শ্রমবাজার ধরে রাখতে দক্ষ জনশক্তির বিকল্প নেই
মুহাম্মদ আনোয়ার শাহাদাত <>
এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম জনশক্তি রফতানি কারক দেশ হলো বাংলাদেশ। জনসংখ্যা রফতানিতে এশিয়ায় ভারতের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। পোশাক খাতের পরপরই দেশের জিডিপিতে সবচেয়ে বেশি অবদান জনশক্তি রফতানি খাতের। দেশের বৃহৎ সংখ্যক জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন জনশক্তি রফতানির অন্যতম উদ্দেশ্য। বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রফতানির মূল গন্তব্য উপসাগরীয় সহযোগিতা সংস্থাভুক্ত (জিসিসি) ছয়টি দেশ। এগুলোর মধ্যে রয়েছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, বাহরাইন ও কাতার। পরবতী সময়ে এর সাথে যুক্ত হয়েছে মালেশিয়া। এছাড়াও সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, আফ্রিকা সহ বিশ্বের প্রায় ১৭০টি দেশে বাংলাদেশি অভিবাসী রয়েছ। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমটি) তথ্য মতে, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত এক কোটিরও বেশি বাংলাদেশি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অভিবাসী হয়েছেন, যার ৭৫ শতাংশই আছে মধ্যপ্রাচ্যে। এবং প্রতি বছর বৈধ ভাবে ১০ লাখের অধিক কর্মী বিদেশে যান। তবে অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও বাস্তবতা হলো, এদের মধ্যে দুই তৃতীয়াংশেরও অধিক অদক্ষ কর্মী। প্রায় ৯০% অদক্ষ কর্মীই যাচ্ছে বিদেশে। যার কারনে হাতছাড়া হচ্ছে ইউরোপ সহ মধ্যপ্রাচ্যের বিশাল শ্রমবাজার। অথচ দেশের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত মজবুত রাখতে অব্যাহত রাখতে হবে রেমিট্যান্স প্রবাহ। যার জন্য প্রয়োজন দক্ষ জনবল গড়ে তোলা, নতুন নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ধান এবং জনশক্তি রপ্তানিতে দালালদের দৌরাত্ম কমানো। নতুবা প্রতিযোগীতামূলক বিশ্বব্যবস্থা ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সন্ধিক্ষণে এসে আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে পিছিয়ে পড়বে বাংলাদেশ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত বাংলাদেশি অভিবাসীদের প্রায় ৯০ শতাংশের কোন ধরনের কাজের প্রশিক্ষণ নেই আর বাকি ১০ শতাংশ প্রবাসী কারিগরি শিক্ষা, ভাষা, কম্পিউটার বা ড্রাইভিং এ ধরনের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। বাংলাদেশী প্রবাসীদের মধ্যে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক কিংবা বৃত্তিমূলক শিক্ষায় ডিগ্রীধারীর সংখ্যা খুবই নগন্য। অদক্ষ শ্রমিকদের বেশির ভাগই যোগাযোগ ও ভাষার অদক্ষতা ছাড়াও আচরণগত সমস্যা, শারীরিক যোগ্যতার অভাব, আধুনিক যন্ত্রপাতি সম্পর্কে ধারনা না থাকা, অভিবাসী দেশের আইন সম্পর্কে অবগত না থাকা, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধি ংম্পর্কে অজ্ঞতার কারনে কাজে অযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের শ্রমশক্তির মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং নিম্ন দিকে ধাবিত করে। ’বাংলাদেশী শ্রমিক মানেই অদক্ষ শ্রমিক’ এমন বাস্তবতার কারনে যারা দক্ষ শ্রমিক বা স্বল্প দক্ষ শ্রমিক আছেন তারাও সবসময় শ্রম অনুযায়ী পারিশ্রমিক পান না বা মূল্যায়িত হন না। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের যথোপযুক্ত তদারকির অভাব এবং জনশক্তি রফতানির সাথে জড়িত দালালদের দৌরাত্মে গ্রামাঞ্চল ও মফস্বলের মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠীর অনেকে বিদেশে পাড়ি দিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। কেননা, কোন ধরনের কাজের প্রশিক্ষণ না নিয়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির আশায় জীবনের শেষ সম্বল বিকিয়ে দিয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়ে প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাবে ভিনদেশে পড়ে চরম বিপাকে। শত কষ্ট আর হাঁড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের পরও বিনিযোগকৃত অর্থ তুলতে পারেন না, ফলে অদক্ষ শ্রমিকদের জীবনে নেমে আসে চরম হতাশা। এর ফলে ব্যক্তিগত ক্ষতি যেমন হচ্ছে তেমনি ভাবে আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে কমে যাচ্ছে বাংলাদেশি শ্রমিকদের মান। যার কারণে আমরা অতীতে দেখেছি মালেশিয়া সহ কয়েকটি দেশে একাধিকবার জনশক্তি আমদানি স্থগিত করা হয়েছিল। তাই আন্তর্জাতিক শ্রমবাজার ধরে রাখতে হলে আমাদেরকে দক্ষশ্রমিক তৈরিতে গভীরভাবে মনোনিবেশ করতে হবে এবং যুগোপযোগি ও কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে এগোতে হবে। জনসংখ্যার ভারে মুহ্যমান দেশে জনসংখ্যাকে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করতে না পারলে দেশের সার্বিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করা কঠিন হয়ে পড়বে এবং রেমিট্যান্স প্রবাহে নিকট ভবিষ্যতে ব্যাপক প্রভাব পড়বে। জনসংখ্যাকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরের সুচিন্তিত ও কার্যকর কোন পদক্ষেপ এই পর্যন্ত কোন সরকারই গ্রহণ করেননি। ফলে মধ্যপ্রাচ্য সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, শ্রীলংকা এমনকি নেপালের শ্রমিকরা যে বেতন পায় আমাদের শ্রমিকরা বেশি পরিশ্রম করেও অপেক্ষাকৃত কম বেতন পায়। বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানি এখনো অদক্ষ ক্যাটাগরিতে রয়ে গেছে। সরকার বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ করে ব্রিজ, কালভার্ট, মেট্রোরেল, সমুদ্রের নীচে টানেল, ফ্লাইওভার সহ নানা উন্নয়ন কর্মকান্ড করলেও সার্বিকভাবে দেশকে একটি টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন সে ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য ও সময়োপযোগী কোন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বা পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। সৌদি আরব সহ মধ্যপ্রাচ্যেও দেশগুলোতে ইতোমধ্যে বাংলাদেশি শ্রমিকদের পরিবর্তে জায়গা করে নিচ্ছে পার্শ¦বর্তী বিভিন্ন দেশের শ্রমিকরা তার একমাত্র কারণ হচ্ছে তারা বিদেশে পাড়ি জমানোর আগে কোন না কোন কাজের প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষতা অর্জন করে তারপর অভিবাসী হয়ে বাইরে পা রাখে যাতে করে কর্মসংস্থানে কোন ধরনের সমস্যা না হয় এবং শ্রমের ন্যায্য মূল্য পায়। প্রশিক্ষিত জনগোষ্ঠীই হলো যে কোন দেশের উন্নয়নের চাবিকাঠি। তাই যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আগামী দিনে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদেরকে প্রস্তুত হতে হবে সার্বিকভাবে। গতানুগতিক শিক্ষার পরিবর্তে কারিগরি শিক্ষায় জোর দিতে হবে অনেক বেশি। এই জন্য আমাদেরকে প্রয়োজনে বিভিন্ন দেশ যেমন- জাপান, জার্মানি, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, মালেশিয়া সহ বিভিন্ন দেশের কারিগরি শিক্ষার মডেল অনুসরণ করতে হবে। এসব দেশে কারিগরি শিক্ষার হার বেশি হওয়ার কারণে তারা এত উন্নত। মালেশিয়া, সিঙ্গাপুর, চীন ও উত্তর কোরিয়ার মতো দেশের উন্নতির মূলে রয়েছে তাদের কারিগরি শিক্ষা। বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশগুলোর কারিগরি শিক্ষার হার দেখলে সহজে বুঝা যায় আমাদের অবস্থান কোন তলানিতে পড়ে আছে। জার্মানিতে ৭৩, জাপানে ৬৬, সিঙ্গাপুরে ৬৫, অস্ট্রেলিয়ায় ৬০, চীনে ৫৫, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৫০ শতাংশ মানুষ কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত ও দক্ষ। কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের তথ্য মতে, আমাদের দেশে কারিগরি শিক্ষার হার প্রায় ২০ শতাংশ। কারিগরি শিক্ষার এই হারকে ৫০-৬০ শতাংশে উন্নীত করতে না পারলে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে আমরা তাল মিলাতে পারবো না। গোটা বিশ্ব এখন প্রস্তুত হচ্ছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য। কারণ প্রযুক্তির এই বিপ্লবে বদলে যাবে মানুষের জীবনমান, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হবে শিল্প, অর্থনীতি ও যোগাযোগ। মানুষের পরিবর্তে কর্মক্ষেত্রে জায়গা দখল করে নিবে মেশিন, রোবট, ইন্টারনেট অব থিংক (আইওটি) সহ প্রযুক্তির নতুন নতুন উদ্ভাবন। এই জন্য প্রযুক্তির এইসব উদ্ভাবন ও পরিবর্তনের সাথে তাল মিলাতে হলে আমাদেরও যুগোপযোগী শিক্ষায়, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় খুব বেশি জোর দিতে হবে। গড়ে তুলতে হবে প্রযুক্তি নির্ভর নতুন নতুন কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন ট্্েরডে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে হবে।
দক্ষ জনশক্তির অভাবে আমরা যে শুধু আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে মার খাচ্ছি তা নয়। আমাদের দেশের শ্রমবাজারও আস্তে আস্তে দখল করে নিচ্ছে বিদেশী দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মীরা। বাংলাদেশে ২১টি খাতে ৪৪টি দেশের প্রায় আড়াই লাখ কর্মী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন বলে টিআইবির একটি গবেষণা প্রতিবেদন বিগত দুবছর আগে বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছে এ সংখ্যা আরো অনেক বেশি। অথচ আমাদের দেশে লক্ষ লক্ষ উচ্চ শিক্ষিত বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে বসে আছে। শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ী ও জনশক্তি রফতানির সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যুগোপযোগী, দক্ষতাভিক্তিক না হওয়ার কারণে প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা নিয়ে বের হলেও শিল্প প্রতিষ্ঠানে যে রকম দক্ষকর্মী প্রয়োজন সেটির চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। তাই ভুরি ভুরি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা না করে কারিগরি শিক্ষায় মনোনিবেশ করা বেশি প্রয়োজন এই মুহুর্তে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশ দূতাবাস গুলোর শ্রমউইং গুলো যদি ঠিকমতো কাজ করে এবং নিয়মিত তথ্য সংগ্রহ করে বাংলাদেশের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো সহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠাণগুলোকে অবহিত করে কোন দেশে কী ধরনের কাজের চাহিদা রয়েছে তাহলে সে হিসেবে আমাদের বিদেশগামী শ্রমিকদেরকে প্রশিক্ষিত করে তোলা সহজ হবে। আমাদেরকে গবেষণা করতে হবে পৃথিবী কোন দিকে ধাবিত হচ্ছে, কাজের ক্ষেত্রে বা শিল্প-কারখানায় কী ধরনের পরিবর্তন আসছে, তথ্য প্রযুক্তিতে নতুন নতুন কী যুক্ত হচ্ছে। কোন দেশে কী ধরনের কাজের চাহিদা রয়েছে সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে তাহলে আমরা ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে প্রতিযোগীতায় টিকে থাকতে পারবো এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ আরো গতিময় করে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী ও মজবুত জায়গায় নিয়ে যেতে পারব।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সৌদি আরব প্রবাসী।