Anjuman-E Rahmania Ahmadia Sunnia Trust

সামাজিক ন্যায়পরায়ণতা প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব

সামাজিক ন্যায়পরায়ণতা প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব

মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ্ আল-মাসুম

মুমিন জীবনের পূর্ণতার জন্য তাকওয়া বিশেষ শর্ত; আর তাকওয়ার পরিচায়ক হলো ন্যায়পরায়ণতা। ব্যক্তিজীবন শুদ্ধ করার পর তাকে পরিবারের অন্যান্য সদস্যের মধ্যেও ইনসাফ কায়েম করতে হবে। অতঃপর তার দায়িত্ব হলো সামাজজীবনে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা। সমাজে বসবাসকারী ব্যক্তিরা পরস্পর সম্পৃক্ত হয়ে কর্মজীবন ও পেশাগত জীবন নির্বাহ করেন। তাই কারো প্রতি যেন কোনো অবিচার না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। যে সমাজে মানুষ ইনসাফ ও ন্যায়বিচার বঞ্চিত হয়, সেখানে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যায়। ক্ষুধা পীড়িত মানুষ বিদ্যমান আইন ও বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারায়। ধর্ম-বর্ণ-দল- গোষ্ঠী নির্বিশেষে মানুষ যখন তার অধিকার বুঝে পায় না, তখন অধিকারের জন্য সে সংগ্রামের পথ বেছে নেয়। প্রাপ্য অধিকার যখন ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হয়, তখন সমাজে এর নানা উপসর্গ দেখা দেয়। চূড়ান্ত বিবেচনায় তা কারো জন্য কল্যাণকর হয় না। তাই ইসলাম ইনসাফ ও সাম্যের প্রতি অত্যধিক গুরুত্বারোপ করেছে। এ প্রসঙ্গে মহান রাব্বুল ইজ্জত ইরশাদ করেন,
لَقَدۡ اَرۡسَلۡنَا رُسُلَنَا بِالۡبَیِّنٰتِ وَ اَنۡزَلۡنَا مَعَهُمُ الۡکِتٰبَ وَ الۡمِیۡزَانَ لِیَقُوۡمَ النَّاسُ بِالۡقِسۡطِ ۚ
অর্থাৎ ‘নিশ্চয় আমি আমার রাসূলদেরকে নিদর্শনাদি দিয়ে প্রেরণ করেছি এবং তাদের সঙ্গে নাজিল করেছি কিতাব ও পরিমাপক পাল্লা, যেন মানুষ ন্যায় বিচার কায়েম করতে পারে।’ মহান আল্লাহ তাআলা আসমানি কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, যাতে মানুষ আকীদা-বিশ্বাস, আখলাক ও আমলের ক্ষেত্রে ন্যায়ের পথে চলতে পারে। শিথিলতা ও বাড়াবাড়ির রাস্তা পরিহার করে চলে। আর পরিমাপক যন্ত্র পাল্লা দিয়েছেন যেন লেদদেন ও বেচা-কেনায় কম-বেশি না করে মানুষ ইনসাফের রাস্তায় চলে। উভয়টি ইসলাম যে ভারসাম্যপূর্ণ ধর্ম তার পরিচায়ক।
অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে,
إِنَّ اللهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا وَإِذَا حَكَمْتُمْ بَيْنَ النَّاسِ أَنْ تَحْكُمُوا بِالْعَدْلِ
অর্থাৎ ‘তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচার-মীমাংসা করবে, তখন ন্যায়ভিত্তিক ফায়সালা করবে।’ সুবিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আপন-পর, ধনী-গরিব, উঁচু-নিচু কোনো পার্থক্য নেই। যে-ই ক্ষতিগ্রস্ত হোক না কেন, ন্যায়ের মানদন্ড অবশ্যই ঠিক রাখতে হবে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, নিশ্চয়ই যারা ইনসাফ ও ন্যায়বিচার করে আল্লাহর কাছে তারা নূরের মিম্বরে আসন গ্রহণ করবে। তারা হচ্ছে এমন সব লোক যারা তাদের বিচার ফায়সালার ক্ষেত্রে পরিবার-পরিজনের ব্যাপারে এবং যেসব দায়-দায়িত্ব তাদের ওপর অর্পণ করা হয়; সেসব বিষয়ে ন্যায়পরায়ণতা ও সুবিচার করে।
ন্যায়পরায়ণতা থেকে বিচ্যুতি একটি জাতিকে ধ্বংস করে দেয়। ন্যায়বিচার ছাড়া কখনোই সভ্য সমাজ ও উন্নত রাষ্ট্র গড়ার কল্পনাও করা যায় না। এ প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِنَّمَا أَهْلَكَ الَّذِينَ قَبْلَكُمْ أَنَّهُمْ كَانُوا إِذَا سَرَقَ فِيهِمْ الشَّرِيفُ تَرَكُوهُ وَإِذَا سَرَقَ فِيهِمْ الضَّعِيفُ أَقَامُوا عَلَيْهِ الْحَدَّ وَاَيْمُ اللهِ لَوْ أَنَّ فَاطِمَةَ بِنْتَ مُحَمَّدٍ سَرَقَتْ لَقَطَعْتُ يَدَهَا
অর্থাৎ ‘হে লোকসকল! তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিসমূহের লোকেরা এ কারণেই (ন্যায়বিচারে অবহেলা) ধ্বংস হয়েছে। যখন তাদের মধ্যে কোনো বড়লোক চুরি করত, তাকে ছেড়ে দেওয়া হতো এবং যখন কোনো দুর্বল লোক চুরি করত, তার ওপর দন্ডবিধি কার্যকর করা হতো। কসম সেই সত্তার, যার হাতে আমার জীবন। যদি আমার কন্যা ফাতিমাও এ অপরাধ করে, তবে আমি তার হাত কেটে দিবো।’

ন্যায়পরায়ণতা প্রতিষ্ঠায় প্রতিবন্ধকতা
কুরআনুল করিমের ভাষায় মৌলিকভাবে দু’টি কারণে মানুষ ন্যায়পরায়ণতা থেকে বিচ্যুত হয়- ১. স্বজনপ্রীতি: সম্পর্কের কারণে মানুষ ন্যায়ের পথ থেকে সরে আসে, যাকে স্বজনপ্রীতি বলা হয়। যা বর্তমানে মহামারির রূপ নিয়েছে। আদালত, প্রশাসন, রাজনীতি ও সামাজিক সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে মানুষ নিজের লোকদেরকে প্রাধান্য দিচ্ছে। ফলে মানুষ ইনসাফ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর শাসনামলে একবার তিনি তাঁর অতি প্রিয় ও মুল্যবান লৌহ বর্ম হারিয়ে গেল। একদিন তিনি দেখলেন কুফার বাজারে জনৈক অমুসলিম সেই বর্মটি বিক্রি করতে নিয়ে এসেছে। কাছে গিয়ে তিনি বর্মটি ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখে চিনে ফেললেন, বললেন – ‘বর্মটি আমার। এটি আমার উটের পিঠ থেকে অমুক রাত্রে … অমুক স্থানে পড়ে গিয়েছিল।’ লোকটি বলল – ‘ জ্বী না, আমিরুল মুমিনীন! এটি আমার বর্ম এবং আমার হাতেই রয়েছে।’ তিনি বললেন – ‘এটি অবশ্যই আমার বর্ম কারণ এটি আমি বিক্রিও করিনি বা কাউকে দানও করিনি। এটি কখনও তোমার হতে পারেনা।’ লোকটি বলল- ‘তাহলে তো মীমাংসার জন্য কাজীর কাছেই যেতে হয়।’ হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেন – ‘ঠিক আছে চল কাজীর কাছেই যাই…।’ তারা উভয়ে তৎকালীন বিচারক কাযী শুরাইহ রাদ্বিয়াল্লহু আনহুর নিকট মামলা দায়ের করেন। খলিফার এর পক্ষে সাক্ষী ছিলেন নিজের ছেলে হযরত হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও তাঁর ক্রীতদাস কাম্বর’। বিচারক উভয়ের বক্তব্য শ্রবণ করে অমুসলিম লোকটির পক্ষে রায় দেন। কারণ পিতার পক্ষে সন্তানের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। অথচ বিচারক ও হজরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমার মাঝে ঈমানী সম্পর্ক ছিল। কারণ দু’জনেই মুসলমান। তাছাড়া তিনি ছিলেন খলিফাতুল মুসলিমিন। অতঃপর ঐ অমুসলিম লোকটি এই ন্যায় বিচার দেখে আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে বলল – ‘হায় আল্লাহ্! আমিরুল মুমিনীন আমার বিরুদ্ধে বিচারপ্রার্থী হয়েছেন তারই অধীনস্থ কাজীর দরবারে! তারই অধীনস্ত কাজী তারই বিরুদ্ধে আমার পক্ষে রায় দিলেন! আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, যে দ্বীন (ধর্ম) এমন সুন্দর শিক্ষা দেয় সেই দ্বীন অবশ্যই সত্য…’ আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি – ‘ আল্লাহ্ ছাড়া ইবাদতের উপযুক্ত আর কোন মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসুল’। ‘হে কাজী! নিঃসন্দেহে বর্মটি আমিরুল মুমিনীনের। তাঁর যে বাহিনী সিফফীন যুদ্ধের উদ্দেশ্যে রওনা করেছিল, আমি তাদের পিছনে পিছনে যাচ্ছিলাম। হটাৎ দেখলাম ধূসর রঙয়ের উঠের পিঠ থেকে বর্মটি পড়ে গেল, সাথে সাথে আমি সেটি তুলে নেই।’ হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এই সব কথা শোনার পর বললেন – ‘তুমি যখন ইসলাম গ্রহণ করেছ তখন বর্মটি আমি তোমাকে দান করে দিলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে আমার একটি ঘোড়াও তোমাকে দিলাম।’

২.বিদ্বেষ ও শত্রুতা
হিংসা বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে মানুষ সুবিচারের পথ থেকে সরে আসে। আল্লাহ তায়ালা এ প্রসঙ্গে বলেন,
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا کُوۡنُوۡا قَوّٰمِیۡنَ لِلّٰهِ شُهَدَآءَ بِالۡقِسۡطِ ۫ وَ لَا یَجۡرِمَنَّکُمۡ شَنَاٰنُ قَوۡمٍ عَلٰۤی اَلَّا تَعۡدِلُوۡا ؕ اِعۡدِلُوۡا ۟ هُوَ اَقۡرَبُ لِلتَّقۡوٰی ۫
অর্থাৎ‘আর কোনো সম্প্রদায়ের শত্রুতা যেন তোমাদের সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে। তোমরা সুবিচার করো, এটাই তাকওয়ার বেশি নিকটবর্তী।’ আলোচ্য আয়াতের ভাষ্য মতে,শত্রুতা-মিত্রতার ভাবাবেগে পরাভূত না হওয়ার স্বভাবই তাকওয়া হাসিলের সর্বাধিক শক্তিশালী ও নিকটতম উপায়। আর এটাই ছিল নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার অনুপম আদর্শ। দয়া বা পক্ষপাতিত্ব কিংবা বিদ্বেষ আল্লাহর বিধান কার্যকরকরণে কোনোরূ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি। উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নিজস্ব ব্যাপারে কারো কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি।

ইনসাফ বা ন্যায়পরায়ণতা প্রতিষ্ঠার কৌশল
সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তা ছিল যুগান্তকারী ও বৈপ্লবিক। যথা:

ক. অর্থ সম্পদের সঠিক ব্যবহার
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অর্থসম্পদ অর্জন, সঞ্চয় ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন আনার প্রয়াস চালান। সমকালীন দুনিয়া বিশেষত প্রাক ইসলামী সমাজে ধনসম্পদ ছিল আভিজাত্যের মাপকাঠি, কামিয়াবির নিদর্শন, শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক। তাই মানুষ হন্য হয়ে অর্থসম্পদ অর্জনের পেছনে ছুটেছে সারা জীবন। বৈধ-অবৈধ হালাল-হারাম, ন্যায়-নীতি, পাপ-পুণ্য এসবের ধার ধারেনি। এভাবে মানুষ হয়েছে অর্থসম্পদের দাস আর অর্থসম্পদ হয়েছে তাদের প্রভু। হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের লক্ষ্যে ওহি নির্ভর যে দর্শন পেশ করেছেন তা হলো মানবজীবনে অর্থসম্পদ অপরিহার্য, জীবন ও জীবিকার তাগিদে অর্থসম্পদ অর্জন করতে হয়, কাজে লাগাতে হয়, কিন্তু তা জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়। ধনসম্পদসহ দুনিয়ার সব কিছুই মানুষের সেবক ও খাদেম। পৃথিবীর সকল বস্তু মানুষের জন্য সৃষ্টি। আর মানুষের সব কর্মকান্ড কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য নিবেদিত। সুতরাং অর্থসম্পদ অর্জন, সঞ্চয় ও ব্যয় করতে হবে আল্লাহর নির্দেশিত পথে। এতেই নিহিত আছে মানুষের মুক্তি ও কামিয়াবি। রাষ্ট্রের আর্থিক সম্পদে জনগণের অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছয় প্রকার রাজস্ব প্রবর্তন করেন। যথা- ১. গনিমাত্ বা যুদ্ধলব্ধ সম্পত্তি, ২. যাকাত বা ধনীদের উপর আরোপিত কর, ৩. খারাজ বা অমুসলিম কৃষকদের ভূমি কর, ৪. জিজিয়া বা অমুসলিমদের নিরাপত্তা কর, ৫. ফাই বা রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি, ৬. সাদকা বা স্বেচ্ছাধীন দান। এসব খাতে সংগৃহীত রাজস্ব নির্ধারিত হারে জনগণের মধ্যে বিতরণ করা হতো। এ ব্যবস্থা রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার মাদানী জীবনে এবং পরবর্তীতে খোলাফায়ে রাশেদিনের শাসনামলে আশানুরূপ সুফল বয়ে আনে।

খ.সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে আদর্শ সমাজ গড়ে তোলেন। বংশ কৌলীন্য ও আভিজাত্যের গৌরবের পরিবর্তে মানবতার ভিত্তিতে সমাজ বন্ধন সুদৃঢ় করেন। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা দেন, আরবের ওপর অনারবের, অনারবের ওপর আরবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। সব মানুষ একে অপরের ভাই। সবাই হযরত আদম আলাইহিস সালামের বংশধর আর আদম আলাইহিস সালাম মাটি থেকে তৈরি। অন্যত্র ইরশাদ করেন,
عن النعمان بن بشير -رضي الله عنهما- قال: قال رسول الله ﷺ مثل المؤمنين في توادهم وتراحمهم وتعاطفهم مثل الجسد إذا اشتكى منه عضو تداعى له سائر الجسد بالسهر والحمى
মুমিনগণ পরস্পরের প্রতি স্নেহ, করুণা ও সহানুভূতি প্রকাশ করার ক্ষেত্রে তাঁদের দৃষ্টান্ত হলো দেহের মতো: যদি এর একটি অঙ্গ অভিযোগ করে (বিপদগ্রস্থ হয়), তবে শরীরের বাকি অংশ নিদ্রাহীনতা ও জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়ে।

গ. নীতি -নৈতিকতা
মনুষ্যত্বের উজ্জীবন, চারিত্রিক উৎকর্ষ ও নৈতিক উপলব্ধি সুস্থ সমাজ বিকাশে সহায়ক আর ইন্দ্রিয়জাত প্রবণতা, অনিয়ন্ত্রিত আবেগ, অনিষ্টকর প্রথা সমাজের সুস্থতার ভিত্তিমূলকে একেবারে নড়বড়ে করে দেয়, জন্ম হয় জুলুম ও অন্যায়ের। যা দমনের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুয়া খেলা, মদ্যপান, নেশাগ্রহণ, ব্যভিচার-সমকামিতা ও অহেতুক রক্তপাত নিষিদ্ধ করে দেন।

ঘ. নারীর ব্যক্তি স্বাধীনতা
রাসূলে মাকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীদের তাদের পছন্দকৃত স্বামী গ্রহণের পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করেন। কন্যা সন্তান হত্যা নিষিদ্ধ করেন। উপরন্তু কন্যা, মেয়ে, বোন লালন পালনকারীদের জান্নাত লাভের সুসংবাদ দেন।
মুসলিম বিশ্বের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু রাষ্ট্রের শাসনভার গ্রহণের পর প্রদত্ত ভাষণে বলেছিলেন, ‘তোমাদের মধ্যে দুর্বলতম ব্যক্তিও আমার কাছে সবল, যদি সে ন্যায়সঙ্গত অবস্থানে থাকে। আর তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক প্রভাবশালী ও শক্তিমান ব্যক্তিকেও আমি আইনের প্রশ্নে, অন্যের অধিকারের প্রশ্নে ছাড় দেব না।’

ঙ. কথা-বার্তায় ইনসাফ
পরষ্পর কথোপকথনেও ইনসাফ করার ব্যাপারে ইসলাম তাগিদ দিয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে-
وَإِذَا قُلْتُمْ فَاعْدِلُوا وَلَوْ كَانَ ذَا قُرْبَى
অর্থাৎ আর যখন তোমরা কথা বলবে, তখন ইনসাফ কর, যদিও সে আত্মীয় হয়।

চ, বিচার কার্যে ইনসাফ: বিচার কাজ পরিচালনার বেলায়ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার প্রতি জোর তাগিদ প্রদান পূর্বক ইরশাদ হচ্ছে-
إِنَّ اللهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا
وَإِذَا حَكَمْتُمْ بَيْنَ النَّاسِ أَنْ تَحْكُمُوا بِالْعَدْلِ
অর্থাৎ নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ দিচ্ছেন আমানতসমূহ তার হকদারদের কাছে পৌঁছে দিতে। আর যখন মানুষের মধ্যে ফয়সালা করবে তখন ন্যায়ভিত্তিক ফয়সালা করবে।

ছ. সন্ধির ক্ষেত্রে ইনসাফ
ইসলাম সন্ধির ক্ষেত্রেও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার কথা বলে। ইরশাদ হচ্ছে-
وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا فَإِنْ بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الأُخْرَى فَقَاتِلُوا الَّتِي تَبْغِي حَتَّى تَفِيءَ إِلَى أَمْرِ اللهِ فَإِنْ فَاءَتْ فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا بِالْعَدْلِ وَأَقْسِطُوا
অর্থাৎ আর যদি মুমিনদের দু‘দল যুদ্ধে লিপ্ত হয়,তাহলে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। অতঃপর যদি তাদের একদল অপর দলের উপর বাড়াবাড়ি করে,তাহলে যে দলটি বাড়াবাড়ি করবে,তার বিরুদ্ধে তোমরা যুদ্ধ কর,যতক্ষণ না সে দলটি আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। তারপর যদি দলটি ফিরে আসে তাহলে তাদের মধ্যে ইনসাফের সাথে মীমাংসা কর এবং ন্যায়বিচার কর।

ন্যায় প্রতিষ্ঠার সুফল
ন্যায় প্রতিষ্ঠার সুফল জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে দৃশ্যমান। যথা-
১. আল্লাহর সন্তুষ্টি
ইনসাফ বা ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে মহান আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়। ইরশাদ হচ্ছে-
إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ
অর্থাৎ নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়বিচারকারীদের ভালবাসেন।

২. শত বছরের আমল অপেক্ষা উত্তম
প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবু হুরায়ারা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, একজন ন্যায়-নীতিবান শাসকের তার প্রজাদের মধ্যে একদিনের ইনসাফের আমল একজন সাধারণ আবেদের একশত বছরের আমল অপেক্ষা অনেক উত্তম।

৩. ইহকালে নিরাপত্তা লাভ
ন্যায় প্রতিষ্ঠাকারী আল্লাহর পক্ষ হতে নিরাপত্তা লাভ করে।
وَقَدْ حُكِيَ أَنَّ أَحَدَ رُسُلِ الْمُلُوْكِ جَاءَ لِمُقَابَلَةِ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ، فَوَجَدَهُ نَائِمًا تَحْتَ شَجَرَةٍ، فَتَعَجَّبَ؛ إِذْ كَيْفَ يَنَامُ حَاكِمُ الْمُسْلِمِيْنَ دُوْنَ حَرَسٍ، وَقَالَ: حَكَمْتَ فَعَدَلْتَ فَأَمِنْتَ فَنِمْتَ فَسَلَّمْتَ يَا عُمَرُ..
অর্থাৎ একদা কোন এক দেশের দূত অর্ধ পৃথিবীর শাসনকর্তা আমিরুল মুসিনীন হযরত উমর বিন খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সঙ্গে সাক্ষাত করতে আসলো। তাঁকে ঐ দূত একটি গাছের নিচে ঘুমন্ত অব্স্থায় দেখে, আশ্চর্যবোধ করলো!! কিভাবে প্রহরী ছাড়া মুসলমানদের বাদশা ঘুমাচ্ছে! আর বলতে লাগলো, বিচারের ক্ষেত্রে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করেছ, লোকদেরকে নিরাপত্তা দিয়েছো। এই জন্যই হে উমরা! তুমি নিরাপদে ঘুমাচ্ছ।

৪.পরকালে আরশের ছায়ায় স্থান
এমন শাসক কিয়ামত দিবসে আল্লাহর আরশের ছায়ায় অবস্থান করবে। এ প্রসঙ্গে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمُ اللهُ فِي ظِلِّهِ يَوْمَ لاَ ظِلَّ إِلاَّ ظِلُّهُ: الإِمَامُ الْعَادِلُ. وَشَابٌّ نَشَأَ بِعِبَادَةِ اللهِ. وَرَجُلٌ قَلْبُهُ مُعَلَّقٌ فِي الْمَسَاجِدِ. وَرَجُلاَنِ تَحَابَّا فِي اللهِ، اجْتَمَعَا عَلَيْهِ وَتَفَرَّقَا عَلَيْهِ. وَرَجُلٌ دَعَتْهُ امْرَأَةٌ ذَاتُ مَنْصِبٍ وَجَمَالٍ، فَقَالَ: إِنِّي أَخَافُ اللهَ. وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ فَأَخْفَاهَا حَتَّىٰ لاَ تَعْلَمُ يَمِينُهُ مَا تُنْفِقُ شِمَالُهُ. وَرَجُلٌ ذَكَرَ اللهَ خَالِياً، فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ
অর্থাৎ সাত প্রকার লোককে আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন তাঁর আরশের ছায়ায় স্থান দান করবেন। সেদিন আরশের ছায়া ছাড়া আর অন্য কোন ছায়া থাকবে না। ১. ন্যায় পরায়ন শাসক। ২. ঐ যুবক যে তার যৌবন কাল আল্লাহর ইবাদতে কাটিয়েছেন। ৩. এমন (মুসলিম) ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত থাকে, একবার মসজিদ থেকে বের হলে পুনরায় প্রত্যাবর্তন না করা পর্যন্ত ব্যাকুল থাকে। ৪. এমন দু’ব্যক্তি যারা কেবল আল্লাহর মহব্বতে পরস্পর মিলিত হয় এবং পৃথক হয়। ৫. যে ব্যক্তি নির্জনে আল্লাহর ভয়ে অশ্রু ফেলে। ৬. যে ব্যক্তিকে কোন সম্ভ্রান্ত বংশের সুন্দরী রমনী ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার আহবান জানায় আর ঐ ব্যক্তি শুধু আল্লাহর ভয়েই বিরত থাকে। ৭. যে ব্যক্তি এত গোপনে দান করে যে তার ডান হাত কি দান করলো বাম হাতও জানলো না। [সহিহ বুখারী,হাদীস:৬৮০৬; সহিহ মুসলিম, হাদীস:২২৫২]
আজকাল অনেককে রাষ্টীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইনসাফ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য খুব তৎপর। অথচ তাদেও ব্যক্তি ও পরিবারে ইনসাফ ও ন্যায়বিচার কায়েমে উদাসীন। যেমন; আমরা অনেকেই নিজ স্ত্রী, সন্তান-সন্তুতি, ভাই-বোন, পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সুবিচার করি না। স্ত্রীকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করছি, ছেলে-মেয়েদের মাঝে পার্থক্য নির্ণয় বা দানের ক্ষেত্রে কম-বেশী করছি, বোনদেরকে মীরাছ বন্টনের সময় ঠকাচ্ছি, পিতা-মাতার হক্ব হচ্ছে সব চেয়ে বেশী, তাদের সাথেও অবিচার করতে পিছপা হচ্ছি না, তাই যদি না হবে তাহলে কোন সভ্য সমাজের লোক কি নিজ পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে কখনও রেখে আসতে পারে? এটা তো শুধু অবিচার নয়, এটা অমানবিক এবং মনুষ্যত্বকেও হার মানায়। ধিক! শত ধিক!! আর এ কারণেই আজকের সমাজ ব্যবস্থায় ইনসাফ ও ন্যায়বিচার দারুনভাবে উপেক্ষিত। কারণ এর গোড়া পত্তন করতে হবে ব্যক্তি ও পরিবার থেকে। তাহলেই তার প্রতিফলন বা সুফল আমরা পাব। সর্বক্ষেত্রে আমরা যখন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হব, তখনই আল্লাহর দরবারে প্রকৃত মুমিন হিসেবে বিবেচিত হব। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ইনসাফ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার তাওফীক দান করুন।

টিকা:
– সূরা হাদিদ, আয়াত:২৫
– সুরা নিসা,আয়াত: ৫৮
– সহিহ মুসলিম
– সহিহ বুখারী,হাদীস:৩৪৭৫; সহিহ মুসলিম, হাদীস:১৬৮৮
– কানযুল উম্মাল; বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা ১০/১৩৬ হা/২০২৫২, ১০/১৩৬; আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ ৮/৫
– সূরা মায়েদা, আয়াত:৮
– হাফিজ আবু শায়খ ইসফাহানী, আখলাকুন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, পৃ. ১৯
– সূরা বাকারা, আয়াত: ২৯
– আহমদ ইবন হাম্বল, মুসনাদ, ৫খ., পৃ. ৪১১
– মিশকাতুল মাসাবিহ; সহিহ বুখারী, হাদীস:২৫৮৬; সহিহ মুসলিম, হাদীস: ৬০১১
– জালালউদ্দীন সুয়ুতি, দুররুল মানসুর, খ-১, পৃ. ৩৯১, ইবনে কাসির, সিরাতুন নবুবিয়াহ, খ-৪, পৃ.৩৯২
– সূরা আনয়াম,আয়াত: ১৫২
– সূরা নিসা,আয়াত: ৫৮
– সূরা হুজুরাত,আয়াত: ৯
– সূরা হুজুরাত,আয়াত: ৯

আরবি প্রভাষক-তাজুশ শরী’আহ মাদরাসা, ষোলশহর, চট্টগ্রাম

 

Share:

Leave Your Comment