Anjuman-E Rahmania Ahmadia Sunnia Trust

সুন্নীয়তকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানে আল্লামা হাফেয ক্বারী সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ (রহ.)’র অবদান

সুন্নীয়তকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানে আল্লামা হাফেয ক্বারী সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ (রহ.)’র অবদান

সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আযহারী>

বিংশ শতাব্দীর অন্যতম ইসলামী চিন্তাবিদ, বহুমাত্রিক যোগ্যতা ও প্রতিভার অধিকারী, তরিকত জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র, সমাজ সংস্কারক, আধ্যাত্মিক রাহবার, আওলাদে রাসূল আল্লামা সৈয়দ মোহাম্মদ তেয়্যব শাহ রহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অন্যতম দিকপাল ও সুন্নীয়তের প্রতিষ্ঠানিক রূপকার। মধ্যপ্রাচ্য, বার্মা, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে ইসলামের মূলধারা সুন্নিয়তের অসামান্য খেদমত ও অবদানের কারণে তিনি বাংলাদেশে যেভাবে বরেণ্য অনুরূপভাবে আন্তর্জাতিক বিশ্বেও তিনি ছিলেন সর্বজন পরিচিত ও সমাদৃত।
শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সামাজিক, রাজনৈতিক, শরীয়ত ও তরিকতসহ বিভিন্ন পরিম-লে তাঁর অসামান্য অবদান সর্বমহলে প্রশংশিত। বিশেষ করে যুগোপযোগী ইসলামী শিক্ষা-দীক্ষার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর প্রতিষ্ঠিত এবং পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক পরিম-লে দৃষ্টি আকর্ষণ ও সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছে। জ্ঞানের গভীরতা, চেতনাপোলব্ধি, বুদ্ধিমত্তা, দূরদর্শিতা ও সাংগঠনিক প্রজ্ঞা তাঁকে বিদ্বান ও বিদগ্ধজনসহ সর্ব শ্রেণীর মানুষের কাছে সম্মানজনক আসনে সমাসীন করেছে।
বিরল প্রতিভার এই মহান ব্যক্তিত্ব ছিলেন শিক্ষা-আদর্শ, ঐতিহ্য-সভ্যতা ও মুসলিম জাগরণের পার্থসারথি। পূর্ববর্তী ইসলামী ব্যক্তিত্ব, তাপস-সাধক ও মনীষীদের সতত প্রতিচ্ছবি। নিম্নে এ মহান তাপসের সংক্ষিপ্ত জীবনী পেশ করা হল:

জন্ম:
রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের ৩৯তম বংশধর হুযুর কেবলা আল্লামা তৈয়ব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ১৩৩৬হিজরী- ১৯১৬খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমন্ত প্রদেশের হাজারা জিলার সিরিকোট শেতালু শরীফের আলে রাসুল আল্লামা সৈয়দ আহমদ শাহ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি’র পবিত্র ঔরশে জন্মগ্রহণ করেন। (১)
শাহানশাহে সিরিকোট আল্লামা সৈয়দ আহমদ শাহ সিরিকোটি ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ কামেল ওলী এবং আওলাদে রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম। তিনি পিতৃকুল-মাতৃকুল উভয় দিক দিয়ে ছিলেন সৈয়দ বংশীয়। তাঁর পূর্বপুরুষ ইসলাম প্রচারে নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে বাগদাদ আসেন সেখান থেকে আফগানিস্তান, আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তানে তাঁর ঊর্ধ্বতন সৈয়দ মুহাম্মদ গফুর শাহ্ ওরফে কাফুর শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বর্তমান আবাসস্থল সিরিকোটের পাহাড়ের শীর্ষে এসে বসতি স্থাপন করেন। তাই হযরত সৈয়দ গফুর শাহকে ‘ফাতেহে সিরিকোট’ বা ‘সিরিকোট বিজয়ী’ বলা হয়। এই প্রখ্যাত ওলীয়ে কামেল হযরত সৈয়দ কাফুর শাহ এর অধঃস্তন পুরুষ হলেন হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি।(২ )

শিক্ষা:
পিতা হযরত সৈয়দ আহমদ শাহ সিরিকোটির তত্ত্বাবধানে ১১বছর বয়সে পবিত্র কুরআন শরীফ হিফয করেন। অতঃপর শ্রদ্ধেয় পিতার নিকট এবং পরবর্তীতে গাউছে দাঁওরা ইলমে লাদুন্নীর প্রস্রবন খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হির প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের হরিপুর দারুল উলুম রহমানিয়া ইসলামিয়া মাদরাসায় দীর্ঘ ১৬বছর যাবৎ কুরআন, হাদীস, তাফসীর ফিকহ্, আরবী ব্যাকরণ, আকাইদ, বালাগাত, মানত্বিক ইত্যাদি ইলমে দ্বীনের শাখাগুলোতে বুৎপত্তি অর্জন করেন। প্রখর মেধা, তীক্ষ¥ বুদ্ধিমত্তা ও অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী এ মহান ব্যক্তি সাতাশ বছর বয়সে যাহিরী জ্ঞার্নাজন সম্পন্ন করেন ও সর্বশেষ সনদ লাভ করেন। তাছাড়া তৎকালীন প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন ফকিহ ও মুফাসসির আল্লামা সরদার আহমদ শাহ লায়লপুরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র সান্নিধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে পাণ্ডিত্য ও দক্ষতা অর্জন করেন। (৩ )

বাইয়াত ও খিলাফত:
তিনি ছিলেন হযরত সৈয়দ আহমদ শাহ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি’র প্রধান খলীফা তথা খলীফায়ে আযম। ১৯৫৮ সালে শাহানশাহে সিরিকোট হযরত সৈয়দ আহমদ শাহ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলাইহির বাংলাদেশ সফরকালীন সময়ে চট্টগ্রামস্থ রিয়াজুদ্দীন বাজারে মরহুম শেখ আফতাব উদ্দীনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে খতমে গাউসিয়া শরীফ চলাকালীন উপস্থিত অনেক পীর ভাইদের সামনে হযরত আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহিকে খেলাফত দান করেন এবং ‘খলীফায়ে আযম’ উপাধিতে ভূষিত করেন।(৪ )

বাংলাদেশ আগমন:
হুযুর কেবলা আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ তাঁর পূর্বপুরুষের ধারাবাহিকতায় ইসলাম প্রচার ও প্রসারে দেশ বিদেশ সফর করেন। তিনি ১৯৬১খ্রিস্টাব্দে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে শুভাগমন করেন। অবশ্য ইতিপূর্বে ১৯৪২ সনে চট্টগ্রামে সর্বপ্রথম তাঁর আগমনের তথ্য পাওয়া যায়। ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের শা’বান মাসে বাংলাদেশে তিনি প্রথম আগমন করে চট্টগ্রাম আন্দরকিল্লাহ শাহী জামে মসজিদে রমযান মাসের খতমে তারাবীতে ইমামতি করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ১৯৭৬ সালে আগমন করেন এবং ১৯৮৬ অবধি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দ্বীন ও মাযহাব-মিল্লাতের বিশাল গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৩৭ থেকে চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে শরিয়ত-ত্বরিক্বতের যে প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছিল আল্লামা সিরিকোটির হাত ধরে; তা ফলে ফুলে সুশোভিত হয়েছে আল্লামা তৈয়ব শাহ’র নেতৃত্বে। এখন প্রায় এক কোটিরও বেশি সত্যের পথিক বান্দাগণ এ মহান সিলসিলার ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহন করে দুনিয়া ও আখিরাতে নাজাতের পথকে সুগম করতে তৎপর।(৫ )

সুন্নীয়তকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানে হযরত তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হির অবদান:
রসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম এবং আওলাদে রাসূল ও সালফে সালেহীনের মতাদর্শের নামই হল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত। এই আদর্শ বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হয়েছে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম, আলে বাইতে রাসূল এবং সত্যিকার উলামায়ে কেরামের অক্লান্ত পরিশ্রম, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও অবিরাম সাধনার মাধ্যমে। আওলাদে রাসূল হুজুর কেবলা আল্লামা সৈয়দ মোহাম্মদ তৈয়ব শাহ রহমাতুল্লাহি আলাইহিও ছিলেন ওই সকল মহান মনীষীদের অন্যতম। যিনি ইসলামের সঠিক আদর্শ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মতাদর্শ ভিত্তিক ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার একজন স্বপ্নদ্রষ্টা। পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ইসলামের সঠিক রূপরেখা প্রতিষ্ঠার সঠিক কর্মপন্থা প্রণয়নপূর্বক বাস্তবমুখী কর্মসূচি ও কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করার মানসে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ও কার্যক্রমগুলোকে বেগবান করার যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে সক্ষম কারীগর।
ইসলামের মূল ভিত্তি হল ইলম বা জ্ঞান। আর এই ইলম বা জ্ঞানের ধারক বাহকদেরকে বলা হয় আলেম বা জ্ঞানী। যতদিন সঠিক আক্বীদা ও বিশুদ্ধ আমলধারী আলেম-ওলামা থাকবেন ততদিন ইলাম টিকে থাকবে। আর যতদিন ইলম টিকে থাকবে ততদিন ইসলামও টিকে থাকবে। তাই ইসলামকে রক্ষা করতে হলে সাচ্চা আলেম তৈরির কোন বিকল্প নেই। তাই হুজুর কেবলার অমীয় বাণী, ‘‘কাম করো ইসলামকে বাঁচাও দ্বীনকো বাঁচাও সাচ্চা আলেম তৈয়ার করো।’’ আর এই সাচ্ছা আলেম তৈয়ার করার জন্যই তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন অসংখ্য দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শরীয়তের পাশাপাশি তরিকতের দীক্ষা অর্জনের জন্যে প্রতিষ্ঠা করেছেন অসংখ্য খানক্বাহ। ইসলামের সঠিক শিক্ষা ও আদর্শ সর্বস্তরের মানুষের মাঝে পৌঁছিয়ে দেয়ার জন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন মসজিদ ও ইবাদত খানা। প্রতিষ্ঠা করেছেন এতিমখানাসহ অসংখ্য দাতব্য ও সমাজ সেবামূলক প্রতিষ্ঠান।
পাশাপাশি তাঁর যুগোপযোগী পদক্ষেপসমূহ বাস্তবায়ন এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর সঠিক, সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিচালনার জন্য গঠন করেছেন বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থা। ওইসব সংগঠন ও সংস্থার পদক্ষেপ ও কর্মসূচিগুলোর পরিধি স্থানীয় গণ্ডি পার হয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও প্রবেশ করেছে এবং সর্বস্তরে সমাদৃত হতে চলেছে। সুন্নীয়তকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দানের ক্ষেত্রে গাউসে যামান আল্লামা তৈয়ব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহির গৃহীত ও বাস্তবায়িত কিছু পদক্ষেপের সংক্ষেপে বিবরণ তুলে ধরা হচ্ছে:

সুশিক্ষার প্রচার-প্রসার এবং সাচ্চা আলেম তৈরির যথাযথ পদক্ষেপ:
‘শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড’ প্রচলিত এই প্রবাদ-প্রবচনের সাথে আল্লামা তৈয়ব শাহ রহমাতুল্লাহি আলাইহি একমত পোষণ করতে পারেননি। তিনি তাঁর পিতা ও পীর-মুরশিদ আল্লামা সৈয়দ আহমদ শাহ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র “কাম করো- দ্বীনকো বাচাও, সাচ্চা আলেম তৈয়ার করো” এ মহান অমীয় বাণীর আলোকে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি হলো, একমাত্র সুশিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড হতে পারে। আর যারা সুশিক্ষায় শিক্ষিত তারাই হলেন সাচ্চা আলেম। তাইতো ওলামায়ে কেরাম ইলম এর পরিচয় তুলে ধরেছেন এভাবে:
هو نور يقذفه الله فى قلب من يحبه يعرف به حقائق الاشياء وغوامضها
“ইলম হলো এমন নূর বা আলো, যা আল্লাহ তাঁর প্রিয় মানুষের অন্তরে ঢেলে দেন। ফলে তিনি তা দ্বারা বস্তুর তত্ত্ব ও রহস্য জানতে পারেন’।
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
يُؤْتِي الْحِكْمَةَ مَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُؤْتَ الْحِكْمَةَ
فَقَدْ أُوتِيَ خَيْرًا كَثِيرًا وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّا أُولُو الْأَلْبَابِ
তিনি যাকে ইচ্ছা হিকমত (ইলম) দান করেন এবং যাকে হিকমত দান করা হয় তাকে প্রভূত কল্যাণ দান করা হয় এবং কেবল বোধশক্তিসম্পন্ন লোকেরাই শিক্ষা গ্রহণ করে। (বাক্বারাহ ২/২৬৯)।
এ সম্পর্কে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
مَنْ يُرِدِ اللَّهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِى الدِّينِ
‘আল্লাহ যার কল্যাণ চান তাকে দ্বীনের জ্ঞান দান করেন’।(৬)
প্রকৃত আলেম তারাই যাদের মাঝে খোদাভীরতা আছে। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
إِنَّمَا يَخْشَى اللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ
‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে মূলতঃ আলেমরাই তাঁকে ভয় করে’ (ফাতির ৩৫/২৮)।
আমরা এই কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, রাসূল প্রেমে উজ্জীবিত সঠিক আকিদা ও নির্ভেজাল আমলধারী আলিমরাই হলেন খোদাভীরু আলিম, আর তাঁরাই হলেন সাচ্চা আলিম বা সাচ্চা নায়েবে রাসূল ও ওয়ারাসাতুল আম্বিয়া। এ সম্পর্কে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
إِنَّ الْعُلَمَاءَ هُمْ وَرَثَةُ الأَنْبِيَاءِ إِنَّ الأَنْبِيَاءَ لَمْ يُوَرِّثُوا دِينَارًا وَلاَ دِرْهَمًا إِنَّمَا وَرَّثُوا الْعِلْمَ فَمَنْ أَخَذَهُ أَخَذَ بِحَظٍّ وَافِرٍ. ‘আলেমরাই নবীগণের উত্তরাধিকারী। নবীগণ দীনার বা দিরহামের উত্তরধিকারী করেন না। বরং তারা ইলমের উত্তরাধিকারী করেন। ফলে যে ব্যক্তি তা গ্রহণ করল সে বৃহদাংশ গ্রহণ করল।(৭)
যথাযথ ওয়ারিশের অনুপস্থিতিতে বা ওয়ারিশ উপযুক্ত না হলে যেমনিভাবে পূর্ব পুরুষের রেখে যাওয়া সম্পদ অরক্ষিত ও বেহাত হয়ে যায় অনুরূপভাবে উপযুক্ত আলিম না থাকলে ইসলাম অরক্ষিত হয়ে যাবে ও অনুপযুক্তদের অধীনে চলে যাবে। ফলে ইসলামের মধ্যে নানা ধরণের গোমরাহী প্রবেশ করবে। এ সম্পর্কে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তাঁর বান্দাদের থেকে ইলম ছিনিয়ে নিবেন না; বরং দ্বীনের আলিমদের উঠিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে ইলমকে উঠিয়ে নেবেন। তখন কোন আলিম অবশিষ্ট থাকবে না। যার দরুন লোকেরা মূর্খদেরকেই ইমাম বা নেতা বানিয়ে নিবে, তাদেরকে দ্বীনের বিষয়ে কোন কিছু জিজ্ঞেস করা হলে তারা না জেনে ফতওয়া প্রদান করবে। ফলে তারা নিজেরা পথভ্রষ্ট হবে এবং অন্যদেরকেও পথভ্রষ্ট করবে। (৮ )
আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি সঠিক আকিদা তথা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের প্রচার-প্রসারের উদ্দেশ্যে তাঁর পিতা আল্লাম সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি কর্তৃক চট্টগ্রাম ষোলশহরে ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মাদরাসা’কে এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ‘সাচ্চা আলেম’ তৈরীর কারখানাতে উন্নীত করার পাশাপাশি ১৯৬৮সালে রাজধানী ঢাকার মুহাম্মদপুরে প্রতিষ্ঠা করন ‘কাদেরীয়া তৈয়্যবীয়া কামিল (এম.এ) মাদরাসা’। যা রাজধানীর বুকে ইসলামের সঠিক মূলধারার একমাত্র উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সুন্নিয়তের প্রাণকেন্দ্র এবং রাজধানীর সূফিবাদী সুন্নি মুসলমানদের একমাত্র অবলম্বন হিসেবে বিবেচিত।
এভাবে তিনি হালিশহর মাদরাসা-এ তৈয়্যবীয়া ইসলামিয়া ফাযিল, চন্দ্রঘোনা মাদরাসা-এ তৈয়্যবীয়া অদুদিয়া সুন্নিয়া, মাদরাসা-এ মুহাম্মদীয়া তৈয়্যবীয়া (ফরিদগঞ্জ), মাদরাসা-এ গাউছিয়া তৈয়্যবীয়া (কুমিল্লা), মাদরাসা-এ তৈয়্যবীয়া সুন্নিয়া (হাটহাজারী), মাদরাসা-এ তৈয়্যবীয়া সুন্নিয়া (ভৈরব), মাদরাসা-এ তৈয়্যবীয়া (করাচী, পাকিস্তান), মাদরাসা-এ আহলে সুন্নাত (রেঙ্গুন, মায়ানমার) সহ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। যা দ্বীন, মাযহাব-মিল্লাত, শরীয়ত-তরীকত বিশেষত মসলকে আলা হযরত প্রচার-প্রসারে অনন্য ভূমিকা পালন করছে যুগযুগ ধরে। (৯)

ঐতিহাসিক ‘জশনে জুলুস’ এর প্রবর্তন:
পবিত্র জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম নবী প্রেমের এক ফাল্গুধারা। মিলাদুন্নবী বিরোধী শক্তি এবং নবীজির শানে বিয়াদবীমূলক আকিদার প্রচার প্রসারকারীদের বিরুদ্ধে এক মুক্ত তরবারী। ১৯৭৪ সাল ছিল ঐতিহাসিক একটি বছর। এ বছর তিনি সিরিকোট শরীফ থেকে আনজুমান কর্মকর্তাদের চিঠি দিয়ে নির্দেশ দিলেন ১২ই রাবিউল আউয়াল রাসূল কারীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের শুভ আগমন দিবস উপলক্ষে ‘জশনে জুলুস’ এর আয়োজন করার। জশনে জুলুস কি এবং কিভাবে তা পালন করা হবে তার রূপরেখা এবং সকল ধরনের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা তিনি চিঠির মাধ্যমে জানিয়ে দেন। বাংলাদেশের জমিনে সর্বপ্রথম এই জুলুস ১৯৭৪ সালে ‘আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া (ট্রাস্ট)’র ব্যবস্থাপনায় বলুয়ারদিঘী পাড়স্থ খানকাহ্ এ কাদেরিয়া সৈয়্যদিয়া তৈয়্যবিয়া হতে শুরু হয়ে ষোলশহর জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদরাসা ময়দানে এসে মীলাদ মাহফিল, মুনাজাত ও তাবাররুক বিতরণের মাধ্যমে সমাপ্ত হয়। ১৯৭৬ সনে স্বয়ং হুযুর কেবলা আল্লামা তৈয়্যব শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এতে নেতৃত্ব দেন। যার ফলে এ জশনে জুলুস বাংলাদেশের ধর্মীয় জাতীয় উৎসবে রূপ নেয়ার পাশাপাশি ‘বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে নিয়ে আসে এক বৈচিত্ররূপ। আজ মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বিরোধীদের জন্য এটি উম্মুক্ত খর্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং বিরোধীরা বাধ্য হয়েছে নিজেদের খোলস পরিবর্তনে। ক্রমান্বয়ে এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় জুলুসে পরিণত হয়। বর্তমানে এটি পৃথিবীর বৃহত্তম জশনে জুলুসে ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম হিসেবে পরিচিত। এ জুলুছ বাংলাদেশের অন্যান্য পীর-মাশায়িখ ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমনভাবে প্রভাবিত করেছে যে, প্রতি বছর তাঁদের নেতৃত্বেও বের হচ্ছে অসংখ্য জুলুস। আজ বাংলাদেশে এমন কোন জেলা-থানা হয়তো নেই যেখানে ‘জশনে জুলুছে ঈদে মীলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম উদযাপিত হচ্ছে না। যা আল্লামা তৈয়ব শাহ’র এক বিশাল খেদমত ও অবদানের স্মৃতি ফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে নি:সন্দেহে।

প্রকাশনার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব:
সর্বমহলে আলোড়ন সৃষ্টিকারী পদক্ষেপগুলোর মধে অন্যতম ছিল বাংলা ভাষায় সুন্নিয়াত ভিত্তিক সাহিত্য প্রকাশনা। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত এবং মসলকে আলা হযরতকে বাংলা ভাষাভাষি মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার প্রচেষ্টায় ১৯৭৬ সনের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে চিঠির মাধ্যমে আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়াকে ‘মাসিক তরজুমান-এ আহলে সুন্নাত’ প্রকাশের নির্দেশ দেন এবং মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে ১৯৭৭ সালের জানুয়ারি থেকে আনজুমান কর্তৃক এ প্রকাশনার যাত্রা শুরু হয়। যেটি ছিল বাতিল ফেরকার জন্য মৃত্যুতুল্য। হুজুর কেবলা বলেন, ‘ইয়ে তরজুমান বাতেল ফেরকাকে লিয়ে মউত হ্যায়’।
গাউসে দাঁওরা খাজা চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি কর্তৃক সংকলিত এ সিলসিলার মাশায়িখ হযরাতে কেরামের বরকতময় দৈনন্দিন ওযীফাসমূহের বিরল গ্রন্থ ‘আওরাদুল কাদেরিয়াতুর রহমানিয়া’ প্রকাশনার মাধ্যমে সিলসিলার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন তিনি। যা আমি অধম বাংলা ভাষায় অনূবাদ করার সৌভাগ্য অর্জন করি।
খাজা চৌহরভী রচিত দুনিয়ার বুকে সাড়াজাগানো দরূদ শরীফের এক বিরলগ্রন্থ ‘মজমুয়ায়ে সালাওয়াতে রাসূল’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। যা সর্বপ্রথম হযরত সিরিকোটি শাহ রাহমাতুল্লাহি কর্তৃক রেঙ্গুনে প্রকাশিত হয় ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে। পরবর্তীতে এর ব্যাপক প্রচার ও প্রকাশের ব্যবস্থা করেন গাউসে জামান তৈয়্যব শাহ্ (রহ.)। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় এই বিরল তাৎপর্যপূর্ণ ৩০ পারা বিশিষ্ট দরূদ গ্রন্থের ২২ পারা পর্যন্ত উর্দু অনুবাদ নিজ তত্ত্বাবধানেই সম্পন্ন করেন; যা পরবর্তীতে বর্তমান হুজুর কিবলা আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ মাদ্দাযিল্লুহুল আলী কর্তৃক ৩০ পারা পর্যন্ত সম্পন্ন হয়ে বর্তমানে বঙ্গানুবাদসহ প্রকাশিত হচ্ছে।
হুযুুর কিবলা স্বনামধন্য আলিম, বিশিষ্ট সংগঠক ও লেখক মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নানকে কুর’আনে করিমের বিশুদ্ধ তরজমা কানযুল ঈমান ও নূরুল ইরফানসহ সুন্নিয়ত ভিত্তিক বাংলা সাহিত্য রচনার জন্য উৎসাহিত করে দোয়া করেন। তাঁর দোয়ার বরকতে আজ বাংলা ভাষাভাষি সুন্নি মুসলমানরা আল্লামা আব্দুল মান্নান সাহেবের লেখনি দ্বারা উপকৃত হচ্ছেন। আনজুমান থেকে প্রকাশিত হয়েছে বহু মূল্যবান গ্রন্থ; যা হুজুর কিবলারই নির্দেশ ও প্রেরণার ফসল এবং সুন্নিয়তের জন্য রক্ষা কবচের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।(১০)
সাংগঠনিক প্রচেষ্টা ও পদক্ষেপ:
সংগঠন শব্দের অর্থ সংঘবদ্ধকরণ ও দলবদ্ধ বা সংঘবদ্ধ জীবন। সমাজবদ্ধ জীবন যাপন মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। এ কারণে মানুষকে সামাজিক জীব বলা হয়। এই সমাজবদ্ধ জীবন যাপনের অপর নাম সংগঠন। ঐক্য হলো যে কোন সমাজের একটি মূল ভিত্তি। এ ভিত্তির উপরেই দাড়িয়ে থাকে সমাজের সৌন্দর্য এবং আদর্শ। সামাজিক ভিত্তি দুর্বল হলে সমাজ ভেঙে পড়ে। আর সামাজিক ঐক্য ধরে রাখার জন্য প্রয়োজন একটি সুস্থ, সুন্দর সামাজিক সংগঠন। এমনকি ধর্মীয় ভাবধারাকে শক্ত করার জন্যও সবার আগে প্রয়োজন সামাজিক একাত্মতা এবং সামাজিক ঐক্য। ইসলাম ফিতরাত বা স্বভাবসুন্দর ধর্ম। ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব ও সৌন্দর্য বিকাশ সাধন সম্ভবপর হয় সংগঠিত কর্মকা-ের মাধ্যমে। সংগঠন ছাড়া বা জামা‘আতবদ্ধ জীবন ব্যতিরেকে ইসলামের অস্তিত্বও কল্পনা করা সম্ভব নয়।
তাই মানব জীবনে সংঘবদ্ধ জীবন যাপনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এই জন্যেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম মুসলিম জনসমষ্টিকে একটি দেহের সাথে তুলনা করেছেন। তিনি এরশাদ করেন, মুমিনদের পারস্পরিক ভালবাসা, দয়া ও সহানুভূতি মানবদেহ সদৃশ। তার কোন অংশ রোগাক্রান্ত হলে সমগ্র দেহ নিদ্রাহীনতা ও জ্বরে দুর্বল হয়ে পড়ে।(১১) মহান আল্লাহ এরশাদ করেন, وَاعْتَصِمُواْ بِحَبْلِ اللّهِ جَمِيْعاً وَّلاَ تَفَرَّقُواْ
‘তোমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে সুদৃঢ়ভাবে আল্লাহর রজ্জুকে ধারণ কর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না’  (আলে ইমরান ১০৩)।
মহান আল্লাহ আরো এরশাদ করেন, ‘তোমাদের মধ্যে এমন একটি জাতি থাকা প্রয়োজন যারা সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎ কাজে নিষেধ করবে। আর তারাই হবে সফলকাম’ (আলে ইমরান ১০৪)।
তিনি আরো এরশাদ করেন, ‘তোমরাই উত্তম জাতি। বিশ্ব মানবের জন্য তোমাদের উত্থান। তোমরা সৎ কাজের আদেশ দিবে ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে’। (আলে ইমরান ১১০)
যখন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টির লক্ষ্যে কোন সংগঠন গঠিত হয় তখন ওই সংগঠনের উপর আল্লাহর রহমত সদা বিদ্যমান থাকে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, يَدُ اللهِ مَعَ الْجَمَاعَةِ ‘জামা‘আতের উপর আল্লাহর হাত রয়েছে’ (১২)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম আরো এরশাদ করেন, ‘তোমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বসবাস কর। বিচ্ছিন্নতা হ’তে সাবধান থাক। কেননা শয়তান একক ব্যক্তির (বিচ্ছিন্নজনের) সাথে থাকে এবং সে দু’জন হ’তে অনেক দূরে অবস্থান করে’।(১৩)
পার্থিব জীবনে সংগঠন একটি বিশাল শক্তি। ঐক্যবদ্ধ জনবল না থাকলে অস্ত্রশক্তিও কোন কাজে আসে না। তাই আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
‘ঈমানদার নারী-পুরুষ পরস্পরের সহযোগী ও পৃষ্ঠপোষক। তাদের সম্মিলিত দায়িত্ব হ’ল সৎকাজে আদেশ দান এবং অসৎকাজে বাধা প্রদান। তারা সালাত কায়েম করবে, যাকাত আদায় করবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে। তাদের প্রতি সত্বর আল্লাহপাক অনুগ্রহ করবেন। মহান আল্লাহ পরাক্রমশালী ও মহিমান্বিত’ (তওবা ৯/৭১)।
এই চরম সত্যকে উপলব্ধি করে আল্লামা হাফেয সৈয়দ তৈয়ব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বাংলাদেশের সুন্নি মুসলমানদের সাংগঠনিক ভিত্তিকে মজবুত করার দিকে বিশেষ মনোনিবেশ করেন এবং একেরপর এক বাস্তবমূখী উদ্যোগ গ্রহন করেন।

গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ এর প্রতিষ্ঠা:
১৯৮৬ সাল ছিল হুযুর কেবলার বাংলাদেশের শেষ সফর। শরীয়ত-তরীকতের কার্যক্রমকে বেগবান করার লক্ষ্যে ১৯৮৬ সনে আনজুমানকে চিঠির মাধ্যমে গাউসুল আযম আবদুল কাদের জীলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর মুবারক নামে ‘গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ’ গঠনের নির্দেশ দেন আল্লামা তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি। আজ এটি সুন্নিয়ত ও ত্বরিকতের জন্য তথা সমগ্র মানবকুলের জন্য এক মহা আর্শীবাদ হয়ে আবির্ভূত হয়েছে দেশে-বিদেশে। বৈশি^ক মহামারী করোনাকালে করোনা রোগীর সেবা ও কাফন-দাফনে এ সংগঠনের কাজ জাত ধর্মের উর্ধ্বে উঠে মানবজাতির কল্যাণে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে; যা ইতোমধ্যেই দেশি ও আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসিত ও সমাদৃত।
আধ্যাত্মিক কর্মকান্ড পরিচালনার মানসে আত্মপ্রকাশ হওয়া গাউসিয়া কমিটি বর্তমানে একটি মানবতার সেবায় সেচ্ছাসেবী সংগঠনে রূপ নিয়েছে। অসহায় মেয়েদের বিয়ে দেওয়া, গাছ লাগিয়ে পরিবেশ বাঁচানো, শীতার্তদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ, শিক্ষার্থীদের শিক্ষাসহায়তা প্রদান, মুসলিম শিশুদের জন্য খৎনা কর্মসূচি, অসহায়ের মুখে অন্নদান, অগ্নিকান্ডে নিহতদের উদ্ধার, আহতদের রক্তদান ও চিকিৎসা সেবা প্রদান, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ সহায়তা প্রদান করা ইত্যাদি কর্মসূচী বাস্তবায়ন এ সংগঠনের রুটিনিক কাজে পরিণত হয়েছে। যে কারণে ‘গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ’ শুধুমাত্র তরীকত ভিত্তিক সংগঠনে সীমাবদ্ধ না থেকে বর্তমানে মানবতার সংগঠন হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করেছে; যা সর্বজন সমাদৃত।
উল্লেখ্য যে, আল্লামা তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি পাকিস্তানেও ‘মজলিসে গাউছিয়া সিরিকোটিয়া’ নামে একটি তরীকত ভিত্তিক সেবামূলক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।(১৪)

একজন সংস্কারক:
যুগের বিবর্তনে, প্রজন্মান্তরে মানুষের জীবনে নতুন নতুন সমস্যা ও চাহিদার উদ্ভব হয়। তাই জীবন ঘনিষ্ট বিষয়গুলোতে সময়ের চাহিদার আলোকে সংস্কারের প্রয়োজন দেখা দেয়। এ প্রয়োজনীয়তা একটি চিরন্তন সত্য যা উপেক্ষা করার কোন জো নেই। মহান রাব্বুল আলামীনের ইচ্ছায় যুগের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হাতেই সাধিত হয় এ সমস্ত সংস্কার কার্যক্রম। তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ছিলেন তেমনি একজন শ্রেষ্ঠ বিদ্বান, বাগ্মী, যুক্তিবিদ ও চিন্তাবিদ। যিনি একজন সংস্কারক হিসেবে নিজেকে নিবেদিত করে সমাজ সংস্কারে ব্যাপক অবদান রেখে গেছেন। ইসলামের সুমহান বাণীকে মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে তিনি ছুটে যান দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। মানুষকে গোমরাহী থেকে ফিরিয়ে আল্লাহমূখী করা এবং সমাজ থেকে অন্যায়-পাপাচার দূর করার জন্য তিনি মানুষদেরকে নসীহত করেন। প্রতিবছর তাঁর বাংলাদেশে সফরকালীন সময়ে আয়োজিত অসংখ্য মাহফিলে তিনি উপস্থিত হয়ে মানুষকে শরীয়ত-তরীকতের শিক্ষা ও দীক্ষা প্রদানের মাধ্যমে তাদের ধর্মীয় পিপাসা নিবারণ করেন।
প্রত্যহ তিনি ফজর নামাজের পর বক্তব্য পেশ করতেন। তাঁর মূল্যবান ভাষণ, জ্ঞানগর্ভ আলোচনা এবং তাফসীরুল কুর‘আন মাহফিলের বিশ্লেষণগুলো ছিল বিশ্ব মুসলিমের জন্য পথ নির্দেশক এবং আক্বিদা-আমল ও তাক্বওয়ার গভীর থেকে গভীরতর স্তরের স্বরূপ উম্মোচন। দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা অনেক আলিম তাঁর মজলিসে উপস্থিত থাকতেন এবং বসতে পেরে উৎফুল্ল ও পরিতৃপ্ত হতেন। অনেকে আবার তাঁর মুরীদ হয়ে যেতেন।
বিশেষতঃ সিলসিলাহর মুরীদদের সুন্নি আক্বিদার উপর অটল রাখা, নবী প্রেমে উজ্জীবিত করা, সর্বোপরি শরিয়তসম্মত জীবন-যাপনের সাথে দ্বীনি খেদমতে উৎসর্গিত হবার প্রেরণা যুগিয়ে তিনি দ্বীনের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় সূচনা করে গেছেন। তাই তাঁকে অনেক গবেষক বর্তমান হিজরি শতাব্দির সুন্নিয়তের পূনরুজ্জীবনদাতা এবং কাদেরিয়া ত্বরিকার মহান সংস্কারক হিসেবে আখ্যায়িত করছেন।

আলা হযরতের চিন্তাধারার প্রচার
চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ, সহস্রাধিক কিতাবের লেখক, আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির যুগান্তকারী চিন্তাধারা নিয়ে বর্তমানে বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা চলছে। বাংলাদেশে মসলকে আ’লা হযরত’র প্রাতিষ্ঠানিক রূপকার হযরত সৈয়দ তৈয়ব শাহ। তাঁর আব্বা হুজুর এই মসলকের উপর জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়ার ভিত্তি দেন ১৯৫৪ তে, আর তিনি একে প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক রূপ দান করেন এদেশে অত্যন্ত সফলতার সাথে, যা আজ সর্বজন স্বীকৃত। আজ সুন্নিয়ত আর মসলকে আ’লা হযরত একাকার হয়ে গেছে সুন্নি জগতে- এটি তাঁর অবদান। হযরত সৈয়দ তৈয়ব শাহ সিলসিলার যাবতীয় কর্মকান্ডে কালামে রেযা ও সালামকে এমনভাবে তুলে ধরেন যা পরবর্তীতে সুন্নী মুসলমানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। বিশেষত, মীলাদ-কিয়ামে সর্বপ্রথম আ’লা হযরতের কালজয়ী নাতে রাসূল ‘মুস্তাফা জানে রহমত পে লাখো সালাম'(সালামী)’র সংযোজক তিনিই। চতুর্দশ শতাব্দির মুজাদ্দিদ, আ’লা হযরতের নাতিয়া কালাম ‘সবসে আওলা ওয়া আ’লা হামারা নবী’ এবং সালামে রেযা ‘মুস্তফা জানে রহমত পে লাখো সালাম’সহ আরো বহু দোয়া-দরূদ-না’ত কাসিদার সংযোজন ঘটিয়েছেন খতমে গাউসিয়া ও গেয়ারভী শরীফে। ফলে আজ এগুলো ঘরে ঘরে সমাদৃত হচ্ছে- যা ইতোপূর্বে এরূপ ব্যাপকতা পায়নি। তাঁরই অনুপ্রেরণায় তাঁরই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বহু লেখক, গবেষক, অনুবাদক ইতিমধ্যে শতাধিক গ্রন্থপ্রণয়ন, অনুবাদ কর্ম, প্রবন্ধ লিখে প্রকাশনা জগতকে উজ্জীবিত করেন।

ওফাত:
আল্লামা হাফেজ ক্বারী সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি প্রায় ৭৭ বছর বয়সে ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দের ৭ই জুন, ১৪১৩ হিজরির ১৫ যিলহজ্জ সোমবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে তাসবীহ পাঠরতাবস্থায় মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দেন। দরবারে আলীয়া কাদেরিয়া সিরিকোট শরীফে তাঁর ওফাত হয় এবং তাঁকে সেখানেই দাফন করা হয় পরদিন মঙ্গলবার। তাঁর ঐতিহাসিক জানাজায় উপস্থিত ছিলেন পাকিস্তানের তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী গওহর আইয়ুবসহ দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী বিশেষতঃ খ্যাতনামা ওলামা-মাশায়েখগণ। দেশ-বিদেশের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমগুলোতে তাঁর ইন্তেকাল, জানাযার সংবাদ’র সাথে সাথে প্রচারিত, প্রকাশিত হয়েছে দ্বীন-মিল্লাতের জন্য তাঁর রেখে যাওয়া যুগান্তকারী অবদান এবং শরিয়ত-ত্বরিকতের অগাধ জ্ঞানের কথা।

উপসংহার:
বাংলাদেশে শরীয়ত ও তরীক্বতের বাগানকে পল্লবিত করা এবং ইসলামের সঠিক ধারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আক্বীদা ও বিশুদ্ধ আমলকে প্রচার ও প্রসার করা এবং সুন্নীয়ত ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যে সকল মনীষীর অবদান অনস্বীকার্য তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আওলাদে রাসুল আল্লামা হাফেজ ক্বারী সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ।
সাধারণ শিক্ষিতদের একটি বদ্ধমূল ধারণা হলো, আল্লাহর অলী-বুজুর্গ ও ওলামায়ে কেরাম মসজিদ মাদরাসা ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন। দেশ-জাতি ও সমাজ গঠন বিশেষত ক্রমপরিবর্তনশীল বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে তাঁরা কোন চিন্তাই করেন না। তাদের এ ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে ছিলেন আল্লামা তৈয়ব শাহ্ (রহ.)। তিনি প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন যে, অলী-বুজুর্গ ও ওলামায়ে কেরাম ধর্মীয় ক্ষেত্রে যেমন অবদান রাখেন তেমনি অবদান রাখেন দেশ, জাতি ও বৈশ্বিক কল্যাণে। যদিওবা তাঁদের জীবন, কর্ম সম্পর্কে যথেষ্ট পরিমাণে লেখা-লেখি ও গবেষণা না হওয়ার কারণে তাঁদের এ অবদানগুলোর বেশিরভাগ লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যায়।
বক্ষমান প্রবন্ধে আমরা তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের উপর সামান্য আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি। কলেবরের সীমাবদ্ধতার কারণে তার জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাদ দিতে হয়েছে। সংক্ষিপ্ত করতে হয়েছে বিশদ আলোচনার দাবীদার বহু বিষয়কে। ফলে প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তার ব্যক্তিসত্ত্বার মূল্যায়নে ঘাটতি রয়ে গেছে। এক্ষেত্রে আল্লাহর তাওফীক হলে ভবিষ্যতে প্রচেষ্টা চালানোর আশা রাখছি ইন শা আল্লাহ।

টিকা:

১. – এ বর্ণনাটি সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। তবে বর্তমানে কেউ কেউ নির্ভরযোগ্য তথ্য সূত্রে মত ব্যক্ত করেন যে, ১৯১৬ সালের পরবর্তী কোন একসময়ে আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ জন্ম গ্রহণ করেন।
২. – local Govt act, Ref-15, Hazara 1871, Pakistan.
৩. – সৈয়দ মুহাম্মদ অছিয়র রহমান, মুর্শিদে বরহক আল্লামা হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহ আলাইহি’র জীবনী গ্রন্থ, (চট্টগ্রাম : তাসলীমা একাডেমী-২০০৬ইং) পৃ.৪২।
৪. – প্রাগুক্ত
৫. – মোছাহেব উদ্দীন বখতেয়ার, ইসলামের মহান সংস্কারক গাউসে জামান আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ (রাহমাতুল্লাহ আলাইহি) শীর্ষক সেমিনার (চট্টগ্রাম:আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া-১৯৯৮ইং) পৃ.০৪ ।
৬. – বুখারী-৭১, মুসলিম-১০৩৭
৭. – আবু দাউদ-৩৬৪১
৮. – বুখারী-১০০, মুসলিম-২৬৭৩
৯. – মোছাহেব উদ্দীন বখতেয়ার, ইসলামের মহান সংস্কারক গাউসে জামান আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ (রাহমাতুল্লাহ আলাইহি) শীর্ষক সেমিনার (চট্টগ্রাম:আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া-১৯৯৮ইং) পৃ.০৪ ।
১০. – দ্বীনের এক অনন্য রক্ষা কবচ-মাতৃগর্ভের অলী, গাউসে জামান আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ (রহ.): মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার।
১১. – বুখারী-৬০১১ ও মুসলিম-২৫৮৬
১২. – তিরমিযী হা/২১৬৬
১৩. – তিরমিযী-২১৬৫
১৪. – মোছাহেব উদ্দীন বখতেয়ার, ইসলামের মহান সংস্কারক গাউসে জামান আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ (রাহমাতুল্লাহ আলাইহি) শীর্ষক সেমিনার (চট্টগ্রাম:আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া-১৯৯৮ইং) পৃ.০৪ ।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ।