Anjuman-E Rahmania Ahmadia Sunnia Trust

মহানবীর সর্বোচ্চ মর্যাদার পরিচায়ক পবিত্র মি’রাজ

মহানবীর সর্বোচ্চ মর্যাদার পরিচায়ক পবিত্র মি’রাজ

মাওলানা মুহাম্মদ আবুল হাশেম

بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ
سُبْحٰنَ الَّذِیْۤ اَسْرٰى بِعَبْدِهٖ لَیْلًا مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ اِلَى الْمَسْجِدِ الْاَقْصَا الَّذِیْ بٰرَكْنَا حَوْلَهٗ لِنُرِیَهٗ مِنْ اٰیٰتِنَاؕ -اِنَّهٗ هُوَ السَّمِیْعُ الْبَصِیْرُ-.
“পবিত্রতা তাঁরই জন্য, যিনি আপন বান্দাকে রাতারাতি নিয়ে গেছেন মসজিদ-ই হারাম হ’তে মসজিদ-ই আক্বসা পর্যন্ত, যার আশেপাশে আমি বরকত রেখেছি, যাতে আমি তাকে মহান নিদর্শনসমূহ দেখাই; নিশ্চয় তিনি শুনেন, দেখেন।” (তরজমা-ই কানযুল ঈমান)

উপর্যুক্ত আয়াতে হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র মি’রাজ শরীফের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। নুবূয়তের দ্বাদশ বছরে বিশ্বকুল সরদার সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মি’রাজ দ্বারা সম্মানিত হয়েছেন। প্রসিদ্ধ মত হচ্ছে, ২৭ রজব মি’রাজ হয়েছে। মক্কা মুর্কারমা থেকে বায়তুল মুক্বাদ্দাস পর্যন্ত রাতের ছোট অংশে তাশরীফ নিয়ে যাওয়া ক্বোরআনের নস দ্বারা প্রমাণিত, সেটার অস্বীকারকারী কাফির। আসমানের ভ্রমণ ও নৈকট্যের পর্যায়গুলোতে পৌঁছা সহীহ, নির্ভরযোগ্য হাদীসসমূহ দ্বারা প্রমাণিত, যা তাওয়াতুর পর্যায়ের নিকটে পৌঁছেছে, সেগুলোর অস্বীকারকারী গোমরাহ (পথভ্রষ্ট)।

মি’রাজ শরীফ জাগ্রত অবস্থায়, শরীর ও রূহ উভয়সহ সংঘটিত হয়েছে-এটাই অধিকাংশ মুসলমানের আক্বীদাহ্। আর আসহাবে রসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র বেশিরভাগই এ আক্বীদাহ্ বিশ্বাসী। আয়াতসমূহ এবং হাদীসসমূহের নসগুলো দ্বারা এটাই ফায়দা হাসিল হয়। (খাযাইনুল ইরফান)

আল্লাহ্ তাবারকা ওয়া তা‘আলা মি’রাজ শরীফের আরো ব্যাপক হাক্বীক্বত নিম্নোক্ত আয়াতসমূহে ইরশাদ করেছেন:
وَ النَّجْمِ اِذَا هَوٰى ——– لَقَدْ رَاٰى مِنْ اٰیٰتِ رَبِّهِ الْكُبْرٰى.
“ওই প্রিয় উজ্জ্বল নক্ষত্র মুহাম্মদের শপথ, যখন তিনি মি’রাজ থেকে অবতরণ করেন; তোমাদের ‘সাহিব’ না পথভ্রষ্ট হয়েছেন, না বিপথে চলেছেন। এবং তিনি কোন কথা নিজ প্রবৃত্তি থেকে বলেন না। তা তো ওহীই, যা তার প্রতি (নাযিল) করা হয়। তাকে শিক্ষা দিয়েছেন প্রবল শক্তিসমূহের অধিকারী, শক্তিমান। অতঃপর ওই জ্যোতি ইচ্ছা করলেন, আর ইনি উচ্চাকাশের সর্বোচ্চ দিগন্তে ছিলেন। অতঃপর ওই জ্যোতি নিকটবর্তী হলো। অতঃপর খুব নেমে আসলো। অতঃপর ওই জ্যোতি ও এ মাহবূবের মধ্যে দু’হাতের ব্যবধান রইলো, বরং তদপেক্ষাও কম। তখন ওহী করলেন, আপন বান্দার প্রতি, যা ওহী করার ছিলো। অন্তর মিথ্যা বলে নি যা দেখেছে। তবে কি তোমরা তার সাথে তিনি যা দেখেছেন তাতে বিতর্ক করছো? এবং তিনি তো ওই জ্যোতি দু’বার দেখেছেন; সিদরাতুল মুন্তাহার নিকটে। সেটার নিকট রয়েছে ‘জান্নাতুল মা’ওয়া। যখন সিদরার উপর আচ্ছন্ন করছিলো যা আচ্ছন্ন করছিলো; চক্ষু না কোন দিকে ফিরেছে, না সীমাতিক্রম করেছে। নিশ্চয় আপন রবের বহু বড় নিদর্শনাদি দেখেছেন।” (তরজমা-ই কানযুল ঈমান)
‘নজম’ نجم দ্বারা উদ্দেশ্য সায়্যিদ-ই আম্বিয়া হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র পবিত্র সত্ত্বা। (খাযিন)
আর ‘شديد القوى’ দ্বারা উদ্দেশ্য হযরত হাসান বসরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর মতে, খোদা তা‘আলার পবিত্র সত্ত্বা। তিনি তাঁর সত্ত্বাকে এ বৈশিষ্ট্য দ্বারা উল্লেখ করেছেন। অর্থ হচ্ছে, সায়্যিদ-ই আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম কে আল্লাহ্ তা‘আলা মাধ্যম ছাড়াই শিক্ষা দিয়েছেন।
(তাফসীরে খাযাইনুল ‘ইরফান, সূত্র: তাফসীরে রূহুল বয়ান)

‘তাফসীর-ই রূহুল বয়ান’-এ বর্ণিত হয়েছে, বিশ্বকুল সরদার সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম افق اعلٰى (উচ্চতর দিগন্তে) অর্থাৎ আসমানগুলোর উপরে সমাসীন হন। আর হযরত জিব্রাইল ‘সিদ্রাতুল মুনতাহা’য় থেমে যান। সম্মুখে বাড়তে পারেন নি। তিনি বলেন, “যদি সামান্যটুকুও সামনে অগ্রসর হই, তা’হলে আল্লাহ্ জাল্লাশানুহুর মহত্বের তীব্র জ্যোতিসমূহ আমাকে জ্বালিয়ে ফেলবে।” কিন্তু হুযূর বিশ্বকুল সরদার সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সম্মুখে অগ্রসর হয়ে গেলেন। তিনি আরশের অবস্থান থেকেও আগে অতিক্রম করে গেলেন। আর হযরত অনুবাদক (ইমামে আহলে সুন্নাত শাহ আহমদ রেযা খাঁন ফাদ্বিলে বেরলবী) ক্বুদ্দিসা র্সিরুহুর অনুবাদও এদিকে ইঙ্গিত বহন করে যে, -এর সম্বন্ধ আল্লাহ্ রাব্বুল ইয্যত মহামহিমের প্রতিই। এ অভিমতটা হযরত হাসান বসরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুরও। (খাযাইনুল ‘ইরফান)
وَ هُوَ بِالْاُفُقِ الْاَعْلٰى- -এর তাফসীরে ইমাম রাযী রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন: হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আসমান সমূহের উপরে যখন পৌঁছেন, তখনই আল্লাহ্র তাজাল্লী (তীব্র জ্যোতি) তাঁর প্রতি মনোনিবেশ করেছে। ثُمَّ دَنَا -এর তাফসীরে মুফাস্সিরীন-এর কতিপয় অভিমত রয়েছে: এক. বিশ্বকুল সরদার সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ্ তা‘আলার সান্নিধ্য লাভ করে ধন্য হয়েছেন। দুই. আল্লাহ্ তা‘আলা আপন হাবীব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম কে আপন নৈকট্যের নি’মাত প্রদান করে ধন্য করেছেন। এটাই সর্বাধিক বিশুদ্ধ অভিমত। (খাযাইনুল ‘ইরফান)
فَتَدَلّٰى -এর অর্থ সম্পর্কেও কিছু সংখ্যক অভিমত রয়েছে, এক. ‘নিকটবর্তী হওয়া’ দ্বারা হুযূরের ঊর্ধ্বলোকে গমন ও সাক্ষাত বুঝানো হয়েছে। আর নেমে আসা দ্বারা ‘অবতরণ’ ও ‘ফিরে আসা’ বুঝানো হয়েছে। তখন সারার্থ এ হয় যে, ‘তিনি আল্লাহ্ তা‘আলার সান্নিধ্য লাভ করেছেন। অতঃপর সরাসরি সাক্ষাতের নি’মাতসমূহের সৌভাগ্য লাভ করে সৃষ্টি জগতের দিকে মনোনিবেশ করলেন। দুই. আল্লাহ্ রাব্বুল ইয্যাত আপন করুণা ও কৃপা দ্বারা আপন হাবীবের নিকটস্থ হলেন এবং এ নৈকট্যকে আরো বৃদ্ধি করলেন। তিন. বিশ্বকুল সরদার সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ্র দরবারে নৈকট্যপ্রাপ্ত হয়ে ‘আনুগত্যের সাজদা’ পালন করেছেন। (রূহুল বয়ান) বোখারী ও মুসলিম শরীফের হাদীসে আছে, ‘নিকটবর্তী হলেন পরাক্রমশালী, রব্বুল ইয্যাত।’ (খাযিন)
مَا كَذَبَ الْفُؤَادُ مَا رَاٰى এর বিষয়ে কতিপয় তাফসীরকারক-এর অভিমত হচ্ছে, হযরত জিব্রাঈলকে দেখেছেন, কিন্তু বিশুদ্ধ অভিমত হচ্ছে, বিশ্বকুল সরদার সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আপন প্রতিপালক আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলাকেই দেখেছেন। আর এ দেখাটাও কীভাবে ছিলো- কপালের চোখে, না অন্তরের চোখে? এ প্রসঙ্গে তাফসীর কারকদের দু’টি অভিমত-ই পাওয়া যায়।

হাদীস সমূহ
 হযরত আবদুর রহমান ইবনে ‘আ-য়িশ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন:
قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: رَأَيْتُ رَبِّيَ عَزَّ وَجَلَّ فِيْ ‌أَحْسَنِ ‌صُوْرَةٍ.
“রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: আমি আমার রবকে উত্তম অবয়বে দেখেছি।” (মিশকাত শরীফ)
অত্র হাদীসে রয়েছে, আমার রব স্বীয় রহমতের হাত আমার দুই স্কন্ধের মধ্যবর্তীতে রাখলেন, অতঃপর আমি তাঁর ‘ফয়য’ (কল্যাণধারা) পৌঁছার শীতলতা নিজ বক্ষে অনূভব করেছি। তারপর আমার ওই সব বিষয়ের অবগতি অর্জিত হয়েছে যা আসমানসমূহ ও যমিনে ছিল।” (মিশকাত শরীফ)

হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু র বাণী: বিশ্বকুল সরদার সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম রাব্বুল ইয্যতকে আপন ক্বলব মুবারক দ্বারা দেখেছেন।
(মুসলিম)

 ত্বাবরানী এবং খাসাইসুল কোবরা-এর মধ্যে রয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা বলেন:
اِنَّ مُحَمَّدًا صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‌رَأىٰ ‌رَبَّهٗ مَرَّتَيْنِ مَرَّةً بِبَصَرِهٖ وَمَرَّةً بِفُؤَادِهٖ.
“নিশ্চয় হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আপন রবকে দু’বার দেখেছেন। একবার কপালের চোখে এবং একবার হৃদয়ের চোখ দ্বারা।”

 হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা থেকেই ইমাম বায়হাক্বী ‘কিতাবুর রুইয়ত’-এর মধ্যে বর্ণনা করেন:
إِنَّ اللّٰهَ اصْطَفٰى إِبْرَاهِيمَ بِالْخُلَّةِ ، وَاصْطَفٰى مُوسٰى بِالْكَلَامِ، وَاصْطَفٰى مُحَمَّدًا بِالرُّؤْيَةِ.
“নিশ্চয় আল্লাহ্ তা‘আলা হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস সালামকে ঘনিষ্ট বন্ধুত্ব, হযরত মূসা আলায়হিস সালামকে কালাম (কথোপকথন) এবং হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে স্বীয় দীদার (দর্শন) দ্বারা স্বাতন্ত্র্য দান করেছেন।”
 হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন:
اِنَّ مُحَمَّدًا صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‌ رَأىٰ ‌ رَبَّهٗ عَزَّ وَ جَلَّ.
“নিশ্চয় হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আপন রবকে দেখেছেন।”
(ইবনে খুযাইমা, যারক্বানী, আলাল্ মাওয়াহিব)

 শিফা শরীফে রয়েছে যে, হযরত ইমাম হাসান বসরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু শপথ করে বলেন:
لَقَدْ ‌رَأَى مُحَمَّدٌ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَبَّهُ
“নিশ্চয় হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ্ তা‘আলাকে দেখেছেন।”

মি’রাজের বর্ণনা
নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এ রাতে হাতীম-ই কা’বার মধ্যে আরাম করছিলেন; এ সময়ে হযরত জিব্রাইল আলায়হিস সালাম উপস্থিত হলেন। হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে ঝমঝম কুপের কিনারায় নিয়ে গিয়ে বক্ষ বিদীর্ণ করলেন এবং পবিত্র ক্বলবকে ঈমান ও হিকমত দ্বারা ভর্তি করে বক্ষ মুবারককে ঠিক করে দিলেন। অতঃপর হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে জান্নাতী বুরাক্বের উপর আরোহন করানো হল, যেটার দ্রুতগামী হওয়ার অবস্থা এমন ছিল যে, দৃষ্টি যেখানে গিয়ে পতিত হয়, সেখানে তার কদম রাখত; আক্বা ও মাওলা হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সেটার উপর আরোহী হয়ে বায়তুল মুক্বাদ্দাস-এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। হুযূরের সুমহান ইরশাদ হচ্ছে: “আমি বায়তুল মুক্বাদ্দাস গমনকালে হযরত মূসা আলায়হিস সালাম-এর ক্ববরের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় দেখলাম, তিনি স্বীয় কবরে দন্ডায়মান হয়ে নামায আদায় করছেন।”[ ] বায়তুল মুক্বাদ্দসে সমস্ত নবী আলায়হিমুস সালাম সায়িদ-ই আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। তারপর সকলেই সায়্যিদুল আম্বিয়া আলায়হি সালাতু ওয়াস সালাম-এর ইমামতিতে নামায আদায় করেন। অতঃপর হুযূর প্রথম আসমানে তাশরীফ নিয়ে গেছেন। সেখানে হযরত আদম আলায়হিস সালাম-এর সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে; দ্বিতীয় আসমানে হযরত ঈসা ও ইয়াহ্ইয়া আলায়হিস সালাম-এর সাথে; তৃতীয় আসমানে হযরত ইয়ূসুফ আলায়হিস সালাম-এর সাথে; চতুর্থ আসমানে হযরত ইদ্রিস আলায়হিস সালাম-এর সাথে; পঞ্চম আসমানে হযরত হারুন আলায়হিস সালাম-এর সাথে; ষষ্ঠ আসমানে হযরত মূসা আলায়হিস সালাম-এর সাথে এবং সপ্তম আসমানে হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস সালাম-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। অতঃপর সিদ্রাতুল মুনতাহা তাশরীফ নিয়ে গেছেন, সেখানে হযরত জিব্রাইল আলায়হিস সালাম আরয করলেন, আমার আক্বা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম! আমার নিকট এ স্থান থেকে আগে যাওয়ার সামর্থ্য নেই। সরকার-ই দো‘আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম একাকী সিদ্রাতুল মুনতাহা থেকে তাশরীফ নিয়ে গেলেন এবং আরশ ও লা মকান-এ উপনীত হলেন। সেখানে তিনি পর্দাহীনভাবে আল্লাহ্ তা‘আলার দীদার অর্জন করেছেন। হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ্ তা‘আলার সাথে কথোপকথন করেছেন এবং আল্লাহ্ তা‘আলা যা ইচ্ছা ওহী করেছেন। হুযূরের প্রতি অপর নি’মাতরাজি ছাড়াও পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরয করা হয়। হাদীস শরীফে এসেছে,
فَأَوْحَى اللهُ إِلَيَّ مَا أَوْحَى، فَفَرَضَ عَلَيَّ خَمْسِينَ صَلَاةً فِي كُلِّ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ،
“আল্লাহ্ তা‘আলা (মাধ্যম ছাড়াই) আমার প্রতি ওহী করেছেন, যা ইচ্ছা ওহী করেছেন; আর আমার উপর প্রতি দিনে ও রাতে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছেন।”[ ]
অতঃপর হযরত মূসা আলায়হিস সালাম-এর বারবার অনুরোধে নয় (৯) বার নামাযের ওয়াক্ত কমানোর জন্য আল্লাহ্ তা‘আলার দরবারে হাযির হয়েছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত পাঁচ ওয়াক্ত নামায অবশিষ্ট রইলো এবং সাওয়াব পঞ্চাশ ওয়াক্ত-এরই বিদ্যমান থাকলো।
ইরশাদ হচ্ছে,
قَالَ: يَا مُحَمَّدُ، إِنَّهُنَّ خَمْسُ صَلَوَاتٍ كُلَّ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ، لِكُلِّ صَلَاةٍ عَشْرٌ، فَذَلِكَ خَمْسُونَ صَلَاةً،
“আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেন: হে মুহাম্মদ! এগুলো দিনে-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামায; কিন্তু প্রতি ওয়াক্তের জন্য দশ ওয়াক্ত নামাযের সাওয়াব পাবে। সুতরাং এ পাঁচ ওয়াক্ত নামায সাওয়াবের ক্ষেত্রে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাযের সমান।”[ ]
এ সুদীর্ঘ সফরের পর হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মক্কা-ই মুর্কারামা তাশরীফ আনলেন এবং এ সুদীর্ঘ সফর রাতের সামান্য অংশে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। সুবহানাল্লাহ্!

মি’রাজ রজনীর ইবাদত
নামায: রাতে জাগ্রত হয়ে দু’ দু’ বা চার চার রাকা‘আত করে নিয়্যত করে নফল নামায পড়বে। একবার সালাতুত্ তাসবীহ্ও পাঠ করবে। বিশেষভাবে এ বার রাকা‘আত নামায অবশ্যই পড়ে নেবে, যার ব্যাপারে হাদীস শরীফে তাগিদ এসেছে। ইমাম গাযালী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেন, “রজবের ২৭ তম রাত, যা লায়লাতুল মি’রাজ। এতে ‘সালাত-ই মা’সূরা’ রয়েছে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: এ রাতে ইবাদতকারীদের শত বছরের ইবাদতের সাওয়াব অর্জিত হয়। যে ব্যক্তি এ রাতে বার রাকা‘আত নামায এভাবে আদায় করলো, প্রতি রাকা‘আতে সূরা ফাতিহা পাঠ করে ক্বোরআনুল হাকীমের যে কোন সূরা পড়বে এবং দু’ রাকা‘আত পর তাশাহ্হুদ শেষ পর্যন্ত পাঠ করে দুরূদ ও দো‘আ-ই মাসূরা’র পর সালাম ফিরাবে। আর বার রাকা‘আত পড়ার পর ১০০ বার এ তাসবীহ্ পাঠ করবে- سُبْحَانَ اللهِ وَالْحَمْدُ لِلّٰهِ وَلَا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ وَاللهُ أَكْبَرُ-
অতঃপর ১০০ বার أَسْتَغْفِرُ اللهَ এবং ১০০ বার দুরূদ শরীফ পাঠ করবে। অতঃপর দুনিয়া ও আখেরাতের বিষয়াদি সম্পর্কে যা কিছু ইচ্ছা হয় দো‘আ করবে এবং দিনের বেলায় রোযা রাখবে, তাহলে নিশ্চিতভাবে আল্লাহ্ তা‘আলা তার সমস্ত দো‘আ কবূল করবেন। কিন্তু যদি সে কোন গুনাহের দো‘আ করে (তাহলে এ দো‘আ কবূল হবে না)।”(ইহ্ইয়াউল্ উলূম, بيان الليالي والأيام الفاضلة فضيلة قيام الليل খ– ১, পৃ. ৩৬১)
দো‘আ: প্রত্যেক নামাযের পর দো‘আ করবে। উত্তম হচ্ছে, ক্বোরআন-হাদীসে বর্ণিত দো‘আসমূহ পাঠ করা। দো‘আর পূর্বে এবং পরে দুরূদ শরীফ অবশ্যই পাঠ করবে। হযরত আবূ উমামা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: পাঁচ রাতে কৃত দো‘আ প্রত্যাখ্যাত হয় না। ১. রজবের প্রথম রাত, ২. শা’বানের পঞ্চদশ রাত, ৩. জুমু‘আর রাত, ৪. ঈদুল ফিতরের রাত এবং ৫. ঈদুল আযহার রাত।[ ]
শব-ই মি’রাজ রজব মাসের সমস্ত রাত অপেক্ষা উত্তম ও মর্যাদাসম্পন্ন, তাহলে এ রাতে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে দো‘আ প্রত্যাখ্যাত হবে না, ইন্ শা আল্লাহু তা‘আলা।
রোযা: ২৭ রজব দিনে রোযা রাখবে। উত্তম হচ্ছে, ২৬ রজবও রোযা রাখা। আর যদি সম্ভব হয় তাহলে মি’রাজের দিনের সাথে রজব মাসে আরো ১৪ টি রোযা রাখবে।
ইমাম বায়হাক্বী ‘শু‘আবুল ঈমান’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: “যে ব্যক্তি রজব মাসে একদিন রোযা রাখে, সে যেন পুরো বছর রোযা রাখল; আর যে ব্যক্তি সাত দিন রোযা রাখে, তাহলে তার জন্য দোযখের সাত দরজা বন্ধ হয়ে যায় এবং যে ব্যক্তি এ মাসে আট দিন রোযা রাখে, তার জন্য জান্নাতের আট দরজা উন্মুক্ত করা হয়। আর এ মাসে দশ দিন রোযা পালনকারী আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট যা কিছু দো‘আ করে, তাকে প্রদান করা হবে; আর যে ব্যক্তি পনের দিন রোযা রাখে, তখন আসমান থেকে একজন ঘোষক আহ্বান করতে থাকে, হে রোযাদার! তোমার ইতিপূর্বের সকল গুনাহ্ ক্ষমা করেছি, এখন নেক আমল শুরু করো। আমি (আল্লাহ্) তোমার মন্দগুলোকে নেকী দ্বারা পরিবর্তন করে দিয়েছি।”[ ]

আসুন, আমরা এ মহিমান্বিত রাতে ইবাদত-বন্দেগী, রোযা পালন ও দো‘আ-মুনাজাতের মাধ্যমে মহামহিম রবের নৈকট্য হাসিলে ব্রত হই। রাব্বুল আলামীন তাওফীক্ব দান করুন। আমীন, বিহুরমাতি সায়্যিদিল মুরসালীন। সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম।

টিকা:

আল ক্বোরআন, সূরা (১৭) বনী ইসরাঈল (ইসরা), আয়াত: ১
আল ক্বোরআন, সূরা (৫৩) নজম, আয়াত: ১-১৮
খাসাইসুল কোবরা, ১/২৬৭
মুসলিম, আস্ সহীহ্, খ– ৪, পৃ. ১৮৪৫, হা/ ২৩৭৫
মুসলিম, আস্ সহীহ্, খ– ১, পৃ. ১৪৫, হা/ ২৫৯/১৬২
প্রাগুক্ত
মুকাশাফাতুল ক্বুলূব (আরবী), পৃ. ২৪৯, দায়লামীর সূত্রে বর্ণিত।
বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, খ– ৫, পৃ. ৩৩৬, হা/ ৩৫২০

লেখক: পরিচালক, আনজুমান রিসার্চ সেন্টার ও খতীব, নওয়াব ওয়ালী বেগ খাঁ জামে মসজিদ, চকবাজার, চট্টগ্রাম

Share:

Leave Your Comment