Anjuman-E Rahmania Ahmadia Sunnia Trust

রোজা রেখে যেভাবে ফিট থাকা যায়

রোজা রেখে যেভাবে ফিট থাকা যায়

ডা. মিজানুর রহমান কল্লোল-

রোজা রাখলে শরীরের মধ্যস্থিত, প্রোটিন, ফ্যাট ও শর্করা জাতীয় পদার্থ গুলো স্বয়ং পাচিত হয়। ফলে গুরুত্বপূর্ণ কোষগুলোতে পুষ্টি বিধান হয়। এই পদ্ধতিকে ‘অ্যান্টো লিসিস’ বলা হয়। এর ফলে শরীরে উৎপন্ন উৎসগুলো বিভিন্ন কোষে ছড়িয়ে পড়ে। এটি হচ্ছে শরীর বিক্রিয়ার এক স্বাভাবিক পদ্ধতি। রোজা এ পদ্ধতিকে সহজ, সাবলীল ও গতিময় করে, যার প্রমাণ আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগেই হিপোক্র্যোটিস এর লেখা থেকেই সবাই জানতেন। (খাদ্য তোমার রোগের ওষুধ) রোজার মাধ্যমে লিভারে রক্ত সঞ্চালন দ্রুত হয় ফলে ত্বকের নিচে সঞ্চিত চর্বি পেশীর প্রোটিন, গ্রন্থিগুলো এবং লিডারে কোষগুলোর রস সমূহ: বেশি নিঃসরণ হয়। ফলে নিয়মিত রোজায় অভ্যাসকারীদের। শারীরিক অসুখ বিসুখ ও অবকাঠামো অন্যদের চাইতে অনেক ভালো থাকে।

ওজন কমানোর বিশেষ সময়
যারা শরীর কমানোর জন্য জিম বা ভিন্ন ধরনের এক্সারসাইজ করেন তাদের জন্য ভালো একটি সময় এ রমজান মাস। দীর্ঘক্ষণ না খেয়ে থাকার ফলে শরীরে জমানো চর্বিগুলো ক্ষয় হতে থাকে। এভাবে ধীরে ধীরে ওজন কমতে থাকে। সাহরি ও ইফতার খাওয়ার সময় পুষ্টিকর খাবারের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। কেউ কেউ ইফতারের পর রিদম এক্সারসাইজ করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে এর পরিবর্তে নামাজ আদায় করে নিতে পারলে নামাজ থেকেই ১০০ শতাংশ রিদম এক্সারসাইজের ফল পাওয়া যায়।
রোজা রাখার কারণে স্থূলকায় শরীরে জমে থাকা কোলেস্টরল শরীরের অন্যান্য জ্বালানির কাজে ব্যয় হয়ে যায় বিধায় শারীরিক ওজন অনেকটা কমে যায় এবং রক্তের সারকুলেশনও ভালোভাবে হয়। ল্যাব পরীক্ষায় দেখানো হয়েছে, রোজা রাখার প্রথম দিন হতে তৃতীয় দিন পর্যন্ত আমাদের শরীরের মাংসপেশির গ্লাইকোজেন যকৃত থেকে শক্তি পেয়ে থাকে এবং তৃতীয়-চতুর্থ দিন থেকে, আমাদের শরীরের চর্বি স্টোরেজ থেকে শক্তি পেয়ে (Ketosis) মোডে পরিবর্তন হয় এবং এভাবে ৩০ দিন পর্যন্ত চলতে থাকলে একজন ব্যক্তির শুধু পেশির স্থু’লতা ২ পাউন্ড লস হয়, সেই হিসাবে সারা শরীরের ৩০ দিনে ৭ পাউন্ড পর্যন্ত শরীরের স্থুলতা কমানো সম্ভব (অবশ্য ইফতার এবং সেহরির প্রোটিন খাওয়ার ওপর নির্ভর করবে কম বেশি প্রমাণিত)। রোজা রাখার অভ্যাসে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষুধা হ্রাস করে বিধায় পরবর্তীতে ঠিক সেভাবে যদি জীবনযাপন করতে পারেন তা হলে এক সবীক্ষায় দেখানো হয়েছে যে, আপনার শারীরিক অবকাঠামো সাধারণের চেয়ে ২০ শতাংশ উন্নীত রাখা সম্ভব, সেই দৃষ্টিতে রোজা বার্ধক্য রোধে ও শারীরিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে সহায়ক।

হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও হাঁপানি রোগীদের জন্য
হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও হাঁপানি রোগীদের জন্য রোজা উপকারী। রোজার ফলে রক্তের ক্ষতিকর কোলেস্টরেলের মাত্রা কমে যায়। ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি ৬০ শতাংশ কমানো সম্ভব। রোজা শরীর বৃত্তীয় প্রভাব, রক্ত শর্করা এবং কোলেস্টেরল কমিয়ে এবং সিষ্টোলিক রক্তচাপ কমিয়ে দেয় অতি সহজে রক্তে কোলেস্টেরলের স্তর হ্রাস করে। পাশাপাশি ধমনীতে দেয়ালে যে কোলেস্টেরলের গাদ থাকে তার Precipitating হার কমে যায় এটিও প্রমাণিত। এভাবে পালাক্রমে কার্ডিয়াক এবং কারডিও’ ভাস্কুলারের দুর্ঘটনাজনিত যেসব অসুখের ভয় আছে তা কমিয়ে দেয় (হার্ট অ্যাটাক জাতীয়) ঠিক তদ্রুপ উচ্চ রক্তচাপ বাড়তে বাধা দেয়ার সঙ্গে রক্তে চর্বি ঘাটতি পিত্ত এবং (Choledocus) জাতীয় পাথর কমাতে বিশেষ সাহায্য করে। লোয়ার কোলেস্টেরলের বেলায় লিপিড প্রোফাইল ইতিবাচক প্রভাব রাখে সে জন্য নিম্ন কোলেস্টেরল খুব সহজে নিয়ন্ত্রণ করে বিধায় স্ট্রোকের আক্রমণ থেকেও অনেকখানি মুক্ত রাখে।

রোজা রাখার সুফল
* অতিরিক্ত ওজন কমাতে সাহায্য করে।
* দেহ থেকে ক্ষতিকর টক্সিন ফ্যাটের সঙ্গে বের হয়ে যায়।
* নিয়ম মেনে স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার ফলে ডায়বেটিক রোগীরাও এর উপকারিতা পেয়ে থাকেন।
* পরিপাকতন্ত্রের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
* উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আসে।
* ধুমপান ও মদ্যপানের আসক্তি কমায়।
* হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।
* গ্যাস্ট্রিক ও আলসারের সমস্যা কমায়।
এ ছাড়া নিয়ম মেনে নামাজ পড়ার ফলে শারীরিক ব্যায়ম হয় এবং নিয়ম মেনে খাবার খাওয়ার ফলে ডায়েটও করা হয়ে থাকে। ফলে নিয়মিত রোজা রাখলে ও নামাজ পড়লে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকেন।

মানসিক দুশ্চিন্তাজনিত বিভিন্ন অসুখ দূর করে
রোজা রাখা ও ধর্মীয় অনুশাসনের ফলে মস্তিষ্কের স্ট্রেস হরমোন করটিসল খুব কম নিঃসরণ হয় যার কারণে যারা মানসিকভাবে বিভিন্ন অসুখে আক্রান্ত তাদের জন্য রমাজান মাস বেশ ভালো একটি সময় বলা যায়। বিপাকক্রিয়ার ফলে মস্তিষ্কের সেরিবেলাম ও লিমবিক সিস্টেমের ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়ে বিধায় মনের অশান্তি ও দুশ্চিন্তা দূর হয় বা কর্মোদ্দীপনাও বেড়ে থাকে কারও কারও বেলায়। অন্যদিকে মস্তিস্কের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধিতে রমজানে রোজা রাখার মাধ্যমে নতুন নতুন কোষের জন্ম হয়ে মস্তিষ্কের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করতে সহায়ক। পবিত্র রোজা শরীরের জন্য চমৎকার (Detox) এবং ধর্মীয় অনুসাশনের ফলে কুরুচি সম্পন্ন বদ অভ্যাস থাকলে তাও দূর হয়ে যায়।

গ্যাস্ট্রিক ও আলসারের সমস্যা
অনেকের সারা বছর গ্যাস্ট্রিক ও আলসারের সমস্যা থাকে। কিন্তু রোজা আসলেই তা কমে যায় বা তেমন সমস্যা করেনা। এর মূল কারণ পাকস্থলীর এনজাইম-লোকে বেশ উত্তেজিত করতে পারে না। মস্তিষ্কে কিছু হরমুন কম নিঃসরণ হয় বলে এক ধরনের অবস করে রাখে বা এ সময় কিছুটা কম হাইড্রোক্লোরাইড নিঃসরণ হয়। পাকস্থলীসহ পরিপাকতন্ত্র বিশ্রাম পায় ও হজম প্রক্রিয়া ও খুব ধীরগতিতে হয়। তাই রোজা রাখলে গ্যাস্ট্রিক ও আলসারের সমস্যা কম থাকে, তারপরও পারফিউরেশন জাতীয় আলসারের চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

ডায়াবেটিস
বলার অপেক্ষা রাখে না ডায়াবেটিস টাইপ ১, রোজা রাখার মাধ্যমে প্রায় ৭০ শতাংশ সেরে যায়। উপবাসের ফলে রক্তে ইনসুলিনের মাত্রা কমে আসে, শর্ত হচ্ছে চিনি জাতীয় খাবার ইফতারের পর না খাওয়া। (কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনেকের আবার সুগার একেবারে কমে গিয়ে হাইপোগ্লাইসেমিয়া দেখা দিতে পারে, সে দিকে একটু নজর রাখা উচিত) সে জন্য টাইপ ১ কে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিশেষজ্ঞরা রোজা রাখার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তবে টাইপ-২ ডায়াবেটিক রোগীরাও সতর্কতার সঙ্গে রোজা রাখতে পারেন এবং নি¤েœর বিষয়গুলো একটু খেয়াল রাখতে হবে। যেমন- হাইপোগ্লাইসেমিয়া (রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কমে যাওয়া), হাইপারগ্লাইসেমিয়া (রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া) ডায়াবেটিস কিটোএসিডোসিস, পানি শুন্যতা এবং থ্রোম্বোসিস, মুখে ওষুধ সেবনকারী ডায়াবেটিস রোগী, ইনসুলিন নিয়ন্ত্রণের ওষুধ, মোট ভোজের ২-৩ ভাগ ইফতারির সময় এবং ১-৩ ভাগ সাহরির সময় খাওয়া ভালো।

আরও কিছু উপকারিতা
অনেকের মতে রোজায় সারা দিন না খেয়ে থাকার ফলে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়। কিন্তু স্বাস্থ্য বিজ্ঞান মতে আমাদের অজান্তেই রোজা রাখার মাধ্যমে স্বাস্থ্যের বিভিন্ন ধরনের উন্নতি হয়ে থাকে। এমনকি অসুস্থ ব্যক্তিদের জন্যও রোজা রাখা উপকারী। তবে রোজা রাখার কারণে যদি কোনো রোগ বৃদ্ধি পায় অথবা রোগী বেশ কষ্ট পায় তবে এ বিষয়ে মুফতিদের সঙ্গে আলোচনা করে নেয়াই ভালো। রোগীদের সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত রোজা না রাখার অনুমতি ইসলামে রয়েছে।

ধূমপানকারীদের জন্য
ধূমপান করা মানেই বিষপান করা। এ কথা আধুনিক যুগে কে না জানে। স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের এ আবিষ্কারের বহু আগেই ইসলাম ধূমপান নিষিদ্ধ করেছিল। ধূমপানের ফলে ফুসফুসের ওপর নিকোটিনের দাগ পড়তে পড়তে এক সময় ধূমপায়ী ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। রমজানের রোজার ফলে ধুমপান থেকে বিরত থাকার কারণে ফুসফুস দীর্ঘসময় নিকোটিনের বিষক্রিয়া মুক্ত থাকে। ফলে ফুসফুস রোগমুক্ত থাকে এবং স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ফিরে আসে। যারা ধূমপান করেন রমজানের রোজা তাদের জন্য অবশ্যই উপকারী। ধূমপান বর্জনের এটা উত্তম সময়।

অ্যালার্জি, সর্দি-কাশির রোগীদের জন্য
অ্যালার্জি, সর্দি-কাশির রোগীদের রোগের কথা বলে অযথা নিজ সিদ্ধান্তে, রোজা না রাখার কৌনো ভিত্তি নেই। এসব ব্যবহৃত এন্টিবায়োটিক, এন্টিহিস্টোমিন কিংবা স্টেরয়েড স্প্রে দিনে দু’ বার বা একবার খেলে বা ব্যবহার করলেই চলে! তবে খাদ্যের বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।

কোষ্ঠকাঠিন্য রোগীদের জন্য
রোজার সময় যেহেতু দীর্ঘক্ষণ না খেয়ে থাকতে হয়, তাই কারো পানি স্বল্পতা হতে পারে। যা কোষ্ঠকাঠিন্য রোগীদের জন্য সমস্যার ব্যাপার। তারা ইফতার ও সেহরিতে প্রচার পরিমাণ পানি, ডাবের পানি, ফলের রস, শরবত, শাকসবজি, সালাদ, ইসবগুলোর ভুসি খেলে আরাম করে রোজা রাখতে সমস্যা হবে না। গরু বা খাসির গোশত, ইলিশ ও চিংড়ি মাছ এবং. যেসব খাবার খেলে মল শক্ত হয়ে যায় তা না-খাওয়াই ভালো। রোজার বিষয়ে স্বাস্থাবিজ্ঞানী ডা. শেলটন বলেছেন, উপবাসকালে শরীরের মধ্যকার প্রোটিন, ফ্যাট, শর্করা জাতীয় পদার্থগুলো স্বয়ং পাচিত হয়। ফলে গুরুতপূর্ণ কোষগুলোর পুষ্টি বিধান হয়। এই পদ্ধতিকে ‘আ্যাস্টোলিসিস’ বলা হয়। (সুপিরিয়র নিউট্রিশন গ্রন্থ)। স্বাস্থ্যবিজ্ঞানী ডা. আব্রাহাম জে হেনরি রোজা সম্পর্কে বলেছেন, রোজা হল পরমহিতৈষী ওষুধ বিশেষ। কারণ রোজা পালনের ফলে বাতরোগ, বহুমূত্র, অজীর্ণ, হৃদরোগ ও রক্তচাপজনিত ব্যাধিতে মানুষ কম আক্রান্ত হয়। স্বাস্থ্য গবেষকদের মতে, সারা বছর অতিভোজ, ‘অখাদ্য-কুখাদ্য, ভেজাল খাদ্য খাওয়ার ফলে আমাদের শরীরে যে জৈব বিষ জমা হয় তা দেহের জনা মারাত্মক ক্ষতিকর। এক মাস রোজা পালনের ফলে তা সহজেই দূরীভূত হয়ে যায়।

রোজার পরও সুন্দর ও ফিট থাকুন
রোজা যেহেতু এখন গরমের সময় হচ্ছে, তাই বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে শরীরে পানিশূন্যতা না হয়। তাই ইফতারের সময় ভাজা, পোড়া কম খেয়ে বিভিন্ন মৌসুমি ফল, ডাবের পানি ও তরমুজ খাওয়া শ্রেয়। তরমুজ হার্ট, ধমনী, কিডনির জন্য খুব উপকারী। তাছাড়া আম, কাঠাল, আনারস, বাঙ্গি থাকতে পারে ইফতারের টেবিলে। এগুলোতে রয়েছে ভিটামিন ‘এ’ ও ‘সি’ যা ‘অ্যান্টি অক্সিডেন্ট’ হিসেবে কাজ করে এবং রোজার পরেও ত্বক সুন্দর ও আকর্ষণীয় রাখে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।

Share:

Leave Your Comment