শবে বরাত উপলক্ষে আলোকসজ্জা করা যাবে কিনা?
জান্নাতুল ফেরদৌস, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: একটি পুস্তকে লায়লাতুল বরাত সম্বন্ধে লেখা হয়েছে- এ রাতকে ভাগ্য রজনী মনে করা, মসজিদকে সাজানো, আলোকসজ্জা করা, ভাল খাবার পরিবেশন, মিলাদ শরীফ পড়া এবং এ রাতের ইবাদতকে হাজার মাসের ইবাদত অপেক্ষা উত্তম মনে করা, শরীয়ত সম্মত নহে বরং গুনাহের কাজ। বর্তমানে শবে বরাত, শবে কদর, ঈদে মিলাদুন্নবী, মিলাদ মাহফিল ও ওরস উপলক্ষে ওলীদের মাজারে ও খানকাহ্, মসজিদ সমূহে অধিক মাত্রায় আলোকসজ্জা করতে দেখা যায়। এ বিষয়ে বিস্তাতির জানালে উপকৃত হবো।
উত্তর: মাহে শা’বানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত পনরতম রজনীকে আরবীতে লায়লাতুল বরাত, ফার্সীতে শবে বরাত বলা হয়। মহান আল্লাহ্ রব্বুল আলামীন তাঁর অনুগত গুনাহগার বান্দাদের পাপরাজি ক্ষমা করত: দুনিয়া ও আখিরাতের নিয়ামত দানে ধন্য করার জন্য বিশেষ বিশেষ কতগুলো রাত দান করেছেন। তন্মধ্যে একটি হল শবে বরাত এটা সম্মানিত, বরকত মন্ডিত ও ফজিলতে পরিপূর্ণ একটি রাতি। এটার ফজিলত সম্পর্কে ক্বোরআন করিম, হাদিস শরীফ সহ বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থে ’ অসংখ্য বর্ণনা রয়েছে। যেমন পবিত্র ক্বোরআনে মহান আল্লাহ্ এরশাদ করেন-
مباركة لیلة فى انزلناه انا- المبین والكتاب حم
-حكیم امرٍ كل یفرق فیھا منذرین كنا انا
অর্থাৎ হা-মী-ম সুস্পষ্ট কিতাবের শপথ, নিশ্চয় আমি একে বরকত মন্ডিত রাতে নাযিল করেছি অবশ্যই আমি ভীতি প্রদর্শনকারী। তাতে পৃথক করে দেওয়া হয় প্রত্যেক হিকমতময় কাজ। [সূরা দুখান: ১-৫]
মুফাসসেরীনে কেরামের কেউ কেউ এ আয়াতে লায়লাতুল মোবারকা দ্বারা শা’বান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত পনরতম রজনী শবে বরাতের বরকত মন্ডিত রাত বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। আর অন্যান্য তাফসির বিশারদগণ লায়লাতুল ক্বদর বা শবে ক্বদর মুরাদ নিয়েছেন। [তাফসীরে রুহুল বায়ান ও রুহুল মা’আনী সূরা দুখানের তাফসির ইত্যাদি]
হুজুর গাউসুল আযম দস্তগীর শেখ সৈয়্যদ আবদুল কাদের জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর কিতাব গুনিয়াতুৎ তালেবিনে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামার একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। বর্ণনাকারী হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, শা’বান মাসের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রজনীতে আমার নিকট হযরত জিবরাঈল আলায়হিস্ সালাম তশরিফ আনলেন এবং বললেন ওহে আল্লাহর রসূল! আপনার নূরানী মাথা মোবারক উপরের দিকে তুলে আসমানের দিকে নজর করুন। আমি বললাম আজ কোন রাত? হযরত জিবরাঈল আলায়হিস্ সালাম বললেন আজ ওই বরকতমন্ডিত রাত যে রাতে মহান আল্লাহ্ স্বীয় রহমতের তিনশত দরজা খুলে দেন। এবং সকল মুসলমানের পাপরাজি ক্ষমা করে দেন। তবে তিনি মুশরিক, যাদুকর, গণক, শরাবী তথা মদ্যপায়ী, সুদখোর ও ব্যভিচারীকে বিশুদ্ধ অন্তরে তওবা না করা পর্যন্ত ক্ষমা করবেন না। মুসনাদে আবদুর রাজ্জাক গ্রন্থে’ কিতাবুস্ সিয়াম অধ্যায়ে বর্ণিত আছে বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এরশাদ করেন-
واول الجمعة لیلة الدعاء فیھن لایرد لیال خمس
ولیلتا شعبان من النصف ولیلة رجب من لیلة
অর্থাৎ এমন পাঁচটি রজনী আছে, যে রজনীগুলোতে দোয়া ফেরত হয় না এগুলো হল জুমআর রাত, রজব মাসের প্রথম রাত, শা’বানের পনরতম রাত তথা বরাতের রাত এবং দুই ঈদের দুই রাত। হাদীস শরীফে আরো উল্লেখ রয়েছে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন- শা’বান মাসের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত পনরতম রজনীতে যে ব্যক্তি জাগ্রত থেকে নামায আদায় করবে এবং তার পর দিন রোযা পালন করবে মহান আল্লাহ্ ঐ দিন সূর্য অস্ত গেলে পৃথিবীর নিকটতম আসমানে অবতীর্ণ হন এবং নিজের বান্দাদের আহ্বান করতে থাকেন এমন কেউ ক্ষমা প্রার্থী আছ যে, আমার কাছে ক্ষমা চায়বে তাকে আমি ক্ষমা করে দেব। কেউ কি রিযিক চাও? আমি রিযক দেব। কেউ কি বিপদ থেকে নিস্কৃতি চাও? আমি নিস্কৃতি দেব। এমন কেউ আছ? এমন কেউ আছ? এভাবে ফজর পর্যন্ত আহ্বান করতে থাকেন। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত আছে এই রাত্রে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞেসা করলেন- তুমি কি জান এ রাতে কি আছে? তিনি বলেন এ হলো মধ্য শা’বানের রাত, তখন রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন আজকের এ রাতে এ বছর যত মানব জন্ম গ্রহণ করবে এবং যত মানুষ মৃত্যু বরণ করবে তা লেখা হয়। এবং তোমাদের নেক আমল সমূহ আসমানের দিকে উঠানো হয় এবং তোমাদের রিযিক অবতীর্ণ হয়। [মেশকাত শরীফ]
মোটকথা শবে বরাতে হায়াত-মাউত, জীবিকা, বিয়ে-শাদী, ভাগ্যে উত্থান-পতন, ধন-দৌলত, ইজ্জত সম্মান ইত্যাদি যাবতীয় কিছু নির্ধারণ করা হয়। তাই উক্ত পবিত্র রাতে মঙ্গল ও কল্যাণ লাভের জন্য রাত জেগে ইবাদত করা, দান খায়রাত করা, আত্মীয় স্বজন ও ফকির মিসকিনের মাঝে ভাল খাবার পরিবেশন করা, আপনজন ও অলি বুযুর্গের কবর/মাযার যিয়ারাত করা, দরূদ-সালাম ও মিলাদ কিয়ামের আয়োজন করা, এবং উক্ত সম্মানিত রাতকে উপলক্ষ করে মসজিদ ও মাজার সমূহকে ইবাদত ও যিয়ারতের সুবিধার্থে সজ্জিত করা উত্তম আমল। এটাকে শরীয়ত সম্মত নয় বলা বা গুনাহের কাজ বলা দ্বীন সম্পর্কে জাহেল ও অজ্ঞ হওয়ার প্রমাণ। তবে হাজার মাসের চেয়ে উত্তম হল পবিত্র লায়লাতুল কদর (কদর রজনী)। পবিত্র ক্বোরআনের সূরা কদর ২ নম্বর আয়াত দ্বারা প্রমাণিত। আর শবে বরাত ও অনেক ফযীলত-মর্যাদাপূর্ণ রজনী। তবে এ মাস পবিত্র রজনীর পবিত্রতা ও মর্যাদা যেন ফটকাবাজী, আতশবাজী এবং অযথা ঘোরা-ফেরা ও অবহেলায় যেন সময় নষ্ট ও ক্ষুন্ন না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা সকলের জন্য জরুরি।
উল্লেখ্য যে, মসজিদ আলোকসজ্জা করা গুনাহের কাজ বা বিদাআত নই বরং ইবাদত ও নবীগণ এবং সাহাবায়ে কেরামের সুন্নাত। যেমন- রূহুল বায়ানে বর্ণিত আছে যে, আল্লাহ্র সম্মানিত নবী হযরত সুলায়মান আলাহিস্ সালাম বায়তুল মুকাদ্দাস শরীফকে এমনভাবে আলোকসজ্জা করেছিলেন, দুই মাইল পর্যন্ত এর আলোতে মহিলাগণ চরকার সুতা কাটতে পারতেন। বিশিষ্ট সাহাবিয়ে রাসূল হযরত দাহ্য়া কলবি রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু মসজিদে নববী শরীফে আলোকসজ্জা করতেন এবং প্রিয়নবীর সাহাবী হযরত তামিম দারি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হযরত ওমর ফারুকে আযম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর খিলাফত কালে পবিত্র রমযান মাসে তারাবিহ্ নামাযের সময় মসজিদে নববী শরীফে আলোকসজ্জা করতেন। আল্লাহর পয়গাম্বর হযরত সুলায়মান আলায়হিস্ সালাম বায়তুল মুকাদ্দাস শরীফে ‘কিবরীতে আহমর’ তথা লাল গন্ধকের আলো জ্বালাতেন যার আলো চতুর্দিকে ১২ বর্গ মাইল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ত।
[তাফসীরে রূহুল বয়ান: কৃত- আল্লামা ইসমাঈল হক্কী হানাফী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, সূরা তাওবা, খন্ড-৩, পৃ.৪০০, তাফসীরে নূরুল ইরফান: কৃত- মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী (রহ.), সূরা তাওবা, পৃষ্ঠা-৩০১]
আল্লামা ইসমাঈল হক্কী হানাফী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি আরো বলেন, সাহাবীয়ে রাসূল হযরত তামিমূদ দারী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু যখন মদিনা মোনাওয়ারায় আগমন করেন, তখন তিনি মসজিদে নববী শরীফের স্তম্ভগুলি ফানসের বাতি দ্বারা আলোকসক্কা দেখে তখন রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববী শরীফের আলোকসজ্জা দেখে হযরত তামিমূদ দারীকে উদ্দেশ্য করে বললেন-نورت مسجدنا نور الله عليك اما والله لوكان لى ابنه لأنكحتكها هذا অর্থাৎ- তুমি আমার মসজিদকে আলোকিত করেছো আল্লাহ্ তা‘আলা তোমাকে আলোকিত করুক। আল্লাহর শপথ-যদি আমার নিকট আর একটা কন্যা থাকত আমি তাকে তোমার বিবাহে সোপর্দ করলাম।
আরো বর্ণিত আছে সর্বপ্রথম মসজিদে নববী শরীফকে বাতি দিয়ে আলোকিত করেছেন এবং মাহে রমযানে তারাবিহ নামাযের জন্য আলোকসজ্জা করেছেন। হযরত আমিরুল মু’মিনীন ওমর ফারুকে আযম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। যা দেখে শেরে খোদা মওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হযরত ফারুকে আযমের জন্য দো‘আ করেছিলেন-نورت مسجدنا نور الله قبرك ابن الخطاب অর্থাৎ আপনি আমাদের মসজিদেকে আলোকিত করেছেন, আল্লাহ্ তা‘আলা আপনার কবর শরীফকে আলোকময় করুক। হে ইবনে খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু।
[তাফসীরে রুহুল বয়ান, সূরা তাওবার তাফসীর, খন্ড-৩, পৃ.৪০০]
সুতরাং এসব বর্ণনাকে লিপিবদ্ধ করেছেন, যুগের শ্রেষ্ঠ মুফাস্সির ও মুফতিগণ। না দেখে বা অবগত না হয়ে এ কথা বলা যে, মসজিদ, মাজার ও খানকাহ্ শরীফ, আলোকসজ্জা করা শরীয়তসম্মত নয় বরং গোনাহ্! তা অজ্ঞতা ও চরম সীমালঙ্ঘন। এ জাতীয় অজ্ঞ ও জাহেলদের জন্য কোন বিষয়ে ফতোয়া/ফয়সালা প্রদান করা হারাম ও মারাত্মক অপরাধ।