মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেভাবে রোজা রাখে
মুহাম্মদ আরিফুর রহমান রাশেদ
রহমত, মাগফেরাত ও নাজাতের মাস মাহে রমজান। পাপ থেকে পরিত্রাণ ও আত্মশুদ্ধির মাস মাহে রমজান। মুসলিম নর-নারীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হল সিয়াম বা রোজা পালন করা। আরবী সাওম শব্দের বহুবচন সিয়াম। সাওম শব্দের অর্থ বিরত থাকা। শরীয়তের পরিভাষায় মুসলিম নর-নারী সুবহে সাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যাবতীয় পানাহার, অশ্লীল কথাবার্তা থেকে বিরত থাকার নাম সাওম বা রোজা। প্রত্যেক রোজাদারের উচিত শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে রোজা রাখা।
মানুষের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেভাবে রোজা রাখবে
সাওমের সংজ্ঞা অনুযায়ী নিছক পানাহার বর্জনের নাম রোজা নয়। প্রকৃত অর্থে রোজা আরো ব্যাপক, এর বিধি নিষেধের আওতা আরো বিস্তৃত। যথাযথ রোজা পালনের জন্য মানবদেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আল্লাহর নিষিদ্ধ বস্তু থেকে বিরত রাখতে হবে। যেমন-
১. মুখ বা জিহ্বার রোজা: মুখ বা জিহ্বা দিয়ে রোজাদার কুরআন তেলাওয়াত করবে, সত্য কথা, ভাল কথা বলবে, আল্লাহ্র জিকরে লিপ্ত থাকবে। পক্ষান্তরে মুখকে মিথ্যা, গিবত, চোগলখুরী ও হারাম খাবার খাওয়া থেকে বিরত রাখবে। এ প্রসঙ্গে সর্বাধিক হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি (রোজা রেখে) মিথ্যা কথা ও মিথ্যা আচরণ পরিহার করে না তার খাবার বর্জন (উপবাস) আল্লাহর কোনই প্রয়োজন নেই। [বুখারী ও মিশকাত শরীফ]
২. অন্তরের রোজা: দেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের প্রাণ কেন্দ্র হলো অন্তর। অন্তরে আল্লাহর ভয় সব সময় অন্তরে থাকা, আল্লাহর জিকরের মাধ্যমে আবাদ রাখা, পক্ষান্তরে অন্তরকে অজ্ঞতা, শিরক, খারাপ চিন্তা-ভাবনা, হিংসা-বিদ্বেষ, অসৎ চিন্তা, হীন পরিকল্পনা করা থেকে বিরত রাখা।
৩. চোখের রোজা: রোজারদার চোখ দিয়ে দেখে কুরআন তেলাওয়াত করবে, শরীয়তের মাসআলা-মাসায়েলসহ ভাল কিছু দেখবে। পক্ষান্তরে অশ্লীল বস্তুসহ বেগানা পুরুষ, বেগানা মহিলাকে, বেগানা মহিলা বেগানা পুরুষকে চোখ দিয়ে দেখা থেকে বিরত থাকবে।
৪. কানের রোজা: কানকে গিবত, মিথ্যা, গান-বাজনা, অবৈধ প্রেমালাপ শ্রবণ থেকে বিরত রাখতে হবে। প্রক্ষান্তরে কুরআন তেলাওয়াত, হামদ-নাতসহ ভাল কোন কিছু কান দিয়ে শ্রবণ করবে।
৫. হাতের রোজা: রোজাদার হাত দিয়ে কুরআন করীমসহ শরীয়তের বই পুস্তক স্পর্শ করবে, মুসলমান ভাইয়ের সাথে দেখা হওয়ার সাথে সাথে মুসাফাহা করবে, কোন এতিমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে। পক্ষান্তরে হাতকে চুরি, ঝগড়া, বিবাদ, সুদ-ঘুষ লেনদেন থেকে বিরত রাখবে।
৬. পায়ের রোজা: পা দিয়ে হেটে মসজিদে যাবে, মানুষকে সহযোগিতা করার জন্য ও ভাল কাজ করার জন্য যাবে। পক্ষান্তরে পায়ে হেটে চুরি-ডাকাতিসহ অন্যায় কাজে যাওয়া থেকে বিরত রাখবে।
৭. পেটের রোজা: পেটকে হারাম খাদ্য ভক্ষণ, সুদ-ঘুষ উপার্জন থেকে বিরত রাখতে হবে। আল্লাহ্ প্রদত্ত হালাল উপার্জন থেকে ভক্ষণ করবে।
সুতরাং যথার্থ ও সার্থক রোজা পালনের জন্য প্রত্যেক রোজাদারের উচিত পেটকে যেভাবে সারা দিন খাবার থেকে বিরত রাখে অনুরূপভাবে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে যাবতীয় গুনাহের কাজ থেকে বিরত রাখা যায় তাহলে ঐ রোজা আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করবে। এ ধরনের রোজা কিয়ামতের দিন রোজাদারকে সুপারিশ করবে। হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে আমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন রোজা ও কুরআন মজীদ উভয়ই বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে হে প্রভু! আমি এ ব্যক্তিকে দিনের বেলায় পানাহার ও যৌনবাসনা থেকে বিরত রেখেছি। সুতরাং তার জন্য আপনি আমার সুপারিশ কবুল করুন। কুরআন বলবে হে আল্লাহ্! এ ব্যক্তিকে আমি রাতের বেলা ঘুম থেকে বিরত রেখেছি। সুতরাং আপনি তার স্বপক্ষে আমার সুপারিশ কবুল করুন। অতঃপর উভয়ের সুপারিশই কবুল করা হবে। [মিশকাত]
উল্লেখিত আলোচনা হতে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি, শুধু উপোষ থাকার নাম রোজা নয় বরং মানুষের শরীরের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে যাবতীয় অন্যায়-অনাচার, পাপকার্য হতে বিরত রাখার নামই প্রকৃত রোযা। যে উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহ্ আমাদের উপর ত্রিশ রোজা ফরজ করেছেন সে উদ্দেশ্য যাতে পরিপূর্ণ হাসিল হয় সে দিকে লক্ষ্য রাখা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।
লেখক: মুদাররিস-বেতাগী রহমানিয়া জামেউল উলুম দাখিল মাদরাসা, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম।