Anjuman-E Rahmania Ahmadia Sunnia Trust

তারাবীহ নামাজ ২০ রাকাত

তারাবীহ নামাজ ২০ রাকাত

মুহাম্মদ সরওয়ার আকবর

পবিত্র রমজান মাসের অন্যতম ইবাদত হলো তারাবীহ নামাজ, যাকে হাদীসে “কিয়ামুল লাইল’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আর কিয়ামুল লাইল হলো রাত জেগে ইবাদত করা। কাজেই তারাবীহ নামাজের দাবি হলো রাত জেগে দীর্ঘক্ষণ ইবাদত করা।
তারাবীহ নামাজ মোট ২০ (বিশ) রাকাত। আর ২০ রাকাত তারাবীহ আদায় করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। ইসলামের সূচনা থেকেই তারাবীহ নামাজ ২০ রাকাত আদায় হয়ে আসছে। সাহাবায়ে কিরাম, তাবেঈন, তবে-তাবেঈনের সোনালী যুগ থেকে পবিত্র মক্কা-মদিনাসহ সমগ্র মুসলিম বিশে^ কোথাও ২০ রাকাতের কম পড়ার প্রমাণ নেই।

১. রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম- এর যুগে তারাবীহ নামাজ
হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, এক রাতে নবীজী মসজিদে তারাবীহ নামাজ আদায় করেন। লোকেরাও তাঁর সাথে নামাজ আদায় করেন। পরের দিনও তিনি একইভাবে নামাজ আদায় করেন, তবে সে দিন লোকের সংখ্যা বেড়ে যায়। অতঃপর ৩য় ও ৪র্থ রাতে অনেক লোকের সমাগম হলেও কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ঘর থেকে বের হননি। সকাল বেলা রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন তোমরা যা করেছ,আমি তা দেখেছি। ঘর থেকে বের হতে আমাকে কিছুই বারণ করেনি বরং আমি এ ভয়ে বের হইনি যে, আমি নিয়মিত আদায় করলে তা তোমাদের উপর ফরজ হয়ে যাবে। আর এটি ছিল রমজান মাসের ঘটনা। (সহীহ বুখারী হাদীস নং – ৮৮২)
বর্ণিত হাদীসের ব্যাখ্যায় প্রখ্যাত হাদীস ভাষ্যকার ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন যে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যে দু’দিন তারাবীহ নামাজ আদায় করেছেন সে দুদিন তিনি ২০ রাকাতই আদায় করেছেন। ৩য় দিন যখন অনেক লোকের সমাগম হয়, তখন তিনি তারাবীহ ফরজ হয়ে যাওয়ার আশংকায় ঘর থেকে ব্রে হননি।
(তালখীছুল হাবীর, ২য় খন্ড, ৫৩ পৃষ্ঠা)।

২. সাহাবায়ে কেরামের যুগে তারাবীহ নামাজ
ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর খিলাফত কালে এবং হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এর খিলাফতের প্রথম দিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর যুগের মত একাকী এবং জামাতবদ্ধ উভয় পদ্ধতিতে আদায় করা হয়। এরপর হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রত্যাশা (তারাবীহ নামাজ সুন্নাত) কে বাস্তবায়ন করেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর যুগ থেকে চলে আসা ২০ রাকাত তারাবীহ গুরুত্বের সঙ্গে আদায় করেন এবং সবাইকে জামাতবদ্ধভাবে এক ইমামের পিছনে আদায়ের ব্যবস্থা করেন। সব সাহাবায়ে কেরাম বিষয়টিকে এক সঙ্গে মেনে নেন। আমরা জানি হযরত সাহাবায়ে কেরাম হলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর কথা ও কর্ম প্রকাশের মূল মুখপাত্র। নামাজের রাকাত নির্ণয় গবেষণা বা যুক্তির কোন বিষয় নয়। কাজেই এ বিষয়ে সাহাবায়ে কেরামের আমলই রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর আমল হিসেবে পরিগণিত হবে।

মক্কা মুকাররমায় তারাবীহ নামাজ
রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে পবিত্র মক্কা শরিফে ২০ রাকাত তারাবীহ নামাজ আদায় হয়ে আসছে। কোন যুগেই এর কম বা বেশী পড়ার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

মদীনা মুনাওরায় তারাবীহ নামাজ
প্রসিদ্ধ তাবেঈ হযরত আব্দুল আজিজ বিন রুফাউ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন যে, হযরত উবাই বিন কা’ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু রমজান মাসে লোকদের নিয়ে মদীনাতে ২০ রাকাত তারাবীহ ও তিন রাকাত বিতর পড়তেন। (“আলু মুসান্নাফ’ ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা নং – ১৬৩ হাদীস নং – ৭৬৮৪)।
ইজমায়ে সাহাবা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম ২০ রাকাত তারাবীহ এর ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামের ইজমা বা সর্ব সম্মত ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ বিষয়ে হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এর সময় থেকে খুলাফায়ে রাশেদীন এবং অন্যান্য সাহাবীদের কোন ধরনের কোন আপত্তি নেই। সবাই জামাতের সাথে ২০ রাকাত আমল করেছেন। মুসতাদারক-ই হাকিম হাদীস গ্রন্থ সূত্রে জানা যায় যে, হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এর আমলে জামাত সহকারে ২০ রাকাত তারাবীহ আদায়ের ব্যাপারে হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু কে পরামর্শ দিয়েছিলেন। হযরত ওমর ও হযরত ওসমান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমার খিলাফতের কালের পর হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এর যামানায়ও লোকেরা তারাবীহ নামাজ ২০ রাকাত আদায় করেছেন। যা ইজমায়ে সাহাবার প্রতিফলন।

যুগসেরা মুহাদ্দিস, ফকিহ ও ইমামদের মতামত
১. ইমাম তিরমিযী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন যে, অধিকাংশ আলেম তারাবীহ নামাজ ২০ রাকাতের পক্ষে মত দিয়েছেন যা হযরত ওমর ও হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর অন্যান্য সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে। এটিই সুফিয়ান সাওরী, ইবনুল মোবারক এবং ইমাম শাফেয়ী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এর মত। ইমাম শাফেই রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেছেন, “আমি পবিত্র মক্কাবাসীকে ২০ রাকাত তারাবীহ পড়তে দেখেছি”।
২. বিখ্যাত তাবেঈ আতা বিন আবি রবাহ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, আমি লোকদেরকে সাহাবী ও তাবেঈদেরকে পেয়েছি তাঁরা বিতরসহ ২৩ রাকাত পড়তেন। এতে এ কথাও প্রমাণিত হয় যে, বিতর নামাজ তিন রাকাত, এক রাকাত নয়।
৩. প্রখ্যাত মুহাদ্দিস মোল্লাআলী ক্বারী (র:) লিখেছেন – ইবনে হাজার আসকালীন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন যে, তারাবীহ নামাজ ২০ রাকাতের উপর সব সাহাবায়ে কেরামের ইজমা বা ঐকমত্য সংঘটিত হয়েছে। (মিরকাত ৩য় খন্ড ৯৭৩ পৃ:)
৪. বুখারী শরীফের ভাষ্যকার ইমাম ক্বাসতালানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু লিখেছেন, হযরত ওমরের যুগের অবস্থা ইজমা বা সর্বসম্মত ঐকমত্য পর্যায়ে গণ্য।
৫. ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশিত ‘দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম’ পুস্তকের ২৬৫নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, রমজানে এশার নামাজের পর অতিরিক্ত ২০ রাকাত সুন্নাত নামাজকে তারাবীহ নামাজ বলা হয়।
(খ) ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশিত ফাতওয়া মাসায়েল ৩য় খন্ডেও তারাবীহ নামাজ ২০ রাকাত বর্ণনা করা হয়েছে।

ইজমায়ে উম্মতের আলোকে তারাবীহ নামাজ
২০ রাকাত তারাবীহ নামাজ রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর সময় থেকে যুগ যুগ ধরে ধারাবাহিকভাবে আদায় হয়ে আসছে। বিশেষত : হযরত ওমরের খিলাফতকালে তারাবীহ নামাজ জামাতবদ্ধভাবে পড়ার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করার কারনে মক্কা মদীনাসহ আরব ও আজম তথা সারা দুনিয়ার মুসলমানদের কাছে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। তখন থেকে সর্বত্রই মুসলমানেরা ২০ রাকাত তারাবীহ পড়তে থাকে বরং এতে মুহাজির আনছার তথা সারা পৃথিবীর মুসলিম উম্মাহর ইজমা সংঘটিত হয়েছে। যার বিপরীতে খুলাফায়ে রাশেদীন সহ অন্য সাহাবীদের কোন ধরনের আপত্তির কথা কোন কিতাবে উল্লেখ নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর পূন্যময় যুগে সাহাবায়ে কেরাম ২০ রাকাত তারাবীহ নামাজ পড়েছেন। এর কম কেউ পড়েছেন বলে ইতিহাসে কোন প্রমাণ নেই। কাজেই তারাবীহ নামাজ ২০ রাকবাত পড়া সব যুগেরই একটি মীমাংসিত বিষয়।

একটি বিভ্রান্তির অবসান
যাঁরা তারাবীহ নামাজ ৮ রাকাতের প্রবক্তা বা ৮ রাকাতের বেশী পড়া না জায়েজ মনে করেন তারা আবুসালামাহ ইবনে আব্দুর রহমানের হাদীসকে দলীল হিসেবে পেশ করেন। যাতে তিনি হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, রমজানে রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সালাত কেমন ছিল? তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম রমজানে বা রমজানের বাইরে ১১ রাকাতের বেশী আদায় করতেন না। হাদীসটিতে মূলত রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর তাহাজ্জুদ নামাজের আমল বর্ণিত হয়েছে, তারাবীহ নামাজ নয়। কারণ, তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ আলাদা নামাজ। এবং রমজান ছাড়া অন্য মাসে তারাবীহ নামাজ নেই। এখানে যেহেতু রমজান ছাড়া অন্য মাসের সালাতের কথাও উল্লেখ আছে। সেহেতু বিষয়টি পরিষ্কার যে, তাহাজ্জুদের নামাজের আমলের কথা বলা হয়েছে। আর তা হলো ৮ রাকাত তাহাজ্জুদ ও ৩ রাকাত বিতর। তারাবিহ্ নামাজ বিষয়ে বর্তমান কতিপয় গোষ্ঠি বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। যুগ যুগ ধরে চলে আসা ২০ রাকাত তারাবীহ্ নামাজ ৮ রাকাত কিংবা ১২ রাকাত বলে মুসলমানদের মাঝে ফিতনা সৃষ্টি করছে, তাই সমগ্র মুসলিম মিল্লাতকে এ ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে।

লেখক: সহকারি পরিচালক- ইসলামিক ফাউন্ডেশন, কক্সবাজার।

Share:

Leave Your Comment