চীনে অনন্য স্থাপত্যশৈলি নিউজি মসজিদ
আবদুর রহিম>
৪ সেপ্টেম্বর থেকে ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ডায়মন্ড সিমেন্টের পরিচালক লায়ন হাকিম আলী এর নেতৃত্বে ২৮ সদস্যের একটি টিম গনচীনের রাজধানী বেইজিং ও বাণিজ্যিক রাজধানী সাংহাই ভ্রমণ করি। আমরা ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর হতে সিংগাপুর এয়ারলাইন্সের একটি বিমানে করে সিঙ্গাপুরে চেংগি বিমান বন্দরের ট্রানজিট হয়ে আরো একটি সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের দ্বিতল বিমানে করে বেইজিং ক্যাপিটাল বিমান বন্দরে পৌঁছি। তখন পরদিন দুপুর ২টা। বেইজিং বিমান বন্দরটি বিশাল। ইমিগ্রেশনে আমাদের টেকনাফের ডিলারের সাথে খানিকটা খিটিমিটি হয়। আমাদের সাথে ছিলেন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব এজাজ মাহমুদ। মজার মানুষ। যে কোন ছোটখাট বিষয়কে মুহূর্তের মধ্যে আনন্দদায়ক করে তুলতে পারেন তিনি। সবাইকে আন্েদর মধ্যে রাখলেন। বিপদ আপদ কাউকে সহজে বুঝতে দেননা। যে কোন সফরে যাওয়ার জন্য তিনি একটি গাইড দিয়ে থাকেন। নাতিদীর্ঘ এই গাইড লাইনে তিনিসব কিছু সাজিয়ে রাখেন। যাতে কারও অসুবিধে না হয়। বিমান বন্দরের প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা সেরে আমরা বাইরে আসলাম। বিশাল চীনের উন্মুক্ত আকাশ, নির্মল বায়ু আমাদেরকে সতেজ করে দিল। পূর্ব থেকে আমাদের জন্য গাড়ি, গাইড, নাস্তা তৈরি ছিল। আমরা গাড়িতে বসার সাথে সাথে চাইনিজ গাইড মিস্টার জাফারি খাবার পানি এবং নাস্তা হাতে দিয়ে দিল। গাড়ি চলতে লাগল হোটেল পানে। আমরা দীর্ঘ বিমান জার্নিতে ক্লান্ত ছিলাম। রাস্তার পাশে সুন্দর গাছগাছালি, ফুল বাগান দেখে মন ভরে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার চোখে ঘুম চলে আসল। কখন যে বেইজিং মেরিওট হোটেল সিটি ওয়ারে পৌঁছে গেলাম বুঝতেই পারিনি। বিশাল হোটেল সম্ভবত পাঁচ তারকা মানের হোটেল। হোটেলে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে আমরা দু’জন দু’জন করে উঠে গেলাম। আমার রুম সঙ্গি হলেন রয়েল এসোসিয়েটের দিদারুল আলম দিদার ভাই, ভাল মনের মানুষ। রুমে প্রবেশ করি অবাক হলাম। ওয়াসরুমে কোন সাওয়ার নেই! টিস্যু দিয়ে মূল কাজটি সারতে হয়। সেটি আমাদের জানা ছিল না। বেড রুম থেকে ওয়াশ রুমের সবকিছু দেখা যায়। মাঝখানে অবশ্যই স্বচ্ছ গ্লাস প্রথমে ওয়াশ রুমে দিদার ভাইয়ের প্রবেশ। আমি আমার বেড থেকে লক্ষ করলাম। তিনি কি যেন খুঁজছেন। আমি চিন্তিত হলাম। হায়রে কোন দেশে আসলাম। বেডরুম থেকে ওয়াশ রুমের নাড়ী নক্ষত্র সব কিছু আমি দেখতেছি। আমি গ্লাসে টোকা দিয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। তিনি আমাকে দেখতে পেয়ে হতবাক।
দরজা খুলে দিলেন আমিসহ ওয়াশ রুমে প্রবেশ করলাম। অনেকক্ষণ খোঁজাখুজির পর একটি সুইচ খুঁজে পেলাম। সুইচ অন করার সাথে সাথে গ্লাসের সাথে লাগওয়া দু-পাশ থেকে পর্দা চলে আসলো। আর বেড রুম দেখা যায় না। আপাতত ইজ্জত রক্ষা হল। পানি খাবার বোতল দিয়ে ওয়াশ রুম সারতে হচ্ছে। পরে আমরা খাবার টেবিলে বসে ওয়াশ রুমের বোতল পদ্ধতি সবাইকে জানিয়ে দিলাম। আমরা তিনরাত চারদিন ছিলাম এই বিখ্যাত হোটেলে। হোটেলের পরিবেশ আমাদের খুব ভালো লেগেছে। ঈদুল আযহার পরদিন যাত্রা করায় আমার মা জননী গরুর মাংস ভুনা করে একটি কাচের বোতলে দিয়েছিলেন। রাতে দু’ এক টুকরো খেলাম। সৌভাগ্যের ব্যাপার আমার ভাতিজা সাদ্দাম চিনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করছে। আমি চীন গমনের সংবাদ তাকে দিয়েছিলাম। তাকে মাংসগুলো দিতে পেরেছি। নইলে মাংসগুলো নষ্ট হয়ে যেত। বেইজিং সফর কালে আমাদের সঙ্গী ছিল। বেইজিং সফরকালে আমরা অনেক গুরুত্বপূণং দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন করেছি। বিশেষ করে-
১. চীনের মহা প্রাচীর (পৃথিবীর সপ্ত আশ্চর্যের একটি)
২. মিং রাজাদের সমাধি।
৩. জেডি ফ্যাক্টরি।
৪. চীনা মার্কেট (সেখান থেকে আমি একটি বিশুদ্ধ চাইনিজ তুলার চাদর ক্রয় করেছি।)
৫. তিয়েন আন মেন স্কয়ার এবং মাও সে তুং এর সমাধি।
৬. পার্ল ফ্যাক্টরি (নামে মাত্র অরজিনাল পার্ল নেই)
৭. ফরবিডেন সিটি/নিষিদ্ধ নগরী (থিয়েন আনমেন স্কয়ার ও মাও সে তুং এর সমাধির বিপরীতে)
৮. টেম্পল অব হেবেন (বৌন্দ মন্দির)
৯. বার্ডস নেস্ট স্টেডিয়াম যেখানে ২০০৮ সালে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক গেমস অনুষ্ঠিত হয়।
১০. নিউজি মসজিদ
১১. হোয়াংহো নদী (কমপক্ষে ২০টি টার্নেল রয়েছে। যা দিয়ে মানুষ এপার-ওপার হয়। এমনকি কিছু কিছু টার্নেলে রয়েছে ২টি যোগাযোগ ব্যবস্থা। একটি গাড়ির জন্য অন্যটির রেলের)
১২. সাংহাই বন্দর।
১৩. ইয়াংজেন নদী টানেল এবং সেতু।
১৪. মনোবেল রেল বা মেট্রো রেল।
১৫. দ্যা বান্ড (নদী পারের বেড়িবাঁধ ও চত্বর) এই ওয়াটার ফ্রন্টকে শত শত বছর ধরে সাংহাইয়ের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা। এটি হোয়াংহো নদীর পশ্চিমাঞ্চলে ওয়াই বালু সেতু থেকে নানপু সেতু পর্যন্ত ১৫০০ মিটার দীর্ঘ।
১৬. ওরিস্টাল পার্ল টিভি টাওয়ার।
১৭. সাংহাই টাওয়ার।
১৮. নান চিং রোড।
১৯. ইয়ানইয়ান গার্ডেন।
২০. জেড বুদ্ধ মন্দির।
২১. সিটি ঈশ্বর মন্দির।
২২. ওয়াটার ভিলেজ চৌওজুয়াং।
২৩. হোয়াংহো রিভার ক্রুজ (হোয়াংছ নদীতে ভ্রমণ সাংহাই ভ্রমণের অন্যতম আকর্ষণ ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই নদী ভ্রমণ দিনে রাতে সমান আকর্ষণীয়। উপভোগ করার সর্বোত্তম উপায় হল নদীতে বিশেষ করে সন্ধ্যায় জাহাজে ভ্রমণ করা।
২৪. ডঙ্গহাই ব্রিজ (২০০৮ সালে প্রথম ১ মে চীনের হংকয়ের জিয়াওযু সেতু চালুর আগ পর্যন্ত এটি বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম ক্রস-সাগর সেতু ছিল। সেতুটি ৬ লেনের ৩২.৫ কিলোমিটার (২০.২ মাইল)। চালু হয় ২০০৫ সালে। সেতুর উভয় পাশে বায়ু বিদ্যুৎ প্লান্টের উইংস রয়েছে। যাতে বিদ্যুৎ উপন্ন হয় এবং প্রবল বাতাস বা জলোচ্ছ্বাসের আঘাত আটকানো যায়।
২৫. ইয়াংসান সমুদ্র বন্দর।
২৬. ফরাসি কনসেশন।
২৭. পিপলস স্কয়ার।
নিউজি মসজিদ
নিউজি জামে মসজিদ রাজধানী চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ মসজিদ। আমরা সবাই একসাথে রিজার্ভ বাসে করে নিউজি মসজিদের সামনে অবতরণ করি। উক্ত মসজিদটির বেইজিংয়ে জিসান জেলায় অবস্থিত। নিউজি মসজিদ সবচেয়ে সুন্দর ও বড় মসজিদ। মিয়াং রাজবংশের রাজারা ৯৯৬ সালে এটি বানিয়েছিলেন। এটি বারোশো খ্রিষ্টাব্দ মোঙ্গলদের আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায় এবং ১৬৯৬ সালে নতুন ভাবে সম্প্রসারণ করা হয়। এখন মসজিদটি আয়তন ৬ হাজার বর্গমিটার এলাকা জুড়ে রয়েছে। মসজিদে আড়াই হাজার মুসল্লী একসাথে নামায আদায় করতে পারেন। মসজিদটিতে আরবী ক্যালিওগ্রাফি মিশ্রণে চিরচারিত চাইনিজ স্থাপত্যশৈলী ও নকশার একটি অনন্য নিদর্শন। আমরা মসজিদে সবাই একসাথে প্রবেশ করি। একটি বোর্ডে মসজিদটির ইতিহাস লেখা আছে সবাই আমরা সেটা পড়লাম। পরে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম এ্যারাবিক ক্যালিওগ্রাফিতে ডিজাইন করা সদর গেটের পাশেই একটি দ্বিতল বিশিষ্ট সোনালী রংয়ের একটি টাওয়ার রয়েছে। সেটা থেকে রমজানের এবং ঈদের প্রথম চন্দ্র দেখা হয়। ইমাম সাহেব মাঝে মাঝে উক্ত টাওয়ারে চড়ে মসজিদের আশে পাশে কারা ঘোরাফেরা করছে সেটা দেখতে পারেন। উক্ত ভবনটি পার হয়ে একটু ভিতরে গেলেই আরো দু’ একটি ঘর দেখতে পাবেন। একটি ফাঁকা জায়গা রয়েছে ফাঁকা জায়গার বাম পাশে রয়েছে মূল মসজিদটি।
মূলত নামাজ পড়া হয় এই মূল মসজিদে প্রবেশ পথে আরবি হরফে পবিত্র ক্বোরআন শরীফের কিছু আয়াত সুন্দর ক্যালিওগ্রাফিতে সাজানো। মূল মসজিদটি ৬শত বর্গ মিটার। যেখানে শুধুমাত্র নামাজ পড়া হয় এই নামাজ পড়ার স্থানে মুসল্লীরা একসাথে নামাজ পড়তে পারবেন। মসজিদের ভিতরে অজুখানা রয়েছে, সেখানে কিছু গাছ রয়েছে। আমরা একটি বড় ডেকসি দেখতে পেয়েছি। ডেকসিটি দেখতে আজমীর শরীফের যে দু’টি বড় ডেকসি রয়েছে সেগুলোর মতে লাগে। এগুলোর গায়ে লেখা আছে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উদযাপনের সময় কাজে ব্যবহৃত হয়। ডান পাশে আমরা আরো দু’ একটি ভবন দেখেছি। মসজিদটি মূলত আমার খুব ভালো লাগলো। চাইনিজ সংস্কৃতি এবং এ্যারাবিক স্টাইল নির্মিত বেইজিংয়ের সবচেয়ে বড় মসজিদ মুসলমান সেটা অন্ততপক্ষে ভিজিট করেন বেইজিং এ কর্মরত সমস্ত ইসলামিক কান্ট্রি অ্যাম্বাসেডারেরা পবিত্র জুমার নামাজ এখানে আদায় করেন। সরকারি সফরে আসা ইসলামিক ডেলিগেটদেরকে সরকারিভাবে এই মসজিদটি পরিদর্শন করানো হয়। এই মসজিদটি চাইনিজ হাইওয়ে থেকে হেঁটে যাওয়া যায়। আমরা সবাই অজু করে মসজিদের দু’ রাকাত নফল নামাজ আদায় করলাম। করে বেরিয়ে আসলাম। আমরা পরিদর্শনের সময় কোন চাইনিজ মুসলিম কিংবা মসজিদের কোন প্রতিনিধি আমাদের সাথে দেখা করেনি। দু’জনকে দেখলাম উকি মেরে আমাদের দেখতে আমরা তাদের সাথে কথা বলতে চাইলে তারা দরজা বন্ধ করে রুমের মধ্যে ঢুকে পড়লো। আশ্চর্য্যরে ব্যাপার হলো রাস্তায় একজন মাত্র ভিক্ষুক দেখতে পেলাম। বিভিন্ন কাজে যারা চীন ভ্রমণ করবেন অন্তত একবার হলেও এই সুন্দর মসজিদটি পরিদর্শন করার জন্য আমি অনুরোধ করছি।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও ডিজিএম ডায়মন্ড সিমেন্ট লি.।