হিজরী নববর্ষের অনুভূতি ও মাহে মুহররমের ম্যাসেজ
মাওলানা মুহাম্মদ সরওয়ার উদ্দিন ক্বাদেরী>
বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণে ঈমানদারের অনুভূতি
বিদায় ১৪৪৪ হিজরী; সু-স্বাগতম ১৪৪৫হিজরী। একটি বর্ষের বিদায় ও আরেকটি নতুন বর্ষের আগমনে একজন প্রকৃত মু’মিনের অনুভূতি কি আনন্দের? নাকি বেদনার? বিবেকের দুয়ারে উদ্ভাসিত হয় কমন এ জিজ্ঞাসা। নতুনকে বরণ করার প্রবণতা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। যেমনটি একজন সাধারণ মানুষ নতুন ভোরের সূর্যোদয় দেখার মানসে আনন্দচিত্তে অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান থাকে। কিন্তু কবির অনুভূতি তার ব্যতিক্রম। জনৈক কবি বলেন, يَسُرُّ النَّاسُ مَا ذَهَبَ اللَّيَالِىْ + وَلكِنْ ذِهَابُهُنَّ لَهُ ذِهَاباً ‘মানুষ রাতের সমাপ্তিতে দিনের আগমনের লক্ষ্যে আনন্দ অনুভব করে। আসলে যা অতিবাহিত হয়েছে তা তো অতিবাহিত হওয়ারই।’ যে দিনগুলো আমাদের শেষ হয়ে গেলো তা তো আমাদের জীবনেরই অংশ ছিল। তা আর কোন দিন ফিরে আসবে না। তাই কবির ভাবনায় ফেলে আসা মূল্যবান সময়টুকু বেদনার। বিগত সময়টুকুতে কতটুকু সফলতা অর্জন করতে পেরেছে সেটাই এখন ভাবনার বিষয়। কারণ, এ দুনিয়ায় মানব সৃষ্টির নেপথ্যে মহান আল্লাহর উদ্দেশ্য নিহিত। বিদগ্ধ আরেকজন কবির অভিব্যক্তি হলো, إِنَّا لَنَفْرَحُ بِالْأَيَّامِ نَقْطَعُهَا + وَكُلُّ يَوْمٍ يُدْنِىْ مِنَ الْأَجَلِ. “নিশ্চয় আমরা যেদিনগুলো কাটাচ্ছি তা আনন্দের মধ্যেই অতিবাহিত করছি। অথচ প্রতিটি দিন আমাদেরকে নিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে।” মানুষের বয়স বাড়ে, কিন্তু জীবন কমে। জীবনের নির্দিষ্ট সময় থেকে একটি বছর সমাপ্ত হওয়ার অর্থ হচ্ছে আমি কবরের দিকে এক বছরের পথ অগ্রসর হলাম।
মুসাফির যেমন কয়েক দিনের জন্য সফরে বের হয়ে যথাসময়ে ফিরে আসে আসল ঠিকানায়, ঠিক তেমনি ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর মুসাফির হিসাবে প্রতিটি মানুষকেও তার হায়াতের নির্দিষ্ট সময় পূর্ণ করে ফিরে যেতে হয় আসল গন্তব্যে। মানুষকে তার সমগ্র জীবনে কয়েকটি স্তর অতিক্রম করতে হয়। যেমন: আদম সন্তানের প্রথম ঠিকানা রূহ জগতে, সেখান হতে পর্যায়ক্রমে স্থানান্তরিত হয়ে পিতার মাধ্যমে মাতৃগর্ভে, দ্বিতীয় ঠিকানা এ ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীতে, তৃতীয় ঠিকানা আলমে বরযখ তখা কবর জগতে। সর্বশেষ ও চুড়ান্ত ঠিকানা অনন্তকালের সুখের স্থান জান্নাতে অথবা অসহনীয় কষ্টের স্থান জাহান্নামে। সবকটি স্তর পেরিয়ে সবাইকে একদিন অবশ্যই চলে যেতে হবে সর্বশেষ ঠিকানায়। সুতরাং এ পার্থিব জগতে কেউ স্থায়ী নয়। মানুষের ইহ জীবন খুবই সংক্ষিপ্ত। এ জগত ছেড়ে কার আগে কে চলে যাবে তার সুনির্দিষ্ট কোন রুটিন নেই আমাদের হাতে। হায়াত ও মউতের একমাত্র মালিক আল্লাহ। জগত স্রষ্টা আল্ল¬াহর চিরন্তন বিধান মোতাবেক দিন যায় রাত আসে, রাতের পর দিন। এভাবে ফুরিয়ে যায় প্রতিটি মানুষের ইহজীবন। হায়াতের একটি দিন চলে যাওয়া মানে মানুষের জীবন বৃক্ষের একটি পাতা ঝরে যাওয়া। যে দিন সবগুলো পাতা ঝরে যায় সেদিনই তার বিদায় ঘন্টা বেজে উঠে। আপনজনেরা সমবেত হয়ে তাকে বিদায় জানায় আনুষ্ঠানিকভাবে। সে ধারাবাহিকতায় আমরাও একই পথের পথিক। অস্বীকার করার কোন জো নেই।
আমরা আমাদের সন্তানের জন্মদিবস পালন উপলক্ষে আনন্দ-উল্লাস করি। বিগত বছরের এ দিন সে জন্ম গ্রহণ করেছিল। তার শুভজন্মকে স্মরণ করার জন্য এই আনন্দ। আনন্দ-উল্লাসের নামে গান-বাজনা, নাচানাচি, লাফালাফি ইত্যাদি। বিবেকবানের কাছে এই আনন্দ-উল্লাসের কোন যৌক্তিকতা নেই। কারণ, যে সন্তানের বয়স গত বছরের এ দিনে শুন্যের কোটায় ছিল আজকের দিনে তার বয়স এক বছর পূর্ণ হলো। সে যদি ৫০বছর পৃথিবীতে বেঁচে থাকার বয়স নিয়ে আসে তাহলে এখন বাকী আছে আর ৪৯ বছর। আরও এক বছর অতিবাহিত হলে বাকী থাকবে ৪৮বছর। এভাবে প্রতি এক বছরে এক বছর কমবে। যেদিন সবগুলো বছর সমাপ্ত হবে সেই দিন সে আর নেই এ ক্ষণস্থায়ী জগতে। অতএব, জন্মদিনে আনন্দ উদযাপন করার চেয়ে আল্লাহর দরবারে সন্তানের পবিত্র জীবনের জন্য, আদর্শ ও সফল জীবনের জন্য যথাসাধ্য ইবাদত-বন্দেগী ও ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করা ঈমানদার-মুসলমানের কর্তব্য। যেন আল্লাহ পাক সন্তানকে যাবতীয় বিপদ-আপদ, অসুখ-বিসুখ থেকে, মন্দ স্বভাব-চরিত্র থেকে মুক্ত রাখেন। সর্বোপরি, আল্লাহ ও তাঁর হাবীবের সন্তুষ্টি ও নির্দেশ মোতাবেক, আউলিয়ায়ে কেরামের পদাংক অনুসরণে জীবন পরিচালনার মাধ্যমে পরকালে সে যেন নাজাত ও মুক্তির ঠিকানা খুঁজে পায়।
কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য যে, ইসলাম ধর্মের অনুসারী আমাদের মুসলিম সমাজে আজ পাশ্চাত্য অপসংস্কৃতি ও বিজাতীয় ধ্বংসাত্মক স্বভাব চরিত্র আমাদের নীতি নৈতিকতাকে বিনাশ করে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিধর্মীরা নতুন নতুন অপসংস্কৃতি রপ্তানী করে আর আমরা তা আমদানী করি। তারা চায় সুক্ষ্ম ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আমাদের চরিত্র হনন করে তাদের দল ভারি করতে। অথচ আমাদের ইসলামী আদর্শ ও সংস্কৃতি আমরা তাদের কাছে পৌঁছাতে পারি না। তারা ভুলেও আমাদের সংস্কৃতি চর্চা করে না। তাহলে আমরা কোন্ দুঃখে তাদেরকে অনুসরণ করি? ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, আমাদের পরিবার-পরিজন, সমাজ ও জাতি এভাবে জাহান্নামীদের দলে নিজেদের নাম লিখাচ্ছে নিয়মিত। হায়া-লজ্জা, বিবেক-বুদ্ধি ও সুস্থ জ্ঞান বলতে যাদের আছে তারা কখনও তাদেরকে অনুসরণ করতে পারে না এবং তাদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করতে পারে না। এটাই হওয়া উচিত ঈমানদার-মুসলমানের বর্ষবরণ ও বর্ষবিদায়ের প্রকৃত অনুভূতি।
হিজরীবর্ষের প্রথম মাস মুহররম। অনেক ঈমানদার-মুসলমান এ সম্পর্কে বে-খবর। অথচ ইংরেজি সন ও মাসের নাম তারিখসহ সবার মুখস্থ। বাংলা নববর্ষকে বরণ করার জন্য পহেলা বৈশাখে আনুষ্ঠানিকতার ছড়াছড়ি। আবার ইংরেজি বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের অনুষ্ঠানের নামে থাকে “থার্টি ফার্স্ট নাইট” উদযাপনের জন্য জমকালো আনুষ্ঠানিকতা। অথচ আমরা কি কখনও চিন্তা করেছি মুসলমান হিসাবে আরবি ও ইসলামী বর্ষপঞ্জি তথা চন্দ্র মাসসমূহের হিসাব সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা? আরবিবর্ষের হিসাব রাখা শুধু প্রয়োজন নয় বরং ক্ষেত্রবিশেষে ফরজও বটে। কারণ, আমাদের যাবতীয় ইসলামিক আনুষ্ঠানিকতা আরবি মাস ও চাঁদের তারিখ অনুযায়ী উদযাপিত হয়। যেমন: ১০ই মুহররম পবিত্র আশুরা উদযাপন ও কারবালার স্মৃতিচারণ, মাহে সফরের শেষ বুধবার আখেরী সাহার শোম্বা। ১২ই রবিউল আউয়াল ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও জশনে জুলুছ উদযাপন। ১১ই রবিউস সানী ফাতেহা-এ ইয়াজদাহুম। ২৭শে রজব শবে মে’রাজ। ১৪ই শা’বান শবে বরাত। ২৭শে রমজান শবে ক্বদর। ১লা শাওয়াল ঈদুল ফিতর। ১০ই জিলহজ¦ পবিত্র ঈদুল আজহা। ১৭ রমজান ঐতিহাসিক বদর দিবস।
মহান আশুরা বনাম কারবালা
‘আশুরা’ একটি ঐতিহাসিক দিন। সৃষ্টির সূচনালগ্ন হতে যুগে যুগে বিভিন্ন নবী-রাসূলের যুগে আল্ল¬াহর হুকুমে অসংখ্য অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হয় এ দিনে। এ সব ঘটনায় রয়েছে ইতিহাসের জোয়ার-ভাটা ও উত্থান-পতন এবং অনেক ট্রাজেডি। তাই আশুরা দিবসটি সকলের নিকট তাৎপর্যবহ একটি দিন হিসাবে পালিত হয়ে আসছে। এমনকি বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্ল¬াল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার যুগেও বিভিন্ন ইবাদত বন্দেগীর মাধ্যমে আশুরা দিবসটি পালিত হত। তখনও কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনা সংঘটিত হয়নি। ৬১ হিজরীতে কারবালার প্রান্তরে কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনা সংঘটিত হয়। তাও ছিল ১০ই মুহররম পবিত্র আশুরার দিবসে। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও রহস্যময়। অনেককে বলতে শুনা যায়, “আশুরা মানে কারবালা দিবস নয়” আবার অনেকে প্রশ্ন করেন, “আশুরার উৎস ও তাৎপর্য কি কারবালা কেন্দ্রিক?” এসব প্রশ্ন ও বক্তব্য অবান্তর। কারণ, কারবালার ঘটনার কারণে মহান আশুরার দিবসের স্বকীয়তায় কোন বাঁধা সৃষ্টি হয়নি বা আশুরার ফযিলত ও বৈশিষ্ট্যে কোন ঘাটতি হয়নি। বরং আশুরা ও কারবালা একই মোহনায় মিলিত হয়ে আশুরার তাৎপর্যে আরো নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
কারবালার ঐতিহাসিক ঘটনা ছিল সত্যের সাথে মিথ্যার দ্বন্দ্ব এবং হক ও বাতিলের লড়াই। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদর্শ সমুন্নত করার জন্য প্রাণপণ জিহাদ। এজিদ ছিল মিথ্যার পক্ষে আর ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন সত্যের পক্ষে। শরীয়ত সব সময় সত্যের পক্ষে কথা বলে। তাছাড়া কারবালা একটি মহান শিক্ষণীয় ঘটনা। পৃথিবীর ইতিহাসে এত বেশী করুণ ও হৃদয় বিদারক ঘটনা আর দ্বিতীয়টি নেই।
পবিত্র আশুরার শিক্ষা
পবিত্র আশুরা পালন আরম্ভ হয়েছে ২য় হিজরীর মুহররম মাস হতে। আর শাহাদাতে কারবালা সংঘটিত হয়েছে ৬১ হিজরীর মুহররম মাসে। ৬১ হিজরীতে এসে আশুরা ও শাহাদাতে কারবালা এক মোহনায় মিলিত হয়েছে। বিগত সাড়ে ১৪ শত বছর যাবৎ দিনের বেলায় আশুরার রোযা এবং রাতে ইবাদত এবং শাহাদাতে কারবালার স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। কারণ, কারবালার হৃদয়বিদারক ও লোমহর্ষক আত্মত্যাগের মধ্যে রয়েছে অনুস্মরণীয় আদর্শ ও শিক্ষা। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের ক্রান্তিকালে অনেক করণীয় ও বর্জনীয় নির্দেশনা এ আশুরায় বিদ্যমান। এই দিনটি আমাদের মাঝে প্রতি বছর আগমন করে। তাই, এই দিনের আবেদন চির অম্লান। দুর্বল, অসহায় ও নির্যাতিত মানবতার সহায় আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের কালজয়ী আদর্শ। শক্তি ও ক্ষমতার জোরে যারা নেশাগ্রস্ত তাদের বিরুদ্ধে অসহায় দুর্বল মানবতার অপ্রতিরুদ্ধ প্রতিবাদের দিন আশুরা। সাড়ে পাঁচ হাজার বছর পূর্বে শক্তিধর ক্ষমতাবান নমরুদের বিরুদ্ধে সেদিন ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম ঈমানদ্বীপ্ত মোকাবেলা করেছিলেন, পবিত্র আশুরা আমাদের সে কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। অন্যায় ও অসত্যের পুজারী পাপিষ্ঠ ইয়াজীদের বিরুদ্ধে ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু‘র প্রতিবাদ ও সংগ্রামের কথা স্মরণ করলে আজো ঈমানী চেতনায় জোয়ার আসে। তাই আমরা ঈমানদার-মুসলমান হিসাবে আশুরায় ইবাদাতও করব, সাথে সাথে শাহাদাতে কারবালার স্মৃতিচারণ করে আউলাদে রাসূলের প্রতি ভক্তি, মুহাব্বতের অনুপ্রেরণাও অর্জন করব। ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু এজিদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন ইসলামী আদর্শ রক্ষার জন্য। শাহাদাত বরণের মাধ্যমে তিনি সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাই আমরা আজ শপথ করব অন্যায় ও অসত্যের সাথে কখনও আপোষ করা যাবে না। সকল বাতিল আকীদার বিরুদ্ধে লড়াই করে সুন্নী মতাদর্শকে রক্ষা করতে হবে। এটাই কারবালার প্রকৃত শিক্ষা।
লেখক: মুহাদ্দিস, গহিরা এফ. কে. জামেউল উলূম বহুমুখী কামিল মাদরাসা, রাউজান, চট্টগ্রাম।