সোনালী অতীত : হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও অসহায় এক রমণী
যাহিদ হোসেন
হযরত জায়েদ ইবনে আসলাম নিম্নোক্ত ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। এক রাত্রে খলীফা উমর ইবনুল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু মদিনাতে নিজেই ঘুরে ঘুরে প্রজাদের অবস্থা দেখছিলেন। আমিও তাঁর সঙ্গে ছিলাম। আমরা শহর ছেড়ে বাইরে গিয়ে দেখি যে, মাঠের মধ্যে একটা ধ্বংসাবশেষ দালান থেকে একটা বাতির আলো জ্বল জ্বল করছে। খলিফা আমাকে বললেন, ‘জায়েদ এস আমরা ওখানে গিয়ে দেখি কে মধ্যরাত্রে আলো জ্বালাচ্ছে।’ আমরা ওখানে পৌঁছতেই একজন রমণীকে দেখলাম, আর পাশেই মাটিতে ঘুমিয়ে আছে তার দুটো শিশু। আর আগুনের উপর একটি হাঁড়ি বসানো। রমণী বলছে, ‘হে খোদা, আমায় দয়া করেন যেন হযরত উমরের কাছ থেকে ন্যায় বিচার পাই। তিনি খেয়ে পরিতৃপ্ত হয়েছেন কিন্তু আমরা এখনও ক্ষুধার্ত। হযরত উমর শুনে আমাকে বললেন, ‘হে জায়েদ, এই রমণী আল্লাহ্র কাছে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে। তুমি এখানে অপেক্ষা কর, আমি গিয়ে জিজ্ঞাসা করি তার কি হয়েছে।’ তিনি রমণীর কাছে গিয়ে বললেন, তুমি মধ্যরাত্রে মাঠের মধ্যে বসে কি রান্না করছো?’ সে বলল, ‘আমি এক অসহায় রমণী; আমার মদিনাতে একটা বাড়ি ও কিছু সম্পত্তি আছে কিন্তু আমার এক পায়সাও নেই। আমার বলতে এত লজ্জা হয় যে, আমার এই শিশু দুটো ক্ষুধার যন্ত্রণায় কেঁদে কেঁদে বিলাপ করছে কিন্তু তাদেরকে দেবার মত আমার কিছুই নেই। আমি এখানে মাঠের মধ্যে চলে এসেছি যাতে প্রতিবেশীরা জানতে না পারে তারা কেন কাঁদছে। যখনই তারা ক্ষুধার যন্ত্রণায় কেঁদে উঠে আমার কাছে খাবার চায় তখনই আমি আগুনে চুল্লী বসিয়ে তাদেরকে বলি, ‘‘তোমরা ঘুমিয়ে পড়, ঘুম থেকে উঠতে উঠতে খাবার রান্না হয়ে যাবে।’’ এই বলে তাদেরকে আমি ঘুমিয়ে রেখেছি। তারা মনে করে যে, আমি কিছু রান্না করছি আর সেই আশায় তারা ঘুমিয়ে যায়, কিন্তু ঘুম থেকে উঠে যখন দেখে কিছুই তৈরি হয়নি, তারা আবার আর্তনাদ শুরু করে। ঐ একই অজুহাতে তাদের এখন আমি ঘুমিয়ে রেখেছি। দুদিন ধরে পানি ছাড়া তাদের আমি কিছুই দিতে পারছি না আর আমার দেবার মত কিছুই নেইও। এই হাঁড়ির মধ্যেও পানি ছাড়া কিছুই নেই।’ হযরত ওমর ওই রমণীর প্রতি দয়াপরবশ হয়ে বললেন, ‘তুমি ন্যায়ভাবেই উমরকে অভিশাপ দিয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছে।’ রমণীটি হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে চিনতে পারেনি। তিনি রমণীকে আবার বললেন, ‘আমি ফিরে না আসা অবধি তুমি এখানে কিছুক্ষণের জন্য অপেক্ষা করতে থাক।
হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তখন আমায় এসে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি চল, আমরা বাড়িতে ফিরে যাব।’ তাঁর বাড়িতে পৌঁছে তিনি ভিতরে ঢুকলেন আর আমি দরজায় দাঁড়িয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পরে তিনি দু’টি চামড়ার থলি ঘাড়ে করে বেরিয়ে এলেন। তিনি আমাকে বললেন, ‘চল আমরা ঐ রমণীর কাছে আবার যাই।’ আমি বললাম, ‘হে খলিফা, আমার কাছে থলি দু’টি দিন, আমি নিয়ে যাই।’ হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু উত্তর দিলেন, হে জায়েদ, তুমি এই বোঝা বহন করলে কিয়ামতের দিন আমার পাপের বোঝা কে বহন করবে? এবং তিনি সারা পথ হেঁটে রমণীর সামনে গিয়ে থলি দুটো রাখলেন- একটার মধ্যে ছিল ময়দা আর অন্যটির মধ্যে ছিল চাউল, তৈল আর ডাল। তিনি আমাকে বললেন, ‘জায়েদ মাঠের মধ্যে গিয়ে খড়কুটা যা পাওয়া যায় নিয়ে তাড়াতাড়ি এস।’ আমি জ্বালানি কাঠের সন্ধানে বের হলাম। তখন হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু কলসী নিয়ে কিছু পানি এনে চাউল ও ডাল চুল্লীর উপর তুলে দিলেন এবং কিছু চর্বি ঢেলে দিলেন। এদিকে রমণী রুটির মত গোলাকার পিণ্ড তৈরি করছে। আনন্দে তার চোখে পানি এসে গিয়েছিল। আমি জ্বালানি কাঠ নিয়ে এলাম। হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু নিজ হাতে চুল্লী ধরিয়ে দিয়ে তার উপর খাবার চড়িয়ে দিলেন।
খাবার প্রস্তুত হলে রমণী তার বাচ্চাদের ঘুম থেকে তুলল এবং হযরত উমর তাদের সামনে খাবার রাখলেন। তারপর কিছু দূরে গিয়ে জায়নামায বিছিয়ে নামায পড়তে শুরু করলেন। কিছুক্ষণ পরে তিনি তাকিয়ে দেখলেন বাচ্চারা প্রাণভরে খাবার খেয়ে তাদের মায়ের সঙ্গে খেলা করছে। তিনি রমণীকে বাচ্চাদের সহ বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘হে রমণী, উমরের প্রতি সদয় হও; তাকে আর অভিশাপ দিও না। তাকে মাফ করে দাও, কারণ সে জানত না যে তুমি অসহায় অবস্থায় আছ।” ক্রন্দরত রমণী বলল, ‘আমি অনুরোধ করছি, আল্লাহ্র নামে শপথ করে বলুন আপনি হযরত উমর কিনা?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি উমর।’ নিঃস্ব অসহায় রমণী বলল, আল্লাহ্ যেন আপনাকে ক্ষমা করেন, আপনি আমাদেরকে খাদ্যাভাবে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছেন।’