সফর মাসের ফযিলত ও আমল
‘সফর’ আরবী সনের দ্বিতীয় মাস। ইসলামের ইতিহাসে এ মাসটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যময়। মানব ইতিহাসের বহু ঘটনা বিশেষভাবে এ মাসে সংঘটিত হয়েছে হাদীস শরীফে এ মাস সম্পর্কে বহু বর্ণনা পাওয়া যায়।
এ মাসে অনেক সম্মানিত নবী নবুয়তের পরীক্ষামূলক মছিবতের সম্মুখিন হয়েছেন, যা ইতিহাসে খ্যাত। যেমন- হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম’র জান্নাতে থাকাবস্থায় নিষিদ্ধ গাছের ফল ভক্ষণ, হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালামকে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ, হযরত আইয়ুব আলায়হিস্ সালাম’র কঠিন বালায় পতিত হওয়া, হযরত ইউনুচ আলায়হিস্ সালাম মাছের উদরস্থ হওয়া, মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর লোবাইদ ইবনে আছম ও তার পুত্রদের কৃত যাদুর বাহ্যিক প্রভাব থেকে আরোগ্য লাভের মত বহু ঘটনা ঘটেছে এ মাসেই।
বালা-মছিবত মুমিনের জন্য পরীক্ষা স্বরূপ। এ ধরণের বিপদে-আপদে ধৈর্য ধারণ ও আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করার জন্য হাদীস শরীফে শিক্ষা দেয়া হয়েছে। অলি বুযুর্গগণ বিভিন্ন ধরণের দু‘আ, নফল নামায, অজিফা ইত্যাদি দ্বারা সাধারণ মানুষকে ধন-স্বাস্থ্য ও সম্পদ এবং ঈমানী বালা-মছিবত থেকে রক্ষা করে খোদার নৈকট্য লাভের পথ দেখিয়েছেন।
এ মাসের নফল এবাদত
সফর মাসের চাঁদ উদিত হওয়ার পর দুই রাকাত করে ছয় রাকাত নফল নামায পড়া যায়। অতঃপর দরূদ শরীফ পাঠ করে নিম্নের দু‘আ পাঠ করবেন-
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা সল্লে আলা মুহাম্মাদিন আবদিকা ওয়া নাবিয়্যিকা ওয়া আ’লা আলিহী ওয়া বারিক ওয়াসাল্লিম। আল্লাহুম্মা ইন্নী আউযুবিকা মিন র্শারি হাযাশ শাহ্রি ওয়া মিন কুল্লি সিদ্দাতিন ওয়া বালাইন ওয়া বালিয়্যাতিন কাদ্দারতা ফীহি এয়া দাহ্রু, এয়া দায়াহারু, এয়া দায়াহারু ওয়া ইয়া কানা এয়া কায়নুন, এয়া কায়নানু এয়া আজালু এয়া আবাদু এয়া মুবদিউ এয়া মুরীদু, এয়া যালজালালী ওয়াল ইকরামি এয়া যাল আরশিল মাজীদী আন্তা তাফয়ালু মা তুরীদু আল্লাহুম্মাহরুছ বি আইনিকা নফ্সী ওয়া আহ্লি ওয়া মালি ওয়া ওয়ালাদী ওয়া দ্বীনি ওয়া দুনয়াঈ মিন হাযিহিছ ছানাতি ওয়াকিনা মিন র্শারি মা ক্বাদাইতা ফীহা ওয়া কারিমনী ফিচ্ছফরে বি করমিন নজরে ওয়াখতিমহু লী বি ছালামাতিন ওয়া আদাতিন ওয়া আহ্লি ওয়া আউলিয়াই ওয়া কারাবায়ি ওয়া জামিয়ি উম্মাতি সাইয়্যিদিনা মুহাম্মাদিন আলায়হিস্ সালামি এয়া যাল জালালি ওয়াল ইকরামি ইবতালাইতানী বি ছিহ্হাতিহা বি হুরমাতিল আবরারি ওয়াল আখয়ায়ি ইয়া আজিজু ইয়া গাফ্ফারু ইয়া কারীমু ইয়া ছাত্তারু বি রহমাতিকা ইয়া আরহামার রাহিমীন।
সফর মাসের প্রত্যেক দিন উক্ত দু‘আ পাঠ করা যায়।
আখেরী চাহার সম্বাহ
সফর মাসের শেষ বুধবারকে আখেরি চাহার সম্বাহ বলে। এদিন অতি গুরুত্ব সহকারে পালন করা হয়। হুজূর সাইয়্যিদে আলম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র প্রতি ইহুদীগণ যাদু করেছিল এবং এর বাহ্যিক প্রভাব তাঁর দেহ মোবারকের বহির্ভাগে ক্রিয়াশীল হওয়ায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। অতঃপর হযরত জিব্রাঈল আলায়হিস্ সালাম আল্লাহর হুকুমে তাঁর হাবীবকে এ সম্পর্কে অবহিত করেন। অতঃপর প্রভাব নষ্ট করার পর হুজূর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এ সফর মাসের শেষ বুধবার সুস্থতা বোধ করেন এবং গোসল করেন। নিম্নে বর্ণিত কার্যদ্বারা এ দিন উদ্যাপন করা অত্যন্ত উপকারী ও ফলদায়ক। সারা বৎসরের বালা-মছিবত, রোগ-শোক থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাইতে এ আমল অত্যন্ত ফলপ্রদ বলে সূফী সাধক ও আলেমগণ মত প্রকাশ করেন।
আমল : এদিন সূর্যোদয়ের পূর্বে গোসল করা উত্তম। অতঃপর সুর্যোদয়ের পর দোহার নামাযান্তে দুই রাকাত নফল নামায পড়া যায়। প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহার পর এগারবার সূরা ইখলাস বা কুল হুয়াল্লাহু আহাদ, সালাম ফিরানোর পর সত্তরবার বা ততোধিক দরূদ শরীফ পাঠ করে নিম্নের দু‘আ তিনবার পাঠ করবেন-
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা র্ছারিফ আন্নী ছুআ হা-যাল ইয়াওমা ওয়া আছিমনী মিন ছূয়িহী ওয়ানাযযিনী আম্মা আছাবা ফীহি মিন নাহূছাতিহী ওয়া র্কুবাতিহী বিফাদ্বলিকা এয়া দাফিয়াশ র্শুরি ওয়া এয়া মালিকান নুশূরি এয়া আরহামার রাহিমীন; ওয়া ছাল্লাল্লাহু আলা মুহাম্মাদিন ওয়া আলিহিল আমজাদি ওয়া বারাকা ওয়াছাল্লাম।
এ দিন নিম্নের আয়াতে সালাম প্রত্যেক ফরজ নামাযের পর পাঠ করে সিনায় ফুঁক দিলে এবং কলা পাতায় বা কাগজে লিখে তা পানীয় জলে দিয়ে পান করলে আল্লাহর রহমতে বহু রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
আয়াতে সালাম
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيْمِ
سَلَامٌ عَلٰى نُوْحٍ فِى الْعَالَمِيْنo اِنَّا كَذٰلِكَ نَجْزِى الْمُحْسِنِيْنَo سَلَامٌ عَلٰى اِبْرَاهِيْمo اِنَّا كَذٰلِكَ نَجْزِى الْمُحْسِنِيْنَo سَلَامٌ عَلٰى مُوْسٰى وَ هَارُوْنo اِنَّا كَذٰلِكَ نَجْزِى الْمُحْسِنِيْنَo سَلَامٌ عَلٰى اِلْيَاسِيْنَo اِنَّا كَذٰلِكَ نَجْزِى الْمُحْسِنِيْنَ oسَلَامٌ عَلَى الْمُرْسَلِيْنَo سَلَامٌ عَلَيْكُمْ طِبْتُمْ فَادْخُلُوْهَا خَالِدِيْنَo سَلَامٌ هِىَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِo
এ দিন গোসল করার পর একটি পবিত্র ও পরিষ্কার পাত্রে পানি নিয়ে কলাপাতা বা কাগজে নি¤েœর দু‘আ ও নক্সা লিখে পাত্রের পানিতে ডুবিয়ে অতঃপর
আখেরী চাহার সম্বাহ সম্পর্কে ফক্বীহগণের অভিমত
জাওয়াহেরুল কুন্জ ৫ম খণ্ডের ৬১৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে সফর মাসের শেষ বুধবার সূর্যোদয়ের পূর্বে গোসল করা উত্তম। সূর্যোদয়ের পর দুই রাকাত নফল নামায পড়া ভাল।
নিয়ম : প্রথম রাকাতে ‘কুলিল্লাহুম্মা মালিকাল মুল্ক এবং দ্বিতীয় রাকাতে قُلِ ادْعُوْا اللهَ أَوِ ادْعُوْا الرَّحْمٰنَ ‘কুিলদ্ ঊ’ল্লাহা আবিদ্ঊ’র রহমান’ থেকে সূরার শেষ পর্যন্ত পাঠ করবে। সালাম ফিরানোর পর নিম্নোক্ত দু‘আ পাঠ করবে-
আল্লা-হুম্মা র্সারিফ্ ‘আন্নী- সূ—আ হা-যাল ইয়াওমি ওয়া’সিম্নী- সূ—আহূ- ওয়া নাজ্জিনী- ‘আম্মা- আখা-ফূ ফী-হি মিন্ নুহূ-সা-তিহী- ওয়া কুরুবা-তিহী- বিফাদ্বলিকা ইয়া- দা-ফি‘আশ্ শুরু-রি ওয়া মা-লিকান্ নুশূ-রি ওয়া-আরহর্মা রা-হিমী-না ওয়া সাল্লাল্লা-হু-তা’আলা ‘আলা- সাইয়্যিদিনা- মুহাম্মাদিওঁ ওয়া আ-লিহিল্ আমজা-দি ওয়া বা-রাকা ওয়া সাল্লাম। [রাহাতুল কূলুব ও জাওয়াহিরে গায়বী]
অনুরূপভাবে ‘জাওয়াহেরে কান্জ, ৫ম খণ্ড, ৬১৭ পৃষ্ঠায় আছে, মাহে সফরের শেষ বুধবার ‘সপ্তসালাম’ লিখে তা পানিতে ধুয়ে পানিটুকু পান করবে। আবদুল হাই লক্ষ্ণৌভী সাহেব তার মজমুয়ায়ে ফাতওয়ায়ও একথা উল্লেখ করেছেন। “তাযকিরাতুল আওরাদ” কিতাবে উল্লেখ আছে-
যে ব্যক্তি আখেরী চাহার সম্বার প্রত্যেক ওয়াক্ত নামাযের পর আয়াতে রহমত (সাত সালাম) পাঠ করে নিজের শরীরে ফুঁক দেয় বা তা পানের উপর লিখে ধুয়ে পান করে, আল্লাহ পাক তাকে সব রকম বালা মুসিবত ও রোগব্যাধি হতে নিরাপদ রাখবেন।
“আনওয়ারুল আউলিয়া” কিতাবে বর্ণিত আছে- যে ব্যক্তি আখেরী চাহার সম্বার দিন দুই রাকাত নফল নামায আদায় করবে আল্লাহ পাক তাকে হৃদয়ের প্রশস্ততা দান করবেন। প্রত্যেক রাকাতে সূরা ফাতিহার পর এগার বার সূরা ইখলাস পাঠ করবে নামায শেষে ৭০ বার দরূদ শরীফ পড়বে (আল্লাহুম্মা সাল্লি আ‘লা সাইয়্যিদিনা মুহাম্মাদিনিন্ নাবিয়্যিল উম্মিয়্যি ওয়া আলা আলিহি ওয়া আসহাবিহী ওয়াসাল্লাম) অথবা প্রতি রাকাতে ৩ বার সূরা ইখলাস দ্বারা নামায শেষ করে ৮০ বার সূরা আলাম নাশরাহলাকা, সূরা নসর, সূরা ত্বীন ও ইখলাস পড়বে।
এ মাসে ওফাত প্রাপ্ত কয়েকজন বুযুর্গ
০৮ সফর: দাতা গঞ্জেবখশ্ লাহোরী (রাহ.) ওফাত।
১১ সফর: হযরত সালমান ফারসী (রাদ্বি.)।
২৬ সফর: মুজাদ্দিদ আল্ফসানী (রাহ.) ওফাত ১০৩৪ হিজরী।
২৫ সফর: ইমাম আহমদ রেযা খান বেরলভী (রাহ.)।
২৯ সফর: হযরত ইমাম হাসান (রাদ্বি.) শাহাদাত ৪৯ হিজরী।
আল্লাহ্ আমাদের বিপদ-আপদ থেকে পানাহ দিন; আ-মীন। বিহুরমাতি সাইয়্যিদিল আম্বিয়া সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম।