Anjuman-E Rahmania Ahmadia Sunnia Trust

লজ্জাশীলতা ও স্বাধীনতা

লজ্জাশীলতা ও স্বাধীনতা

মুহাম্মদ নাজমুল হোছাইন মুনির

প্রত্যেক কিছুর একটি নির্দিষ্ট সীমারেখা থাকে। যা অতিক্রমকারীকে সীমালঙ্ঘনকারী বলা হয়। আবার এই সীমানার মধ্যে থাকলে সে স্বাধীনও বটে। কুরআন ও হাদিসের বেশকিছু জায়গায় সীমালঙ্ঘনকারীকে মুনাফিক বলেও আখ্যায়িত করা হয়েছে। ঠিক তেমনি ঈমানেরও কিছু নির্দিষ্ট সীমারেখা রয়েছে। আর তার সীমারেখার গন্ডি হলো- সত্তরের অধিক শাখা-প্রশাখা। তন্মধ্যে একটি হলো হায়া বা লজ্জা। যেমনিভাবে পবিত্র হাদিসে উল্লেখ রয়েছে- الْحَيَاءُ شُعْبَةٌ مِّنَ الْإِيْمَانِ অর্থ: লজ্জা হলো ঈমানের শাখা সমূহ থেকে একটি শাখা। [১]
মুসলমান নর-নারীদের মধ্যে যদি এই শাখাটির যথাযথ আমল থাকে, তাহলে তার মধ্যে লজ্জাশীলতা এবং স্বাধীনতা আছে বলে গণ্য করা হবে। পক্ষান্তরে, যার মধ্যে লজ্জার লেশমাত্র নেই, অশ্লীলতা রয়েছে তাকে পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ আছে বলে ধরে নেয়া হবে।

পবিত্র কুরআনের আলোকে
ইসলাম সকলকে শালীনতা বজায় রেখে নিজ নিজ পোষাকের উপর স্বাধীনতা দিয়েছে। সুন্দর ও নির্দিষ্ট পোষাক মহান আল্লাহর নিদর্শন বলেও পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে-
یٰبَنِیۡۤ اٰدَمَ قَدۡ اَنۡزَلۡنَا عَلَیۡکُمۡ لِبَاسًا یُّوَارِیۡ سَوۡاٰتِکُمۡ وَ رِیۡشًا ؕ وَ لِبَاسُ التَّقۡوٰی ۙ ذٰلِکَ خَیۡرٌ ؕ ذٰلِکَ مِنۡ اٰیٰتِ اللّٰهِ لَعَلَّهُمۡ یَذَّکَّرُوۡنَ
অর্থ: হে আদম সন্তানগণ! নিশ্চয়ই আমি তোমাদের নিকট এমন পোষাক অবতরণ করেছি, যা দ্বারা তোমাদের লজ্জাস্থানসমূহ গোপন করবে এবং এটি এমন যে, তোমাদের আরাম হবে; এবং তাকওয়ার পোষাক- সেটাই সর্বোৎকৃষ্ট। এটা আল্লাহর নিদর্শন সমূহের অন্যতম; যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে। [২]
বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে মুসলিম নারীদের দৃষ্টি আরও সংযত হওয়া বাঞ্ছনীয়। তাদের চেহারার মাধ্যমে আসল রূপ ফুটে উঠে। সেখান থেকে ফিতনার উদ্ভব ঘটে। তাই শরীর ঢাকার পাশাপাশি তাদের চেহারা ঢাকাও আবশ্যক। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করছেন- یٰۤاَیُّهَا النَّبِیُّ قُلۡ لِّاَزۡوَاجِکَ وَ بَنٰتِکَ وَ نِسَآءِ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ یُدۡنِیۡنَ عَلَیۡهِنَّ مِنۡ جَلَابِیۡبِهِنَّ অর্থ: ওহে নবী! আপন বিবিগণ, সাহেবযাদীগণ ও মুসলমান নারীদেরকে বলে দিন- তারা যেন নিজেদের চাদরগুলোর একাংশ স্বীয় মুখের উপর ঝুলিয়ে রাখে। [৩]
মুসলমান নারীগণ বেপরোয়া গতিতে চলাফেরা না করে স্ব স্ব ঘরে অবস্থান করতে হবে। আর বেপরোয়া কিংবা বে-পর্দায় চলা- এটা জাহেলী যুগের নারীদের লক্ষণ। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন- وَ قَرۡنَ فِیۡ بُیُوۡتِکُنَّ وَ لَا تَبَرَّجۡنَ تَبَرُّجَ الۡجَاهِلِیَّۃِ الۡاُوۡلٰی অর্থ: (হে মহিলাগণ!) তোমরা নিজেদের গৃহসমূহে অবস্থান করো এবং বে-পর্দা থেকো না যেমনিভাবে জাহেলী যুগে পর্দাহীনতায় ছিল। [৪]
নারীদের সতীত্ব রক্ষা এবং সাজসজ্জা বাহিরে প্রদর্শন না করতে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে-
وَ قُلۡ لِّلۡمُؤۡمِنٰتِ یَغۡضُضۡنَ مِنۡ اَبۡصَارِهِنَّ وَ یَحۡفَظۡنَ فُرُوۡجَهُنَّ وَ لَا یُبۡدِیۡنَ زِیۡنَتَهُنَّ অর্থ: (ওহে নবী!) মুসলমান নারীদেরকে নির্দেশ দিন তারা যেন নিজেদের দৃষ্টিসমূহকে নীচু রাখে এবং নিজেদের সতীত্বকে হেফাযত করে আর নিজেদের সাজ-সজ্জাকে যেন প্রদর্শন না করে। [৫]
অথচ, বর্তমানে নারীরা বাইরে যেভাবে নিজেকে সৌন্দর্যমন্ডিত করে উপস্থাপন করছে সেটা একেবারেই নাজেহাল অবস্থা। তাদের উচিত, পরিধেয় বস্ত্রসমূহ ঢিলেঢালা করে পরিধান করা। জরুরি প্রয়োজনে বাহিরে যেতে হলে পর্দা করে কিংবা বোরকা পরিধান করে বের হওয়া। উল্লেখ্য যে, বর্তমান সময়ে আধুনিক ডিজাইনে যে বোরকা প্রচলিত আছে তা নারীদের পর্দার জন্য যথাযথ গ্রহণীয় নয়।
নারীদের পাশাপাশি ঈমানদার পুরুষদের দৃষ্টিও সংযত রাখা এবং তাদের লজ্জা স্থানের হেফাযত করতে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন-
قُلۡ لِّلۡمُؤۡمِنِیۡنَ یَغُضُّوۡا مِنۡ اَبۡصَارِهِمۡ وَ یَحۡفَظُوۡا فُرُوۡجَهُمۡ ؕ ذٰلِکَ اَزۡکٰی لَهُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰهَ خَبِیۡرٌۢ بِمَا یَصۡنَعُوۡنَ অর্থ: মুমিনদেরকে (পুরুষ) বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাযত করে, এটাই তাদের জন্য অধিক পবিত্র। তারা যা করে নিশ্চয় আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক অবহিত। [৬]

পবিত্র হাদিসের আলোকে
লজ্জার গন্ডিতে আবদ্ধ ব্যক্তির স্থান জান্নাত। আর নির্লজ্জতা ও দুশ্চরিত্রওয়ালা ব্যক্তির স্থান জাহান্নাম। এ মর্মে হাদিসে পাকে ইরশাদ হচ্ছে-
عن أبى هريرة رضي الله عنه قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم اَلْحَيَاءُ مِنَ الْإِيْمَانِ وَالْإِيْمَانُ فِى الْجَنَّةِ وَالْبَذَاءُ مِنَ الْجَفَاءِ وَالْجَفَاءُ فِى النَّارِ-
অর্থ: হযরত আবূ হুরায়রাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, লজ্জা ঈমানের অঙ্গ। আর ঈমানের স্থান জান্নাত। পক্ষান্তরে, নির্লজ্জতা দুশ্চরিত্রের অঙ্গ। আর দুশ্চরিত্রতার স্থান জাহান্নাম। [৭]
ঈমানের একটি অংশের নাম লজ্জা। এর বিপরীত নির্লজ্জতাকে পবিত্র হাদিসে পাকে মুনাফেকীর অংশ বা শাখা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- اَلْحَيَاءُ وَ الْعِىُّ شُعْبَتَانِ مِنَ الْإِيْمَانِ، وَالْبَذَاءُ وَالْبَيَانُ شُعْبَتَانِ مِنَ النِّفَاقِ-
অর্থ: লজ্জা ও অল্প কথা বলা ঈমানের দু’টি শাখা। আর অশ্লীলতা ও বাকপটুতা মুনাফেকীর দু’টি শাখা। [৮]
দ্বীন-ই ইসলামের স্বভাবই হচ্ছে নমনীয়তা বা লজ্জাশীলতা, যার মধ্যে ঈমান-ইসলামের রেশ রয়েছে, তার মধ্যে অবশ্য লজ্জাশীলতা রয়েছে।
عن زيد بن طلحة قَالَ قَالَ رَسُوْلُ الله صلى الله عليه وسلم اِنَّ لِكُلِّ دِيْنٍ خُلُقًا وَخُلُقُ الْإِسْلاَمِ الْحَيَاءُ-
অর্থ: হযরত যায়দ ইবনে তালহা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, প্রত্যেক দ্বীনের একটি বিশেষ স্বভাব আছে। আর দ্বীন ইসলামের বিশেষ স্বভাব হলো লজ্জাশীলতা। [৯]
লজ্জাশীল ব্যক্তিকে সৎ এবং লজ্জাহীন ব্যক্তিকে নিকৃষ্ট লোক বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লালাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা দিয়েছেন পবিত্র হাদিসে-
قَالَ رَسُوْلُ الله صلى الله عليه وسلم يَا عَائِشَةُ لَوْكَانَ الْحَيَاءُ رَجُلاً كَانَ رَجُلاً صَالِحًا وَ لَوْكَانَ الْفُحْشُ رَجُلاً لَكَانَ رُجُلٌ سُوْءٌ-
অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, হে আয়েশা! লজ্জা যদি কোনো লোক হয় তাহলে সে হবে সৎ ব্যক্তি। আর অশ্লীলতা যদি কোনো লোক হয় নিশ্চয়ই সে হবে নিকৃষ্ট লোক। [১০]
ঈমান ও লজ্জা একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। একটিকে গ্রহণ করে অন্যটিকে ছাড়া যাবে না। মানুষদের থেকে যখন এ দু’টি থেকে কোনো একটি উঠিয়ে নেয়া হবে অপরটি আপনা-আপনি উঠে যাবে। হাদিস শরীফে উল্লেখ রয়েছে-
عن عمر رضى الله عنه قَالَ قَالَ رَسُوْلُ الله صلى الله عليه وسلم اَلْحَيَاءُ وَالْإِيْمَانُ قَرْنَاءَ جَمِيْعًا فَإِذَا رُفِعَ أَحَدُهُمَ رُفِعَ الْآخَرُ-
অর্থ: হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, লজ্জা ও ঈমান একটি অপরটির সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সুতরাং এর একটি তুলে নেয়া হলে অপরটিও তুলে নেয়া হবে। অপর এক বর্ণনায় আছে, যখন উভয়ের কোন একটিকে ছিনিয়ে নেয়া হয়, তখন অপরটিও তার পশ্চাতে অনুগমন করে। [১১]
মহান আল্লাহ যখন কোনো বান্দার অকল্যাণ চান, তখন তার থেকে লজ্জা ছিনিয়ে নেন। তারপর তাকে অভিশপ্ত শয়তান হিসেবে আখ্যা দেন। যেমনটি পবিত্র হাদিসে পাকে ইরশাদ হয়েছে-
إنَّ الله إذا أرادَ بعبدٍ هلاكًا، نَزَعَ منه الحياءَ، فإذا نزع منه الحياء، لم تلقه إلاَّ مقيتًا مُمَقَّتًا، فإذا كان مقيتًا ممقتًا، نزع منه الأمانةَ، فلم تلقه إلا خائنًا مخوَّنًا، فإذا كان خائنًا مخونًا، نزع منه الرحمة، فلم تلقه إلافظًا غليظًا، فإذا كان فظًا غليظًا، نزع رِبْقَ الإِيمان من عنقه، فإِذا نزع رِبْقَ الإيمان من عنقه لم تلقه إلا شيطانًا لعينًا ملعنًا-
অর্থ: আল্লাহ কোনো বান্দার ধ্বংস চাইলে তার থেকে লজ্জা ছিনিয়ে নেন। যখন লজ্জা ছিনিয়ে নেয়া হয় তখন সে হয় বিদ্বেষপরায়ণ। বিদ্বেষপরায়ণ হলে তার থেকে আমানতদারিতা তুলে নেয়া হয়। আমানতদারিতা তুলে নেয়া হলে সে খেয়ানতকারী হয়। খিয়ানতকারী হলে তার থেকে রহমত তুলে নেয়া হয়। ফলে সে কঠোরতা ও নির্দয়তা লাভ করে। নিষ্ঠুর-নির্দয় হলে তার থেকে ঈমানের রশি খুলে নেয়া হয়। আর ঈমানের রশি যখন তার গ্রীবাদেশ থেকে খুলে নেয়া হয়, তখন সে অভিশপ্ত শয়তান হিসাবে বিদ্যমান থাকে। [১২]
আজ তথাকথিত পোষাকের নামে স্বাধীনতা চাওয়া ব্যক্তিবর্গ প্রকৃতপক্ষে ইসলামের দুশমন। কেননা, তারা মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিধানকে অগ্রাহ্য করছে। যেভাবে পোশাক পরিধান করার বিধান দেওয়া হয়েছে সেটার প্রতি তারা বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করছে। অর্ধনগ্ন পোশাক নিয়ে তারা প্রতিযোগিতা করছে। ছেলেরা মেয়েদের রূপে আর মেয়েরা ছেলেদের রূপে রূপান্তরিত হওয়ার জন্য দৌঁড়ঝাপ দিচ্ছে। এভাবে তারা মুসলিম যুব সমাজকে অপসংস্কৃতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে বেহায়াপনা ও অশ্লীলতার দৃশ্য ক্রমশই বেড়ে চলছে।
মহান আল্লাহ সকলকে সঠিক তথ্য অনুধাবন করার তাওফিক দান করুন এবং মুসলিম সমাজকে সমস্ত অপসংস্কৃতি থেকে বাঁচিয়ে রাখুন। আ-মী-ন।

তথ্য সূত্র:
১. বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত হা/০৫
২. সূরা আরাফ, আয়াত-২৬
৩. সূরা আহযাব, আয়াত-৫৯
৪. সূরা আহযাব, আয়াত-৩৩
৫. সূরা নূর, আয়াত-৩১
৬. সূরা নূর, আয়াত-৩০
৭. তিরমিযী হা/২০০৯, মিশকাত হা/৫০৭৬
৮. তিরমিযী হা/২০২৭, মিশকাত হা/৪৭৯৬
৯. বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত হা/৫০৯০
১০. সহীহ আত-তারগিব হা/২৬৩১
১১. মিশকাত হা/৫০৯৩
১২. জামেউল উলূম-১ম খন্ড, ৪৯৯পৃ:

লেখক: শিক্ষার্থী: জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদ্রাসা, চট্টগ্রাম।

Share:

1 Comment

  1. najmulhossain munir

    Says Rajab 24, 1444 at 11:33 pm

    আলহামদুলিল্লাহ।

Leave Your Comment