Anjuman-E Rahmania Ahmadia Sunnia Trust

সুদানে রক্তক্ষয়ী সংঘাত : লাভ কার?

সুদানে রক্তক্ষয়ী সংঘাত : লাভ কার?

আবসার মাহফুজ

সুদান আবার প্রক্সিযুদ্ধের নতুন ফ্রন্টে পরিণত হওয়ার বিষয়টি উদ্বেগজনক ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিচ্ছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে কিছু বিদেশি শক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় অভ্যন্তরীণ দলগুলোর হানাহানি, রক্তপাত সুদানকে ঠেলে দিচ্ছে আরেকটি গৃহযুদ্ধের দিকে। ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের পর ২০২১, অতঃপর ২০২৩-এ এসে অস্থিরতা ও অশান্তির পারদ চরমে উঠেছে। গত ১৫ এপ্রিল ২০২৩ থেকে চলমান সংঘর্ষে সহস্রাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহানের নেতৃত্বে সুদানি সেনাবাহিনী ও মোহাম্মদ হামদান দাগালোর নেতৃত্বাধীন সুদানের আধাসামরিক বাহিনীর (র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস-আরএসএফ) মধ্যে সংঘটিত এই লড়াইয়ে আহত হয়েছেন হাজার হাজার সুদানি। যদিও এখন যুদ্ধবিরতি চলছে, তবে যে কোনো সময় ফের রক্তাক্ত যুদ্ধের সূচনা হতে পারে। কারণ, সুদানের এমন অনাকাক্সিক্ষত সংঘাতে পানি সিষ্ণন করছে কয়েকটি বিদেশী শক্তি। সংগতকারণে তাদের স্বার্থ সুরক্ষিত না হলে যুদ্ধ পুরোপুরি থামার সুযোগ নেই। আগ্নেয়গিরির মতো কিছুদিনের জন্যে সুপ্ত থাকলেও যে কোনো সময় জেগে উঠতে পারে যুদ্ধের দামামা। এতে মদদদাতারা লাভবান হলেও চরম ক্ষতির শিকার হবেন সুদানি জনগণ।

উল্লেখ্য, একসময় বিভিন্ন পরাশক্তি সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হলেও পরবর্তীতে তারা আধুনিক বিশ্বে নতুন প্রজন্মের বিধ্বংসী অস্ত্রের ভয়াবহতা বিবেচনায় পারস্পরিক ক্ষয়ক্ষতি ও জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকির কথা চিন্তা করে নিজস্ব স্বার্থ হাসিলে ‘প্রক্সিযুদ্ধ’ বা ‘ছায়াযুদ্ধ’কে বেছে নেয়। ক্রমশ প্রক্সিযুদ্ধের ধারণা তাদের জন্য ‘পছন্দনীয় বিকল্প’ হয়ে ওঠে। বর্তমান সময়ে তারা একে অপরের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ, সংঘাতের রাস্তায় না গিয়ে বরং আড়ালে থেকে কলকাঠি নাড়ে। এখন পরাশক্তিগুলো বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করে থাকে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে। যুদ্ধের গতিপথ নিয়ন্ত্রণে রাখতে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য আড়ালে-আবডালে প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তাসহ নানামাত্রিক সহায়তাও প্রদান করে থাকে। এই যুদ্ধের মধ্যদিয়ে নিজের মিত্রদের একত্রিত করে প্রতিপক্ষের ওপর এবং এমনকি শত্রুপক্ষের প্রক্সিদের বিরুদ্ধেও প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায় খুব সহজেই। তবে স্নায়ুযুদ্ধকালে প্রক্সিযুদ্ধগুলো মূলত আদর্শকেন্দ্রিক থাকলেও এখন তা নিজস্ব স্বার্থগত তথা অর্থনৈতিক রূপও ধারণ করেছে। আবার অপরাশক্তিগুলোও প্রক্সিযুদ্ধ চর্চা করছে। লক্ষ করলে দেখা যাবে, বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে প্রক্সিযুদ্ধ চলছে। আবার এসব যুদ্ধে পরাশক্তিগুলোর বাইরে বিভিন্ন অপরাশক্তিও স্বার্থগতকারণে ইন্ধন যোগাচ্ছে। আর এসব প্রক্সিযুদ্ধের লক্ষ হচ্ছে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে নিয়ে শাসন-শোষণ ও খবরদারী জারি রাখা। সিরিয়া এবং লিবিয়ার দিকে তাকালে দেখা যায়। এসব দেশে যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার বাইরেও ইরান, তুরস্ক সহ কয়েকটি দেশ যুক্ত নিজস্ব স্বার্থগত কারণে। লিবিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের দুটি দেশও প্রক্সিযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে সেখানকার বিভিন্ন উপদলকে দিয়ে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে অন্তত তিনটি পক্ষ রয়েছে- ইরান ও রাশিয়া সমর্থিত বাশার আসাদ সরকার; ওয়াইপিজি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা রাষ্ট্র দ্বারা সমর্থিত পিকেকে-এর সিরিয়ান শাখা এবং তুরস্ক সমর্থিত মূলধারার সিরিয়ার বিরোধী দল। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শক্তিগুলো ইউক্রেনকে বলির পাঁঠা করে রাশিয়ার সাথে প্রক্সিযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। ভারত এবং পাকিস্তানও বিভিন্ন শক্তিকে ব্যবহার করে পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রক্সিযুদ্ধ চালাচ্ছে। এভাবে সারাবিশ্বেই এখন পরাশক্তিগুলোর বাইরেও বিভিন্ন দেশ প্রক্সিযুদ্ধে জড়িয়ে বিশ্বকে অশান্ত করে তুলছে। আফ্রিকান দেশ সুদানও এখন প্রক্সিযুদ্ধের নতুন ফ্রন্টে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন বহির্শক্তির ইন্ধনে অভ্যন্তরীণ দলগুলোর হানাহানি, রক্তপাত সুদানকে ঠেলে দিচ্ছে আরেকটি গৃহযুদ্ধের দিকে। বিভিন্ন আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তি ক্রমশ জটিলতর হয়ে ওঠা সুদান সংকটকে নিজের স্বার্থে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। এদের মধ্যে একপক্ষের প্রধান লক্ষ হচ্ছে সুদানের প্রাকৃতিক সম্পদ শোষণ। আরেকপক্ষের টার্গেট নীলনদের ওপর! এই দ্বিমুখী লক্ষ্য পূরণের জন্য শক্তিগুলো অবিরত চেষ্টা চালিয়ে আসছে। ফলে সেখানে প্রক্সিযুদ্ধ বন্ধের সম্ভাবনা ক্ষীণ বলতে হবে।

প্রসঙ্গত, সুদানে প্রক্সিযুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে বহু আগে। প্রায় ৩০ বছর ধরে স্বৈরশাসন চালিয়ে সুদানকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করে দেওয়া এবং গণহত্যা চালিয়ে বহু মানুষ হত্যা করা প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশিরকে একটি সামগ্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে উৎখাতের পর দেশটিতে ক্ষমতার শূন্যতা তৈরি হয়েছিল। আরএসএফ নাকি সেনাবাহিনী দেশ চালাবে তাই নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে চার বছর ধরে ভেতরে-ভেতরে টানাপোড়েন চলছিল। শেষপর্যন্ত বিভিন্ন বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক শক্তির মদদে তা সরাসরি সশস্ত্র লড়াইয়ে রূপ নিয়েছে। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, ২০ বছর আগে দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় দারফুর এলাকায় সরকারবিরোধী একটি বিদ্রোহকে বন্দুকবাজ ভাড়াটে ও খুনিদের দিয়ে দমন করা হয়েছিল। বিদ্রোহ দমনকারী ওই সরকারপন্থী গ্রুপের সদস্যদের বলা হতো জানজাবিদ। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে একটি অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে ক্ষমতা দখল করা সামরিক শাসক ওমর আল-বশির সে সময় দারফুরে তাঁর প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী পাঠাতে চাননি। এর বদলে তিনি দারফুরের আদিবাসী ও উপজাতীয়দের বিভেদ উসকে দিয়ে সেখানকার বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে জানজাবিদদের তার প্রক্সিসেনা হিসেবে লাগিয়ে দেন। এরপর থেকে সেখানে অশান্তি শুরু হয়। বিভিন্ন শক্তি সুদানে প্রভুত্ব বিস্তারের প্রতিযোগিতা শুরু করে। কেউ সরকারের পক্ষে, কেউ বিরুদ্ধ পক্ষকে সমর্থন ও মদদ দেয়। প্রেসিডেন্ট বশির আধা সামরিক বাহিনীর মর্যাদা দিয়ে আরএসএফ নামে আলাদা একটি আনুষ্ঠানিক বাহিনী গড়েন। এই বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন মোহামেদ হামাদান দাগালো (তিনি ‘হেমেদতি’ নামে বেশি পরিচিত)। তবে ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন তীব্র হলে হেমেদতি সেনাবাহিনীর সঙ্গে এক হয়ে বশিরকে গদি থেকে ফেলে দেন। সামরিক অভ্যুত্থানের পর দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো পরিচালনার জন্য গঠন করা হয় ট্রানজিশনাল মিলিটারি কাউন্সিল (টিএমসি)। একপর্যায়ে বুরহানকে টিএমসির প্রধান করা হয়। এ কাউন্সিল দুই বছরের মধ্যে নির্বাচনের মাধ্যমে বেসামরিক প্রশাসনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দেশটির বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বেসামরিক সংগঠন তাদের অন্তর্ভুক্ত করতে দাবি জানাতে থাকলে এবং এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক চাপ আসলে মাসকয়েক পর টিএমসি বদলে গঠন করা হয় সার্বভৌম পর্ষদ (এসসি)। সার্বভৌম পর্ষদেরও প্রধান হন বুরহান। পর্ষদের উপনেতা আরএসএফ-এর প্রধান দাগালো। সার্বভৌম পর্ষদের নেতা হিসাবে বুরহান কার্যত সুদানের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী হন। সামরিক-বেসামরিক অংশীদারত্বের ভিত্তিতে গঠিত এ পর্ষদ ২০১৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে সুদান চালাচ্ছিল। তবে দেশ পরিচালনায় কিছুদিনের মধ্যেই তাদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এমন এক পরিস্থিতিতে ২০২১ খ্রিস্টাব্দে আরও একটি সামরিক অভ্যুত্থান হলে এ সরকারকে ক্ষমতা থেকে চলে যেতে হয়। অতঃপর ২০২২ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে একটি বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর বিষয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সেনাবাহিনী ও আরএসএফ-এর মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির এক চুক্তি স্বাক্ষরও হয়। তবে তাদের ভেতর পুনরায় মতবিরোধের জন্য সেই সমঝোতাও চূড়ান্ত রূপ লাভ করতে পারেনি। তারপর থেকেই বুরহান ও দাগালোর মধ্যে বিরোধ তীব্র হতে থাকে। মূলত সুদানে বেসামরিক শাসন ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনার অংশ হিসাবে আরএসএফ সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা এবং দুটি বাহিনীকে একীভূত করার পর নতুন বাহিনীর নেতৃত্বে কে থাকবেন অথবা কে কার অধীনে কাজ করবেন তা নিয়ে সুদানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল আব্দেল ফাত্তাহ আল-বুরহান ও আরএসএফ-এর প্রধান জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালোর মধ্যে মতবিরোধের সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে দাগালো আরএসএফ-এর সশস্ত্র সদস্যদের দেশের বিভিন্ন অংশে মোতায়েন করেন। তার এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি সুদানের সেনাবাহিনী। তারা এ ব্যবস্থাকে তাদের জন্য হুমকি হিসাবে ধরে নেয়। ফলে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। যদিও এ উত্তেজনা প্রশমনে তাদের মধ্যে অল্পবিস্তর আলোচনাও শুরু হয়েছিল। কিন্তু ফলপ্রসূ হয়নি। এ পরিস্থিতিতে জেনারেল দাগালো আরএসএফ-এর সদস্যদের রাস্তায় নামায়, যা শেষ পর্যন্ত একটি পূর্ণাঙ্গ লড়াইয়ে রূপ নেয়। এ লড়াই রাজধানী খার্তুমসহ দেশটির অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। আর এতে স্বার্থ রক্ষার মানসে পরোক্ষে যুক্ত হয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক শক্তি।

সুদানের সংঘাতময় পরিস্থিতিতে এযাবৎ সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটে। লক্ষাধিক মানুষ সুদান ছেড়ে পার্শ্ববর্তী দেশ চাঁদে আশ্রয় গ্রহণ করে। বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক মিশনসহ সে দেশে বসবাসরত বিদেশি নাগরিকদের উদ্ধার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। উল্লেখ্য, উত্তর আফ্রিকার দেশ সুদানের আয়তন ১৮,৮৬,০৬৮ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা ৩ কোটি ৮৬ লাখ ৪৮ হাজার। দেশটিতে সুন্নি মুসলমানের সংখ্যাই বেশি। মুসলমানরা আবার দুই ভাগে বিভক্ত। স্থানীয় বা নুবিয়ান মুসলমান ও আরব বংশোদ্ভূত মুসলমান। দেশটি শতবছরের ওপর ব্রিটিশদের অধীনে ছিল। তখন সাম্প্রদায়িক মানসে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী সুদানের মুসলমান অধ্যুষিত উত্তর অংশকে উত্তর সুদান এবং খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ ও খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ দক্ষিণ অংশকে দক্ষিণ সুদান হিসাবে বিভক্ত করে শাসন করে। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে বৃটিশরা সুদানকে স্বাধীনতা দিয়ে চলে গেলেও যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটিশদের ইন্ধনে খ্রিষ্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ দক্ষিণ সুদানে গৃহযুদ্ধ বাধে, যা ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলে। বিভিন্ন শক্তির মধ্যস্থতায় ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ সুদান স্বায়ত্তশাসন লাভ করে। ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ সুদানে পুনরায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এতে সরাসরি মদদ দেয় যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা। তাদের মদদে খ্রিস্টান অধ্যুষিত দক্ষিণ সুদান স্বাধীনতার ডাক দেয়। এতে শুরু হয় ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ। এ গৃহযুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষে প্রায় ২০ লাখ মানুষ নিহত হয় এবং বাস্তুহারা হয় প্রায় ৫০ লাখ। শেষপর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ২০১১ খ্রিস্টাব্দে এক গণভোটের মাধ্যমে দক্ষিণ সুদান স্বাধীনতা এনে দেয়। দেশটির বিশাল তেলক্ষেত্রসহ নানা খনিজ সম্পদের অবস্থান ছিল দক্ষিন সুদানে। ফলে দেশ ভাগের পর সুদানের অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়ে। আবার প্রেসিডেন্ট বাশির সরকারের ওপর চলমান মার্কিন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাও দেশটিকে একেবারে শক্তিহীন করে দেয়। এতে সেনাবাহিনী ও আধা সামরিক বাহিনীর দ্বন্দ্ব যোগ হয়ে সুদানকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করে। এখন সেনাবাহিনী ও আরএসএফ এর দ্বন্দ্বকে রক্তাক্ত রূপ দিয়ে বিভিন্ন দেশ। ফলে দেশটি এখন বিভিন্ন দেশের স্বার্থগত প্রক্সিযুদ্ধের নতুন ফ্রন্টে পরিণত হয়েছে। উল্লেখ্য, দুক্ষিণ সুদান স্বাধীন হওয়ার পরও সুদান পেট্রোলিয়াম ও খনিজ তেলে সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গণ্য হচ্ছে। তেল ছাড়াও প্রাকৃতিক গ্যাস, সোনা, রুপা, জিপসাম, জিংক, লোহা, সিসা, ইউরেনিয়াম, কপার, গ্রানাইট, নিকেল, তামাসহ গুরুত্বপূর্ণ খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ দেশ সুদান। সংগতকারণে এসব খনিজ সম্পদে লোলুপ দৃষ্টি আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া সহ বিভিন্ন দেশের। সুদানের সোনা উত্তোলন ও নিরাপত্তা স্বার্থ ধরে রাখতে রাশিয়া সুদানের মিলিশিয়াদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবর এসেছে। আবার সুদানে যাতে গণতন্ত্র বিকশিত না হতে পারে সে জন্য উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের কিছু অগণতান্ত্রিক সরকার ও রাজতন্ত্র সুদানের সেনাবাহিনী ও মিলিশিয়া উভয় শিবিরকেই মদদ দিয়ে আসছে বলেও অভিযোগ আছে। এই অবস্থায় সুদানে এখন যা ঘটছে তা অনিবার্যই ছিল।
তবে সুদানের জনমানুষের স্বার্থে এবং আফ্রিকার আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে সুদানে শান্তি ফিরিয়ে আনা জরুরি। এ ক্ষেত্রে আরবলীগ, জাতিসংঘ, আফ্রিকান ইউনিয়নকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। একইসঙ্গে সুদানের সেনাবাহিনী ও আধা সামরিক বাহিনীর উপলব্ধি দরকার। এ যুদ্ধে তারা কেউই জিতবে না। তাদের বুঝতে হবে বিভিন্ন শক্তি তাদেরকে মদদ দিয়ে স্বার্থ হাসিলে ব্যবহার করছে। আখেরে তারা এবং দেশটির জনগণই অকল্পননীয় ক্ষতির শিকার হবে। এ অবস্থা চলমান থাকলে সুদান আরো কয়েক টুকরো হয়ে যাবে। তাই বিবদমান পক্ষগুলোর বোধদয় জরুরি। তবে দেশটির সাধারণ মানুষ এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। তারা পূর্ণশক্তিতে জাগ্রত হয়ে বিবদমান পক্ষগুলোকে আলোচনার টেবিলে বসে সংকটের যুক্তিপূর্ণ সমাধানে বাধ্য করলে সুদানে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে, সন্দেহ নেই।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক; সভাপতি-গ্রিন অ্যালায়েন্স বাংলাদেশ।

Share:

Leave Your Comment