আল্লাহ ওয়ালাদের শাফায়াত বিশ্বাস করা ঈমান-ইসলামের অপরিহার্য আক্বিদা
অধ্যক্ষ হাফেয কাজী আবদুল আলীম রিজভী
তরজমা: (হে কাফিরগণ!) তোমাদের জন্য কি পুত্র-সন্তান, আর তাঁর জন্য (অর্থাৎ আল্লাহর জন্য) কন্যা সন্তান? তখন তো এটা জঘন্য অসংগত বন্টন। এগুলো কতগুলো নাম বৈ অন্য কিছু নয়, যেগুলো তোমরা ও তোমাদের পিতৃ-পুরুষ রেখে ফেলেছো। আল্লাহ সেগুলোর পক্ষে কোন দলিল অবতীর্ণ করেননি। তারা তো নিছক কল্পনা ও প্রবৃত্তিরই অনুসরণ করেছে। অথচ নিশ্চয় তাদের নিকট তাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে হিদায়াত এসেছে। মানুষ কি পেয়ে যাবে যা কিছুর সে কামনা করবে? সুতরাং আখিরাত ও দুনিয়া সবকিছুর মালিক একমাত্র আল্লাহ। এবং কত ফেরেশতাই রয়েছে আসমান সমূহে যে, তাদের সুপারিশ কোনরূপ কাজে আসবেনা। কিন্তু আল্লাহ যখন অনুমতি দান করবেন যার পক্ষে চান ও (যাকে) পছন্দ করেন। (তার পক্ষে সুপারিশ ফলদায়ক হবে)। নিশ্চয় যারা আখিরাতের উপর ঈমান আনয়ন করে না তারা ফিরিশতাদের নাম নারীদের মতই রাখে। এবং তাদের সে সম্পর্কে কোন জ্ঞান নেই। তারা তো নিছক অনুমানের পেছনে পড়েছে এবং নিশ্চয় অনুমান নিশ্চিত বিশ্বাসের স্থলে কোন কাজে আসে না। ॥
———————————————————————————————-[সুরা আন-নাজম, ২১-২৮ নং আয়াত]
আনুষঙ্গিক আলোচনা
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পবিত্র বাণী (“হে কাফিরগণ!) তোমাদের জন্য কি পুত্র সন্তান, আর তাঁর অর্থাৎ (আল্লাহর) জন্য কন্যা সন্তান? এর ব্যাখ্যায় তাফসীর শাস্ত্র বিশারদ ওলামায়ে কেরাম উল্লেখ করেছেন- উপরোক্ত আয়াত সমূহে মহান আল্লাহ রাসূলে করীম রউফুর রহীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের নূবুওয়াত-রিসালত ও তাঁর উপর অবতীর্ণ মহান ঐশী বাণী ‘ওয়াহীয়ে ইলাহী’ সংরক্ষিত হওয়ার প্রমাণাদি বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। আলোচ্য আয়াত সমূহে কাফির মুশরিকদের নিন্দা করা হয়েছে। তারা কোনরূপ দলিল প্রমাণ ব্যতিরেকেই বিভিন্ন ভূত প্রতিমাকে উপাস্য ও কার্যনির্বাহী সাব্যস্ত করে রেখেছে এবং নূরানী ফেরেশতাকূল কে আল্লাহর কন্যা রূপে আখ্যায়িত করতো এবং বলতো الملايكة بنات الله অর্থাৎ ফেরেশতা আল্লাহর কন্যা। (নাউজুবিল্লাহ) এহেন অবাস্তব ও কাল্পনিক দাবীর নিন্দা করে উদ্ধৃত আয়াতে আল্লাহ বলেন- তোমাদের জন্য পুত্র সন্তান আর আল্লাহর জন্য কি কন্যা সন্তান? নাউজুবিল্লাহ। বাস্তব জীবনে তোমরা নিজেদের জন্য কন্যা সন্তানকে খুবই অপছন্দ কর। এমনকি কারো ঘরে কন্যা সন্তান ভুমিষ্ট হওয়ার সুসংবাদ দেওয়া হলে রাগে ক্ষোভে তার মুখমন্ডল কালো-মলিন হয়ে যেত। যেমন কোরআনে করিমে এরশাদ হয়েছে- وَإِذَا بُشِّرَ أَحَدُهُم بِالْأُنثَىٰ ظَلَّ وَجْهُهُ مُسْوَدًّا وَهُوَ كَظِيمٌ-
অর্থাৎ তাদের কাউকে যখন কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেওয়া হতো তখন সে রাগান্বিত ও তার চেহরা মলিন হয়ে যেত।”
আবার অনেক কাফের-মুশরিক এ কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবরস্ত করে ফেলতো। (নাউজুবিল্লাহ) এহেন অপছন্দনীয় কন্যা সন্তানকে তারা আল্লাহর জন্য বন্টন করেছে আর পুত্র সন্তানকে নিজেদের জন্য বন্টন করেছে। কোন কোন রেওয়ায়তে রয়েছে তারা কাল্পনিক ও মনগড়া প্রতিমাদেরকেও আল্লাহর কন্যা রূপে আখ্যায়িত করতো।
আরবের কাফির-মুশরিকরা অসংখ্য প্রতিমার পুজা করতো, তন্মধ্যে তিনটি প্রতিমা ছিল সমধিক প্রসিদ্ধ। আরবের বড় বড় গোত্রগুলো এগুলোর পূজা-অর্চনায় আত্মনিয়োগ করেছিল। প্রতিমাত্রয়ের নাম ছিল লাত, ওয্যা ও মানাত। লাত তায়েফের অধিবাসী ছাকীফ গোত্রের জন্য নির্দিষ্ট, ওয্যা কুরাইশ গোত্রের এবং মানাত বনু হেলান গোত্রের প্রতিমা ছিল। এসব প্রতিমার অবস্থান স্থলে মুশরিকরা বড় বড় জাঁকজমকপূর্ণ গৃহ নির্মাণ করে রেখেছিল। এসব গৃহকে কাবার অনুরূপ মানমর্যাদা দেওয়া হতো। রাসূলে খোদা আশরাফে আম্বিয়া সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম পবিত্র মক্কা বিজয়ের পর এসব গৃহ ধুলিস্যাৎ করে দেন। [তাফসিরে কুরতুবি শরিফ]
উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাস্সেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন যে, আরবি ভাষায় ظن শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন: প্রথমত ظن মানে অমূলক ও ভিত্তিহীন কল্পনা। উদ্ধৃত আয়াতে এই অর্থেই বুঝানো হয়েছে। এটাই মুশরিকদের প্রতিমা পূজার কারণ ছিল। দ্বিতীয়ত: ظن মানে এমন ধারণা-কল্পনা যা দৃঢ় বিশ^াসের বিপরীতে আসে। আর ইয়াকিন তথা দৃঢ় বিশ্বাস সেই বাস্তবসম্মত অকাট্য জ্ঞান কে বলা হয় যাতে কোন সন্দেহ ও সংশয়ের অবকাশ নেই। যেমন, কোরআনে করিম অথবা হাদীসে মুতাওয়াতির থেকে অর্জিত জ্ঞান। এর বিপরীত ظن তথা ধারনা সেই জ্ঞান কে বলা হয়, যা ভিত্তিহীন কল্পনা তো নয়, বরং দলিলের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। তবে এই দলিল অকাট্য নয়, যাতে অন্য কোন সম্ভাবনাই না থাকে। যেমন সাধারন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত বিধি-বিধান। প্রথম প্রকার কে يقينيت তথা দৃঢ় বিশ্বাস প্রসূত বিধানাবলী এবং দ্বিতীয় প্রকার কে ظنيت তথা ধারনাপ্রসূত বিধানাবলী বলা হয়ে থাকে। এই প্রকার ধারনা শরিয়তে ধর্তব্য। এর পক্ষে কুরআন ও হাদীসে সাক্ষ্য-প্রমান বিদ্যমান রয়েছে। এই ধারনা প্রসূত বিধান অনুযায়ী আমল করা ওয়াজীব। এ বিষয়ে সবাই একমত। আলোচ্য আয়াতে যে ধারনাকে নাকচ করা হয়েছে, তার অর্থ অমূলক ও ভিত্তিহীন কল্পনা। তাই কোন খটকা নেই।
উদ্ধৃত আল্লাহর পবিত্র বাণী “এবং কত ফেরেশতাই রয়েছে আসমান সমূহে যে, তাদের সুপারিশ কোনরূপ কাজে আসবেনা। (কারো পক্ষে) কিন্তু যখন আল্লাহ অনুমতি দান করবেন যার পক্ষে চান ও (যাকে) পছন্দ করেন। (তার পক্ষে ফেরেশতাদের সুপারিশ ফলদায়ক হবে।) এর ব্যাখ্যায় মুফাস্সেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন- মহা প্রলয় ‘কিয়ামত’ সংগঠিত হওয়ার পর আখিরাতে বিচার দিবসে মহান আল্লাহর মুকাবিল প্রতিদ্বন্ধ¦ী হয়ে কেউ কারো পক্ষে আল্লাহর নিকট কোন রূপ সুপারিশ-শাফায়াত করত: নির্ধারিত কোন আযাব লাঘব কিংবা মুক্তি নিশ্চিত করতে কখনো পারবে না। যেমন মুমিন মুসলিম ব্যতীত অন্যান্য মনগড়া ভ্রান্ত ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করে ও বলে বেড়ায় যে, তাদের ধর্মাবতার ব্রাক্ষন, ঠাকুর-পুরোহিত, বিভিন্ন কাল্পনিক দেব-দেবী ও প্রতিমাগুলো পরকালের কঠিনতম সংকটময় সন্ধিক্ষনে আল্লাহর নিকট তাদের জন্য শাফায়াত করে তাদের নাজাত নিশ্চিত করবে। (নাউজুবিল্লাহ)
বক্ষমান আয়াতের প্রথমাংশে বিধর্মীদের এহেন মনগড়া, ভিত্তিহীন ও কাল্পনিক বিশ্বাসকে পুরোপুরি বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু আয়াতের শেষাংশে الا من بعد ان يأذن الله বলে কিয়ামতের দিন আল্লাহর দরবারে তাঁরই অনুমতি অনুমোদনক্রমে নবী, রাসূল সাহাবী তাবেয়ী, হাক্কানী-রব্বানী ওলামা-ইমামগণ ওলী গাউস কুতুবগণ এমনকি মুমিনগণের নাবালেগ সন্তানদের শাফায়াত আল্লাহর সমীপে গুনাহগার মুমিনগণের জন্য কবুল হবে। এ বিষয়কে স্পষ্টরূপে সাব্যস্ত করা হয়েছে সুতরাং আল্লাহর কোরআনের আলোকে প্রমাণিত হয় যে, বিধর্মীদের জন্য আল্লাহর নিকট তাদের ধর্মাবতার উপাস্য ঠাকুর-পুরোহিত-প্রতিমা দেব-দেবীর শাফায়াত সুপারিশ করার এখতেয়ার ও এর মাধ্যমে তাদের মাগফিরাত-নাজাত নিশ্চিত হওয়ার বিষয়কে অবিশ^াস কিংবা অস্বীকার করা দুটোই কুফরী ও স্পষ্ট গোমরাহী।
কুরআনে করীমের অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে-
من ذا الذى يشفع عنده الا باذنه অর্থাৎ কে সেই ব্যক্তি যে, আল্লাহর দরবারে শাফায়াত করবে? (নিজস্ব ক্ষমতা কর্তৃত্ব বলে অর্থাৎ এমন কেউ নেই) কিন্তু আল্লাহরই অনুমতি-অনুমোদন সাপেক্ষে। (আল্লাহ ওয়ালাদের শাফায়াত তারই নিকট গৃহীত হবে ও নাজাত নিশ্চিত হবে।) [তৃতীয় পারা আয়াতুল কুরসি]
বিশ্ব বিখ্যাত আকায়িদের কিতাব শারহে আকায়িদে নাসাফিয়্যাহ এর মধ্যে রয়েছে-
الشفاعة ثابتة للرسول والاخيار অর্থাৎ আল্লাহর দরবারে নবী-রাসূল ও আল্লাহ ওয়ালাগণের শাফায়াত করার এখতেয়ার কুরআন-হাদীসের আলোকে প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত সত্য। এছাড়া কোরআনে করীমের আরো অসংখ্য আয়াত ও হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর অগণিত রেওয়ায়ত ও আইম্মায়ে মুজতাহেদীনের সত্যাশ্রয়ী ও নির্ভরযোগ্য অভিমত রয়েছে। যদ্বারা প্রমাণিত হয় যে, হযরাতে আম্বিয়ায়ে কেরাম ও আল্লাহওয়ালাদের শাফায়াত কে বিশ্বাস করা ঈমান ও ইসলামের অন্যতম আকিদা।
লেখক: অধ্যক্ষ, কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া কামিল মাদরাসা, মুহাম্মদপুর, এফ ব্লক, ঢাকা।