Anjuman-E Rahmania Ahmadia Sunnia Trust

যোহরের নামাযের ফযীলত ও মাসায়েল

যোহরের নামাযের ফযীলত ও মাসায়েল

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি

وَعَنْ اَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ اَنَّ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ اِذَا اَشْتَدَّ الْحَرَّ فَابْرِدُوْا بِاالظَّهْرِ فَاِنَّ شِدَّةَ الْحَرِّ مِنْ نَيْحِ جَهَنَّمَ (رواه ابن ماجه) عَنْ جَابِرِ بْنِ شَمُوْرَةَ رَضِىَ اللهُ اَنَّ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يُصَلِّىْ الظَّهْرَ اِذَا دَخَضَتِ الشَّمْسِ [رواه ابن ماجه )

অনুবাদ: হযরত আবু হুয়াররা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলাল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যখন গরমের তীব্রতা বেড়ে যায়, তখন তোমরা যোহরের নামায দেরীতে আদায় করবে। কেননা গরমের প্রখরতা জাহান্নামের উত্তাপ থেকে সৃষ্টি হয়। [ইবনে মাযাহ্, ১ম খন্ড, হাদীস-৬৭৮]
হযরত জাবির ইবনে সামুরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম পশ্চিমাকাশে সূর্য ঢলে পড়ার পর যোহরের নামায আদায় করতেন। [ইবনে মাযাহ্, ১ম খন্ড, হাদীস-৬৭৩]

প্রাসঙ্গিক আলোচনা
বর্ণিত হাদীস শরীফদ্বয়ে যোহরের নামাযের বিষয়ে শরয়ী বিধান আলোকপাত হয়েছে, হাদীসের বর্ণনার আলোকে মুজতাহিদ ইমামদের গবেষণামূলক মাসআলা ও এতদসংক্রান্ত প্রাসঙ্গিক বর্ণনা উপস্থাপন করার ক্ষুদ্র প্রয়াস।
মাসআলাঃ দ্বিপ্রহরের সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ার সাথে সাথেই যোহরের নামাযের ওয়াক্ত শুরু হয়। ইমাম আযম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির মতানুসারে প্রত্যেক বস্তুর ছায়া তার মূল ছায়া ব্যতীত দ্বীগুণ না হওয়া পর্যন্ত যোহরের সময় অবশিষ্ট থাকে।
[ফতোয়ায়ে রজভীয়াহ্, খন্ড-২, পৃ. ২১০]

যোহর নামাযের রাকা‘আত সংখ্যা
যোহরের ফরজ চার রাকা‘আত, ফরজের পূর্বে চার রাকা‘আত সুন্নাতে মুআক্কাদাহ্, ফরজের পর দু’ রাকাআত সুন্নতে মুআক্কাদাহ্, দু রাকাআত নফল, মোট ১২ রাকাআত। [নুরুল ইযাহ্, পৃ. ১১২]
ফরজের পূর্বে চার রাকাআত সুন্নতে মুআক্কাদাহ্র ফযীলত
হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি যোহরের প্রথম চার রাকাআত পড়লো, সে যেন চার রাকাআত তাহাজ্জুদ নামায আদায় করলো।
[তাবরানী শরীফ]

পাঁচ ওয়াক্ত নামায উম্মতে মুহাম্মদী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র বৈশিষ্ট্য
পূর্ববর্তী আম্বিয়ায়ে কেরাম তাঁদের প্রতি মহান আল্লাহর প্রদত্ত নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে বিভিন্ন সময় যে নামায আদায় করেছেন তা সমষ্টিগতভাবে মহান আল্লাহ্ উম্মতে মোহাম্মদী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে দান করেছেন। পূর্ববর্তী নবীগণের শরীয়তে সমষ্টিগতভাবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের বিধান ছিলনা। এটা মহান আল্লাহ কর্তৃক নবীজিকে প্রদত্ত মি’রাজের অনন্য উপহার। এটা উম্মতে মুহাম্মদীর শ্রেষ্ঠত্বের দলীল। উম্মুল মু’মেনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা থেকে বর্ণিত, ফজরের নামাযের সময় হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম’র তাওবা আল্লাহর দরবারে কবুল হয়। তিনি শুকরিয়া স্বরূপ দু’ রাকাআত নামায আদায় করেন। এটা হল ফজরের নামায।
হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম কর্তৃক যোহরের সময় হযরত ইসমাঈল আলায়হিস্ সালামকে কুরবানীর উদ্দেশ্যে আল্লাহর দরবারে উৎসর্গ করার পর তা কবুল হলে শুকরিয়া স্বরূপ চার রাকাআত নামায আদায় করেন। এটা হলো যোহরের নামায।
আল্লাহ্ তা‘আলা স্বীয় কুদরত প্রমাণের জন্য হযরত উযায়র আলাইহ্সি সালামকে একশ বছর পর পুনরায় জীবিত করা হলে তার শুকরিয়া হিসেবে চার রাকাআত নামায আদায় করেন, এটা হলো আসরের নামায।
মাগরিবের সময় হযরত দাউদ আলায়হিস্ সালামকে ক্ষমা করা হলে তিনি আল্লাহর শুকরিয়া হিসেবে তিন রাকাআত নামায আদায় করেন, এটা হলো মাগরিবের নামায।
আমাদের নূরনবী সরকারে দোআলম সর্বপ্রথম এশার নামায আদায় করেন। [তাহাভী শরীফ]
পাঁচ ওয়াক্ত নামায অস্বীকারকারী ব্যক্তি সর্বসম্মতভাবে কাফির ও মুরতাদ হিসেবে গণ্য। ইচ্ছাকৃত নামায ত্যাগ করা কবীরাহ্ গুনাহ্। [ফিক্বাহর কিতাবসমূহ দ্রষ্ট্রব্য]

আরাফার ময়দানে যোহরের নামাযের ওয়াক্ত
ওয়াক্ত অনুযায়ী নামায পড়া ফরজ। তবে আরাফা ও মুযদালিফার হুকুম ব্যতিক্রম। আরাফাতের ময়দানে যোহর ও আসর নামায যোহরের সময় পড়ে নিতে হবে। মুযদালিফায় মাগরীব ও এশা নামায, এশার সময় পড়ে নিতে হবে। [বাহারে শরীয়ত, খন্ড-৩য়, পৃ. ১৬১]
মাসআলাঃ শীতকালে যোহরের নামায তাড়াতাড়ি পড়া মুস্তাহাব, গ্রীস্মকালে দেরী করা মুস্তাহাব। একা পড়–ক বা জামাআত সহকারে পড়–ক।
মাসআলাঃ আরাফাতের যেখানে যোহর আসর একত্রে পড়া হয়, তার মধ্যে বা তারপর সর্বপ্রকার সুন্নত নফল মাকরূহ।
[বাহারে শরীয়ত]

যোহরের শেষের দু’ রাকাআত নফলের ফযীলত
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি যোহরের (ফরজের) পূর্বের চার রাকা‘আত এবং জোহরের পরের চার রাকাতের প্রতি যতœবান হবে আল্লাহ্ তা‘আলা তার উপর জাহান্নামের আগুন হারাম করে দেবেন। [সুনানে নাসাঈ, হাকীম-১৮১৭]
আল্লামা শামী রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, তাঁর জন্য সুসংবাদ হলো, তার শেষ পরিণাম সৌভাগ্যের সাথে (অর্থাৎ ঈমানের সাথে হবে) মৃত্যু হবে। সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে না। [শামী, খন্ড-২য়, পৃ. ৪৫২]
নফল সালাত ফরজ সালাতের পরিপুরক হবে।
হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে-
عَنْ اَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ اِنَّ مَا يُحَاسِبُ بِه الْعَبْدَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ عَمَلِه خَابَ وَخَسَرَ فَاِنْ انتقص مِنْ فَرِيْضَةٍ شَيْئًا قَالَ الرَّبُّ تَبَارَكَ وَتَعَالَى اُنْظُرُوا هَلْ لعبْدِىْ مِنْ تَطُوَّعٍ فَيَكْمِلْ بِهَا مَا انْتُقصَ مِنَ الْفَرِيْضَةِ ثُمَّ يَكُوْنُ سَائِرِ عَمَلِه عَلى ذَالِكَ [رواه ابو داؤد]
অর্থ: হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম থেকে বলতে শুনেছি, কিয়ামতের দিন বান্দার আমল থেকে সর্বপ্রথম সালাত সম্পর্কে হিসেব নেওয়া হবে। তার সালাত যদি সঠিক হয় সে সফলতা লাভ করবে, আর সালাত যদি বিনষ্ট হয়, সে ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফরজ নামাযের হিসাবে যদি কিছু ত্রুটি থাকে তখন আল্লাহ্ তা‘আলা বলবে তোমরা দেখো!, আমার বান্দার কোনো নফল বন্দেগী আছে কিনা?
যদি থাকে তাহলে এর দ্বারা ফরজের ত্রুটি পূর্ণ করো। পরে তার অন্যান্য সব আমলের ব্যাপারে অনুরূপভাবে ঘাটতি পূরণ করা হবে।
[আবু দাঊদ শরীফ, হাদীস-৮৬৬, মিশকাত শরীফ, হাদীস-১৩৩০]

নামায প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর প্রশাসনিক নির্দেশ
হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু প্রশাসনিক দায়িত্ব লাভের পর সরকারি কর্মকর্তাদের প্রতি নামায প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে লিখিতভাবে নির্দেশ জারী করেন, হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে-
اِنَّ عُمَرَ بْنُ الْخَطَّاب رَضِىَ اللهُ عَنْهُ كَتَبَ اِلى عُمَّالِه اِنْ اَهَمَّ اُموْرِكُمْ عِنْدِىْ الصَّلوةِ فَمَنْ خَفِظَهَا وَخَفَظَ عَليْها حَفَظَ دِيْنَه وَمَنْ ضَيّعِهَا فَهُوَ لِمَا سِوَاهَا اَضْيع [موطا]
অর্থ: হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাঁর কর্মকর্তাদের প্রতি এ মর্মে লিখিত নির্দেশ পাঠান যে, তোমাদের যাবতীয় কাজের জন্য আমার নিকট সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো নামায কায়েম করা। যে ব্যক্তি নামায বিনষ্ট করল, সে নামায ছাড়াও অন্যান্য সব কর্মও অধিক বিনষ্টকারী। [মুয়াত্তা মালিক]
মাসআলাঃ নামাযরত অবস্থায় কুরআন মজীদ থেকে আয়াত কিংবা কোন কাগজ থেকে বা লিখিত স্থান হতে দেখে দেখে সূরা তিলাওয়াত করা এবং নামাযের মধ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে দেখা বা ইচ্ছাকৃতভাবে দেখে পড়া মাকরূহ। [আলমগীরি, খন্ড-১ম, পৃ. ১০১]
আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদেরকে যথাযথভাবে নামাযের পাবন্দী করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক: অধ্যক্ষ-মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম।

Share:

Leave Your Comment