পাপ, পুত-পবিত্র, রহমাতুল্লিল আলামীন-এর পবিত্র সত্ত্বাকে এ ময়দানে সহ্য করতে হয় নি, কিন্তু উৎসর্গ হোন! এ আপাদমস্তক ¯েœহ ও দয়ার ধারক, স্বীয় সম্প্রদায় ও মানবতার সত্যিকার কল্যাণকামীর উপর, যিনি স্বীয় সম্প্রদায়ের এমন শত্রুতাপূর্ণ, বরং লজ্জাকর, কষ্টদায়ক, অমানবিক আচরণ সত্ত্বেও রজনীসমূহে জেগে জেগে তাদের হিদায়তের জন্য দো‘আ করতেন। সারকথা হলো:
جو بات دل سے نکلتی ہے اثر رکھتی ہے
پر نہیں طاقت پرواز مگر رکھتی ہے
লেখক: পরিচালক, আনজুমান রিসার্চ সেন্টার ও খতীব, নওয়াব ওয়ালী বেগ খাঁ জামে মসজিদ, চকবাজার, চট্টগ্রাম।