কোন পথে পাকিস্তান
আবসার মাহফুজ <>
দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ খ্র্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল। কিন্তু জন্মের পর থেকেই দেশটি আলোর পথ ছেড়ে হেঁটেছে অন্ধকারের দিকে। রাজনৈতিক নেতাদের হটকারিতার সুযোগে দেশটির রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নেয় সামরিক বাহিনী। পরিণামে গণতন্ত্র শক্তি হারায়। গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকতা পায়নি। জনগণের মতামতের চেয়ে সেনাবাহিনীর মতই প্রাধান্য পেতে থাকে। সেনাবাহিনী যদিও সবসময় ক্ষমতা দখল করেনি, কিন্তু ক্ষমতার রশি তাদের হাতেই থাকে সবসময়। রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান সেনাবাহিনীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে গেলেই নানা অজুহাতে তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে গদিচ্যুত করে। পাকিস্তানের ইতিহাস বলছে, জনগণের ভোটে নির্বাচিত কোনো প্রধানমন্ত্রীই সেনাবাহিনীর ইচ্ছাকে গুরুত্ব না দিয়ে টিকে থাকতে পারেনি। এর সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছেন ইমরান খান। বিভিন্ন ইস্যুতে সেনাপ্রধানের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হলে সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে বিদায় নিতে হয়েছে সংসদে আস্থাভোটে হেরে। যদিও এতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ হাত ছিল, তবে সেনাবাহিনীর সমর্থন থাকলে ইমরানকে গদিচ্যুত হতে হতো না। এখন সংসদ ভেঙে দিয়ে জাতীয় নির্বাচনের জন্য একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়েছে। নির্বাচনে জয়ী হয়ে পাকিস্তান মুসলিম লিগ, বা পাকিস্তান পিপলস পার্টি, বা অন্য কোন দল কিংবা জোট সরকার গঠন করবে। কিন্তু প্রশ্নটি হচ্ছে, রাজনীতি ও রাষ্ট্রক্ষমতা সেনাবাহিনীর ভুতমুক্ত হবে? যদি না হয়, তাহলে দেশটি কি অন্ধকার থেকে আলোর পথে প্রত্যাবর্তন করতে পারবে? যদি তা না হয়, তাহলে পাকিস্তান সমৃদ্ধির পথে হাঁটবে কী করে?
উল্লেখ্য, পাকিস্তান রাষ্ট্রের একেবারে সূচনালগ্ন থেকেই শাসকগোষ্ঠীর নানা হঠকারিতা দেশটিতে সেনাবাহিনীকে ক্ষমতার প্রতি প্রলুব্ধ করতে থাকে। যদিও দেশটির জন্মের বছরকয়েক সেনাবাহিনী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রতি কিছুটা নির্লিপ্ত ছিল। কিন্তু বেসামরিক শাসকদের নানা ব্যর্থতার সুযোগে উচ্চাবিলাসী সেনাবাহিনী ক্ষমতার মোহ থেকে বেশিদিন দূরে থাকতে পারেনি। দেশটির গত ৭৬ বছরের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় ৩৪ বছরই সরাসরি শাসন-শোষণ চালিয়েছে সেনাবাহিনী। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে দফায় দফায় এ প্রক্রিয়া অব্যাহত ছিল ২০০৮ পর্যন্ত। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান (১৯৫৮-৬৯), জেনারেল ইয়াহিয়া (১৯৬৯-৭১), জেনারেল মুহাম্মদ জিয়াউল হক (১৯৭৭-৮৮) এবং জেনারেল পারভেজ মোশাররফ যেন অনেকটা ‘উত্তরাধিকার সূত্রে’ পাকিস্তানে সেনাশাসন চালিয়েছেন। অন্যসময়েও পরোক্ষ সেনাশাসনে ছিল দেশটি। প্রসঙ্গত, পাকিস্তানে সেনাশাসনের প্রক্রিয়াটি ‘নিজের পায়ে কুড়াল মারা’র মতো করে ত্বরান্বিত করেন দেশটির প্রথম প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি সেনাবাহিনীর সমর্থনে সংবিধান বাতিল করেন এবং ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসাবে নিযুক্ত করেন। এর পরেই আইয়ুব নিজেকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসাবে ঘোষণা করেন। পাশাপাশি ইস্কান্দার মির্জাকে নির্বাসিত করেন তিনি। আইয়ুব প্রশাসনকে পুনর্গঠন করেন এবং কৃষি সংস্কার এবং শিল্পের উদ্দীপনার মাধ্যমে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য কাজ করেন। তার সময়ে বিদেশি বিনিয়োগকেও উৎসাহিত করা হয়েছিল। একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা তৈরির প্রথম প্রচেষ্টার মাধ্যমে ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মার্চ আইয়ুব খানের ক্ষমতার ইতি ঘটে। এদিন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন তারই উত্তরসূরি জেনারেল ইয়াহিয়া খান। দেশব্যাপী গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচন ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে সামরিক আইন জারি করে ক্ষমতায় বসেন তিনি। সেই নির্বাচনের আওয়ামী লীগ পূর্বপাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে ১৬০টি আসন জিতেছে এবং তারপরে পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) ৮১টি আসন নিয়ে বহু ব্যবধানে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল। কিন্তু বিজয়ী দল আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়নি। পরিণামে পূর্বপাকিস্তানে নাগরিক বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়। একাত্তরের ২৫ মার্চ বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করতে গণহত্যা চালালে পূর্বপাকিস্তানের জনগণ রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। নয় মাসের যুদ্ধশেষে পাকবাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয় ও আত্মসমর্পণের মধ্যদিয়ে পূর্বপাকিস্তান বিশ্বের রাজনৈতিক মানচিত্রে ভাস্বরহ হয় ‘স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ’ নামে। এরপর পিপিপি নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদত্যাগ করেন ইয়াহিয়া খান। ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে ভুট্টোর ক্ষমতাসীন পিপিপি ব্যাপক বিজয় দাবি করলেও তখন বিরোধীদলগুলোর ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ দেশটিকে অশান্তিতে ফেলে দেয়। আর তারই সুযোগ নিয়ে ৮ বছর ধরে অপেক্ষায় থাকা জেনারেল মুহাম্মদ জিয়াউল হক ‘ঝোপ বুঝে কোপ’ মারেন; জারি করেন সামরিক শাসন। দেশে এলো তৃতীয় সামরিক শাসক। জিয়া নিজেকে সেনাপ্রধানের পদে অধিষ্ঠিত করেন এবং ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের সংবিধানে পরিবর্তন এনে নিজে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদকে বরখাস্ত করার ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দের নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসাবে ঘোষণা করেন। যদিও নিয়তির পরিহাসে ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র তিন মাসের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন সামরিক সদস্য নিয়ে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন জিয়া। পরবর্তী ১১ বছর চারটি স্বল্পকালীন নির্বাচিত সরকার দেশটিকে শাসনের সুযোগ পেয়েছে। বিকল্পভাবে প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো (১৯৮৮-৯০ এবং ১৯৯৩-৯৬) এবং নওয়াজ শরিফের (১৯৯০-৯৩ এবং ১৯৯৭-৯৯) নেতৃত্বে গঠিত দুটি সরকারকেই বরখাস্ত করেছিলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট। এক্ষেত্রে ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে জিয়াশাসনের সংবিধানে ঢোকানো একটি ধারাই অনুসৃত হয়েছে, যা সামরিক শক্তির প্রতিনিধির গোপন কার্যকলাপের ইঙ্গিত দেয়। বিষয়টি বুঝতে পেরে নওয়াজ শরিফ তার দ্বিতীয় মেয়াদে ওই ধারাটি ত্রয়োদশ সংশোধনী হিসাবে সংবিধান থেকে বাতিল করতে সমর্থ হন। কিন্তু এই পদক্ষেপও বেসামরিক সরকারকে নির্বিচারে বরখাস্ত থেকে সুরক্ষা দিতে পারেনি। যা প্রমাণিত হয় জেনারেল পারভেজ মোশাররফের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার মধ্য দিয়ে। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ক্ষমতা দখলে নেন। পরে অবশ্য ২০০১ খ্রিস্টাব্দে তিনি বেসামরিক প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আসেন। ২০০১ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট স্বনিযুক্ত হন। ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন- সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতিকে বরখাস্ত করা, ইসলামপন্থি জঙ্গিদের বিরুদ্ধে একটি সেনা-অভিযান পরিচালনা করা, সেনাপ্রধানের পদে থাকাকালীন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ইত্যাদি। নভেম্বর ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি সামরিকপ্রধানের পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য হন এবং তিনি কার্যকরভাবে ক্ষমতা হারান।
এরপর ২০০৮ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) জয়লাভ করলে অভিশংসনে পড়ার ভয়ে প্রেসিডেন্ট পদ ছাড়েন মোশাররফ। পাকিস্তান থেকে লন্ডনে চলে যান। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানে ফিরে এলেও তাঁর রাজনৈতিক অভিলাষ পূরণ হয়নি। নওয়াজ শরিফ ক্ষমতায় এলে বিচারের মুখোমুখি হতে হয় মোশাররফকে। এ অবস্থায় সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে দুবাইয়ে পালিয়ে যান তিনি। বিশেষ আদালত তাঁর বিরুদ্ধে মৃত্যুদ-াদেশ দিলে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জোরালো বিরোধিতা আসে। এরপর ৭০ বছর বয়সি ইমরান খান ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। কিন্তু গত বছর শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ার পর সংসদে অনাস্থা ভোটে ক্ষমতা হারান। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ২০২১ খ্রিস্টাব্দের আগস্টে আফগানিস্তান থেকে ন্যাটো বাহিনীর বিদায়ে ইমরানের ভূমিকায় ওয়াশিংটন বেজায় নাখোশ ছিল। গোয়েন্দা সংস্থা ‘ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স’-এর তখনকার মহাপরিচালক জেনারেল ফয়েজ হামিদকে দিয়ে ইমরান তালেবানকে অন্ধভাবে মদদ দেন, যা পশ্চিমা সৈনিকদের লজ্জাজনকভাবে কাবুল ছাড়ার তাৎক্ষণিক সংকট তৈরি করে। তখন থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইমরানকে বিদায় দিতে নানা কৌশলের আশ্রয় নেয়। কিন্তু পারেনি ইমরানের ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে। তবে ইমরান নিজের কফিনে শেষ পেরেকটি নিজেই লাগিয়েছেন। ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের মুখে ২০২২-এর ফেব্রুয়ারিতে ইমরানের রাশিয়া সফর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কাছে তাঁর ‘আইসোলেশন’ বা বিচ্ছিন্নতা নিশ্চিত করেছিল। একই মাসে ইমরান চীনে শীতকালীন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও যান, যুক্তরাষ্ট্র যা কূটনৈতিকভাবে বর্জন করেছিল। আর ওয়াশিংটনের ইচ্ছা-অনিচ্ছার সঙ্গে এমন দূরত্ব বাড়ার মুখেই ইমরান জাতীয় পরিষদে অনাস্থা ভোটের মুখে পড়েছিলেন। ওই ভোটে ইমরানের পরাজয় নিশ্চিত করতে দেশটির ‘ডিপস্টেট’ ভূমিকা রেখেছিল।
এ পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ জাতীয় পরিষদ ৯ আগস্ট ভেঙে দেন দেশটির প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি। জাতীয় পরিষদ বিলুপ্তির ধারাবাহিকতায় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচনের পথ প্রশস্ত করার লক্ষ্যে ১২ আগস্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের নাম ঘোষণা করা হয়। পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে বেলুচিস্তান আওয়ামি পার্টির (বিএপি) নেতা আনোয়ারুল হক কাকারের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। পাকিস্তানের সবচেয়ে কম জনসংখ্যার প্রদেশ বেলুচিস্তানের একজন স্বল্পপরিচিত সিনেটর কাকার। তাঁর নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই পাকিস্তানের আগামী জাতীয় নির্বাচন হবে। পাকিস্তানের সংবিধান অনুযায়ী, মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেওয়ায় ৯০ দিনের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন হতে হবে। অর্থাৎ, নিয়ম অনুসারে, দেশটিতে আগামী নভেম্বরে নির্বাচন হওয়ার কথা। তবে সাংবিধানিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের জেরে দেশটিতে সাধারণ নির্বাচনের তারিখ নিয়ে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। আবার পাকিস্তানে পর্দার আড়ালে দেশটির সেনাবাহিনীর ব্যাপক ভূমিকা থাকার কারণে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ তার সাংবিধানিক সময়সীমার চেয়ে প্রসারিত হয়, তাহলে পাকিস্তান একটি নির্বাচিত সরকার ছাড়া দীর্ঘদিন পরিচালিত হওয়ার পরিস্থিতিতে পড়বে। বিষয়টি পাকিস্তানের শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে তার নিয়ন্ত্রণ আরও সুসংহত করার সুযোগ তৈরি করে দেবে। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানের রাজনীতি আরো সঙ্কটে পড়বে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে জন্মলাভ করায় এবং কাশ্মীর নিয়ে ভারতের সাথে দ্বন্দ্বের কারণে পাকিস্তানে শুরু থেকেই নিরাপত্তার ইস্যুটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণে শুরু থেকেই সেনাবাহিনী গুরুত্ব পেয়ে এসেছে দেশটিতে, যা ক্রমে রাজনীতিতে তাদের প্রভাব বিস্তারের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। শুরু থেকেই বেসামরিক নেতৃবৃন্দকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে দেয়নি সেনাবাহিনী। তারা নিজেরা নিজেদের সিদ্ধান্ত নিত। প্রতিরক্ষা বিষয়ে সব সিদ্ধান্ত সেনাবাহিনী দ্বারাই প্রভাবিত ছিল। সেসব নিয়ে বেসামরিক নেতৃবৃন্দকে কোন বিতর্ক কিংবা হস্তক্ষেপ করা, কিংবা প্রতিরক্ষা বিষয়ক সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ মিলিটারি কখনো দিত না। তাছাড়া পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব রাজনীতি থেকে সেনাবাহিনীকে পৃথক না করে বরং বারবার তাদের ওপর নির্ভর করেছে, যার ফল হিসেবে দেশটিতে সামরিক বাহিনী এত প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে। বলতে গেলে প্রায় সূচনালগ্ন থেকেই দেশটির শাসনব্যবস্থায় সামরিক-বেসামরিক যৌথ অংশীদারিত্ব চালু হয়ে গিয়েছিল আর রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতা এবং অদক্ষতার কারণে সেটি হয়েছিল বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। এভাবে তারা একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়, ক্রমে যেটি অত্যন্ত ক্ষমতাবান প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী নিজেদের অভ্যন্তরে অটোনমি রক্ষা করে চলে, সেখানে তারা কাওকে হস্তক্ষেপ করতে দেয় না। পাকিস্তানের সামরিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব সামরিক বাহিনীকে যে কোনো স্বাধীনতা দিয়েছে এবং তাদের মধ্যে কোনো হস্তক্ষেপ করতে যায়নি। দেশটির সামরিক বাহিনীও বেসামরিক সরকারকে বলেছে যে, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে তাদের পূর্ণ স্বাধীনতা দরকার। আর এই স্বাধীনতার ব্যবহার করে সামরিক বাহিনী শুধু তাদের সক্ষমতাই বাড়ায়নি, বরং কর্পোরেট এবং প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়ও গড়ে তুলেছে।
পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, প্রথম সেনা অভ্যুত্থান হবার পর সেনাবাহিনী আর ব্যারাকে ফিরে যায়নি। রাষ্ট পরিচালনার দায়িত্ব মাঝেমধ্যে রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে ফিরলেও, সেনাবাহিনী সবসময়ই ছিল ক্ষমতার আশেপাশে। দেশটির ৭৫ বছরের ইতিহাসে সামরিক বাহিনী শাসন করেছে ৩৪ বছর। যখন তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল না, তখনও তাদের প্রাধান্য ছিল সবকিছুতে। সেজন্য নিরাপত্তার প্রশ্নটিকে ব্যবহার করেছে তারা বরাবর। যেহেতু রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের অল্প সময়ের মধ্যেই ভারতের সাথে সীমান্তে একটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল পাকিস্তান, তার ফলে নিরাপত্তার ইস্যুটি প্রতিষ্ঠিত করা সহজ হয়েছিল তাদের জন্য। এর পেছনে অবশ্য অর্থনৈতিক কারণটিও খুবই জরুরি। পাকিস্তানের অর্থনীতিতে তারা সবচেয়ে বড় প্লেয়ারদের একটি। কৃষি এবং শিল্প উৎপাদন থেকে সেবাখাতে সেনাবাহিনী শত শত ধরনের ব্যবসা আছে। কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয়ের ৩০ শতাংশের বেশি তাদের পেছনে খরচ হয়- যার মধ্যে প্রতিরক্ষা বাজেট, বড় অংকের পেনশন ভাতা আছে। এছাড়া বেসরকারি ব্যবসা-বাণিজ্যেও জড়িয়ে আছে সেনাবাহিনী। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রীয় সম্পদে যে পরিমাণ ভাগ পায় তা দিয়ে তারা তাদের কাঠামোগত শক্তিও বৃদ্ধি করেছে বছরের পর বছর ধরে। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের সিনেট রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে সেনাবাহিনী প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলারের একটি বাজেট নেয় নিজেদের জন্য। যা সেবছর দেশটির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সরকারি ব্যায় ছিল। কমপক্ষে ৫০টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে ব্যাবসায়িক অংশীদারিত্ব রয়েছে সেনাবাহিনীর। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বেকারি এবং চিনির কারখানা থেকে শুরু করে ব্যাংক-এয়ারলাইন্সও রয়েছে। ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে দেশটির সেনাবাহিনীর বিনিয়োগ ছিল আনুমানিক প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার। এভাবে তারা সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে। সেনাবাহিনী শিক্ষা খাতে আছে, তার মাধ্যমে তাদের প্রচার করা ন্যারেটিভটা হচ্ছে যে সেনাবাহিনী হচ্ছে একমাত্র বাহিনী যারা দেশকে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক শত্রুদের থেকে রক্ষা করছে। এবং মানুষ সেটা বিশ্বাস করে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতিতেও দেশটির সেনাবাহিনীর প্রভাব ব্যাপক। বলা হয়ে থাকে শত্রু কিংবা মিত্র যেমনই হোক, বহির্বিশ্বের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক কেমন হবে তা নির্ধারিত হয় দেশটির সেনাসদর দফতরে। এমনকি পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে বহির্বিশ্বের সাথে দেশটির সম্পর্ক নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতেও দেখা যায়। যেমন ইউক্রেন-রাশিয়া সংকট শুরু হলে, ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসন সমর্থনযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছিলেন দেশটির সেনাপ্রধান কামার বাজওয়া। অথচ সেসময় ইমরান খান রাশিয়া সফরে ছিলেন এবং তিনি পশ্চিমা দেশগুলোর চাওয়া অনুযায়ী তক্ষুনি যুদ্ধের ব্যাপারে মন্তব্য করতে রাজি ছিলেন না। দেশের অন্য সব ক্ষেত্রেও সেনাবাহিনীর প্রভাব রয়েছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তানে যেসব রাজনৈতিক কাঠামো ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলো কখনই শক্তিশালীভাবে গড়ে ওঠেনি। এর প্রধান কারণ হচ্ছে- বিভিন্ন সময়ে সামরিক বাহিনী রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছে। আর রাজনৈতিক নেতৃত্বে দুর্বলতার কারণে বারবার শক্তির বিচারে রাজনীতির তুলনায় সামরিক বাহিনী এগিয়ে থেকেছে। এছাড়া পাকিস্তানে যেসব রাজনৈতিক দল রয়েছে তারা বিভিন্ন সময়ে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করতে চেয়েছে। তারা সেনাবাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে ক্ষমতায় আসা, ক্ষমতা ধরে রাখা বা কাউকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ- সেটাও করেছে। আর এসব কারণেই একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ভূমিকায় রয়েছে দেশটির সামরিক বাহিনী। এ ছাড়া দেশটির রাজনৈতিক দলগুলোও পারষ্পারিক কোন্দলে যুক্ত থাকার কারণে পাকিস্তানে রাজনৈতিক একক কোনো দলও যেমন গড়ে ওঠেনি তেমনি এসব রাজনৈতিক দলের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থাও কমতে শুরু করেছে। এ ছাড়া পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোর বিকল্প হিসেবেও অনেক ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ চায় সাধারণ মানুষ। সব মিলিয়ে পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর অবস্থান এখন এমনই শক্তিশালী যে, যে কোন রাজনৈতিক দলই তাদের সাথে আপোষ না করে টিকে থাকতে পারে না। বলা হয়ে থাকে, এ পর্যন্ত দেশটির কোন প্রধানমন্ত্রী তার পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। এখন দেশটিতে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে মার্কিন হস্তক্ষেপও সুস্থ রাজনীতিচর্চাকে ব্যাহত করছে। যদিও গত কয়েকবছর ধরে, সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে দেশটির তরুণপ্রজন্ম সামাজিক নানা ইস্যুতে সোচ্চার হচ্ছে; এই তরুণদেরই অনেকে, যারা ইমরান খানের সমর্থক, তারা সেনাবাহিনীর সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলে এখন বিক্ষোভ করছেন রাস্তায় গত কয়েক মাসযাবত, স্লোগান তুলেছেন ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’; কিন্তু এই বিক্ষোভ সেনাবাহিনী কর্তৃত্ব আর প্রাধান্য কমানোর মত সক্ষমতায় কতদিনে পৌঁছাবে সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ নন বিশ্লেষকেরা। সে ঘটনা খুব শীঘ্র ঘটবে এমন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। কারণ দেশটির তরুণপ্রজন্মের খাঁটি গণতন্ত্র ও উন্নয়নের পথ ধরে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন পূরণের পথে প্রধান বাধা হয়ে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সেনাবাহিনীর ক্ষমতা চর্চার বিষয়টি। সংগতকারণে সেনানিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রই যে পাকিস্তানর ললাটলিখন হয়ে থাকবে আরো বহুবছর, তা অনেকটাই স্পষ্ট।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক; সভাপতি-গ্রিন অ্যালায়েন্স বাংলাদেশ।