এ চাঁদ এ মাস: মাহে যিল্হজ্ব
পবিত্র হজ্ব, কোরবানি ও ঈদুল আজহার মহান সওগাত নিয়ে সম্মানিত মাস মাহে যিল্হজ্ব আমাদের দ্বারে উপস্থিত। এ মাস হিজরী বর্ষের শেষ মাস হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ।
হাদীস শরীফে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহ্ পাক দিবস সমূহের মধ্যে চারটি দিবসকে সম্মানিত করেছেন- জুমার দিন, আরাফার দিন, ঈদুল আজহার দিন এবং ঈদুল ফিতরের দিন। তদ্রুপ চারটি মাসকে মর্যাদাপূর্ণ করেছেন- ১. জিলক্বদ, ২. জিলহজ্ব, ৩. মর্হরম, ৪. রজব।
এ মাসের নফল ইবাদত
এ মাসের নতুন চাঁদ উদিত হবার পর যে ব্যক্তি দু’রাকাত করে চার রাকাত নফল নামায (প্রতি রাকাতে পঁচিশ বার করে সূরা ইখলাস দ্বারা) আদায় করবে তার জন্য অগণিত সওয়াবের কথা হাদিস শরীফে উল্লেখ রয়েছে। এ মাসে ১ তারিখ থেকে ৯ তারিখ পর্যন্ত রোযা রাখা অত্যন্ত বরকতময় মুস্তাহাব । বিশেষত ৯ যিলহজ্ব ইয়াওমে আরাফা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ দিন। এ দিন রোযা আদায়ে বহু সাওয়াব রয়েছে।
এ মাসের ১০ম রাতে বিতর নামাযের পর দুই রাকাত করে চার রাকাত নফল নামায আদায় করবেন। এর প্রতি রাকাতে সূরা কাউছার (ইন্না আ’ত্বায়নাকাল কাউছার) তিনবার এবং সূরা ইখলাস (কুলহুয়াল্লাহু আহাদ) তিনবার করে পড়বেন। এ মাসের যে কোন রাতের শেষ অধ্যায়ে প্রতি রাকাতে তিনবার আয়াতুল কুরসী, একবার সূরা ফালাক্ব এবং সূরা নাস দ্বারা চার রাকাত নামায আদায় করবে। অতঃপর দু’হাত তুলে নি¤েœর দো’আটি পাঠ করবেন।
সুবহানা যিল ইজ্জাতি ওয়াল জাবারূত, সুবহানা যিল কুদরাতি ওয়াল মালাকূত, সুবহানা যিল হাইয়্যিল লাযী লা য়ামূতু, লা ইলাহা ইল্লা হুয়া ইউহয়ী ওয়া য়ূমীতু ওয়াহুয়া হাইয়ুন লা য়ামূতু সুবহানাল্লাহি রাব্বিল ইবাদি ওয়াল বিলাদি, আল্হামদু লিল্লাহি কাছীরান তাইয়্যিবাম মুবারাকান আলা কুল্লি হাল। আল্লাহু আকবর কাবীরান, রাব্বানা ওয়া জাল্লাজালালাহূ ওয়া কুদরাতাহূ বিকুল্লি মকান। এরপর আল্লাহর নিকট স্বীয় প্রার্থনা নিবেদন করলে ইন্শাআল্লাহ কবুল হবে। এ নামায ও দোয়ার আমল একবার আদায় করলে হজ্ব ও মদীনা তাইয়্যিবাহ যিয়ারতের সওয়াব পাওয়া যাবে। আর প্রথম দশ রাতে নিয়মিত আদায় করলে জান্নাতুল ফিরদাউস অবধারিত এবং এক হাজার পাপ মার্জনা করা হবে।
তাকবীরে তাশরীক
এ মাসের ৯ তারিখ ফজর নামায হতে ১৩ তারিখ আসর নামায পর্যন্ত প্রতি ফরজ নামাযের পর (জমাতে হোক বা একাকি) নি¤েœর তাকবীর পাঠ করতে হবে এবং ভুলে গেলে স্মরণ হওয়া মাত্র পাঠ করে নেবে। ১ বার পাঠ করা ওয়াজিব, ৩ বার পাঠ করা মুস্তাহাব। আর মহিলারা নিম্নস্বরে পাঠ করবে।
তাকবীর: আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হাম্দ।
ঈদুল আজহার রজনীটি আল্লাহ্র করুণা লাভের পঞ্চরাত্রির অন্যতম। এ রাতে বিনিদ্র থেকে নফল ইবাদতের মাধ্যমে রাত অতিবাহিত করার মধ্যে অশেষ কল্যাণ ও সাওয়াব নিহিত রয়েছে।
এ মাসে ওফাতপ্রাপ্ত বিশিষ্ট আউলিয়া কেরাম
০১ যিলহজ্ব : খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী (রাহ.)।
০১ যিলহজ্ব : হযরত শাহ্সূফী আমানত খান (রাহ.)।
০৭ যিলহজ্ব : হযরত ইমাম মুহাম্মদ বাকের (রাহ.)।
০৮ যিলহজ্ব : ইমাম মুসলিম ইবনে আকিল (রাদ্বি.)।
০৮ যিলহজ্ব : হযরত ইমাম আবু যর গিফারী (রাহ.)।
১০ যিলহজ্ব : হযরত হাফেজ মুহাম্মদ বজলুর রহমান (রাহ.)
১৫ যিলহজ্ব : হযরত সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ (রাহ.)।
১৭ যিলহজ্ব : হযরত ইমাম আবু বকর শিব্লী (রাহ.)।
১৮ যিলহজ্ব : হযরত নঈম উদ্দীন মুরাদাবাদী (রাহ.)
১৯ যিলহজ্ব : মাহ্বূবে ইলাহী হযরত নিযামুদ্দীন (রাহ.)।
২৬ যিলহজ্ব : হযরত খান জাহান আলী (রাহ.)।
আগামী চাঁদ আগামী মাস : মাহে মুররম
হিজরীবর্ষ সূচনাকারী সম্মানিত মাস মুুর্হরম বিভিন্ন তাৎপর্য এবং ইতিহাসের বহু প্রসিদ্ধ ঘটনার ধারক। পৃথিবীর আদি হতে বহু স্মৃতিকে এ মাস স্মরণ করিয়ে দেয়। বিশেষত- এ মাসের দশম তারিখটিতে বহু ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, যা ইতিহাসে রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও কিছু ঘটবে বলে হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে।
১০ মুর্হরম বা আশুরা দিবসে হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম’র দোয়া কবুল, হযরত আদম, হযরত হাওয়া, হযরত ইব্রাহীম ও হযরত ঈসা আলায়হিমুস্ সালাম’র জন্ম, হযরত এয়াকুব আলায়হিস্ সালাম’র সাথে হযরত ইউসুফ আলায়হিস সালাম’র মিলন, হযরত মূসা আলায়হিস্ সালাম ও তাঁর কউমকে নীলনদ হতে পরিত্রাণ এবং ফেরআউন ও তার সৈন্যদের সলিল সমাধি, হযরত মূসা আলায়হিস্ সালাম আল্লাহ্র সাথে কথা বলার সৌভাগ্য এবং তাওরাত কিতাব লাভ, হযরত নূহ আলায়হিস সালাম’র সময়ে মহাপ্লাবনের পর সঙ্গীদের নিয়ে নৌকা হতে ভূমিতে অবতরণ, হযরত ইদ্রীস আলায়হিস্ সালাম ও হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালামকে আসমানে উত্তোলন, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ও উম্মুল মুমিনীন হযরত খাদিজাতুল কুবরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা’র শাদী মুবারক এবং হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র ফোরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে সপরিবারে শাহাদাত বরণ প্রভৃতি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। আশুরা তারিখে কোন এক শুক্রবার মহাপ্রলয়ে পৃথিবীর ধ্বংস ঘটবে। এ দিনটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের জন্য মাতম ও আহাজারীর পরিবর্তে ক্বোরআন সুন্নাহসম্মত কতিপয় আমল নি¤েœ পেশ করা হলো।
আমল
আশুরা দিবসে ইবাদতের নিয়তে গোসল করলে জীবনে কুষ্ঠ রোগ হতে মাহফুজ থাকবে। এই দিন এবং তার পূর্ববর্তী দিনসহ রোযা পালন, পরিবার পরিজনসহ উন্নত খাদ্যের আয়োজন করে শুকরিয়া আদায়, খিচুড়ি বা হালিম জাতীয় আহার্য তৈরি করে ইমাম হুসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু) এবং শহীদানে কারবালার জন্য ঈসালে সওয়াবের ব্যবস্থা, চোখে সুরমা ব্যবহার, সামর্থানুযায়ী দান-খায়রাত, ওয়াজ-নসীহতের ব্যবস্থা ইত্যাদি অত্যন্ত পুণ্যময় কাজ।
মর্হরম মাসের ১ তারিখে দু’রাকাত নামায আদায় করা যায়। সূরা ফাতিহার পর সূরা ইখলাস তিনবার করে পড়বেন। এরপর দু‘আটি পাঠ করলে সারা বৎসর শয়তানের প্ররোচনা হতে রক্ষা পাবেন এবং ইবাদতে একনিষ্ঠতা হাসিল হবে।
দু‘আ
আল্লা-হুম্মা আনতাল আর্বারুল কদী-ম, ওয়াহা-জিহী ছানাতুল জাদী-দাহ, ইন্নী- আসআলুকা ফী-হাল ইসমাতা, মিনাশ শায়তা-নির রাজী-ম ওয়া আউলিয়া-ইশ শায়তা-ন, ওয়ামিন র্শারিল বালা-য়া- ওয়াল আ-ফা-ত, ওয়াল আউনা হা-জিহিন নাফসিল আ-খিরাতি বিস্সূ-ই ওয়াল ইশতিগা-লা বিকা ইউর্ক্বারিবুনী- ইলাইকা, ইয়া- যালজালা-লি ওয়াল ইক্র—ম।
আশুরার দিনে দুই রাকাত করে চার রাকাত নামায আদায় করবেন। প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহার পর একবার সূরা যিল্যাল, একবার কাফিরূন ও একবার সূরা ইখলাস পড়বেন। নামায শেষে কমপক্ষে একশত বার দরূদ শরীফ আদায় করবেন। অন্য এক বর্ণনা মোতাবেক আরো চার রাকাত নামাযের নিয়ম পাওয়া যায়। প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহার সাথে পঞ্চাশবার করে সূরা ইখলাস পাঠ করতে হবে।
রোযা
এ মাসে প্রথম দশদিনে রোযা রাখার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এমনকি অন্ততপক্ষে একটি রোযা পালনের জন্য হাদীস শরীফে তাগিদ দেয়া হয়েছে।
তেলাওয়াত
এ মাসে অধিকহারে ক্বোরআন তিলাওয়াত ও দুরূদ শরীফ পাঠ করার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে। বিশেষত- আশুরা দিবসে কমপক্ষে দশটি আয়াত তিলাওয়াত কারীর জন্য সমুদয় ক্বোরআন শরীফ খতম করার সওয়াব দেয়া হবে বলে উল্লেখ রয়েছে। আমাদের উচিত এ মাসটিকে যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিপালন, আমাদের সামাজিক ও ব্যক্তিগত সকল ক্ষেত্রে হিজরী সাল ও তারিখের গুরুত্ব প্রতিফলন। ব্যক্তিক ও সামাজিক সকল ক্ষেত্রে ধর্মীয় মূল্যবোধের অনুবর্তন করার জন্য সচেষ্ট হওয়া নববর্ষের সূচনাতে আমাদের সে কামনাই থাকবে।