কোরআন অবমাননা বিশ্ব শান্তির অন্তরায়
আবসার মাহফুজ >
ইউরোপের শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে খ্যাতি আছে সুইডেনের। দেশটির অবস্থান ইউরোপ মহাদেশে। এর রাজধানী স্টকহোম। কিন্তু ইদানিং দেশটিতে খ্রিস্টান উগ্রবাদ মাথাচারা দিয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রায়ই দেশটিতে ইসলাম ধর্মের অবমাননার ছাপ পাওয়া যাচ্ছে। দেশটিতে কিছু খ্রিস্টান জাতীয়তাবাদী উগ্রবাদী প্রকাশ্যে পবিত্র কোরআনে আগুন ধরিয়ে দিয়ে মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থের অবমাননা করছে। কিন্তু এমন অসভ্য ও ন্যাক্কারজনক ঘটনাকে বাকস্বাধীনতা বলে যুক্তি দেখিয়ে যাচ্ছে দেশটির সরকার। যুক্তরাষ্ট্রসহ পুরো পশ্চিমা দুনিয়াও এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনাকে পরোক্ষে সমর্থন দিয়ে আসছে। ফলে আশকারা পেয়ে মুসলিমবিদ্বেষী চক্রটিঁ বার বার কোরআনের অবমাননা করার দুঃসাহস দেখাচ্ছে। সর্বশেষ গত ২৮ জুন আবারো দেশটির রাজধানী স্টকহোমের একটি মসজিদের বাইরে এমন ঘটনা ঘটিয়েছে এক ব্যক্তি ও সাঙ্গপাঙ্গরা। তবে এর আগে মুসলিমবিশ্বে এমন অসভ্যতার বিরুদ্ধে তেমন সোচ্চার না হলেও এবার কিন্তু প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে। এবার বাংলাদেশসহ মুসলিমবিশ্বের তীব্র ক্ষোভের মুখে পড়েছে সুইডেন। পোপ ফ্রান্সসও এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। শুধু তাই নয়, কোরআন অবমাননার কারণে তুরস্ক সুইডেনকে ন্যাটো সদস্যপদ আটকে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ফলে বাধ্য হয়ে সুইডেন সরকার অপরাধীকে গ্রেপ্তার এবং এমন ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে। এটি একটি ইতিবাচক দিক, সন্দেহ নেই। তবে এ ঘটনায় আনা নিন্দা প্রস্তাবে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি দেশ বাকস্বাধীনতার ধোঁয়া তুলে বিপক্ষে ভোট দিয়ে যে কুদৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তা খুবই গর্হিত এবং একটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানমূলক বিশ্ব গড়ার পথে অন্তরায়।
উল্লেখ্য, মুসলিমবিদ্বেষী দেশ হিসেবে পরিচিত ফ্রান্সে যেমন বার বার আপত্তিকর কার্টুন এঁকে মহানবির সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মানহানির অপচেষ্টা করা হয়েছে এবং বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার কুযুক্তি দিয়ে দেশটির সরকার তা জায়েজ করার চেষ্টা করেছে। তেমনি সুইডেনেও পবিত্র কোরানে আগুন দিয়ে মুসলিম বিদ্বেষের প্রকাশ ঘটিয়েছে একটি উগ্রগোষ্ঠী। আর দেশটির সরকার অপরাধীদের শাস্তি দেয়ার পরিবর্তে মত ও বাকস্বাধীনতার খোঁড়া যুক্তি দিয়ে সে অপকর্মকে উৎসাহিত করেছে। ফলে এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটছে বার বার। বিবিসি’র রিপোর্টও বলছে, সুইডেনে পবিত্র কোরআন অবমননার ঘটনা এটিই প্রথম নয়। দেশটি মুসলিমদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন অবমাননার জন্য বিশ্বজুড়ে বারবার খবরের শিরোনামে এসেছে। আগেও বেশ কয়েকবার সুইডেনে কোরআন পোড়ানো হয়েছে। গত এপ্রিল মাসে মালমো শহরে স্ট্রাম কুর্স নামের একটি কট্টর ডানপন্থী সংগঠন কোরআন শরিফ পোড়ায় এবং এর জেরে সে দেশে ব্যাপক বিক্ষোভ চলে। সুইডেনের গণমাধ্যম এর বরাত দিয়ে বিবিসি জানায়, যারা কোরআন অবমাননা করছে তাদের ভাষ্য হচ্ছে, পশ্চিমা সমাজের গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার এবং নারী অধিকারের মতো বিষয়গুলোর সাথে কোরআন সাংঘর্ষিক এবং তাই এটা নিষিদ্ধ করা উচিত। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ডেনমার্ক ও সুইডেনের কট্টর ডানপন্থী রাজনৈতিক দল স্ট্রাম কুর্স অভিবাসন-বিরোধী ও ইসলাম-বিদ্বেষী বলে পরিচিত। সংগঠনটির নেতৃত্বে রয়েছেন রাসমুস পালুদান নামের একজন উগ্রপন্থী। চলতি বছর জানুয়ারিতে এবং ২০২০ খ্রিস্টাব্দেও সুইডেনে একই রকম ঘটনা ঘটেছে। প্রসঙ্গত, সুইডিশদের সাথে ইসলামের প্রথম পরিচয় হয় ১৬শ-১৭শ শতকে, যখন দেশটি সামরিক শক্তি অর্জন করছিল। সুইডিশ সা¤্রাজ্যের প্রসারের সাথে সাথে তার ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিও চরম আকার ধারণ করে। সুইডিশরা যদিও মূলত ক্যাথলিক ছিলেন, কিন্তু ১৬শ শতকে দেশটি একটি লুথেরান প্রটেস্টান্ট দেশে পরিণত হয়। ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে সুইডিশরা তাদের পিতৃপুরুষদের ধর্মমতকে বেআইনি ঘোষণা করেন। সে সময় ক্যাথলিক ও মুসলমানদের ‘প্রকৃত খ্রিস্টান ধর্মের’ শত্রু হিসেবে দেখা হতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সাথে সাথে সুইডেনে উদারনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটে। দেশটি পরিচালিত হয় ধর্মনিরপেক্ষ আইনের আওতায়। ফলে দেশটিতে ধর্মীয় সহাবস্থান ও সৌহার্দ বিরাজ করে। কিন্তু বছরকয়েক ধরে দেশটিতে নানা কারণে খ্রিস্টানধর্মীয় উগ্রবাদের উত্থান ও বিস্তার ঘটেছে। সাধারণ মানুষের মনেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সুইডেন ইসলামিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ওমর মুস্তাফাও বলেছেন- উগ্রবাদের উত্থানে বর্তমান সময়ে সুইডিশদের মনোভাবে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটছে। তিনি বলছেন, সুইডেনে ইসলাম বিদ্বেষ ক্রমশই বাড়ছে। আর সেটার বহিঃপ্রকাশ শুধু ইন্টারনেটে নয়, বাস্তবে মুসলমানদের জীবনে প্রতিনিয়ত তা ঘটছে। মুসলমানদের দেখা হচ্ছে ঘৃণার চোখে। বিভিন্ন সময় মুসলমানদের ওপর আক্রমণ চালানো হচ্ছে, কিন্তু বাকস্বাধীনতার দোহাই দিয়ে এসব অপরাধের বিচার হচ্ছে না। ফলে এমন ঘৃণীত অপরাধ বাড়ছে দিন দিন। ২৮ জুন ২০২৩ সুইডেনে কোরআন পোড়ানোর সর্বশেষ ঘটনার পর সংবাদমাধ্যমের কাছে তিনি নানাধরনের বিদ্বেষমূলক কর্মকা-ের বিবরণ দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে রাস্তাঘাটে মুসলমান নারীদের হেনস্থা, মুসলিমদের বাড়িঘরে আগুন দেওয়া এবং মসজিদের ওপর চোরা হামলার ঘটনা। উল্লেখ্য, পবিত্র কোরআন এবং মহানবী হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর অবমাননা মুসলিমদের ধর্মীয় অনুভূতিতে সবচেয়ে বড় আঘাত। সুইডেনের আগে ফ্রান্সের একটি ম্যাগাজিনও বেশ কয়েকবার মহানবীকে নিয়ে অবমাননাকর চিত্র প্রকাশ করেছে। বিশ্বজুড়ে মুসলিমদেশগুলো এসব ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। মহানবীর অবমাননার পর ফ্রান্সকে বয়কটের ডাক ওঠে। এর প্রভাব পড়ে ফ্রান্সের অর্থনীতিতেও। ফলে ফ্রান্স শুরুতে অপরাধীদের পক্ষ নিলেও আন্তর্জাতিক ব্যাপক চাপের মুখে সুর নরম করতে বাধ্য হয়। শেষপর্যন্ত দেশটি মহানবিকে অবমাননার ঘটনার নিন্দা জানিয়ে ফ্রান্সকে বয়কট না করার আহ্বান জানায়।
বিবিসির প্রতিবেদন বলছে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সুইডেন ডেমোক্র্যাট পার্টি এখন মুসলিমবিদ্বেষ ছড়ানোর ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে। এটি মূলত উগ্র ডানপন্থী দল, যারা একসময় নাৎসি ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাস করতো। মাত্রা কম হলেও এরা এখনও বর্ণবাদী এবং মাইগ্র্যান্ট-বিরোধী। ফলে যেসব কট্টর ডানপন্থী দলকে একসময় ‘ফ্রিঞ্জ’ বা প্রান্তিক গোষ্ঠী বলে মনে করা হতো তারাই এখন রাজনীতির ময়দানে প্রধান শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এসব ডানপন্থী দল পরিকল্পিতভাবে সুইডিশ সমাজে যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা ‘ট্যাবু’ বা নিষিদ্ধ, তারা সেটা ভাঙতে চায়। জুডি সাফেইন বার্কলে পলিটিক্যাল রিভিউর এক নিবন্ধে লিখছেন, শুধু সুইডেন না বরং বিশ্বজুড়েই ইসলাম-বিদ্বেষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে সিরিয়া এবং ইরাকের মতো দেশের মুসলিমরা যারা নিজ দেশে যুদ্ধাপরাধ এবং আর্থিক সংকটের শিকার হয়েছেন। বিভিন্ন দেশে কট্টর জাতীয়তাবাদী মনোভাবের সাথে যুক্ত হয়েছে ‘জেনোফোবিয়া’ বা বিদেশির সম্পর্কে আতঙ্ক। মানুষ নিজের সাংস্কৃতিক পরিচয়, জীবিকা এবং এমনকি নিরাপত্তা হারানোর ভয়ে এখন ‘অন্যদের’ সাহায্য করতে অস্বীকার করছে। এটা কোন আশ্চর্যের বিষয় নয় যে সুইডেনের ঘটনাও একই রকম। তবে সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয়টি হচ্ছে- এবার ঈদুল আজহার দিনে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমের সেন্ট্রাল মসজিদের বাইরে পবিত্র কোরান অবমাননার ঘটনাটি ঘটেছে আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে। সুইডেনের সরকারি ব্রডকাস্টার এসটিভি বলেছে, স্টকহোমের সেন্ট্রাল মসজিদের সামনে ঈদুল আজহার দিনে ইরাক থেকে আসা অভিবাসী সালমান মোমিকা ও এক ব্যক্তি পবিত্র কোরআনে আগুন দেয়। এই ব্যক্তি কোরআন নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছিল। কোরআন পোড়ানোর অনুমতি নিতে আদালতে গিয়েছিল সে। পরে আদালত তাকে অনুমতি দেয়। এটি খুবই দুঃখজনক। দেশটির আদালত বাকস্বাধীনতার নামে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় গ্রন্থ পবিত্র কোরানে আগুন দেয়ার অনুমকি কীভাবে কোন্ যুক্তিতে দিতে পারে তা বোধগম্য নয়। প্রশ্নটি হচ্ছে, যে আদালত পবিত্র কোরানে আগুন দেয়ার অনুমতি দিয়েছে, সে আদালতে যদি কেউ পবিত্র বাইবেলে আগুন দেয়ার অনুমতি প্রার্থনা করতেন তাতে কী আদালতের সায় থাকতো? কখনোই না। একইসঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকেও বাকস্বাধীনতার যুক্তি দিয়ে প্রথমে এমন অপরাধ ও ধর্মীয় বিদ্ধেষকে জায়েজ করার চেষ্টা করা হয়েছে। তাদের কাছেও প্রশ্ন, এক্ষেত্রে পবিত্র কোরানের স্থলে পবিত্র বাইবেল হলে তারা কী করতেন ও কী বলতেন। নিশ্চয়ই বিপরীত কথাই বলতেন। মনে রাখা দরকার, কারও অনুভূতিতে আঘাত বা কাউকে আক্রমণাত্মক বা উসকানি দেওয়ার জন্য ঘটানো কোনো ঘটনা মত প্রকাশের স্বাধীনতা হতে পারে না। বাকস্বাধীনতার অপযুক্তিতে যারা পরধর্মমতকে অবমাননার সুযোগ করে দেয়, তারা কখনো ‘সভ্য’ বলে দাবি করতে পারে না। প্রকৃত অর্থে তারা অসভ্য এবং বর্বর। এরা গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের জিগির তুললেও এদের দ্বারা মানবাধিকার সুরক্ষিত হতে পারে না। এরা সভ্যতা ও মানবতার শত্রু। একটি সৌহার্দময় মানবসাম্যের বিশ্ব গড়ার প্রধান অন্তরায়। সংগতকারণে এদের বিরুদ্ধে সোচ্চারকণ্ঠ হওয়া ধর্ম-বর্ণ-দেশ নির্বিশেষে সব মানবিক মানুষের অপরিহার্য দায়িত্ব ও কর্তব্য।
আশার বিষয় হচ্ছে, এবারের ঈদুল আজহার দিনে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমের একটি মসজিদের বাইরে পবিত্র কোরআনের অবমাননার ঘটনাটি মুসলিমবিশ্ব ছাড়াও সর্বমানবীয় চেতনার সভ্যমানুষদের নাড়া দিয়েছে। এমন অসভ্য ঘটনার পর বিশ্বের তীব্র ক্ষোভের মুখে পড়েছে সুইডেন। পবিত্র কোরআন পোড়ানোর ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিশ্ব। আরব ও মুসলিম দেশগুলোই শুধু নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, পোপ ফ্রান্সিসসহ পশ্চিমারাও এই ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে। খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় গুরু পোপ ফ্রান্সিস সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে কোরআন পোড়ানোর ঘটনায় ক্ষোভ ও বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। সংযুক্ত আরব আমিরাতের সংবাদপত্র আল-ইত্তিহাদকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পোপ ফ্রান্সিস বাকস্বাধীনতার নামে এ ধরনের কর্মকা-ের নিন্দা জানান। পোপ বলেন, ‘আমি এ ধরনের কর্মকা-ে ক্ষুব্ধ এবং বিরক্ত বোধ করি। কোরআন পোড়ানোর ঘটনা অনুমোদন দেওয়া অগ্রহণযোগ্য এবং নিন্দিত।’ ১২ জুলাই ২০২৩ নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করেছে জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে (ইউএনএইচআরসি)। ৫৭ জাতির ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) পক্ষ থেকে পাকিস্তান প্রস্তাবটি উত্থাপন করে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ কয়েকটি দেশ বিরোধিতা করলেও প্রস্তাবটি পাস হয়। পাস হওয়া প্রস্তাবটিতে ধর্মীয় বিদ্বেষ প্রশ্নে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করার জন্য জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার প্রধানের প্রতি আহ্বান জানানো হয় এবং ধর্মীয় বিদ্বেষ প্রতিরোধের জন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে প্রয়োজনীয় আইন সংশোধনের অনুরোধ করা হয়। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংগঠন ইউএনএইচআরসি-এর প্রধান ভলকার টার্ক বলেছেন, ‘পবিত্র কোরআন পোড়ানোর ঘটনা সার্বিকভাবে বিদ্বেষ তৈরি করেছে, সহিংসতার জন্ম দিয়েছে এবং মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত হেনেছে। এ ধরনের ঘটনা অনভিপ্রেত। এগুলো বন্ধ হওয়া দরকার।’ মুসলিমবিশ্বের দাবি, এই ঘটনা মুসলিম জনসমাজের বিশ্বাসের ওপর আঘাত। সুইডেনে কোরআন পোড়ানোর ঘটনায় ‘অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন (ওআইসি)’ জরুরি বৈঠক করে এবং ভবিষ্যতে পবিত্র কোরআনের অবমাননা এড়ানোর জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানায়। বৈঠকের পরে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘পবিত্র কোরআন অবমাননার পুনরাবৃত্তি রোধে ওআইসি তার সদস্য দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ ও সম্মিলিত ব্যবস্থা গ্রহণ করার’ আহ্বান জানিয়েছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান কড়াভাবে বলেছেন, ‘আমরা এই পশ্চিমাদের উচিত শিক্ষা দিয়ে বোঝাব, মুসলিমদের অপমান করাটা চিন্তার স্বাধীনতার মধ্যে পড়ে না।’ কোরআন পোড়ানোর ঘটনাকে উসকানিমূলক, অসুস্থ বিবেচনাপ্রসূত ও অগ্রহণযোগ্য বলেছে ইরান। এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে সৌদি আরব বলেছে, ‘বারবার এমন ঘৃণ্য কাজ করা হচ্ছে, এটি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।’ সুইডেনে পবিত্র কোরআন অবমাননার সর্বশেষ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এক বিবৃতিতে কোরআন অবমাননাকে ‘একটি প্রকাশ্য উস্কানি’ বলে মন্তব্য করেছে জোটটি। এছাড়াও বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ পবিত্র কোরআন পোড়ানোর ঘটনায় নিন্দা প্রকাশ করেছে। মুসলিম দেশগুলো কড়াভাষায় প্রতিবাদ জানিয়ে এর বিচার দাবি করেছে। মরক্কো ও জর্ডান এ ঘটনার প্রতিবাদে স্টকহোম থেকে তাদের রাষ্ট্রদূতদের দেশে ফিরে আসতে বলেছে। মরক্কোর রাবাতে সুইডিশ রাষ্ট্রদূতকে তলবও করা হয়। মিশর বলেছে, যখন মুসলিমরা ঈদুল আজহা পালন করছে তখন এই লজ্জাজনক ঘটনা বিশেষভাবে উস্কানিমূলক। এদিকে সুইডেনের রাজধানী স্টকহামে কোরআন পোড়ানোর ঘটনায় সুইডিশ পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা। বিদ্রোহী এই গোষ্ঠীর ট্রেডমার্ক এবং বাণিজ্যিক সংস্থাগুলো সুইডেনের ৩০টি সংস্থা ও ১০০টি ব্র্যান্ডের একটি তালিকা তৈরি করেছে; যেগুলোর পণ্য বয়কট করা হবে। মুসলিমবিশ্বের অন্যদেশগুলোরও উচিত হবে, সুইডেনের পণ্য বর্জনের পথে হাঁটা। এতে দেশটিতে কিছুটা হলেও ইসলাম ও মুসলিমবিদ্বেষের ঘটনা কমে আসবে।
পবিত্র কোরআন অবমাননার বিরুদ্ধে বিশ^সম্প্রদায়, বিশেষ করে মুসলিমবিশে^র এমন প্রতিক্রিয়া কাজ দিয়েছে। সুইডেন শুরুতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বললেও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে অবশেষে নিন্দা প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছে। এছাড়া ওই ব্যক্তিকে অন্যের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অপরাধে গ্রেফতার করা হয়েছে। পরে সুইডিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, ‘কোরআন বা অন্য কোনো ধর্মীয় গ্রন্থ পোড়ানো খুবই আপত্তিকর ও অসম্মানজনক কাজ এবং স্পষ্ট উসকানি। বর্ণবাদ, জেনোফোবিয়া এবং এই ধরনের অসহিষ্ণুতার কোনো স্থান সুইডেন বা ইউরোপে নেই।’ আমরা আশা করবো, সুইডেন সরকার বিষয়টির যুক্তিসঙ্গত ও সম্মানজনক ফায়সালা করবে। কারো বিশ্বাস ও ধর্মানুভূতিতে আঘাত করে এমন অসভ্য ও অমানবিক আইনের বিলুপ্তি ঘটাবে। আর শুধু সুইডেন নয়, ফ্রান্সসহ অন্যান্য দেশেরও উচিত হবে মুসলিমসহ বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণা ছড়ানোর তৎপরতা, আইন, আচরণ ও রীতিগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করা। অন্যথায় একটি সহাবস্থানমূলক, নিরাপদ, শান্তি ও সৌহার্দময় সমৃদ্ধ বিশ^ গড়ার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। ঘৃণার আগুন কাউকে রেহাই দেবে না। আমরা এ ব্যাপারে সবার শুভবোধের উদয় প্রত্যাশা করি।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক; সভাপতি-গ্রিন অ্যালায়েন্স বাংলাদেশ।